কড়চা – ২।।
আমি খেতে বসেছি। টমেটো, আলু আর শিং মাছ দিয়ে একপাতিল ঝোল রান্না করেছেন আম্মা। তরকারি পুড়ে গিয়েছিল। টমেটো পোড়া তরকারি অখাদ্য হয়। এটাও অখাদ্য হয়েছে। তবে আমার খিদেপেটে অমৃত মনে হচ্ছে। আজকের টেনশনে মনে হয় রান্না খারাপ হয়ে গেছে। এমনিতে আম্মার রান্নার সুনাম আছে। আব্বা ব্যাগ ভরে বাজার আনেন আর আম্মা সুস্বাদু নানাপদ রান্না করেন। আব্বা খাদ্যরসিক, খেতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করেন, কিন্তু পেটুক না। অল্প ভাত নেন প্লেটে, মেপে মেপে খান। আব্বার মতো আব্বার খাওয়ার দৃশ্যও সুন্দর। আব্বার সবকিছুই সুন্দর। আমাদের আম্মাও সুন্দরী। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম আব্বার পাশে আম্মা এখনো সেই আগের মতোই ক্রাশ কাপল। আমরা পাঁচভাইবোন কেউ আব্বা আম্মার সৌন্দর্যের এককণাও পাইনি অদ্ভুতভাবে। হেরিডিটি যেন আমাদের পরিবারে এসেই নিজের যোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু চুলোর পিঠ আর আমাদেরকে খাবার বেড়ে ডাইনিংএ দিতে দিতে আম্মা নিজের যত্নটুকু করারও সময় পান না, নিজের জন্য তার কোনো সময় নেই। আব্বা কবিতা ভালোবাসেন, কবিতার বই কিনতে বইমেলায় গিয়ে ফ্লাওয়ার ক্রাউন পরা মেয়েদের সাথে ছবি তোলেন, আম্মা তখন রান্নার ফাঁকে ফাঁকে খুন্তা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্টার জলসায় সিরিয়াল দেখেন। আব্বা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে উল্লাস করেন, মাঝে মাঝেই সাগরের শহরে না গেলে তার একঘেয়ে লাগে, আম্মা ঢেউয়ে পা ভেজাতেও ভয় পান বলে পানিতে নামেন না। আব্বা সপ্রতিভ – বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যান, এখানে ওখানে ট্যুরপ্ল্যানিং থাকে প্রায় উইকেন্ডেই, আম্মা আমাদেরকে নিয়ে দুপুরের ঘুমটা বেশি পছন্দ করেন! এনিভার্সারি কেক কাটতে আম্মা লজ্জা পান, আব্বার সাথে কোথাও যেতে হলেও আমাদের কাউকে না কাউকে আঁচলে গেরো দেন।
সজীব আসেনি খেতে। ও আমার সামনে আসছে না। যে ব্লান্ডার ও করেছে তাতে আমার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে। ভয়ের কিছু নেই, আমি ওকে বকব না। ওর জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলে একই কাজ করত। আব্বা ল্যাপটপ থেকে ফেসবুক লগআউট করতে ভুলে গেছেন। সজীব গেম খেলতে গিয়ে সব চ্যাট হিস্ট্রি পেয়ে গেছে। আর স্ক্রিনশট নিয়ে সবভাইবোনকে পাঠানোর সাথে সাথে আম্মাকেও আলোকিত করেছে।
আম্মার চোখমুখ লাল। গুনগুন করে কাঁদছেন। ওড়নার আঁচলে নাক মুছছেন। আমি গ্রাহ্য করলাম না। সেই কৈশোরবেলা থেকে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এখন সয়ে গেছে। আলাদা করে কিছু মনে হয় না। নাকি আমি পুরুষ বলে এত কঠিন? শিমুর তো অভ্যাস হয়ে যায়নি। ইমুরও না। সাব্বিরের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। ওরও কি আমার মতই মনে হয়, নাকি আমিই শুধু ভাবলেশহীন, নির্বিকার পাথর হয়ে গিয়েছি!
সিন্থিয়া ফোন করেছে, আমি বাঁহাতে ফোন রিসিভ করলাম। ‘হ্যালো, তুমি কোথায়?’ সিন্থিয়ার গলায় অসহিষ্ণুতা।
‘আমি তো বাসায়!’
‘বাসায়? মানে কখন বাসায় গেলা? তুমি না সচিবালয়ে আসছ?’
‘কাজ শেষ, বাসায় চলে আসছি।’
‘তোমার জন্য এখানে রোদের মধ্যে বসে আছি আমি।’
‘হলে চলে যাও। আজকে আসব না আমি।’
‘আশ্চর্য, আমাকে এইভাবে বসায় রেখে, বাসায় চলে গেছ তুমি?’
‘বাসায় ইমার্জেন্সি।’
সিন্থিয়ার সুর নরম হলো ‘কী হইছে? আন্টি ভালো আছেন? আংকেল?’
‘সেসব কিছু না। এমনি, অন্য একটা ব্যাপার!’
‘ওহ! একটা ফোন তো করতে পারতে রিয়াজ! আমি বসে থাকতাম না তাহলে! অপেক্ষা অনেক কষ্টের, আর এরকম অকারণ হলে আরও কষ্ট হয়!’
সিন্থিয়া ও ফোন রেখে দিলো। দিক। ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না আর। সিন্থিয়ার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত যতটা আগ্রহ থাকে, দেখা হওয়ার পরে ঠিক ততটাই আফসোস হয়। কবে চাকরি হবে, চাকরি পাচ্ছি না কেন, কবে ওর বাসায় বিয়ের কথা বলব! মেয়েগুলো বোঝে না কেন, ইচ্ছে করে কেউ চাকরি না পেয়ে থাকে না। আমি তো তাও বসে নেই। নিজের স্টার্টআপ নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সিন্থিয়া এটা বুঝতেই চায় না। অবুঝ আচরণ করে। ওর ধারণা ফ্যামিলি ব্যাকিং আছে বলে আমি পায়ের উপর পা তুলে খাই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে হলে চাকরি পাওয়ার তাড়া থাকত আমার আর এতদিনে চাকরি জুটিয়ে ফেলতাম!
খাওয়া শেষ করে আমি সজীবকে ডাকলাম ‘খাইছিস?’
‘না।’
‘এখনো খাসনি? কেন?’
‘আম্মাও খায়নি।’
‘সেইজন্য তুই না খেয়ে থাকবি? আম্মাদের এত খাওয়া লাগে না। এরা দুইদশদিন না খেয়ে থাকলেও কিছু হবে না। তুই আমি একবেলা না খেয়ে থাকলে পরের বেলা আর হাঁটার জোর পাব না।’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘তুই প্লেটে ভাত নে। আগে খা।’
সজীবেরও খিদে পেয়েছিল, বাসায় চলমান পরিস্থিতির কারণে খেতে পারছিল না, চটপট খেতে বসে গেল।
শিমু আর ইমু ফুলে বোম হয়ে বসে আছে। আমার দিকে তীর্যকচোখে তাকিয়ে বলল ‘খাবার তোর গলা দিয়ে নামল?’
‘কেন নামবে না? খেয়ে দেখ, কী মজা হয়েছে!’
ওরা জবাব দিলো না, ফুলতে লাগল। আম্মা সেই গুণগুণে কান্না নিয়ে নাক মুছতে মুছতে এসে বসল ওদের পাশে। আমার দিকে না তাকিয়ে বলল ‘আমি আর এখানে থাকব না। তোদের বাপের সংসার আর করব না। আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দে নইলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দে।’
‘আম্মা, এর আগেও আপনি বহুবার এইভাবেই গ্রামে যেতে চাইছেন। এই ঘটনা এই প্রথম ঘটেনাই কিন্তু।’
‘সে তো তোদের আব্বা মানসম্মান চিন্তা করে যাই না।’
‘আব্বার মান সম্মান নিয়ে না ভেবে যদি নিজের আত্মসম্মান নিয়ে একটুখানি ভাবতেন তাহলে হয়তো এরকম হতো না।’
‘তুই যা। আমার সামনে থেকে যা! কুলাঙ্গার ছেলে পেটে ধরেছি। কোথায় ওই মাগীর চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে মায়ের পা ধরে মাফ চাওয়াবে, তা না মা কী করেছে আর কী করেনি সেগুলো নিয়ে মাকেই দোষ দিচ্ছে। আরে, আমার সারাজীবন তোদের জন্যই তো খেটে গেলাম!’
আজ একইদিনে দ্বিতীয়বারের মতো কুলাঙ্গার গালিটা শুনলাম। আম্মা আবার গুনগুন করে কাঁদছেন। শিমু, ইমু, সাবিনা খান নামের মহিলাটাকে উদ্দেশ্য করে নানারকম অশ্রাব্য গালি ঝাড়ছে। এই সাবিনা খান আর আব্বা ক্লাসমেট- একই কলেজের ছাত্র ছিলেন। মহিলা ঢাকার বাইরের একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ওনার স্বামী খুব অত্যাচারী ছিল শুনেছি। এক ছেলে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। ডিভোর্স সম্ভবত হয়নি তবে তারা একসাথে থাকেন না। আব্বার সাথে কোনোভাবে দেখা হয়ে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। আব্বা তো বটেই আমাদের সবার সাথেই মহিলা টাচে থাকেন। শিমুর বিয়েতে বেশ ওজনদার একটা গয়না গিফট করেছিলেন। সজীবকে বই গিফট করেন। ইমুকে অনলাইন প্রিঅর্ডার করে জয়পুরি মালা আনিয়ে দিয়েছেন ইন্ডিয়া থেকে, ওর টিকটক ভিডিওতে লাইক,কমেন্ট করেন। সাব্বিরের জন্য পারফিউমের কেস পাঠান। আমার পত্রিকায় স্পন্সর করেছেন, পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দেন। মেইলবক্সে এখনো দুটো কবিতা পড়ে আছে। যদিও সেসব কবিতা আমি পড়ে দেখি না, প্রতিচরণের শেষশব্দে অন্তমিল থাকলেই যে কবিতা হয় না সেটা বোঝা কবি এইদেশে খুব অল্প। আমি মহিলাকে একটা ফিরতি মেইল করে দিলাম ‘কোনো কিনখা গিমাদের লেখা আমার পত্রিকায় আর ছাপা হবে না!’ গালাগালির এই ভার্শনটা আমি ফেসবুকে শিখেছি। বাংলা ভাষায় এ এক যুগান্তকারী আবিস্কার। আপনি গালি দিলেন, বুকের যন্ত্রণা কমল আবার মুখও খারাপ করা হলো না! আশ্চর্য। ব্যাপারটা হুমায়ূন আহমেদের জানা থাকলে বলতেন ‘বড়ই আচানক বিষয়!’
সাবিনা খানকে গালাগাল দিয়ে সেরে আমি আম্মার কথার জবাব দিলাম ‘ওই মহিলাকে টানাটানি কেন করব? আব্বার দোষ কি কম?’
‘এইরকম নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ যদি গায়ের উপর এসে পড়ে, পুরুষমানুষ কতক্ষণ ঠিক থাকে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমি তো ভাবতেও পারি না!’
‘আসলেই বড়োভাইয়া, মহিলাই কিন্তু নোংরা। মেসেজগুলো দেখ। এইটা দেখ…’ শিমু মোবাইলটা আমার দিকে নিতে আসলো। এতগুলো স্ক্রিনশট আমি সবগুলো ভালোভাবে দেখিওনি। শিমুর হাতেরটা দেখলাম, সাবিনা খান লিখেছে ‘তোমার ঠোঁটে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে! পান করতে ইচ্ছে করে তোমাকে। কবে আবার আগের মত কাছে পাব?’
আব্বা রিপ্লাই করেনি কিন্তু একটা লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে রেখেছে।
এই মেসেজে পরিস্কার, এই মহিলার সাথে আব্বার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং তারা একসাথে অন্তরঙ্গ সময় ও কাটিয়েছেন!’
‘ছিঃ। আমি তো মারজুকের সাথেও এভাবেও কথা বলতে লজ্জা পাব! তুই আমাকে মহিলার ফোন নম্বর দে তো!’
‘কী করবি?’
‘গালি দিয়ে ভূত ছাড়াবো!’
আমি একটু আগে স্পেশাল ভাষায় গালাগাল করেছি সেটা না বলে বললাম ‘দেখ, এই মেসেজে এটা তো স্পষ্টই যে আব্বার একটা ভূমিকা আছে। উত্তেজিত হোস না। আব্বা আসুক, তার সাথে কথা বলি আমরা! দেখি কী বলে? তার রেসপন্স কী?’
আম্মা সাব্বিরকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ‘ও সাব্বির, দেখ তোর আব্বার কাণ্ড!’
বিমর্ষমুখে ঘরে ঢুকেছে সাব্বির। সেইভাবেই বলল ‘নতুন কী!’
আসলেই নতুন না। আমি যখন এসএসসি দেই তখন এক মহিলা একদিন বাসায় এসে উপস্থিত। হাতে চালের আটার রুটি, কষা মাংসের বাটি, আচারের বয়ম। কী? তার মেয়ের বিয়ে দিতে চান আব্বার সাথে! আমরা কী হতভম্ব হব, মহিলা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। তার মেয়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কীভাবে যোগাযোগ আব্বার সাথে মহিলা বলতে পারেন না, কিন্তু মেয়ে তার একেবারে পাগল আব্বার জন্য। মেয়ের পাগলামি দেখে মহিলা আব্বার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে এসেছে। আমরা পাঁচভাইবোন তখন সারি বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছি তার সামনে। মহিলা একটুর জন্য দাঁতকপাটি লাগাননি!
সেবারও আব্বার মোবাইল থেকে শতশত এসএমএস উদ্ধার হয়েছিল, রোমান্টিক উক্তি সম্বলিত! আম্মা সারারাত কেঁদেছিলেন। আব্বা আম্মার ঘর থেকে মারপিটের শব্দও পেয়েছিলাম। সারারাত আমরা চারভাইবোন অভুক্ত পেটে গোল হয়ে বসে থেকেছিলাম। সজীবকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল শিমু। তবে পরেরদিন আম্মা একদম স্বাভাবিক। আমাদেরকে ডেকে বললেন ‘মেয়েটা পাগল। মানসিক সমস্যা আছে। তোমার আব্বা একটু সময় দেয়, কথা বলে, মেয়েটা যেন আত্মহত্যা করে না বসে! বন্ধুর মতই। তোমাদের আব্বা মানুষ কিন্তু খারাপ না!’
আমি জানি না আম্মা কিছুই বোঝেন না, নাকি বুঝেও না বুঝে থাকেন! আবার আমাদের সামনে আব্বার ইমেজটাও খারাপ হতে দেন না। এতে লাভ কিছু হয়নি; আমরা ভাইবোনরা একটা টক্সিক ফ্যামিলি লাইফ পেয়েছি, হীনমন্যতায় ভুগেছি, আত্মনির্ভরশীলতা তৈরি হয়নি, সম্পর্কের গুরুত্ব দিতে শিখিনি!
সাব্বিরের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। ও একমূহুর্ত চুপ থেকে বলল ‘আব্বা ওই মহিলাকে বিয়ে করেছেন নাকি? কি একটা নাকফুল দেওয়াদেয়ি দেখলাম, তাই তো মনে হলো!’
ইমু চট করে আরেকটা স্ক্রিনশট পড়তে শুরু করল ‘তোমার নামের নাকফুলটাই আমার সবচেয়ে বড় অলংকার, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ! আমার জীবন থাকতে এটা আমি আমার কাছ থেকে আলাদা করব না। মরে গেলেও ওটাসহই কবরে নামিও।’
সাবিনা খান লিখেছেন আব্বাকে!
চলবে…
Afsana Asha