#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
— ” ও হাত কেটে পড়ে যাক। ওদিকে তাকানোর দরকার নেই। এখন তোমার নজর শুধুমাত্র আমার উপর আর এই বিরিয়ানির চামচের উপর থাকবে। নাও, বড় করে একটা হা করো তো, কুইক। ”
আভা কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর হাত ওই ছেলে এভাবে ধরে বসে আছে আর ও তাকাবে না? আবার ওর নিজের হাত কেটে পড়ে যেতে বলছেন? অদ্ভুত! আহনাফ আভাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু বাঁকালো। আভা আহনাফের হঠাৎ তাকানো দেখে তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে খাবার মুখে দেওয়ার ভান করে বললো,
— ” আপনি খান। আমি নিজে খেয়ে নিবো। ”
এই বলে আভা নিজের প্লেট থেকে খাবার মুখে নিতেই আহনাফ আভার বাম হাত হাত ছেড়ে ডান হাত আটকে নেয়। আভা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ বললো,
— ” আমি জানি তোমার একটা ডান হাত আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওই হাতের শক্তি কষ্ট করে অপচয় করতে হবে না। হা করো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ”
আভা পুনরায় মানা করতে গেলে আহনাফ এবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। আভা এতে কিছু বলার জো রাখে না। তাই না চাইতেও হা করে। আহনাফ আভার মুখে চামচ দিয়ে খাবার পুড়ে দেয়। আহনাফ নিজে এক চামচ খাবার খাচ্ছে আরেক চামচ আভার মুখে দিচ্ছে। আর আভার না চাইতেও তার দেওয়া খাবার গিলতে হচ্ছে।
— ” সরি একটা জরুরী ফোন ছিলো। দেরি হয়ে গেলো। ”
আচমকা মিনহাজ সেকথা বলতে বলতে চেয়ারে এসে বসলো। মিনহাজকে দেখে আহনাফ ঝট করে আভাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে একাই খেতে লাগলো। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে আপাতত এর মত দুনিয়ায় আর কোনো ভদ্র ছেলে নেই।কি অদ্ভুত! আভা চোখ বেটে নিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। এক সেকেন্ডে রূপ বদলে নিলো। বাহ্!
— ” আভা,খাচ্ছো না কেনো? এখনো সব খাবার প্লেটে পড়ে আছে। ”
একথা শুনে আভা ভ্রু কুচকে তাকালো আহনাফের দিকে। নিজে সব কলকাটি নেড়ে এখন ওকেই ফাঁসানো হচ্ছে। মিনহাজ খাবার মুখে নিতে নিতে একপলক আভার প্লেটের দিকে তাকালো। এখন পর্যন্ত মাত্র কয়েক চামচ বিরিয়ানি খেয়েছে। মিনহাজ আভার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
— ” এই তুই খাওয়া চিনিস না? খাচ্ছিস না কেনো? শেষে খাবার নষ্ট করবি? ”
আভা দাত কেটে মিনহাজের দিকে একবার তাকালো। আহনাফ ঠোঁট চেপে লুকিয়ে হাসছে। আভা আহনাফের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— ” আমার পেট ভরে গেছে। আমি বাসায় যাবো। ”
আহনাফ আর মিনহাজের খাওয়া প্রায় শেষ। আহনাফ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বললো,
— ” আমি বিল মিটিয়ে আসছি। তোমরা এগোও।”
আহনাফ বিল মিটাতে চলে গেলে আভা মিনহাজের দিকে তাকালো। দাত খিচিয়ে বললো,
— ” ভাই, তোমার এখন এই কথা না বললে চলছিল না? ”
মিনহাজ আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললো,
— ” কি কথা? কোন কথা? ”
— ” তুমি জানোনা কোন কথা? ”
— ” না তো। ”
আভা মুখ ফুলিয়ে এক শ্বাস টানলো। ভাই তার এখন মোটেও নিজের দোষ স্বীকার করবে না সেটা ও খুব ভালো করেই জানে। আভা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— “তুমি থাকো। আমি যাচ্ছি। ”
আভা কথাটা বলেই আগে আগে হাটা ধরলো। আভাকে চলে যেতে দেখে মিনহাজ নিজেও আভার পিছু পিছু এক দায়িত্বশীল ভাইয়ের মতো হাঁটতে লাগলো।
রাত অনেক হয়েছে। আহনাফ গাড়ি চালিয়ে আভা আর মিনহাজকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিলো। ওরা সবাই গাড়ী থেকে নামতেই মিনহাজ আহনাফকে বাই জানিয়ে আগে আগে হাটা ধরলো। আভা নিজেও চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হুট করে আহনাফ আভার হাত আটকে নেয়।নিজের হাতে বাঁধা পড়ায় আভা পিছন ফিরে তাকায়। আহনাফ ভ্রু বাঁকা করে বললো,
— ” তুমি কোথায় যাচ্ছো? ”
— ” কেনো? বাসায়। ভাইয়া তো আগেই চলে গেলো। ”
আহনাফ আভার এক হাত ধরে আভার দিকে এগিয়ে এলো। আভা আহনাফের এগুনো দেখে দুপা পিছালে আহনাফ পা থামিয়ে হাসলো। আভার চোখের চোখ রেখে বললো,
— ” মিস বউফ্রেন্ড, তোমার ভাইয়ার আগে চলে যাওয়ার কারণ হলো আমাদের প্রাইভেসি দেওয়া।আর সেটা তোমার গবেট মাথায় ঢুকলো না। ভেরি ব্যাড। ”
একথা বলে আহনাফ চোখ টিপ্পনী দিলো আভাকে। এতে আভা ক্ষণিকের মধ্যেই বোকা বনে গেলো। ভাই তার একা উনার কাছে রেখে গেছে।এই মুহূর্তে আভার রীতিমত দুঃখ দুঃখ পাচ্ছে। একরকম হাত পা ছড়াছড়ি টাইপ দুঃখ। তার ভাই কি গাদ্দারীটাই করলো! আভার এসব ভাবনার মাঝেই আহনাফের দিকে চোখ দিলো। আহনাফ গাড়িতে পিঠ দ্বারা হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে আভার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের এমন শীতল চাহনি দেখে আভার চারপাশটা অস্বস্তিতে ঘিরে গেলো। ইতি-অতি তাকিয়ে কানের পিছনে চুল গুজলো ও। এই ছেলেটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?
আচমকা আহনাফ আভার বাম হাত ধরে ওকে গাড়ির দরজা খুলে আভাকে পিছন সিটে বসিয়ে দিলো। আভা চমকে উঠে বললো,
–” আরে, কি করছেন? ”
আহনাফ কিছু না বলে নিজেও গাড়ির পিছনের সিটে আভার পাশে বসে গাড়ির দরজা লাগিয়ে ফেললো। আভা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
–” কি করছেন আপনি? ”
আহনাফ এবারও কোনো উত্তর না করে হুট করে নিজের দুনো পা মুড়িয়ে আভার কোলে মাথা রাখলো। আহনাফ খুব লম্বা হওয়ায় অর্ধেক পা-ই মুড়িয়ে রাখতে হয়েছে। আহনাফের এমন আচরণে আভা ত রীতিমত হতবম্ব। চোখ বড়বড় করে আহনাফের দিকে তাকালো। এই ছেলে কোলে মাথা রাখলো কেনো? আহনাফ আভার কোলে মাথা রেখে আভার চোখের দিকে তাকালো। শীতল কণ্ঠে বললো,
— ” ঘুম পাচ্ছে আমার। ”
আভা আহনাফের মাথা নিজের কোল থেকে উঠানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত আভা হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললো,
–” ঘুম পাচ্ছে বাসায় গিয়ে ঘুমান। আমার কোলে কেনো? কেউ দেখে নিবে। উঠুন। ”
আভার কথা শুনেই আহনাফের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ হলো না। আহনাফ আভার এক হাত নিজের চুলে রেখে বললো,
–” বউফ্রেন্ড, চুলটা টেনে দাও ত। খুব মাথা ধরেছে। ”
আভা আহনাফের চুলে থাকা হাত সরিয়ে নিতে চাইলে আহনাফ চোখ বন্ধ করেই বললো,
–” তুমি কি চাও কেউ আমাদের একসাথে এভাবে দেখুক? যদি এখন আমার চুল টেনে না দাও তাহলে কিন্তু আমি গাড়ির দরজা খুলে ফেলবো। সবাই তখন আমাদের একসাথে গাড়িতে প্রেম করতে দেখবে। গ্রেট হবে না ব্যাপারটা? ”
আভা এবার কান্না করে দেওয়ার উপক্রম। এভাবে এক ছেলের মাথা নিজের কোলে রেখে তারই চুল টেনে দেওয়া মত অস্বস্তিকর কাজ বোধহয় দুনিয়াতে আর কিছু নেই। আভাকে নিরুত্তর দেখে আহনাফ এবার চোখ খুললো। আভার চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” খুলে দেই দরজা? ”
আহনাফের মুখে ওমন ভয়ংকর কথা শুনে আভা তাড়াহুড়ো করে বললো,
— ” না, না। দিচ্ছি, দিচ্ছি। ”
আহনাফ মুচকি হেসে আবারও চোখ বন্ধ করলো। আভা ধীরে ধীরে আহনাফের চুল টেনে দিচ্ছে। আর মনে মনে নিজের ভাইয়ের নামে কুটলি করছে। ভাই তার কেনো এখানে একা রেখে গেলো! এখন বুঝো ঠেলা।
প্রায় অনেকক্ষণ হলো। আহনাফের কোনো সাড়াশব্দ নেই। উজ্জ্বল ফর্সা মুখখানার তীক্ষ্ণ ভাব খানিক কমে এসেছে। সবসময় কুচকে রাখা ভ্রু এই মুহূর্তে সোজা হয়ে আছে। উনি ঘুমিয়ে গেলেন কি? আভা আহনাফের দিকে ঝুঁকে ডাক দিলো,
— ” শুনছেন। ঘুমিয়ে গেছেন নাকি? হ্যালো। ”
আহনাফের চোখের পাঁপড়ি খানিক কেপে উঠলো। পিটপিট করে চোখ মেললো সে। ঘুমঘুম চোখের সামনে আভাকে ঝুঁকে থাকতে দেখে তরিগরি করে উঠে বসলো। আহনাফের হঠাৎ এমন আচরনে আভা অবাক হলে আহনাফ চোখ কচলে বললো,
— ” সরি। চোখ লেগে এসেছিলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে, না? তুমি বাসায় চলে যাও। এগিয়ে দিতে হবে?”
আভা ওড়না ঠিকঠাক কাধে জড়িয়ে বললো,
— ” বাসা দুই তলায়। এগিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো। ”
আভা গাড়ি থেকে বেরুতে গেলে আহনাফ আবারও আভার হাত আটকে নেয়। আভা ভ্রু কুটি করে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ আভার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসায়,
— ” সুন্দরী বউ বিয়ে করলে এই এক ঝামেলা, ম্যাডাম। কখন কার নজর পরে যায় বলা মুশকিল। তাই চোখে চোখে রাখতে হয়। বুঝলেন? ”
আহনাফের কথা শুনে আভা শিউরে উঠলো। শরীর জমে হিম শীতল হতে লাগলো। আহনাফের ওমন ফিসফিস আওয়াজ তার হৃদস্পন্দন শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। শব্দ হচ্ছে ” ধুকধুক ধুকধুক। ” আহনাফ কি শুনলো সেই শব্দ? শুনলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আহনাফ ধীরে ধীরে সরে এলো আভার থেকে। আহনাফ সরতেই আভা দিগ্বিদিক না তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসার গেটের ভিতর ঢুকে গেলো। আহনাফ আভার যাওয়ার পথের পানে তাকিয়ে মাথা চুলকে ছোট্ট করে হাসলো। আভা ভিতরে যেতেই আহনাফ গাড়ি চালু করে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আজ দিনটাই অদ্ভুত সুন্দর ছিলো তার। এতটা সুন্দর দিন আগে কখনোই তার জীবনে আসেনি। কখনোই না।
#চলবে
শব্দসংখ্যা- ১১০০+
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/215322450512323/?app=fbl