কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১
চায়ের কেটলি চুলায় বসালো আরশি। দশ মিনিট আগে তিরা ফোনে জানিয়েছে সে স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়েছে। তার মানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। এসেই বায়না ধরবে চা খাওয়ার। তিরার ধারণা যদি চা বানানোর কোনো প্রতিযোগিতা হতো তবে আরশি সেখানে চ্যাম্পিয়ন হতো।
কলিং বেল বাজতেই আরশি দৌড়ে গেল বারান্দায়। বাড়ির মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তিরা। তাকে দেখতে পেয়েই আরশি বলল,
“দাঁড়া আসছি।”
আরশি দৌড়ে নিচে নামলো। ছোটো বাগান পেড়িয়ে গিয়ে গেট খুলতেই তিরা ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো আরশিকে। আরশিও তিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“অবশেষে আসলি! আমি তো ভেবছিলাম এবার বাড়ি থেকে আসবিই না।”
“কি করব বল। এতদিন পর গেলাম কিছুদিন তো থাকতেই হয়। তার উপর আবার এখন পড়াশোনা নেই।”
আরশি তিরাকে ছেড়ে গেট লাগাতে লাগাতে বলল,
“এখনই পড়াশোনা সবচেয়ে বেশি।”
“ওহ বড়দের মত জ্ঞান দিস না তো। আর কতদিন দাদীমা থাকবি?”
তিরা আরশির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে পেছনের দিকে উলটো হাঁটছিল। আরশি বলল,
“তুই কতদিন বাচ্চা থাকবি?”
একথা বলে আরশি তিরার দিকে ঘুরতে না ঘুরতেই একটা ঘটনা ঘটলো। তিরা কাব্যর সাথে জোরেসোরে একটা ধাক্কা খেলো। কাব্য কোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দ্রুত হেঁটে আসছিল, আর তিরাও উলটো হাঁটছিল তাই কেউই খেয়াল করতে পারেনি। তিরা প্রচন্ড ব্যাথা পেলো। ঝগড়া করার জন্য পেছনে ঘুরতেই কাব্য বলল,
“মাফ করবেন, আমি বেখেয়ালে হাঁটছিলাম। আপনি কি ব্যাথা পেয়েছেন?”
কাব্যকে দেখে আর তার কথা শুনে তিরার ব্যাথা কোথায় গায়েব হয়ে গেল। ছেলেটা জিন্স, পোলো টিশার্ট পড়া। লম্বা, ছিপছিপে শরীরের কালো দেখতে একটা ছেলে। কিন্তু কিছু একটা মুগ্ধ করে ফেলল তিরাকে যা সে ধরতে পারলো না। তিরা মৃদু হেসে বলল,
“ইটস ওকে। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
“আমি কাব্য। আমি এবাড়ির নিচতলাটা ভাড়া নিয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
ততক্ষণে আরশি এসে তিরার পাশে দাঁড়িয়েছে। সে বলল,
“ওহ আচ্ছা আপনি সাহিল ভাইয়ার বন্ধু অনন্ত ভাইয়ার ছোটোভাই?”
কাব্য তাকালো আরশির দিকে,
“জ্বী।”
তিরা হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমি তিরা। আপনার নিকটস্থ প্রতিবেশী। দোতলায় সাহিল ভাইয়াদের সাথেই থাকি। সাহিল ভাইয়া আমার মামাতো ভাই।”
কাব্য হ্যান্ডশেক করে বলল,
“পরিচিত হয়ে ভাল লাগলো।”
এরপর কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি?”
আরশি কিছু বলার আগেই তিরা বলল,
“ও আরশি, সাহিল ভাইয়ার ছোটো বোন।”
“আচ্ছা আজ তাহলে আসি। গরীবের বাসায় আপনাদের চায়ের দাওয়াত রইলো, দেখা হবে।”
তিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কাব্য বেরিয়ে গেল। তিরা মাটিতেই বসে পড়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো কাব্যর চলে যাওয়া পথের দিকে। ঠোঁটে একটা লম্বা হাসি ঝোলানো। আরশি তিরার হাত ধরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল,
“এসব কী হচ্ছে?”
“জানেমান আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি।”
“হোয়াট? এই ব্যাটার উপর?”
“প্লিজ ডোন্ট কল হিম ব্যাটা। হি ইজ সো কিউট!” আরশি হেসে বলল,
“উফ তুই না আজকাল যার তার উপর ক্রাশ খাওয়া শুরু করেছিস! চা বসিয়ে এসেছি। আমি গেলাম, তুই তাড়াতাড়ি উপরে আয়।”
ছাদে বসে চা খেতে খেতে তিরা আরশিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা ভাবী কোথায় রে?”
“ভাবী বাবার বাড়িতে গেছে। ওর ডেলিভারি ডেট কাছে চলে এসেছে না?। একেবারে বাবু হওয়ার পর আসবে।”
“ওহ।”
“তুই কোনো এডমিশন কোচিং এ যাবি কবে থেকে।”
“কাল থেকেই যাব ভাবছি, কাল ক্লাস আছে না?”
“হ্যাঁ। এত দেরী করে এলি! প্রথম কতগুলো ক্লাস মিস করলি!”
“সমস্যা নেই তুই তো ক্লাস করেছিস, তুই আমাকে বুঝিয়ে দিস।”
“তা দেয়া যাবে।”
“আচ্ছা আরশি ভাইয়া না বলেছিল কোনো ব্যাচেলর ভাড়া দেবে না! তাহলে এবার হঠাৎ দিল যে?”
“উনি তো অনন্ত ভাইয়ার ভাই, বাসা পাচ্ছিল না। অনন্ত ভাইয়া সাহিল ভাইয়াকে অনুরোধ করেছিল কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তখন ভাইয়াই তাকে বলে যে আমাদের নীচতলা খালি। আর উনি তো একা থাকে। ওইরকম দলবাঁধা ব্যাচেলর তো না।”
“ভাগ্যিস ভাড়া দিয়েছিল। নাহয় ওকে পেতাম কোথায়! কি সুন্দর নাম কাব্য! কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর ঠোঁট! উফফ উফফ আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে আমি তো মরে যাব জানেমান।”
“ধ্যাত তুই এই বুড়ো ব্যাটাকেও ক্রাশ খেতে ছাড়লি না! আমার জাস্ট হাসি পাচ্ছে।”
“এসব বললে হবে না। এ প্রজেক্টে তোর আমাকে সাপোর্ট দিতেই হবে।”
“কেন আগের প্রজেক্টের কী হলো?”
“ধুর ওটাকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। ১ মাস প্রেম করেই বলে রুমডেটে যেতে!”
আরশি হাসতে হাসতে বলল,
“যার তার উপর ক্রাশ খেয়ে প্রেম করলে এরকমই হবে।”
“শোন আগেরটা যা তা হলেও কাব্য কিন্তু যা তা না। আর তুই আজকেই সাহিল ভাইয়ার মোবাইল থেকে ওর নাম্বার চুরি করে দিবি।”
“আমি পারব না। এই কাজ তো একদমই পারব না। ধরা খেলে ভাইয়া আমাকে জবাই করে ফেলবে।”
তিরা কাচুমাচু হয়ে বলল,
“মানুষের অনুভূতির প্রতি তোর কোনো শ্রদ্ধা নেই কেন রে বোন?”
আরশি হেসে বলল,
“এক দেখাতেই এত অনুভূতি!”
তিরা খুব সিরিয়াস মুখ করে অনুরোধের সুরে বলল,
“তুই এটলিস্ট একটা প্রেম কর বোন। একটা প্রেম করলেই তুই এসব বুঝতে পারবি তার আগে বুঝবি না। আমি তোকে বেস্ট একটা ছেলে খুঁজে দেব।”
“এভাবে ছেলে খুঁজে আমি প্রেম করব না। ভালো লাগা থেকেও করবো না। কখনো যদি কারো প্রতি ভালবাসা হয়ে যায়, সেও যদি ভালবাসে তবেই প্রেম করব। সত্যিকারের প্রেম এত প্ল্যান করে হয়না তিরা। যখন হওয়ার এমনিতেই হয়ে যায়। কিছুতেই আটকানো যায় না। তুই ভাল লাগা থেকে প্রেম করিস বলেই তোর প্রেম টেকে না।”
“আজকাল প্রেম টেকানো বহু কঠিন রে।”
“বাদ দে তো এসব চল নিচে যাই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”
রাত ঘুমানোর সময় তিরা আবার বলল,
“আরু.. জানেমান.. প্লিজ আমাকে কাব্যর ফোন নাম্বারটা চুরি করে দে। তুই যা চাইবি আমি তাই দেব।”
“আমার মাথা খাচ্ছিস কেন তিরা? আমি এসব চুরি চামারির মধ্যে নেই। তোর ব্যবস্থা তুই করে নে।”
“এটাকে চুরি বলে না সোনা। প্লিজ কাজটা করে দে।”
“আমি পারব না। ভাইয়া টের পেয়ে গেলে কি জবাব দেব? আমি এটাও বুঝতে পারছি না কী আছে এই ছেলের মধ্যে? তুই এত দ্রুত প্রেমে পড়িস কীভাবে বল তো?”
“কী আছে মানে? বল কি নেই? এই ছেলে তো চরম সেক্সি হবে মামা।”
“ছি।”
“ছি ছি করিস না তো। ও একদম আমার মনের মত হবে দেখিস।”
“একবার দেখেই এতকিছু কীভাবে বুঝলি শুনি?”
“উফ আরশি আমি তো তোর মত অন্ধ না। আমি ছেলেদের দেখলেই বুঝে যাই কে কেমন! বয়স তো ১৮ হয়ে গেছে আর এখনো একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাতে পারলি না! কী আছে তোর জীবনে? পান্তাভাত জীবন তোর। আর আমার জীবন দেখ, ইটস লাইক কাচ্চি বিরিয়ানি।”
“তোর কাচ্চি বিরিয়ানী নিয়ে তুই থাক। আমার পান্তাভাতেই চলবে। আর একবারো এইসব নাম্বার চুরি করার কথা বলবি না। এক ফ্লোর নিচেই থাকে। যখন ইচ্ছে গিয়ে কথা বলে আসবি। চায়ের দাওয়াত দিয়েছেই মনে নেই?”
“ওহ শিট! চায়ের দাওয়াতের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এইজন্য তোকে এত ভালবাসি।”
একথা বলতে বলতেই তিরা আরশিকে জাপটে ধরে গালে একটা চুমু দিল। আরশি হেসে ফেলল।
চলবে..