কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১২
তিরা ঘরের দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে খামটা খুলে বসলো। ছেলেটা লম্বা ৬ ফিট, ফরসা গায়ের রঙ, দেখতে বলিউডের নায়কদের মতো। হাসিটা এত সুন্দর যে তিরার মনে হলো এই হাসি দেখতে দিলে ভাত খেতে না দিলেও হবে। এত সুন্দর একটা ছেলেকে বাবা তার বিয়ের জন্য দেখছে! মনে মনে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তিরা। ছেলেটার নাম যাদিদ। বয়স ২৪। তিরার মাথায় একটা দুষ্টুমি এলো। যাদিদকে ফোন করে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ওর নাম্বার থেকে ফোন করা যাবে না, ওর নাম্বার নিশ্চয়ই তাকে দেয়া হয়েছে বা হবে। তিরার একটা এক্সট্রা সিমের বিশেষ বক্স আছে। সেখান থেকে এক্সট্রা সিম নিয়ে মোবাইলে ঢুকিয়ে নিলো। এরপর যাদিদের নাম্বার খুঁজতে গিয়ে বেকুব হয়ে গেলো। নাম্বারের পাশে ব্রাকেটে লেখা বাংলাদেশে যখন থাকে তখন সে এই নাম্বার ব্যবহার করে। মিশনে থাকাকালীন তাকে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যাবে। সবগুলোর লিংক দেয়া আছে। তিরা ঝটপট সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে ঢুকে যাদিদের প্রফাইলের প্রতি ইঞ্চি ঘেঁটে ফেললো। তিরা আরো মুগ্ধ হলো। তিরা জানেনা যাদিদ এখন কোথায় তবুও কল করে ফেললো, দেখা যাক পাওয়া যায় কিনা। রিং হতে লাগলো। তার মানে সে এখন বাংলাদেশেই আছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো,
“হ্যালো..”
এক হ্যালোতেই তিরার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, ছেলের কন্ঠস্বরও দেখি সুন্দর! তিরা বললো,
“হ্যালো যাদিদ।”
“কে বলছেন প্লিজ?”
তিরা ঢং করে বললো,
“আমাকে চিনতে পারছো না?”
“আপনার সাথে এর আগে আমার কথা হয়নি। সুতরাং আপনাকে আমার চেনার কথা নয়, পরিচয় দিন।”
“আমি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। ব্রেকাপ হয়েছে বলে এভাবে ভুলে গেলে? আমার সাথে কাটানো সব মধুর মধুর স্মৃতি তুমি ভুলে গেছো!”
“আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের ভয়েস আমি চিনি। আমার বাবা বিয়ের জন্য যেসব জায়গায় বায়োডাটা ছড়িয়েছে আপনি সম্ভাবত তাদের মধ্যে কেউ হবেন!”
তিরা অবাক হবে না কষ্ট পাবে বুঝতে পারলো না। যাদিদের গার্লফ্রেন্ড ছিলো? পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝালো, ‘তোরও বয়ফ্রেন্ড ছিলো তিরা। বিয়ের আগে এগুলো কোনো ব্যাপার না।’ যাদিদ বললো,
“বিয়ের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত আমার বাবা মা নেবেন৷ সুতরাং আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো। বিরক্ত করতে খুব বেশি ইচ্ছে করলে তাদেরকে করুন। তাদের ফোন নাম্বারও দেয়া আছে।”
যাদিদ লাইনটা কেটে দিলো। তিরা তখনো ফোন হাতে বসে রইলো।
আরশি চা খেতে খেতে বই পড়ছিলো। তিরার ফোন এলো তখনই। আরশি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তিরা বললো,
“জানেমান! আমি তো মরে গেছি। তুই যে তিরার সাথে কথা বলছিস সে মৃত তিরা।”
আরশি হেসে বললো,
“আবার ক্রাশ খেয়েছিস?”
“শুধু ক্রাশ না, এবার আমি ক্রাশ, আকাশ, বাতাস সবকিছু খেয়ে ফেলেছি!”
আরশি হেসে বললো,
“ছেলেটা কে?”
“যাদিদ। আল যাদিদ ইব্রাহিম।”
“বাহ সুন্দর নাম।”
“আরু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে।”
“তুই যার উপর ক্রাশ খাস তাকেই তোর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম মনে হয় তিরা।”
“নো আরু নো, এবার ব্যাপার ভিন্ন। বাবা এক ছেলে দেখেছেন আমার বিয়ের জন্য। ছবি আর বায়োডাটা দেখেই আমি শেষ! ছেলে নেভি অফিসার। অথচ বয়স মাত্র ২৪। আমি তার উপর ভীষণভাবে ক্রাশ খেয়েছি!”
আরশি বললো,
“ওয়াও! ফ্রুটফুল ক্রাশ!”
“একদম। একটু আগে কথাও বলেছি। যদিও আমার পরিচয় দেইনি। উফফ কন্ঠটা এতো সুন্দর! এতো সুন্দর করে কথা বলে! জীবনে যত ক্রাশ খেয়েছি তার মধ্যে সেরা ক্রাস যাদিদ। ওকে তো বিয়ে করতেই হবে আরু।”
“পড়াশোনার কী হবে?”
“সে আমি জানিনা। আর আমি তো তোর মতো ভালো স্টুডেন্টও নই। এতো পড়াশোনা করে কী হবে?”
আরশি তিরার কথায় হাসতে লাগলো।
হঠাৎ সাহিলের ফোন পেয়ে আরশি হাসপাতালে গেলো। রশ্নির ব্যথা উঠেছে। রশ্নির বাড়ির লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। সাহিল অফিস থেকে এসেছে। হাসপাতালে সারাদিন অপেক্ষা করতে হলো। সন্ধ্যার পর রশ্নির মেয়ে হলো। সবাই বলছে মেয়ে দেখতে নাকি তার ফুপীর মতো হয়েছে। এ কথা শুনে আরশির লজ্জা লাগলো। সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের দেখলে বোঝা যায় না সে কার মতো হয়েছে, একটু বড় হলে বোঝা যায়। তবুও আরশি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, দেখতে ওর মতো হয়েছে হোক কিন্তু ওর মতো ইন্ট্রোভার্ট যাতে না হয়। ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের অনেক রকম জ্বালা থাকে।
আরশির ঘুম আসছিলো তাই ক্যান্টিনে গেলো কফি খেতে। কফি খেয়ে ফিরে আসতেই সাহিল বললো,
“আরশি আমার তো যেতে অনেক রাত হবে। তুই বরং বাসায় চলে যা।”
“তোমার সাথেই নাহয় গেলাম।”
“আমার দেরি হবে। আবার ঠিক নেই আজ নাও যেতে পারি। তুই অনেকক্ষণ ছিলি ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুই বরং চলে যা।”
“ঠিকাছে ভাইয়া। আমি তাহলে ভাবীর সাথে আরেকবার দেখা করে আসি।”
আরশি ভাবীর সাথে দেখা করতে কেবিনে ঢুকতেই কাব্যর মুখোমুখি পড়ে গেলো। আরেকটু হলেই ধাক্কা লেগে যেতো। কাব্য আরশিকে বাঁকা চোখে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলো। আরশি ভাবীকে বললো,
“এ কালা চণ্ডীদাস আবার এখানে কেন এসেছে?”
রশ্নি খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
“বাবুকে দেখতে এসেছে। একী নামে ডাকিস তুই ওকে? দেখতে পারিস না কেন?”
“তিরা থাকলে দেখতে কেমন ক্ষেপে যেতো।”
রশ্নি হেসে দিল। আরশি বললো,
“অবশ্য সে রিসেন্টলি আবার ক্রাশ খেয়েছে।”
রশ্নি আবারো হেসে বললো,
“সেকী! ওর চণ্ডীদাসের কী হবে?”
আরশি হেসে বললো,
“চণ্ডীদাস বাদ। এবারেরটা অবশ্য ফ্রুটফুল ক্রাশ। ফুপাজান ওর বিয়ের জন্য ছেলে দেখেছেন, সেই ছেলের ছবি দেখেই ক্রাশ খেয়েছে।”
“উফ পারেও মেয়েটা!”
“আচ্ছা ভাবী আমি আজ উঠি। কাল সকাল সকাল চলে আসবো।”
“আচ্ছা সবধানে যাস। চাচীকে অলরেডি ফোনে বলে দিয়েছি বাসায় যেতে। তোর ভাইয়া না ফিরলে চাচী আমাদের বাসাতেই থাকবে।”
“আচ্ছা।”
আরশি কেবিন থেকে বের হতেই সাহিল বললো,
“আরশি তোর একা যেতে হবে না। কাব্য বাসায় যাচ্ছে, ওর সাথেই চলে যা।”
“আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া।”
“কাব্য তো বাসায়ই যাচ্ছে। তুই একা কেন যাবি? ওর সাথে গেলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। রাত একদম কম হয়নি।”
“ঠিকাছে।”
আরশি আর কথা বাড়ালো না৷ কে জানে বেশি আপত্তি করলে সাহিল কি না কি ভেবে বসে! আরশি কাব্যকে বললো,
“চলুন।”
কাব্য বললো,
“হ্যাঁ চলুন।”
সাহিল কাব্যকে বললো,
“এই কাব্য তুই আরশিকে আপনি আপনি বলিস?”
কাব্য আমতা আমতা করে বললো,
“হ্যাঁ।”
“কেন? ওকে তুই করে বলবি। অবশ্য হঠাৎ করে তুই বলতে সমস্যা হতে পারে সেক্ষেত্রে তুমি বল। ছোটো একটা মেয়েকে আপনি বলিস এটা কেমন কথা!”
কাব্য বললো,
“আসলে ভাইয়া সেভাবে কথাই হয়নি কখনো।”
“একই বাসায় থাকিস আর পরিচয় নেই! কি আজব তোরা। যা পরিচয় হতে হতে বাসায় যা।”
আরশি ও কাব্য লিফটে উঠলো। লিফটে আপাতত আর কেউ নেই। আরশি দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, লিফটের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য। আরশির মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝিমঝিম করছে। কেন যেন কাব্যর সাথে যাওয়াতে ওর ভালো লাগছে। আবার কাব্যর সাথে যাওয়াতেই খুব অস্বস্তি লাগছে। হাত পা কাঁপছে। কাব্য সরাসরি তাকিয়ে আছ আরশির দিকে। আরশির এই অবস্থা দেখে কাব্য ঠিক করলো আজ পুরো রাস্তা ও আরশির দিকে তাকিয়ে থাকবে। এতোদিন লুকিয়ে দেখতো। ধরা তো পড়েই গেছে, এখন আর লুকোচুরির কোনো দরকার নেই। এখন বেহায়া হবে, চরম বেহায়া।
কাব্য উবার কল করেছে। গাড়ি এখনো এসে পৌঁছয়নি। হাসপাতালের সামনেই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলো তারা। কাব্য টিস্যু বের করে আরশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আপনি ঘামছেন।”
আরশি টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। এর মধ্যেই গাড়ি এসে গেলো। ওরা গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলতে শুরু করতেই কাব্য আরশিকে বললো,
“পানি খাবেন?”
“নো থ্যাংকস।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে ছিলো আর আরশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কাব্য আবার বললো,
“সাহিল ভাইয়া অবশ্য জানেনা, আমি অনুমতি ছাড়া কাউকে তুমি করে বলিনা। সে বড়ই হোক আর ছোটো!”
আরশি যেদিকে তাকিয়ে ছিলো সেদিকেই তাকিয়ে বললো,
“আপনার ইচ্ছে হলে বলবেন। সবারই বাক স্বাধীনতা আছে, আমি তো কাউকে আটকে রাখিনি।”
“তোমার অনুমতি দেয়ার কৌশল টা কিন্তু দারুণ লাগলো।”
আরশি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রাখলো। হাসলেই ধরা পড়ে যাবে। আবারো কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্যই আবার বললো,
“শুনলাম তিরা বিয়ের প্রস্তাব আসা পাত্রের উপর ক্রাশ খেয়েছে!”
আরশি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“কার কাছে শুনলেন?”
“তিরার কাছেই শুনলাম।”
“আপনার তিরার সাথে কথা হয়?”
“হ্যাঁ। আমরা তো বন্ধু।”
“হুম আপনারা তো আবার আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের মতো ভালো বন্ধু।”
কাব্য হো হো করে হেসে দিলো। আরশি একটা কথাও কাব্যর দিকে তাকিয়ে বলছে না। কিন্তু কাব্য আরশির দিকেই তাকিয়ে আছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“ওটা বিশ্বাস হয় তোমার?”
“আমার বিশ্বাসে কী যায় আসে?”
“তবু বলো।”
“যার নিজেরই বয়স ২০/২১ তার মেয়ের বয়স কীভাবে ১৯ হয়?”
“মেয়ে নয়, এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে!”
আরশি এবার মুচকি হাসলো। কাব্য বললো,
“আমার বয়স ২২।”
“আন্দাজ কাছাকাছিই করেছি।”
“তা ঠিক।”
আরশি এবার ড্রাইভারকে বললো,
“ভাইয়া এসিটা বন্ধ করে দিন, জানালা খুলবো।”
ড্রাইভার এসি বন্ধ করতেই আরশি জানালা খুলে দিলো। কাব্য খানিক ভেবে বললো,
“সিগারেটের গন্ধে সমস্যা হচ্ছিলো?”
আরশি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। কাব্য বললো,
“বাবু দেখতে যাব বলে হাসপাতালে ঢোকার আগে খাইনি। তুমি সাথে আছো বলে বের হয়েও খাইনি।”
আরশি এবারো কাব্যর দিকে তাকালো না। বললো,
“হাসপাতালে বোঝা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখানে বন্ধ জায়গায় কাছাকাছি বসে আছি তো, গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।”
কাব্য হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। বাড়ি পৌঁছতে আর পাঁচ মিনিট লাগলো। এই পাঁচ মিনিটে কাব্য আর একটা কথাও বললো না। দুজনে চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলো। সিঁড়ি পর্যন্ত একসাথে এলো। আরশি দোতলায় চলে গেলো। কাব্য নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। এই এতক্ষণ দুজন মানুষ আর একটি কথাও বললো না।
চলবে…