–” দেখুন, আমি কথা প্যাচানো পছন্দ করি না। সোজাসুজি বলছি। মেয়ে হিসেবে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বউ হিসেবে একদম না।”
আভা একথা শুনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফের এই নির্মম বাক্য শুনে তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না। আভা জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে খুব রয়ে সয়ে বললো,
— ” ভালো কথা তো। ”
আহনাফ গম্ভীর চোখে আভার দিকে তাকালো। মেয়েটা ভারী অদ্ভুত তো। অন্য মেয়ে হলে এই মুহূর্তে কয়েকটা ঝাজালো কথা শুনিয়ে দিয়ে শান্ত হতো। সেক্ষেত্রে এই মেয়ে!
সম্পূর্ণ নীরব ছাদ। দুপাশে অনেকগুলো বড় বড় বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। আহনাফ ছাদের একপাশের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, নিচে গলিতে একদল কিশোর ছেলে ক্রিকেট খেলছে। আহনাফ সেদিকে তাকিয়ে আভাকে বললো,
— ” গলিতে কি সবসময় ক্রিকেট খেলা হয়? ”
আভা মাথা নাড়লো। যার অর্থ হ্যাঁ। আচমকা আহনাফ এক অদ্ভুত কথা বলে বসলো।
— ” তাহলে এখানে আসলে মাঝেমধ্যে ওদের সাথে ক্রিকেট খেলা যাবে। কি বলো? ”
আভা চুপ করে রইলো।কয়েক মিনিট লেগে গেলো এই কথা বুঝতে তার। যখন কথাটা বোধগম্য হলো তখন বিস্ময় নিয়ে বললো,
— ” আপনার তো আমাকে পছন্দ হয়নি। তাহলে আমার বাড়িতে আসবেন কেনো? ”
আহনাফ মৃদু হেসে পাশে থাকা টব থেকে একটা বেলি ফুল ছিঁড়ে সেটার মুখ ভরে ঘ্রাণ নিলো। দারুন ঘ্রাণ তো! আহনাফ সেই বেলি ফুল দু আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে আভার মুখোমুখি দাড়ালো। আভা এতে অস্বস্থিতে পিষ্ট হয়ে পিছিয়ে দাড়ালো। আহনাফ আরো একটু এগিয়ে এসে হুট করে খুব যত্ন নিয়ে সেই বেলি ফুল আভার কানের পিঠে গুঁজে দিলো। আভা অবাক হয়ে কানে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো বেলি ফুলটা। আহনাফ মুচকি হেসে আবারও রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলো। বললো,
— ” এখন থেকে এই বাড়ি তো আমারই হবে,তাইনা? নাকি আসতে দিবে না? দরজা খুলে আমাকে দেখেই বলবে,” কৃপা করে এবার আসুন। ঘরে চাল নেই। ”
কথাটা বলেই আহনাফ হুহা করে হেসে দিলো। আভা সেই হাসির দিকে বিরক্তি চোখে তাকালো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বিরক্তি মুগ্ধতায় পরিণত হলো। আভার আচমকাই মনে হলো এই ছেলেটার হাসি মারাত্মক সুন্দর। যাকে তাকে ঘায়েল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড আছে বোধহয়। তাই আভা আনমনে প্রশ্ন করে ফেললো,
— ” আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? ”
আহনাফের হাসি থেমে গেলো। থমথমে চোখে তাকালো আভার দিকে। বললো,
— ” কেনো? প্রেম প্রেম পাচ্ছে নাকি? ”
আভা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।হুট করেই মনে হলো সে একটু বেশি লাগামহীন কাজ করে ফেলেছে। তার উচিত হয় নি এটা বলা। খুব হঠাৎই করেই আভার মনে হলো তার ব্যক্তিত্ব লোপ পাচ্ছে। এভাবে তার ভাবা একদম ঠিক হচ্ছে না। তাই আভা কিছু না ভেবেই আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে উঠলো,
— ” আমি আর প্রেম? প্রশ্নই উঠে না। আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
আহনাফ চেয়ে রইলো আভার দিকে। পা এগিয়ে আভার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নত হওয়া আভার মুখের দিকে তাকালো কিছুক্ষণ। তারপর মুচকি হেসে আভার কপালের ভাজ আঙ্গুল দিয়ে সোজা করে দিলো। আভা এতে খানিক নড়েচড়ে দাড়ালে আহনাফ ভাবুক গলায় বললো,
— ” ওকে,ওকে। জাস্ট চিল। আমি প্রেমে পড়ার জন্যে তোমায় প্রেশার ক্রিয়েট করছি না। ”
অতঃপর নিরবতা। আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। আর আভা! সেতো তার লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত। এই ছেলেটা না জানি হুট করে কোন বেফাঁস কথা বলে দেয়, কে জানে?
— ” এক সেকেন্ড, মিস। আপনি কি কোনো কারণে লজ্জা পাচ্ছেন? দুনো ফোলা ফোলা গাল এত লাল হয়ে আছে কেনো? ”
আহনাফ তীক্ষ্ম চোখে আভার দিকে তাকিয়ে বললো।আভা এবার লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে গেলো। এভাবে বলার কি হলো? ছেলেটা ভারী অসভ্য! আহনাফ টিপ্পনী কেটে বললো,
— ” কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম তুমি নাকি ছেলেদের সাথে খুব মারামারি করো। যাকে বলে কলার ছিঁড়ে ফেলা টাইপ মারামারি? আর সেই তুমি আমার সামনে লজ্জা পাচ্ছ? ও মাই গড! ইটস মিরাকেল। ”
আভা এবার লজ্জায় মাথা নত করে একেবারে থুতনির সাথে লেগে গেলো। এত লজ্জা! ছি ছি ছি! তার মারামারির খবর এই ছেলে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে? হায় হায় ! আহনাফ এবার দমে এলো। একটু দূরে সরে দাঁড়ায়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিলো। শ্বাসের সাথে ছাদে লাগানো হরেক রঙের ফুলের গন্ধ নাকে প্রবেশ করে গলার কাছে সুরসুরি দিতে লাগলো। ভালো লাগছে।
আহনাফ আভার করা প্রশ্নের উত্তর দিতে বললো,
— ” না,আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। কিন্তু একটা বউফ্রেন্ড আছে। ”
“বয়ফ্রেন্ড! ” ছেলেদের বয়ফ্রেন্ড থাকে? কিভাবে? আভা বোকার মতন প্রশ্ন করে বসলো,
— ” আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে? আপনি কি ঠিক আছেন ? কিসব বলছেন? ”
আহনাফ ভ্রু কুচকে ফেললো। আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” ইটস বউফ্রেন্ড। বউ-ফ্রেন্ড। নট বয়ফ্রেন্ড। ”
আভা ফ্যালফ্যাল করে তাকালো আহনাফের দিকে। ছেলেটা কি উন্মাদ! বউফ্রেন্ড আবার কি? আভা জিজ্ঞেস করলো,
— ” বউফ্রেন্ড আবার হয় নাকি? ”
— ” হ্যাঁ। হয় তো। হবে না কেনো? ”
— ” কে সে? ”
আভার করা প্রশ্নে আহনাফ পুনরায় এগিয়ে এলো আভার দিকে। আভা এবার পিছিয়ে গেলো না। এই ছেলে আগানো ছাড়া আর কিছু করবে না, সেটা সে জানে।কিন্তু আভার পা কাপছে। থরথর, থরথর করে। শব্দ হচ্ছে কি? আহনাফ কি লক্ষ করলো ব্যাপারটা? এই অসভ্য ছেলে টা দেখে ফেললে না জানি কোন লজ্জায় ফেলে। আভা চেষ্টা করলো পায়ের কাপুনি কমানোর। তবে ব্যার্থ হলো। বরং আভাকে অস্বস্থিতে ফেলে তার পা বাবাজি নিজে নিজেই দ্বিগুণ বেগে কেপে উঠলো। আহনাফ আভার সামনে এসে দাড়ালো। আভা আহনাফের বুক বরাবর। ছেলেটা লম্বা খুব! আহনাফ আচমকাই আভার নাক টিপে দিলো। আভা চমকে তাকালো। আহনাফ হেসে বললো,
— ” এই বুচা নাকের অধিকারিণী হলো আমার বউফ্রেন্ড। ”
আহনাফ জিন্সের পকেটে দুহাত গুঁজে শিস বাজিয়ে নিচে চলে গেলো। আর আভাকে দিয়ে গেলো একঝাঁক প্রশ্নের ভান্ডার।কিন্তু উত্তর কই? আভা হন্যে হয়ে আহনাফের দেওয়া প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজলো। তবে একটাও পেলো না। ছেলেটা খুব রহস্যময়। সারা শরীরে কি রহস্য নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই ছেলে? রহস্যের তৈরি জামা কাপড়ও কি পড়ে? কি রং সেই রহস্যের? সাদা নাকি আকাশের রং? তবে আফসোস! আভা সেই রহস্য ভেদ করতে পারলো না।
______________________
আভা শাড়ি খুলে বিছানার এলোমেলোভাবে রেখে দিলো। এতক্ষণ বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছিল এই শাড়ি। এই বারো হাতের শাড়ি পড়ে নাকি মেয়েদের সুন্দর হতে হয়। যাতে ছেলেরা মেয়েকে দেখেই পলক ঝাপটানোর আগেই বলে দেয়, ” মা-শা-আল্লাহ। ” কিন্তু এই শাড়ি পড়া যে কতটা বিরক্তিকর সেটা এই মেয়েরাই ভালো বলতে পারে।
আভা টাওয়েল মাথায় পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো। একটু আগের বিরক্তি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। আভা আয়নার সামনে দাড়ালো। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে গান ধরলো,
” একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘ বরন কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ। ”
আহা! কি গান। মন ছুঁয়ে গেলো। আভা মুখে ক্রিম ট্রিম লাগাতে ব্যস্ত তখনই হুড়মুড়িয়ে আভার মা তার রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে ফোন। তাও উল্টা করে ধরে রাখা। আভা ফোনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। মা জননী যে এখন একটা উত্তেজনাপূর্ণ খবর দিবেন সেটা তার ভালোই আন্দাজ করেছে। আভার মা আভার কাছে এসে তাড়াহুড়ো করে বললেন,
— ” ছেলেপক্ষ রাজি হয়ে গেছে। ”
উত্তেজনার কারণে উনার একটা শব্দের সাথে আরেকটা শব্দ মিশে যাচ্ছিল। আভা মায়ের কথা স্পষ্ট না বুঝলেও তার সারমর্ম বুঝলো। আর সে অবাক হলো। চোখে শীতল ভাব এনে বললো,
— ” মা? শান্ত হও। ছেলের আমাকে পছন্দ হয়নি। তাই রাজি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ”
আভার মা ফোন টেবিলের উপর রেখে বললেন,
— ” আরে। ছেলে নিজে ফোন দিয়ে বলেছে সে এই বিয়েতে রাজি। আর রাজি না হওয়ার তো আমি কিছু দেখছি না। মেয়ে আমার কম নাকি? ”
— ” মা, তোমার মেয়ে তোমার কাছে সবসময় পদ্মফুল। কিন্তু অন্যের কাছে ঠিকই শৈবালের মত। তাই লাফালাফি করো না। ভালো করে জেনে নিয়ে তারপর বলো। ”
— ” এই তুই আমারে শিখাস। ছেলে নিজে আমারে ফোন দিসে। কি সোনার টুকরা ছেলে। ও মিথ্যা বলবে আমার সাথে?”
আভা আর কিছু বললো না। মায়ের বলা সোনার টুকরা ছেলে যে তার সাথে কয়লার মত ব্যাবহার করেছে সেটা তো আর মাকে বলা যাবে না। ক্ষেপে যেতে পারেন। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।
এখন শুরু হলো মায়ের লেকচার। এভাবে চলবি, এভাবে চলবি না। সংসার, স্বামী, আরো কত কিছু। আভা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে হাই তুললো। জোর করে মাকে বিছানা থেকে তুলে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললো,
— ” আমি এখন ঘুমাবো। একটা লম্বা ঘুম দিয়ে তারপর তোমার ভাষণ শুনবো। বাট নাও আই অ্যাম টায়ার্ড। ”
আভার মা মেয়ের ঘুমের কথা শুনে ব্যস্ত হলেন। মেয়ে না ঘুমালে চোখের নিচে কালি পড়বে। তখন আবার দেখতে খারাপ লাগবে। তার চেয়ে বরং ঘুমাক। আভার মা মেয়েকে একলা রেখে চলে এলেন।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ফিরতে না ফিরতে মুঠোফোন বেজে উঠলো দ্বিগুণ শব্দে। আভা বিরক্ত হয়ে বালিশ পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো। অজানা নাম্বার। তবে রিসিভ করলো ও। ফোন কানে ধরতেই মধুর পুরুষালি কণ্ঠে একজন বললো,
— ” হ্যালো মিস.বউফ্রেন্ড? ”
#চলবে?
#ওয়েডিং_স্টোরি
#সূচনা_পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
নায়ক আহনাফ, নায়িকা আভা। আর হ্যাঁ, হ্যাপি এন্ডিং। ফার্স্ট পার্ট কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। হ্যাপি রিডিং।