কড়চা – ৩
ভরপেট খাওয়ার পরপর আমার জমিয়ে খিদে পায়। আম্মা সবসময়ই আমাদেরকে টাটকা খাওয়াতে ভালোবাসেন। খিদে পেয়েছে বললেই নানারকম স্ন্যাকস ঝটপট করে দেন পিঠে পায়েস সিঙারা থেকে শুরু করে চাউমিন বা স্যান্ডউইচ, মিটবল কিছুই বাদ যায় না। বাসার পরিস্থিতি খুবই জটিল কিন্তু আমি বারচারেক ফ্রিজের ডালা খুলে চিরুনি অভিযান চালিয়েছি। কিছু পাইনি। বিস্কিটের পটের নিচের দিকে কয়েকটুকরো বর্নভিটা বিস্কিট পেয়ে কুটকুট করে কামড়ে খেয়েছি। ডিপ ফ্রিজে ফ্রোজেন স্ন্যাকস আছে। ভেজে ফেললে হয়ে যায়। কিন্তু কিচেনে তেলেভাজার অভ্যাস আমাদের নেই। আম্মা আমাদের তিনভাইকে তুলোর উপর করে মানুষ করেছেন, গরম তেলের ছ্যাকা খেতে শিখিনি আমরা। কিন্তু এখন কাউকে কিছু তৈরি করে দেওয়ার কথা বলা যাবে না। শিমু আর ইমু খুব কঠিন মুখ করে বসে আছে। জ্যামের বয়ম আছে একটা, মিক্সড ফ্রুট জ্যাম। একটু বাটার মিশিয়ে খেয়ে নিলাম। খারাপ লাগল না খুব একটা।
আম্মা, শিমু আর ইমুর সাথে কথা বলছেন, কানে আসছে। আম্মা বলছেন ‘একটা মেয়ে যদি কোমর দুলায়, বুক দুলায়ে কোনো পুরুষের সামনে আসে, পুরুষটা কীভাবে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখবে?’
সাব্বিরের কানেও কথাটা গেছে। ও মুখ ভেঙিয়ে বলল ‘হ্যাঁ, তাই তো। পুরুষের কাজই তো কন্ট্রোল হারানো!’
আমি ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম।
‘বাবু? তোর আব্বা কোথায়? আসলো না তো এখনো। ফোন দে তো একটা।’ আম্মার কথায় আমি অবাক হলাম না।
সাব্বির বলল ‘আসুক সময়মতো!’
‘কুমড়োফুলের বড়া খাবে বলেছিল। সকালে নিজে বাজার থেকে দিয়ে গেছে। আমি গুছিয়ে রেখেছি। কখন আসবে জানলে ব্যাটারটা বানিয়ে রাখতাম। আসলে গরম গরম ভেজে দিতাম। তোরাও তো খাবি, না?’
সাব্বিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হেসে ফেললাম। আমাদের আম্মা! সহজ সরল আম্মা আমাদের! কুমড়োফুলের ব্যাটারের ঘনত্বের হিসাব করেই তার দিন কেটে যায়। ওতে লবণ কম হলে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান। আমাদেরকে খেতে দেওয়া আর আলমারিতে পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের সালোয়ার কামিজের সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তা ছাড়া তার ভাবনাচিন্তার জগৎটা একদম সংকীর্ণ।
শিমু বলল ‘আব্বা মনে হয় আজকে দেরি করে আসবেন!’
আমি বললাম ‘আব্বা আজকে নাও আসতে পারেন!’
আম্মা অবাক হলেন ‘আসবে না কোথায় যাবে?’
‘জানি না। বললেন তো বাসায় ফিরবেন না!’
‘ফোন কর একটা!’
‘পারব না আম্মা!’
আম্মা জানেন আমি আম্মার কথা শুনি না। আমরা কেউই শুনি না। গুরুত্ব দেই না আম্মার কথায় আমরা কেউই। আমরা বলতে আমরা তিন ভাই। ছোটোবেলা থেকে আমরা এটাই শিখেছি, এটাই জেনেছি আর এটাই বুঝেছি যে মাকে ভালোবাসতে হয় কিন্তু মা বা মেয়েদের কথায় গুরুত্ব দিতে নেই। মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তি খুবই নিম্নমানের। আম্মার রাজত্ব শুধু কিচেনের কেবিনেটগুলোর তাকের উপর – এর বাইরে যে বিশাল পৃথিবীটা সেখানে আম্মার বুদ্ধি একদমই কাজের না। তেমনি আমাদের বোনগুলোও – বুদ্ধির ঠিলে সব। আম্মার চরিত্রের কার্বণকপি। শিমু আর ইমুকেও আমাদের বাসায় কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ওরা ঘরের কাজ করে, আমাদের তিনভাইয়ের বিছানা তোলে, আমরা জামা-প্যান্ট পাল্টিয়ে সেখানেই ফেলে রাখি, ওরা তুলে বিনে রাখে, ধোয়ার পর গুছিয়ে তুলে রাখে। আমি যেখানে সেখানে বই ছড়িয়ে রাখি, সাব্বিরের চায়ের কাপ থাকে খাটের কোণায়, সোফার চিপায় – ওরা খুঁজে বের করে কিচেনে পাঠায় সেগুলো। সজীব ভাত খেয়ে প্লেটটা সিংকেও নেয় না। পানিটাও ইমুর এনে দিতে হয়। শিমু-ইমু পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে, আমাদের পরিবারে মেয়েদের পড়াশুনায় খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় – কিন্তু ততক্ষণই, যতক্ষণ না একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসে যায়। শিমুর খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। ওর বর মারজুক দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি টেলিযোগাযোগ কোম্পানির কর্মকর্তা। আমরাই অবস্থাগত দিক দিয়ে ওদের থেকে নিচু আছি। আব্বা লক্ষ টাকার ফার্নিচার, অলংকার দিয়েছেন শিমুকে, তারপরও নাকি প্রায়ই ওকে খোঁটা শুনতে হয়, ঢাকাশহরে আব্বার স্থায়ী কোনো আবাস না থাকায়। আম্মা শিমুকে বারবার শিখিয়ে দেন, শশুরবাড়ির কোনো কথায় যেন উত্তর না করে। পুরুষ মানুষের হাজারটা দোষ স্ত্রীকেই হজম করে যেতে হয়, নইলে নাকি সহধর্মিণী হওয়া যায় না।
আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে আম্মা শিমুকে বললেন ‘শিমু, তুই একটা ফোন দে। তোর কথা তোর আব্বা শোনে। তোর কথার গুরুত্ব দেয়।’ আমি জানি আব্বা শিমুকে নয়, শিমুর বরের পদমর্যাদাকে গুরুত্ব দেন। শিমু আর ইমু, আব্বার আদুরে মেয়ে, না চাইতেই সব পেয়ে যায় কিন্তু তাদের কোনো মতামত একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয় আব্বার কাছে।
শিমু উত্তর দিলো ‘যদি না আসতে চায়?’
‘বলবি, সজীব অসুস্থ হয়ে গেছে নইলে বল ও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে!’ আমি হেসে ফেললাম। মোক্ষম ওষুধ আব্বার অসুখে। আব্বা পুত্রপ্রেমী। তার পুত্ররা তার খুব প্রিয়। আমি, সাব্বির বা সজীবের জন্য তিনি যেকোনোকিছু করতে পারেন।
শিমু আব্বাকে ফোন দিলো লাউডস্পিকারে রেখে ‘আব্বা আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম!’
‘আব্বা বাসায় আসবেন কখন?’
‘কেন?’
‘সজীব বাসা থেকে চলে গেছে। ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ আম্মা এপাশ থেকে নিঃশব্দে প্রম্পট করলে শিমু তাই বলল।
‘ফোন করে দেখো!’
‘ফোন নেয় নাই।’
‘আমি কী করব? এর জন্য তোমাদের আম্মা দায়ী। সিনক্রিয়েট করে বাসার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করবে শুধু শুধু। ছেলেটার কথাও ভাববে না। রাখো? আমি আসছি।’
আব্বা ফোন কেটে দিলেন। এখন আব্বা আসবেন, আমরা সবাই জানি। আম্মা সজীবকে ডাকলেন ‘সজীব, তুই এখনই ছাদে চলে যা!’
সজীব বোকার মতো তাকিয়ে থাকল ‘ছাদে কেন যাব?’
‘তোর আব্বাকে বলেছি তুই বাসা ছেড়ে চলে গেছিস। তুই ছাদে যা। তোর আব্বা তো ছাদে যাবেই খুঁজতে।’
সজীবের অন্ধকারভীতি আছে। ও অস্বীকার করল ‘না, আমি যাব না।’
শিমু বলল ‘আচ্ছা, আমি খেয়াল রাখতেছি, আব্বার গাড়ি ঢুকতে দেখলেই তোকে বলব, তখন ছাদে দৌড় দিবি।’
‘আমার ভয় লাগে।’
‘আরে যা না। এক মিনিট লাগবে। সিঁড়িতে থাকবি, আব্বা উঠতে শুরু করলেই ছাদে গিয়ে দাঁড়াবি।’
‘হুহ!’ সজীব ঠোঁট উল্টাল ‘তাইলে স্পাইডারম্যানের যে নতুন টিশার্টটা লঞ্চ হয়েছে ওইটা আমাকে দিবা বলো?’
আম্মা তাড়া দিয়ে বললেন ‘আচ্ছা, যা, আমি দেবো।’
‘কথা দিলা?’
‘হুম।’
বাবা-মায়ের ভেতর সমস্যা থাকলে সন্তানরা সেটার সুযোগ ভালোমতোই নেয়।
সাব্বির আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি সাব্বিরের দিকে। আমাদের সম্ভবত দেজ্যাভু হচ্ছে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেবার সাব্বির ক্ষেপেছিল! এইচএসসি পরীক্ষা ছিল বেচারার। রাত জেগে পড়া করত। নোট করত। মুখস্থ পড়ার আওয়াজে আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও ঘুমাতে পারত না।
পুরোনো কাগজপত্র ভাংগারির কাছে বিদায় করতে গিয়ে আম্মা সেবার একতাড়া টাটকা চিঠি বের করে এনেছিলেন আব্বার ড্রয়ার থেকে। মোবাইলের বান্ডেল মেসেজের সেই স্বর্ণযুগে চিঠির আদান-প্রদান যথেষ্ট আবেগের ব্যাপার আর সেই চিঠিগুলোও ছিল আবেগে টইটম্বুর। চিঠির প্রেরক ভিন্নধর্মাবলম্বী এবং আবেগ এতটাই চূড়াস্পর্শী যে সে আব্বার পদতলে নিজ ধর্মও ত্যাগ করতে ইচ্ছুক।
পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে সাব্বির সেসব চিঠি মুখস্থ করতে থাকল আর রাগে ওর নাকের পাটা ফুলতে থাকল, প্রচন্ড শীতে ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেল।
এদিকে আম্মা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, আব্বার সাথে তুলকালাম লাগছে। সারাদিন ঘরের অবস্থা নারকীয়।
মধ্যরাতে আম্মা সাব্বিরের পাশে এসে ফিসফিস করলেন ‘সাবু, তোর আব্বাকে এই পথ থেকে ফেরত আন।’
‘আমি কী করব আম্মা?’
‘তুই বাসা থেকে চলে যা!’
‘কোথায়?’
‘তোর কোনো বন্ধুর বাসায় যা!’
‘আম্মা, এভাবে এতরাতে কারো বাসায় যাওয়া যায় না।’
‘তাহলে, রাস্তায় যা। এমনিই হাঁটাহাঁটি কর কিছুক্ষণ।’
‘তারপর?’
‘তোর আব্বা তোকে আনতে গেলে, তোর মাথায় হাত দিয়ে কসম খাওয়াবি, সে আর ওই মেয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবে না।’
আমিও তখন জোশে এসে গিয়েছি, সাব্বির আর শিমু, ইমুর উত্তেজনা আমাকে প্রভোক করছিল। আব্বাকে গিয়ে বললাম ‘আপনার জন্য সাব্বির এই রাতে বাড়ি থেকে চলে গেছে।’
আব্বা রেগে ছিলেন। দপ করে চোখের আগুন নিভে গেল, সেখানে ভয়ের ছায়া প্রকট হলো। রাজনৈতিক ধরপাকর চলছে তখন পুরোদমে। আর একদিনের গ্যাপ দিয়েই সাব্বিরের কেমিস্ট্রি ফার্স্ট পেপার পরীক্ষা।
আব্বা আমাকে ডাকলেন ‘বাবু চল তো এগিয়ে গিয়ে দেখি! চারিদিকে পুলিশের টহল!’
‘আমি কেন যাব? আপনি এইগুলার পেছনে দায়ী। আপনিই খোঁজেন।’
‘আয় বাবু। আয় তো!’
আব্বার সাথে বেরিয়ে সাব্বিরকে খুঁজতে সত্যিই গলদঘর্ম হতে হয়েছিল সেবার। এরাস্তা, ওরাস্তা, কয়েককিলো হেঁটেও ওর দেখা মেলেনি। সমস্ত আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীকে ফোন করে সাব্বির তাদের ওখানে গেছে কিনা খোঁজ নিতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত সাব্বিরের দেখা মিলল বড় খেলার মাঠের মাঝখানে, রাত তিনটায়, চারহাতপা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে আছে!
আম্মা সবসময় আব্বার এই ব্যাপারগুলো চেপে গেলেও সাব্বিরের বাড়ি ছাড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে সবাই সেবার আব্বার চরিত্রের এই দিকগুলো জেনে গিয়েছিল। নানা আর মামারা মিলে মিটিং ডেকেছিলেন। সেখানে আম্মা আব্বাকেই সাপোর্ট করেছিলেন, চিঠিগুলোর মধ্যে আব্বার কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি বলে আব্বার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছিলেন। বাড়াবাড়ি এবং আব্বার সাথে খারাপ ব্যবহার করার অপরাধে আম্মা সাব্বির ও আমার সাথে তিনদিন কথাও বলেননি!
সাব্বির আর আমি চোখেচোখে তাকিয়ে পুরোনো স্মৃতি মনে করে নিলাম। আব্বা ঘরে ঢুকেই বললেন ‘কোথায় গেছে তোমাদের ভাই? এতগুলো মানুষ তোমরা, ছোটোভাইটাকে আটকাতে পারলে না?’
‘আপনি এর ওর ক্ষেতে মুখ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, পারছি আটকাতে?’
শিমুর কথার প্রতুত্তর করলেন না আব্বা। চোখ গরম করে তাকালেন।
শিমু ক্ষেপে গেল ‘চোখ দেখাবেন না। আপনার জন্য মানসম্মান সব যেতে বসেছে। চোখ তুলে কথা বলতে পারি না আমরা, লজ্জায়!’
‘বাপের পরিচয় দিস না!’ শিমুর উপর রাগ করে আব্বা আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘কাজ নেই তো! আরামে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা ছাড়া তো কাজ নেই। বসে বসে সিরিয়াল দেখবে আর সিরিয়ালের কুটনামি শিখবে। বাচ্চাগুলোরে বেয়াদব বানায় ফেলছে একদম!’
আম্মাও অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন ‘পরকিয়া করে আবার বড়ো বড়ো কথা! এই ছেলেমেয়েগুলো ভালো বলে সহ্য করে।’
‘তা কী করবে, মারবে আমারে?’ বলেই আব্বা আরও ক্ষেপে গেলেন ‘মার! আয় তোরা, মার আমাকে!’
‘আব্বা, আপনি এমন ভাব করতেছেন, যেন কোনো অন্যায় করেননি।’
‘এই কী অন্যায় করছি আমি? খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, এখন এই বাড়িতে তোর কী? তুই এইখানে এসে সবাইরে উস্কানি দিস কেন?’
শিমু হতবাক হয়ে গেল! বিড়বিড় করে বলল ‘আমি উস্কানি দিয়েছি?’
‘দিয়েছিস তো! নিজের বাড়ি গিয়ে করবি এসব। এটা তোর বাড়ি না!’
শিমুর চোখ থেকে আগুন ঝরছে যেন। নিঃশ্বাসে ফুলছে ও…
*****
আব্বা সজীবকে খুঁজে এনে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন ‘শান্তি নেই কোথাও। এত অশান্তি আর ভালো লাগে না!’
আমরা কেউ কথা বললাম না। শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে আব্বা ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।
আম্মা সজীবকে ডাকলেন, ‘তোর আব্বাকে কসম দিয়ে বলাইছিস?’
সজীব অবাক হলো, ‘কীসের কসম?’
‘কেন? বললাম না, তোর মাথায় হাত দিয়ে তোদের আব্বাকে কসম করাবি? ওই মহিলার সাথে যেন কোনো যোগাযোগ না রাখে?’
‘বলেছিলেন? আমার মনে ছিল না!’
‘তাহলে তোকে ছাদে পাঠালাম কেন? কী বলছে তোর আব্বা?’
‘আব্বা? কিছু বলেন নাই!’
‘কিছু বলে নাই?’
‘না। বলেছেন শুধু, সজীব বাসায় আসো।’
‘আর তুই চলে আসলি?’
‘আসব না?’
‘কিছুই বললি না?’
‘কী বলব!’ বিরক্তমুখে বলল সজীব। আম্মাও ওকে আর কিছু বললেন না। শিমু নিঃশব্দে কাঁদছে। আব্বা ওকে বলেছেন, এটা ওর বাড়ি নয়। সেই অভিমান ওর যাচ্ছেই না। যেকোনো আবদারে ওর কথাই শেষ কথা ছিল আব্বার কাছে। ও যা চেয়েছে আব্বা কোনোদিন না করেন নাই। মেয়েরা আব্বার কাছে ডলের মতো। কোনোদিন শিমু, ইমুকে বকেন না।
আব্বা ফ্রেশ হয়ে এসে টিভির সামনে বসলেন। একাত্তর টিভির সংবাদ ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘কী রে ইমু, কিছু খেতে টেতে দিবি? কিছু আছে তোদের ঘরে?’
ইমু আম্মার দিকে তাকালো। আম্মা চোখের পানি মুছে উঠে গেলেন।
আব্বা টিভিস্ক্রিনের দিকে চোখ দিয়েই বললেন, ‘তোমাদের আম্মা অল্পতেই সিনক্রিয়েট করা মানুষ। তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়ে। তোমরাও যদি মায়ের মতো বাতাসে দুঃখ টেনে আনো, কেমন করে হবে? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এমন পরিস্থিতি করা ঠিক?’
শিমু রেগে ছিল, চিৎকার করে বলল, ‘এইটা সামান্য বিষয়?’
আব্বাও রাগ দেখালেন এইবার ‘তোমার সাথে আমি কথা বলব না। বেয়াদব মেয়ে!’
শিমু রাগে কাঁপছে। আমি বললাম ‘এই শিমু চুপ কর!’
আব্বার কাছে এরকম বকুনি খাওয়াটা শিমুর জন্য নতুন। ও চুপ করতে পারল না। সেইরকম রেগে রেগে বলল, ‘আপনি আম্মাকে ঠকাবেন এইভাবে, এইরকম মহিলার সাথে খারাপ খারাপ মেসেজ দেবেন, এইটা সামান্য ব্যাপার?’
‘এই, কী খারাপ মেসেজ দেখেছিস তুই? কোনটা খারাপ?’ আব্বাও চিৎকার করে চলেছেন।
‘এই যে, এগুলো খারাপ মেসেজ না?’
‘না, মোটেও না। কে বলেছে তোদের এগুলো খারাপ মেসেজ? সারাদিন অফিসে মুখ গুঁজে গাধার খাটুনি খাটি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কামলা দিই তোদের জন্য। আমারও তো একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার আছে। একটু শান্তি দরকার।’
‘এইসব আপনার রিফ্রেশমেন্ট?’ সাব্বির এতক্ষণ নিজেকে দমিয়ে রাখলেও এবার রেগে গেল।
‘তোদের মতো বেয়াদবদের মুখ দেখার চাইতে তো শান্তি! মনে রাখিস, তোদের ইনকাম খাই না আমি।’
‘কী বেয়াদবি করেছি আমরা? বলেন?’ সজীবও এগিয়ে এসেছে।
সবগুলো বাচ্চাকে বিপক্ষে কথা বলতে দেখে আব্বা হয়তো একটু দমে গেলেন। কিন্তু চিৎকার করা কমালেন না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘আমার ছেলের ভাষা এত বাজে হবে, এ আমি কল্পনাতেও আনিনি। একজন ভদ্রমহিলাকে এত নিকৃষ্ট ভাষায় অপমান করার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি।’
আমি বুঝলাম, আমার কিনখা-গিমা মেইল আব্বার কাছে ফরোয়ার্ড হয়ে গিয়েছে।
আমি বললাম ‘ওইটা ওনার পাওনা মনে হইছে!’
‘না। তোমার অভিযোগ থাকলে সেইটা আমার বিরুদ্ধে। গালি দিতে হলে আমাকে দেও। বাইরের একজনের সম্মানহানি কেন করবা? এটা তোমার এখতিয়ারের বাইরে!’
‘বাইরের একজন যখন আমার ঘরের শান্তি নষ্ট করার পেছনে ভূমিকা রাখে, তখন আমার এখতিয়ারের সীমানাটাও বড়ো হয়ে যায়!’
‘তোমার ঘর মানে কী? ঘর আমার। লায়েক হয়ে গেছ, না? আমার টাকায় চলো, এখনো। ভুলে যেও না!’
‘বারবার এই কথা মনে করিয়ে দেবেন না, আব্বা। আমাদের অধিকার আছে আপনার ইনকামে। আপনার দায়িত্ব এটা। কোনো দয়া করতেছেন না আপনি।’
‘আর তোমাদের কোনো দায়িত্ব নেই? জন্মদাতারে সম্মান করাটা তোমাদের দায়িত্ব না?’
‘সম্মান যদি আপনি না রাখতে পারেন, সেইটা আপনার ব্যর্থতা আব্বা!’
‘বারবার এক কথাই বলতেছ রিয়াজ। আমি এমন কোনো কাজ করিনাই। তোমরা শুধু শুধু বাড়াইতেছ! আর অন্য একটা ভদ্রমহিলাকে অসম্মান করেছ।’
‘অসম্মান? আমি ওইটারে জুতা দিয়ে পিটাব! স্কুলে চাকরি করে না? এইসব মেসেজের স্ক্রিনশট আমি ছাপায়ে ওর স্কুলে বিলি করব!’ শিমু এসে কথা কেড়ে নিলো।
‘কী এমন খারাপ আছে মেসেজে?’
‘কিছু খারাপ নেই?’
‘না, নেই!’
আব্বা কেন শিমুকে আরও বেশি ক্ষেপাচ্ছেন, কে জানে? শিমুও ক্ষেপে লাল হয়ে বলল ‘আমি এখুনি গার্লস গ্রুপে এই স্ক্রিনশট পোস্ট দিচ্ছি। দেখি, মেয়েরা কী বলে! ওদের তো আব্বা না, ওরা তো কাউকে চেনেও না!’
‘দে, কী করবি কর!’ আব্বার কন্ঠেও জেদ।
বলতে দেরি হলো, শিমুর পোস্ট দিতে দেরি হলো না!
মূহুর্তে পোস্টে কমেন্ট এসে ভরে যেতে যাগল। সেসব কমেন্ট আবার শিমু উচ্চস্বরে পড়েও শোনাতে শুরু লাগল৷
‘দুজনেই সমান দায়ী। ঝাড়ুপেটা করা লাগে এসব পুরুষ আর মহিলাদের!’
‘পরকীয়া করে নোংরা মানুষেরা।’
‘দুজনেই তো দোষী। আপনি শুধু মহিলার কথা কেন বলছেন?’
‘কে হয় আপনার?’
‘পরিবারগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছে এই পরকীয়া!’
‘মহিলাটা একটা নটি!’
‘এইসব মহিলারা জাহান্নামে যাবে!’
শিমুর কমেন্ট পড়ার মাঝখানে আম্মা অগ্নিমূর্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। ‘এত বড়ো বড়ো ছেলেমেয়ের বাপ, তার কী এসব মানায়? ছিঃ। মেয়ে বিয়ে দিয়েছ, কয়দিন পরে তো নানা হবা! এখনো এইসব? আর কত সহ্য করব আমি? ছেলেমেয়ের সামনে মুখ দেখাতে পারি না। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার!’
শিমুকে আজ ভূতে পেয়েছে। ও আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘আপনার জায়গায় আমি থাকলে, গলায় দঁড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তাম এতক্ষণে!’
আম্মা কাঁদতে কাঁদতে আবার কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজতে চলে গেলেন।
আব্বা শিমুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘তোমার মনে হচ্ছে না, তুমি অনেক বাড়াবাড়ি করতেছ?’
‘না, মনে হচ্ছে না। আপনি ট্রিগার করেছেন আমাদেরকে!’
‘বেয়াদবের দল। বেয়াদব খাওয়াচ্ছি আমি। যা! সবগুলো বেরো, আমার ঘর থেকে। আজকেই বেরোবি সবকয়টা। তোদের মা কে নিয়ে তোরা সব চলে যাবি!’
‘অবশ্যই যাব। আপনার মতো দুশ্চরিত্র মানুষকে আব্বা বলতে লজ্জা হচ্ছে আমার!’
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম শিমুর ভাষা শুনে।
বিয়ে হয়ে গেলেই কি মেয়েরা এমন স্বাধীন হয়ে যায়? পিতা-মাতা আর অভিভাবক থাকে না? মেরুদণ্ডহীন মায়ের অভিভাকত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে কি শিমুর শিরদাঁড়া একটু বেশি জোর পেয়েছে নাকি অভিভাবকহীন হয়ে অসভ্য হয়ে উঠেছে? যত যাই হোক, আব্বা তো! কথা বলায় আরেকটু সংযমী হওয়া উচিত শিমুর!
চলবে…
আফসানা আশা