ওহে প্রিয় পর্ব-৩৭

0
2621

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৭
________________
সাড়ে এগারোটার দিকে দিলারা ভবনে পৌঁছায় হ্যাভেন৷ নানুমনির নামে এই ভবনটি নির্মাণ করা হলেও হ্যাভেনের মন চায় দিলারা নাম কেটে শান্তি নিকেতন লিখতে। এই যে সে এসেছে বাড়িতে প্রবেশ করেনি তবুও মনটা কেমন প্রশান্তি তে ভরে ওঠছে। এরপর যখন নানুমনির কোলে মাথা রেখে নানারকম গল্পে মশগুল হবে,নানুমনির হাতে আলুমাখা ভাত খাবে আহা প্রাণটা একদম জুরিয়ে যাবে তার। গেটের সামনেই রিদি আর হিয়া দাঁড়িয়ে ছিলো৷ দু’জনই একসঙ্গে হ্যাভেনকে কেমন আছো জিগ্যেস করলো। উদ্ধত হ্যাভেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু হেসে বললো,

-‘ ভালো আছি তোরা ভালো? তোদের ভাবি কোনরুমে আছে ‘?

রিদি জানালো তার রুমে। হিয়া ড্রাইভারের হাত থেকে ফলগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলো ভিতরে। আর ড্রাইভার গাড়ি থেকে লাগেজ বের করে আবারো ভিতের চলে এলো। হ্যাভেন রিদির সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে শার্টের হাতা ফোল্ড করে ওঠানের একপাশে চাপকলে হাত,মুখ ধুয়ে টাইলস করা ছোট্ট একতলা ছাদ বিশিষ্ট বাথরুমে ঢুকে পড়লো। রিদি ছুটে ভিতরে গিয়ে হিয়া কে বললো,

-‘ এই হিয়ু হাভু ভাইয়ের তয়ালে বের কর তাড়াতাড়ি’।

-‘ তুই আবার দাদানকে হাভু বলছিস কপালে কিন্তু ভীষণ দুঃখ আছে রিদি। সামনে বিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারিস না বইনা ‘।

রিদি জিহ্বায় কামড়ে ধরে দাঁত বের করে হেসে ওঠলো৷ এক কান ছুঁয়ে বললো,

-‘ এই প্রমিস করছি আর বলবো না তুই কিন্তু ভাইয়া কে কিছু বলিস না ‘।

-‘ ওকে ওকে তাহলে তোর জামাইকে বলিস গেটে যেনো মোটা অংকের টাকা পাই আর জুতোটা যেনো আমার চোখের সামনেই মেলে রাখে একদম ‘।

দুজনই খিলখিল করে হেসে ওঠলো। তখনি ভিতরে ঢুকলো হ্যাভেন। মুডি একটা ভাব নিয়ে বোনদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,

-‘ হিহি করে হাসছিস যে আমার তয়ালে বের করেছিস ‘?
.
সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে নানুমনিকে জাষ্ট দেখা দিয়েই আহির কাছে চলে গেলো হ্যাভেন। রুবিনাও তার পিছু পিছু গেলো। হ্যাভেন তাকে জিগ্যেস করে,

-‘ কি খেয়েছে সকালে ‘?

-‘ ফোনে তো বললাম শুধু একটা ডিম খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে আর ওঠেনি আমিও ডাকিনি ‘।

চিন্তিত মুখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার আহির দিকে তাকায় হ্যাভেন। কাঠের চেয়ার’টা টেনে বিছানার পাশেই বসে। হাত বাড়িয়ে কপাল চেক করে দেখে বেশ গরম। হাত সড়িয়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আহির ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে। নাকের ডগা,ওষ্ঠজোরা টকটকে লাল হয়ে আছে। কোঁকড়ানো সিলকি চুলগুলো ফুলে ভীষণ এলোমেলো অবস্থা। গরমের মধ্যেও গায়ে পাতলা কাঁথা টেনে রেখেছে। চোখ ফিরিয়ে নিলো হ্যাভেন রুবিনার দিকে শান্ত দৃষ্টি মেলে বললো,

-‘ এখন কিছু খাওয়ানো উচিত তারপর এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো উচিত ‘।

-‘ রাতে ঘুম হয়নি ঠিকঠাক এখন ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।বারোটার পর ওঠিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়িয়ে ওষুধ গুলো খাওয়িয়ে দেওয়া যাবে ‘।

-‘ হুম যাও তাহলে আমি আছি ‘।

-‘ তুই এখানে বসে থাকবি ‘? একটু অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলো রুবিনা। কারণ তার ছেলে যে কতোটা ধৈর্যহারা আর অশান্ত তা খুব ভালো করেই জানে সে।

গম্ভীর কণ্ঠে হ্যাভেন উত্তর দিলো,

-‘হুম ‘।

ছেলের মতিগতি বোঝা বড় দায় অবশ্য আহির প্রতি এখন যথেষ্ট সুগ্রাহী হ্যাভেন। ভেবেই স্বস্তির এক শ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। হ্যাভেনও দ্রুত ওঠে গিয়ে দরজা লক করে দিয়ে আবার পূর্বের স্থানেই বসলো। তবে এবার আহির দিকে আরেকটু এগিয়ে বসলো। কপাল চেক করে কাঁথা সড়িয়ে গলায় আলতো স্পর্শ করলো। কপালের তুলনায় গলার তাপমাত্রা আরো বেশী। কাত হয়ে ঘুমাচ্ছিলো আহি। হ্যাভেনের স্পর্শে তার ঘুমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। ফল স্বরূপ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নড়েচড়ে গা থেকে কাঁথা ফেলে দিয়ে চিৎ হয়ে আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। বাঁকা হেসে সোজা হয়ে বসলো হ্যাভেন৷ পকেট থেকে ফোন বের করে হ্যারিকে কল করে কিছু সময় কথা বললো। ফোনে কথা বললেও তার দৃষ্টিজোরা নিবদ্ধ ছিলো পুরোটাই আহির দিকে। এতোটাই মগ্ন হয়ে দেখছিলো যে একটা সময় চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেলো। ফোনের ওপাশে হ্যারি কি বলছে না বলছে কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না সে। শুধু অনুভব করছে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। সামনের এই ঘুমন্ত রমণীর ঘুমন্ত মুখশ্রী দীর্ঘ সময় নিয়ে তৃপ্তি সহকারে না দেখলে বুঝি আজ তার মরণই হবে৷ এতোদিন সে কোথায় ছিলো? কোন রাজ্যে বিভোর ছিলো যে এই আশ্চর্যান্বিত সৌন্দর্যের অধিকারীনিকে নজরেই পড়েনি তার? দু’টো বছর সে কি করে এই দৃশ্যটাকে অবহেলা করতে পারলো? সত্যি ভীষণ অপরাধ হয়ে গেছে তার দ্বারা। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওষ্ঠজোরা নাড়িয়ে চাপা স্বরে হ্যারিকে বললো,

-‘ রাখছি রাতে দেখা হচ্ছে ‘।

পকেটে ফোন রেখে তাকিয়েই রইলো আহির দিকে। এলোমেলো ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো পুরো কপাল জুরে ছেয়ে আছে। পাতলা চিকন কালো ভ্রুজোরার মাঝবরাবর টকটকে লাল ছোট্ট একটি পিমপলও জায়গা দখল করে নিয়েছে। না বোচা না তরতরা মধ্যম আকারের নাকটা লালচে বর্ণ ধারণ করাতে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেলো যখন নজরে পড়লো আহির নাকের বাম ভাগের সিদ্রটার দিকে। গত দু’বছর এ পাশটায় তার দেওয়া নাকফুলটাই পড়ে ছিলো সে। অথচ আজ এ পাশটা ফাঁকা। নানাভাইয়ের মৃত্যুর পর নানুমনিকে নাকফুল খুলতে দেখেছিলো। সংস্কৃতির নিয়ম অনুসারে সকল মা,বোনরাই এসব মেনে চলে। আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে হয়তো অনেকেই এই নিয়ম এখন অনুসরণ করে না। ধর্মীয় কোন বিধানও নেই এ বিষয়ে। তবুও পূর্বযুগ থেকে এ রীতি মেনে আসছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। বিয়ে তো ভেঙে যায়নি স্বামীর দেওয়া গিফট হিসেবে পড়ে থাকলে খুব ক্ষতি নিশ্চয়ই হতো না? মেয়েটা ভীষণ জেদি দুটো’বছর জেদটাকে দমন করে রাখলেও একটি ঝড় সব ওলটপালট করে দিলো। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ঘড়িতে সময় দেখে আবারো আহির কপাল চেক করলো। হাত সড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আহির লাল টকটকে কোমল ওষ্ঠ জোরায়। জ্বরের প্রকোপে মেয়েটার পুরো মুখশ্রীটাই বদলে গেছে পাশাপাশি চোখে লাগছে খুব৷ যদিও গায়ের ফর্সা বর্ণটা বেশ ফ্যাকাশে লাগছে তবুও গায়ের গড়ন বরাবরের মতোই মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণীয় লাগছে। গায়ের গড়নেই যেনো বৈবাহিক ছাপ স্পষ্ট। আর এই ছাপ টা ফেলেছে সে নিজেই। ভাবতেই বক্ষঃস্থলে সুখ এবং খুশির ঢেউ খেলে গেলো। তৃপ্তময় শ্বাস ত্যাগের পাশাপাশি ওষ্ঠকোনে ফুটে ওঠলো কুটিল হাসি৷ বড্ড আফসোস হতে লাগলো এবার। দু’টো বছর কতোশতোবার এই ঠোঁটে ঠোঁট নেড়েছে সে অথচ কখনো একটিবারের জন্যও দুজনের ঠোঁটে ঠোঁটে হয়নি কোন কথোপকথন। তবে অসংখ্য বার আহির বিতৃষ্ণাগুলোর স্বাক্ষী হয়েছে। ভাবনাগুলো যখন গভীর থেকেও গভীরে পদার্পণ করছিলো আচমকাই দৃষ্টি আঁটকে যায় আহির বক্ষঃস্থলের বিভাজনের মাঝবরার লাল তিলটার দিকে। হয়তো কখনো প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে বোনা হয়নি অসংখ্য স্বপ্নের জাল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে হয়নি অনুভূতি মিশ্রিত কোন বাক্যব্যায়। কখনো বক্ষঃস্থলে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে দেয়নি। দীর্ঘসময় নিয়ে শুনতে দেয়নি তার হৃদয়ের স্পন্দনগুলো। দেয়নি প্রশান্তিময় শ্বাস ত্যাগ করতে। দেয়নি পরিতৃপ্ত শ্বাস গ্রহন করতে। তবে অসংখ্যবার তার এই বক্ষঃস্থলে নিজের প্রশান্তিটুকু ঠিক খুঁজে নিয়েছে। স্বার্থপরতা করেছে খুব। চোখ থাকতেও অন্ধের মতো মেয়েটার মাঝে ডুবে থেকেছে। মন থাকতেও দেয়নি একটু খানি তার পরশ। বড্ড অপরাধ হয়ে গেছে তার দ্বারা। লম্বা এক শ্বাস ত্যাগ করলো হ্যাভেন। তার দৃঢ় দৃষ্টিজোরায় আহিকে পুরোটাই বদ্ধ করে নিলো। অদম্য কিছু ইচ্ছেরা মন মস্তিষ্কে কিলবিল শুরু করে দিলো। শরীর জুরে বয়ে গেলো শীতল এক শিহরণ। আহির প্রতিটা নিঃশ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগের মূহুর্তে বক্ষঃস্থলের ওঠানামার সে দৃশ্য তার মাথা ঝিম ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। ওষ্ঠজোরায় তার নিশপিশ শুরু হয়ে গেলো। অদম্য কিছু ইচ্ছেরা আছড়ে পড়লো তার বক্ষঃপিঞ্জরায়। এক ঢোক গিলে আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিলটায় সবে ওষ্ঠজোরা ছোঁয়াবে সেই ক্ষণেই আঁতকে ওঠে সরে গেলো সে। চোখ বন্ধ করে বারকয়েক শ্বাস নিয়ে বিরবির করলো,

-‘ নাহ অনেক তো হলো জোর পূর্বক অধিকারের খেলা। শরীরের তাগদ আর কতো? মনের ওপর কিচ্ছু নেই। অগোচরে ভালোবাসার অধিকার থাকলেও এই গভীর স্পর্শ দেওয়ার অধিকার টুকু বোধ হয় আহি দেয়নি ‘।

সোজা হয়ে বসে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো হ্যাভেন। ঘড়িতে সময় দেখলো একটা ছুঁই ছুঁই। অনেক বেশিই সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এবার আহিকে ডাকতে হবে। অনেক ঘুমিয়েছে একেবারে মাথা নষ্ট করে দেওয়া ঘুম হয়েছে আর নয় ভেবেই আবার এগিয়ে গিয়ে আহির গালে আলতো ছুঁয়ে ডাকতে থাকলো,

-‘ আহি…আহি… আহি ‘?

নড়েচড়ে আচমকাই চোখ মেলে তাকালো আহি। কপাল কুঁচকে দু’ভ্রুজোরার মাঝে মোটা দাগ ফেলে ঘুমু ঘুমু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হ্যাভেনের দিকে। হাত সড়িয়ে নিলো হ্যাভেন তার অমন ঘুমকাতুরে মুখশ্রী ফোলা দুটো চোখ দেখে থতমত খেয়ে গেলো। কি জানি কি হয়ে গেলো তার। বক্ষঃস্থল কেঁপে ওঠলো কেমন। নিঃশ্বাস হয়ে গেলো ভারী। নিজেকে সংযত রাখতে গিয়েও কেমন দিশেহারা হয়ে গেলো। তাই অমন ভাবেই থতমত খাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-‘ ঘুমিয়েছো? না মানে ঘুম হয়নি? আরেকটু ঘুমাবে ‘?

বিষয়টা বুঝতে ঠিক দেড় মিনিট সময় লাগলো আহির। ত্বরিতগতি তে সটান হয়ে ওঠে বসলো সে। হ্যাভেনও সোজা হয়ে চেয়ারে বসে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি আশপাশে অশান্ত নজর বুলিয়ে পাশ থেকে ওড়নাটা ওঠিয়ে গায়ে জরিয়ে একটুখানি চোখ ডলে নিয়ে হাই তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হ্যাভেনের দিকে। জ্বরে মাথা ভন ভন করছে। শরীর ব্যাথায় অসহ্য হয়ে ওঠেছে। ঠান্ডা লাগায় নিঃশ্বাসটুকুও ঠিকভাবে নিতে পারছে না। আরেকটু ঘুমাতে পারলে বোধহয় আরাম পেতো। কিন্তু এই উন্মাদটা কখন এলো? কি আশ্চর্য ব্যাপার না! ঘুম থেকে ডেকে তুলে প্রশ্ন করছে ঘুম হয়নি আরেকটু ঘুমাবে? বাহ এমপি সাহেব বাহ জবাব নেই আপনার।

-‘ কেনো হাভু ভাই আমি কি বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে নাচানাচি করছিলাম যে ঘুম থেকে তুলে প্রশ্ন করছেন ঘুমিয়েছি কিনা বা আরেকটু ঘুমাবো কিনা ‘?

ঘুমকাতুরে কন্ঠে জোর পূর্বক কাঠিন্যতা মিশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বললো আহি।

চলবে…
(কপালে বেশ দুঃখ আছে খুব দুঃখ আছে। পাগল ক্ষেপানো ঠিক না আহি তুমি বুঝনা কেনো?)
সকল প্রিয়দের জানাই ইদ মোবারক । সকলকেই ইদের শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা রইলো। নেক্সট পার্ট আসবে ২৫ তারিখ। যদি তার আগে সময় পাই তাহলে আর এক পার্ট দিতে পারি। সবাইকে আবারো ইদ মোবারক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here