কড়চা – ৪ (শেষ পর্ব)
‘এই শিমু, থাম। কী বলিস এইগুলা?’ আসন্ন দুর্যোগের কথা চিন্তা করে আমি চুপ করতে বললাম শিমুকে।
আব্বাকেও বললাম ‘আপনিও তো কথা বাড়াচ্ছেন, আব্বা। কাঠগড়ায় আপনি। আপনার কোনো জবাব থাকলে বলেন। অকারণ চিৎকার করলে নির্দোষ প্রমাণ হয়ে যাবেন না!’
‘ওই মহিলা, বদমহিলা, আমার জীবনটাকে শেষ করে দিলো। প্যানপ্যান করে বাচ্চাগুলোর কান ভাঙিয়ে আমার বিপক্ষে দাঁড় করায় দিছে। বাপ এখন শত্রু এদের কাছে। বাপের কাছে জবাব চায়!’ কুৎসিত আর অশ্রাব্য গালি দিয়ে আব্বা, আম্মাকে মারতে তেড়ে গেলেন।
সাব্বির আর আমি আব্বাকে জাপটে ধরে থামালাম। শিমু রাগে কাঁপছে, ‘ছেড়ে দে ভাইয়া। ছেড়ে দে। মারুক আম্মাকে। আমি রেকর্ড করি। তারপর অনলাইনে ছেড়ে দেবো। সভ্য, ভদ্র, ভালো, জেন্টলম্যানের ভেতরে যে বউপেটানো কুৎসিত মানুষ থাকে, সেটা সবাই দেখবে। হাইফাই, শিক্ষিত, কর্পোরেট হাইঅফিশিয়ালের চকচকে মুখের পেছনের সত্যিটা সব মানুষ জানবে।’
আব্বা এবার শিমুকে মারতে উদ্যত হলেন, আমরা প্রাণপণে আটকালাম।
সজীব ঝগড়াঝাটি দেখতে পারে না। ওর প্যালপিটিশন শুরু হয়। ও নিজের ঘরে ছিল। উঠে এলো। ওকে দেখে আব্বা শান্ত হলেন। আস্তে করে বললেন ‘এসব কী বাবু? তোমাদের আম্মার কথায় তোমরা এভাবে প্রভাবিত হও?’
আর কেউ না জানুক, সজীব ভালোমতো জানে, এই পুরো ঘটনার পেছনে আম্মা কোথাও নেই। কিন্তু আম্মাকে দোষের ভাগীদার হতে দেখে ও স্বীকার করার আগেই আমি বললাম ‘আম্মাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আম্মা কী করেছেন? আমি তো বলেছি আপনাকে, মেসেজগুলো আমি পেয়েছি। বারবার আম্মাকে কেন টানছেন?’
সজীব, আব্বাকে নিয়ে সোফায় বসালো।
আম্মা ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না শুরু করলেন ‘কিছু হলেই আমাকে মারতে আসে। শরীরে খুব শক্তি, না? ওই হাত পড়ে যাবে। ওই শক্তি থাকবে না। অথর্ব হয়ে থাকতে হবে। তখন কোনো প্রেমিকা থাকবে না, আমার ঘাড়েই গছতে হবে!’
দুর্বলের অস্ত্র হচ্ছে অভিশম্পাত করা। আম্মা সেটাই খুব ভালোমতো করতে জানেন। শুধু তাতেই থামলেন না আম্মা, অতীতের খোঁচাখুঁচিও শুরু করলেন, ‘এর বাপও ছিল এমন। আমার শাশুড়িকে কম জ্বালাতন করেনি। কয়েকদিন পরপরই বিয়ে করে নিয়ে আসত একেকটা। শেষে কী হলো, হাগা-মুতা সব সেই তোদের দাদীরই দেখা লাগল! এরও তাও হবে!’
আমাদের দাদার উল্লেখে আব্বা আবারও ক্ষেপে গেলেন, ‘এই তুই আমার বাপ তুলিস?’ বলেই আম্মাকে, আম্মার বাবা তুলে গালিগালাজ শুরু করলেন।
আগে অবাক হতাম, এখন আর হই না। এখন সব স্বাভাবিক লাগে। দাদার বহুবিবাহে যে আব্বা, দাদির জন্য কষ্ট পেতেন, তিনি কী করে সেই একই অপরাধ আমার আম্মার সাথে করেন? আবার, নিজের বাবা সম্পর্কে বদনাম শুনতে না পেরে কীভাবে আম্মার বাবা তুলে গালিগালাজ করেন?
এখন অবাক হই না। এটাই স্বাভাবিক। পুরুষের জন্য স্বাভাবিক। পুরুষেরা গালিগালাজ করবে, মারবে – আবার ক্ষমা চাইবে, আদর করবে, নারীরা সব ভুলে যাবে – পুরুষের মাহাত্ম্যর জয়গান গাইবে!
‘আব্বা থামেন। অনেক হইছে। এইভাবে আম্মাকে গালি দেবেন না। আমরা সহ্য করব না আর।’
‘তুই চোখ রাঙাস কারে? বের হবি, সবগুলো আজকে এই বাসা থেকে বের হবি। তোদের জায়গা রাস্তায়। বস্তিতে। ফ্ল্যাটবাসায় থাকার যোগ্যতা তোদের নেই। আজকেই বের হবি সব! তোদের মাকে নিয়ে বের হবি!’
‘হ্যাঁ, তা তো বের হবোই। তাহলে ওই নটিরে ঘরে ওঠাতে তো আপনার সুবিধা হয়!’ শিমু পুরোই ফায়ার হয়ে আছে! আমি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি ওর কথাবার্তায়। আব্বা কখনো আমাদের গায়ে হাত তোলেননি। এবারে হয়তো আত্মহারা হলেন। উঠে এসে শিমুর মাথায় জোরে একটা চাটি মারলেন।
শিমু ঘুরে পড়তে গেলে ইমু এসে ধরল ওকে৷ ইমু শান্ত ধরনের মেয়ে। শিমুও চুপচাপ গোছের। আজ ওকে ভূতে পেয়েছে। ইমু শান্ত করার চেষ্টা করল ‘আর বাড়াসনে আপা। আব্বা এমনিতেই রেগে আছেন। জিনিসটা বাড়তেছে শুধু!’
‘এই মেয়ে এখনই বের হবি। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না!’ শিমুকে মেরেও আব্বার রাগ কমেনি।
‘আমিও আপনার মুখ দেখতে চাই না।’ শিমুও আব্বার মতোই ক্রমাগত উত্তর করে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমি জানি না কী করা উচিত। শিমুর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমার অন্তত মাথা খারাপ করা চলবে না। কিন্তু এখন কী করে সামলাব সেটাও বুঝতে পারছি না।
সাব্বির আব্বার মুখোমুখি বসল। আস্তে আস্তে বলল ‘আব্বা পুরো ব্যাপারটা উলটা হয়ে যাচ্ছে না?’
‘কীসের উলটা?’
‘এই দেখেন, যেখানে আপনার উচিত জবাবদিহি করা সেখানে আপনিই রাগ দেখাচ্ছেন!’
‘কীসের জবাবদিহি? কার কাছে জবাবদিহি? তোমরা আমার গার্জিয়ান?’ আব্বার কন্ঠ চড়াইতে।
‘না। আমরা গার্জিয়ান না। কিন্তু আপনার কার্যকলাপ আমাদের অসুস্থ করে দিচ্ছে। এই যে ঘটনাটা ঘটতেছে, সেটা কি আজই প্রথম? এর আগে আমি এরকম বেয়াদবি করিনি আপনার সাথে? এই একই ব্যাপার নিয়ে বড়োভাইয়াও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি? এটা থামছে কোথায়? আমাদের খুব কষ্ট হয় আব্বা। খুব লজ্জা লাগে। ভয় লাগে। এইযে মেসেজ চালাচালি করেন, ওই মহিলা যদি ওগুলো কখনো লিক করে দেয়, ভাবতে পারছেন কী হবে? আপনার সন্তান আমরা সেটা এখন আমাদের জন্য লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘দেখো, আমি এমন কিছু করিনি যে তোমরা লজ্জা পাবা! বরং আমার ছেলে ভদ্রমহিলাকে যে ভাষায় গালিগালাজ করেছে সেটা আমার জন্য অপমানজনক!’
‘ভদ্রমহিলা? নটি একটা। বড়োভাইয়া দে তো মোবাইলটা। আমি দেখি, তুই কী বলেছিস? কম পড়লে আমি একটু মনের সাধ মিটাই!’
সাব্বিরের কথায় আব্বার গলার স্বর নেমেছিল, শিমুর কথায় আবার উঠল ‘তোমার বোনের ভাষাটা শুনলে? এও মেয়ে আমার জন্ম?’
‘আব্বা, একটু আগে আপনি আমাদের সামনে আমাদের আম্মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন।’
‘তোমার আম্মা ওটারই যোগ্য?’
‘আর ওই বেশ্যা বুঝি জানটা, কলিজাটা শোনার যোগ্য?’ শিমুর মুখ বিকৃত হয়ে এসেছে।
আব্বা তীব্রদৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে। আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম ‘শিমুর কথা শুইনেন না আব্বা, ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘তো কী করতে বলো তোমরা আমাকে? কী করব আমি? সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে আসি এসব দেখতে? তোমাদের এই ভাষা শুনতে? তোমাদের মুখ দেখতে?’ আব্বাও কেঁদে ফেলেছেন।
আমি আরও চোরাবালিতে আটকে গেলাম। এ কোন গোলোকধাঁধাঁ? সংসার কেন এত জটিল? আব্বার পরিশ্রমে, তার স্ট্যাটাসে ঢাকা শহরের উচ্চমধ্যবিত্তের কাতারে ফেলে দেওয়া যায় আমাদেরকে। অভাব বুঝিনি, যা চাহিদা সব পেয়েছি। চাওয়ার আগেই পেয়েছি। তিনভাই আমরা, কেউ নেশাখোর হইনি। বোনেরা কোনো ছ্যাচড়া প্রেমে জড়িয়ে নাক কাটেনি।কেউ জটিল অসুখে ভুগছি না। তবুও, ওয়ালে আটকে থাকা ফটোফ্রেমের মতো সুখী নই কেন আমরা? বাইরে থেকে সুখী পরিবার দেখতে মনে হলেও, এ আমাদের কেমন অসুখ?
সাব্বির আব্বার কাছে গিয়ে বসল। নিজের মোবাইলটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল ‘তাহলে আব্বা, বিষয়টা কী দাঁড়ালো? আম্মা কান্না করছে। শিমু কান্না করছে। আপনিও কাঁদছেন? কেন? আসলে ব্যাপারটা কী? কেন এসব হচ্ছে?’
আব্বা ওর দিকে তাকালেন না। ওর প্রশ্নের উত্তরও দিলেন না।
সাব্বির আবার জিজ্ঞেস করল ‘কথা বলেন আব্বা? না বললে তো হবে না।’
আব্বা তবুও চুপ করে থাকলেন।
আমার মাথার শিরা দপ করে উঠল রাগে। সাব্বির ভেতর ভেতর রাগ করল কিনা বোঝা গেল না। মুখ অভিব্যাক্তিহীন। নম্র কন্ঠেই বলল ‘তাহলে কি ধরে নেব, আপনি ওই মহিলাকে বিয়ে করেছেন?’
আব্বা হেসে ফেললেন এবার ‘পাগল হয়ে গেছ তোমরা। তোমরা পাগল, তোমাদের মা পাগল। এখন আমাকেও পাগল বানাচ্ছ?’
সাব্বির একটা স্ক্রিনশট দেখিয়ে বলল ‘তাহলে এটা কী, আব্বা? এইযে নাকফুল দিয়েছেন? আমি তো জানি, এই দেশের মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর চিহ্নস্বরূপ নাকে অলংকার পরে! আর মহিলা তো এটাও বলছেন যে আপনার নামের নাকফুল!’
আব্বা হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন ‘কেউ যদি আমার নামে নাকফুল পরে তো আমি কী করতে পারি? আমি তাকে বিয়েও করিনি, নাকফুল কিনেও দিইনি, পরতেও বলিনি!’
‘আপনি তো মানাও করেননি, আব্বা! এতে তো আপনার সম্মতিই বোঝা যাচ্ছে। আর এই নীরব সম্মতির জন্য আপনাকে দায়বদ্ধও থাকতে হবে।’
‘তোমরা কি আমাকে জোর করে দায়বদ্ধ বানাবা?’ ঠাট্টার ছলে বললেন আব্বা।
‘আব্বা, আপনার এইসব নীরব সম্মতি, ধরি মাছ না ছুঁই পানি আমাদের সংসারে, আমাদের জীবনে কম অশান্তি ডেকে আনেনি। প্রতিদিন আমরা ঘরে পা দিয়ে আতঙ্কিত হয়েছি, আজ আবার কী নতুন কাহিনী করেছেন আপনি, আম্মা কী নতুন অশান্তি করেছেন? একটা পিসফুল সন্ধে কাটিয়েছি আমরা, আমার মনে পড়ে না!’
‘থেকো না আমার সাথে। আমি খারাপ মানুষ, আমার সাথে থেকো না!’
আমার মাথা চড়চড় করে উঠেলেও সাব্বির যথেষ্ট ঠান্ডামাথায় বলল ‘এই একটাই তো অস্ত্র আপনার। আম্মাকেও ঠেকা দিয়ে রাখেন, আমাদের পায়েও শেকল বেঁধে দেন।’
‘অদ্ভুত! ভদ্রমহিলা যদি আমাকে নিয়ে কিছু কল্পনা করে, তার কল্পনাতে তো তোমাদের কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা না। সে তার কল্পনার জগতে থাকুক, তোমরাই তো আমার সবকিছু।’ আব্বা বললেন।
শিমু আবার মাঝখানে ঢুকল ‘আর আম্মাও যদি এইরকম কিছু করে। এইরকম মেসেজ দেওয়াদেওয়ি করে?’
‘আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা ইচ্ছে করুক, তাতে আমি কিছু বলব না!’
‘কেন? ঘর থেকে বেরুতে হবে কেন? আপনি তো ঘরে বসেই আকাম করতেছেন। আম্মা কেন পারবে না?’
‘এইটা তার ঘর না!’ আব্বার সাফ জবাব!
‘আম্মার ঘর না? এইটা আম্মার ঘর না? আপনি টাকা দেন বলে এইটা আপনার ঘর, আম্মা যে সারাদিন সংসারের পেছনে পড়ে থাকে, তাতেও এটা আম্মার ঘর হয় না?’ শিমু ক্ষিপ্ত খুব।
‘না। কী করে সে? দুইটা কাজের লোক রাখা আছে।
নাড়াচাড়া করে দুইটা রান্না করে শুধু। আর কী করে? কী যোগ্যতা আছে তার?’
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। আমাদের কিছু বলার নেই এখানে। আসলেই তো, আম্মার কী যোগ্যতা আছে? ইন্টার পড়তে পড়তে বিয়ে। বছর ঘোরার আগে আমি গর্ভে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় আমি রীতিমতো নড়াচড়া করি পেটে। সেটা নিয়ে একটা গল্পও আছে। পেটের ভেতর আমার লাথি খেয়ে আম্মা অস্বস্তিতে নড়াচড়া করতে শুরু করলে, ইনভিজিলেটর আম্মাকে নকলের অভিযোগে দাঁড়াতে বলেছিলেন। বরাবর ফার্স্টগার্ল থাকা আম্মা রেগে গিয়ে বলেছিলেন ‘আমার কাছ থেকে নকল না বের করা পর্যন্ত আমি বসব না!’ ভীষণ জেদি আর শক্ত আমাদের সেই আম্মা, পরপর সাব্বির আর শিমুর জন্ম দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে শিঁরদাড়ার জোর ছেড়ে দেন। হাইস্কুলের হেডমাস্টার নানাজানের দেওয়া বিয়ের পরেও আম্মাকে পড়তে দেওয়ার শর্ত আব্বা বরখেলাপ না করলেও আম্মা নিজেই আর পড়াশোনায় আগ্রহ পাননি। তাই আম্মাকে এখনো ইন্টারপাশ বলেই তামাশা করেন আব্বা। একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনকেই শুধু যোগ্যতা বললে আমাদের আম্মার আসলেই কোনো যোগ্যতা নেই। ঘর-বর-সংসার ছাড়া আম্মার আর কোনো লক্ষ্য নেই, জীবন নেই। বারবার আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন, তার কারণও আম্মা। আব্বা জানেন, আম্মার পক্ষে এই ছলনার চারদেয়াল আর মিথ্যে সামাজিকতা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব। নইলে এই ঢাকাশহরেই নানাজানের দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের ওয়ারিশান আম্মা, আমাদেরকে নিয়ে নিজের পথ করতে পারতেন। এত বিলাসবহুল জীবন হয়তো পেতাম না আমরা, কিন্তু ডালভাতে আমাদের সবগুলো ভাইবোনকে মানুষ করার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আমার নানাজান আম্মাকে দিয়ে গেছেন। আম্মাকে একবার বলেছিলাম সেই কথা। আম্মা হাহা করে বলে উঠেছিলেন ‘কী বলিস এসব? আমি মুখ দেখাব কীভাবে? মানুষ কী বলবে? তোর চাচীদের কাছে ছোটো হয়ে যাব। আমার বোনেরা সবাই কত ভালো আছে! সবার কাছে আমার মানসম্মান সব যাবে!’
নিজের বোনেদের কাছে কীংবা জা-দের কাছে মিথ্যে অহমিকা বজায় রাখতে গিয়ে আম্মা যে নিজের ছেলেমেয়েদের চোখে, স্বামীর চোখে কত তুচ্ছতম হয়ে উঠেছেন, সেই হিসাব তিনি কখনোই কষতেও চান না! আব্বাও ভালোমতোই জানেন, আম্মার প্রিয় এই দুর্বলতার খবর!
আমাদের কোনো প্রশ্নের জবাবই পাওয়া হলো না। কোনোদিন পাইও না। থেমে যাওয়া আলোচনাটা আবার শুরু করার চেষ্টায় সাব্বির বলল ‘আপনি বলতে চান, ওই মহিলাকে আপনি বিয়ে করেননি?’
‘না রে বাবা। বিশ্বাস কর তোরা!’ আব্বা দুইহাত জোড় করলেন।
‘ভালো কথা। কিন্তু সম্পর্ক তো একটা আছে। সেটাও কম অপরাধ না। এই মেসেজগুলোর কী জবাব দেবেন, আব্বা?’
আব্বা সাব্বিরের মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনশটগুলো দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন ‘বাবারে তোরা এত পাগল কেন? দেখ তো, আমি কি কোনো উত্তর দিয়েছি? সে মহিলা একা মানুষ। একা হাতে বাচ্চা মানুষ করছে। চাকরিও করছে। লোনলি ফিল করে। আমাকে দুটো একটা কবিতা লিখেটিখে যদি শান্তি পায় তবে কী ক্ষতি তাতে?’
‘এগুলো কবিতা?’ শিমু ভয়াবহ রকম চিৎকার করল।
আব্বা ঠোঁট টিপে রাগ সামলে বললেন ‘বেয়াদব মেয়ে, আমার সামনে আসবি না তুই কোনোদিন!’
আব্বা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘তোমরা জবাব চেয়েছ, আমি জবাব দিয়েছি। তোমরা বিশ্বাস করবা কী করবা না, সেটা তোমাদের ব্যাপার! আমার কোনো সে নেই।’
দুবার হাঁটু নাচিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন আব্বা। তারপর বললেন ‘তোমাদের আম্মাকে ডাকো?’ আমরা নড়লাম না দেখে আব্বা নিজেই ডাকলেন ‘কই? আসো তো, এদিকে আসো।’
আম্মা কুমড়োফুলের বড়া ভেজে নিয়ে এসেছেন। ছোটো টি-টেবিল টেনে তার উপর রেখে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই, আব্বা আম্মার হাত ধরে টানলেন ‘আরে বোকা, বসো তো! বসো এখানে।’
জোর করে আম্মাকে টেনে পাশে বসালেন আব্বা। আম্মা তখনো ফোঁপাচ্ছেন। আব্বা বললেন ‘আরে পাগল, তুমি এইসব ছাতামাথা বানিয়ে কষ্ট পাও? সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, বলে না? তোমার হইছে সেই অবস্থা। নেও তো, খাও। আমার হাতে খাও।’ আব্বা ভাজা কুমড়োফুল থেকে একটু ভেঙে আম্মার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন।
আম্মা খাবারটা মুখে নিয়ে নীরবে কাঁদতে থাকলেন। আব্বা সজীবকে বললেন ‘যা তো, আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়!’
অফিস যাওয়া আসার সময় আব্বা একটা লেদার ব্যাগ ক্যারি করেন। তাতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের সাথে সাথে লাঞ্চবক্সও নিয়ে যান বাসা থেকে। সেই ব্যাগটা নিয়ে এলো সজীব। আব্বা ব্যাগ থেকে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা প্যাকেট বের করলেন। সেটা আম্মার হাতে দিয়ে বললেন ‘গতমাসেই কিনেছিলাম। দিনবিশেক হয়ে গিয়েছে, আমার মনে ছিল না।’
আম্মা কাগজের র্যাপিংটা ছিঁড়ে একটা বক্স বের করলেন। ডায়মন্ডের একজোড়া পাঁচপাথরের টপ। দুলদুটো ছোটো কিন্তু তার ঝলকানিতে আম্মার মুখটা লাজুক হয়ে উঠল। গয়নাটা বাকসে পুরে আম্মা আব্বাকে বললেন ‘ওই মহিলার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তোমার?’
‘না। বললাম তো, না!’
‘তাহলে আর ওর সাথে কথা বলবা না, বলো?’
‘আচ্ছা, যাও বলব না।’
‘ঠিক তো?’
‘হ্যাঁ!’
‘তবে এখন মেসেজ দিয়ে বলো, তোমার সাথে যেন কখনো যোগাযোগ না করে!’
‘বলার কী দরকার? আমি উত্তর না দিলেই তো হলো!’
‘না, হলো না। লেখো, মেসেজ লেখো!’
‘আরে বাদ দাও না?’
আম্মা সজীবকে ডেকে বললেন ‘সজীব, তুই তোর আব্বার হয়ে মেসেজ লিখে দে!’
সজীব আম্মার কাছে জানতে চাইল ‘কী লিখব?’
‘লেখ, আমার স্ত্রী আর সন্তান আমার কাছে সবার আগে। আপনি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না। আমাকে মেসেজ দেবেন না। আমাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করবেন না।’ আম্মা বললেন।
সজীব দ্রুত হাতে মেসেজ লিখে সেন্ড করতেই আব্বা বললেন ‘হয়েছে? শান্তি এবার তোমাদের?’
‘না। তুমি সজীবের মাথায় হাত দিয়ে কিরা করো, আর কখনো ওই মহিলার সাথে কথা বলবা না, মেসেজ দিবা না!’ আম্মা বললে আব্বা উত্তর দিলেন ‘এইসব কিরা কসম আবার কী?’
‘না, না কিরা করো?’ আব্বার হাত টেনে সজীবের মাথায় দিলেন আম্মা।
আব্বা কিরা করে বললেন ‘আমি আর ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করব না!’
আম্মা হেসে উঠে শিমু আর ইমুকে ডেকে বললেন ‘আয় রাতের খাবারের ব্যবস্থা করি। মারজুকও তো তোকে নিতে আসবে, তাই না? চল হাতে হাতে একটু কাজ করে দিবি।’
কিচেনের দিকে যেতে যেতে আব্বার কানে না যায় এমনভাবে আম্মা শিমুকে বললেন ‘আব্বার সাথে বেয়াদবি করেছিস শিমু। আব্বা কষ্ট পাইছে না? ছিঃ। আমি করি, করি। তাই বলে তুই কেমন করে আব্বার সাথে খারাপ ব্যবহার করলি? মানুষ শুনলে আমাকে লজ্জা দেবে। বলবে, আমার মেয়েকে আমি কোনো ভালো শিক্ষা দিইনি। খবরদার শিমু, আর যেন কোনোদিন এই দুঃসাহস তোর না হয়! মারজুকের সাথে চলে যাওয়ার আগে আব্বার কাছে মাফ চেয়ে নিস, কেমন?’
শিমু করুণচোখে তাকালো আমার দিকে। আমি সাব্বিরের চোখে তাকালাম। এমন মাফ চাওয়ার দিন আমার আর সাব্বিরের জীবনেও এসেছিল। আজ শিমু। কাল হয় তো ইমু, পরশু হয়তোবা সজীব! আজকে আব্বা কসম দিয়েছেন সজীবের মাথায় হাত দিয়ে। মাসকয়েক সেই কসমের জোর থাকবে। তারপর কিরার বাঁধন আলগা হতে হতে হয়তো ইন্সটাগ্রাম নইলে জিমেইলে কথার আদান-প্রদান শুরু হবে অন্য কোনো রিনা খানের সাথে। ষোড়শী বা চল্লিশোর্ধ্ব – কোনো আপত্তি হবে না আব্বার। আব্বার রূপমুগ্ধ, গুণমুগ্ধ সেইসব নারীরা পঙ্গপালের মতো আত্মাহুতি দিতে ছুটে আসবে – আব্বার সংসার, পুত্রকন্যা আছে জেনেও। আব্বা আগাবেনও না, পেছাবেনও না। কাউকে না ও বলবেন না, আবার ভার্চুয়াল খামচির সুখও নিতে চাইবেন। হয়তো ভার্চুয়ালের বাইরে আসবে না কখনো এইসব সম্পর্ক। আবার এরকম মেসেজ লিক হবে, সেদিন হয়তো মাথাঠাণ্ডা মেয়ে ইমু চিৎকার করবে, বেয়াদবি করবে আব্বার সাথে।
কিন্তু এই সমস্যাটার সমাধান হবে না কোনোদিনও। আমরা আসলে কখনোই সমস্যার সমাধানটা খুঁজে পাব না!
এইসবকিছু আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এরকম থাকবাড়ি দেওয়া আর জোড়াতালির সমাধান, বিবর্ণ সম্পর্কের টানাপোড়েন – এই আমাদের নিত্যদিনের কড়চা!
সমাপ্ত।
Afsana Asha
বি.দ্র.- কড়চা শব্দের অর্থ – জীবনী, দিনলিপি, রোজনামচা!