কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ পর্ব-১৫

0
6355

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi

“পর্ব-১৫(বিয়ে-তৃতীয়াংশ)”

পরনের গেঞ্জি ঝাড়তে ঝাড়তে নিচে নেমে আসছে আয়ান। ছুটির দিন বিধায় আজকে লেট করে ঘুম থেকে উঠেছে সে। আয়ানকে নামতে দেখে আফরোজ চৌধুরী উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলেন,

–‘ দাদুভাই জলদি এসো। দেখো তোমার ফুপিকে নিয়ে এসেছি।’

আয়ান চোখ তুলে তাকালো তাদের দিকে। ফুপির চেহারা তার তেমন একটা নলেজে নেই। যখন তার ফুপি চলে যায় তখন সে খুব ছোট ছিল। আয়ান ধীর পায়ে এসে ফুপির বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। আয়েশা চৌধুরী আয়ানকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে। এই আয়ান, আদ্রকে ছোট বেলায় নিজ হাতে মানুষ করেছে সে।ওদের ছেড়ে কখনোই যেতে চান নি তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি সবটা করতে বাধ্য করেছে।

এদিকে আয়ানকে দেখা মাত্রই মৃধার আনন্দিত মুখখানা নিমেষেই ছেঁয়ে গেল অস্থিরতায়। তার এই মুহুর্তে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এই লাইট এতক্ষণ ছিল না বলে সে বেশ ভালো ছিল। এখন তো আর শান্তিতে বসতে পারবে না। ফুপির সঙ্গে মুলাকাত চলাকালীন সময়ে আদ্র আয়ানকে ডেকে বলে উঠল,

–‘ আরে এবার এদিকেও তো একটু দেখ। এই হলো মুগ্ধ আমাদের ছোট ভাই। আর এই হলো মৃধা আমাদের বোন।’

বোন কথাটা শুনা মাত্রই আয়ান বিষম খেয়ে উঠল। আফরোজ চৌধুরী আর আয়েশা চৌধুরীর চোখ কোঠর থেকে বেড়িয়ে আশার উপক্রম। কিন্তু এক অজানা কারণে মৃধার বেশ প্রশান্তি লেগেছে আদ্রের কথায়। সে মনে মনে আয়ানের অবস্থা দেখে হাসছে। ওদের খুনসুটি চলার মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয় ন্যায়রা। ছুটির দিন গুলোতে সে আয়ানের সঙ্গে সময় কাটায়। আয়ান যেতে না চাইলেও তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র কর্ম। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আয়ানদের বাড়িতে এত লোকজনের উপস্থিতি দেখে বেশ অবাক হয় ন্যায়রা। সবথেকে বেশি অবাক হয় মৃধাকে দেখে। ন্যায়রা কিছু বলতে নিবে তার আগেই আদ্র তাকে বলে,

–‘ ন্যায়রা এ হলো আমার ফুপি আয়েশা চৌধুরী। আর এই হলো আমার ফুপির ছেলে মেয়ে মৃধা আর মুগ্ধ।’

ন্যায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘ তাহলে এতোদিন পরিচয় দেননি কেন?’

আদ্র হতাশাক্রান্ত কন্ঠে বলল,
— ‘ সে অনেক লম্বা ইতিহাস। পরে একদিন সময় করে বলব। এখন বসো।’

অতঃপর ন্যায়রাও ওদের সঙ্গে আড্ডায় জয়েন হলো।

———————-

অধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই চেয়ে আছে আফরোজ চৌধুরীর মুখপানে। তিনি সবাইকে কিছু একটা জরুরি সিদ্ধান্ত জানাবেন। সবার মনেই কৌতুহল।শুধু আয়েশা চৌধুরী জানেন তার বাবার মনের কথা। কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না। চুপচাপ বসে রয়েছেন। নিজের মনে কথা সাজিয়ে আফরোজ চৌধুরী এবার মুখ খুললেন। গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলেন,

–‘ আমি একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেটা খুব দ্রুত কার্যকর করতে চাই। সিদ্ধান্ত টা হলো আয়ান আর মৃধার বিয়ে নিয়ে। আমি চাচ্ছি খুব শীঘ্রই ওদের দু’জনের চার হাত এক করে দিব। সেই সঙ্গে সঙ্গে আদ্র দাদুভাইকেও বিয়ের পিরিতে তুলে দিব। তারজন্যও পাত্রী রেডি করা হয়ে গেছে।’

আফরোজ চৌধুরীর সিদ্ধান্ত শুনে সবাই খুশি হলেও আয়ান, মৃধা আর ন্যায়রার চেহারা হয়ে উঠল বিবর্ণ। মৃধা যেন পাথর হয়ে গেছে। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মেঝেতে। আয়ানও স্তব্ধ। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। কিন্তু ন্যায়রা আর চুপ থাকতে পারল না। সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,

–‘ এটা কী করে সম্ভব? আয়ানের সঙ্গে মৃধার কখনোই যায় না। তারওপর ওরা তো কাজিন।’

আফরোজ চৌধুরী ন্যায়রার কথায় ভীষণ চটে গেলেন। তিনি ক্ষিপ্র কন্ঠে বললেন,

–‘ আয়ান, মৃধা কাজিন ঠিক আছে আপন ভাইবোন তো আর নয়। আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ আছে। কিন্তু তুমি বাহিরের মেয়ে হয়ে আমাদের ফ্যামিলির ভেতরকার বিষয়ে মত প্রকাশ করছ কীভাবে। যেখানে আয়ান,মৃধা কেউ কিছু বলছে না সেখানে তুমি কীভাবে এসব বলার সাহস করছ তাও আবার আমার মুখের ওপর। তুমি আয়ানের ফ্রেন্ড হতে পারো তাই বলে এই নয় যে তুমি অনধিকার চর্চা করবে। এই বিষয় টা এখানেই ফাইনাল। খুব শীঘ্রই আদ্র,আয়ান,
মৃধার বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।’

কথা শেষ করে আফরোজ চৌধুরী রেগে হনহন করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।এদিকে ন্যায়রা বেশ অপমানিত হলো আফরোজ চৌধুরীর কথায়। একদিকে প্রণয়ের বিরহ আরেকদিকে অপমান দুই-য়ে মিলে তার মনে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। ন্যায়রা আয়ানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

–‘ আয়াননন, তুই কিছু বল।তুই কী এই বিয়েটা করতে চাস?’

অধীর আগ্রহ নিয়ে ন্যায়রা চেয়ে আছে আয়ানের দিকে। শুধু ন্যায়রা নয় ওখানে উপস্থিত সকলেই আয়ানের উত্তরের অপেক্ষায়। বিশেষ করে মৃধা। সে তো কান খাঁড়া করে আছে আয়ান কী বলে শোনার জন্য। তার ধারণা আয়ান এই বিয়েতে কখনোই মত দিবে না। এমনটা হলে মৃধার জন্যই ভালো হবে। তাকে আর কিছু করতে হবে না বিয়ে ভাঙার দ্বায়িত্ব টা তাহলে আয়ানই নিবে। কিন্তু মৃধা আর ন্যায়রাকে অবাক করে দিয়ে আয়ান ন্যায়রাকে মিন করে বলল,

–‘ দাদুভাই-এর সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। তার কথার অবাধ্য আমি আগেও হইনি আর আজও হব না। ‘

আয়ান আর এক মুহুর্ত লেট না করে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল ওপরে। এদিকে আয়ানের উত্তর শুনে সবাই প্রচন্ড খুশি হলো। আয়েশা চৌধুরী তো খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ বলে ফেললেন। কিন্তু মৃধার মনে ঝড়ের গতিবেগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আয়ান তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে এটা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এদিকে ন্যায়রা প্রচন্ড আশ্চর্য হয়েছে আয়ানের কথায়। আয়ান তো মৃধাকে সহ্যই করতে পারত না তাহলে কীভাবে বিয়েতে রাজি হলো? ন্যায়রার এখন মৃধাকে চোখের বালি মনে হচ্ছে। এতদিন মৃধাকে ভালো লাগলেও আজ আর সে তাকে মেনে নিতে পারছে না। ইচ্ছে করছে তাকে খুন করে আয়ানকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিতে। ন্যায়রা চোখ ভর্তি জ্বল আর মন ভর্তি ক্ষোভ নিয়ে চৌধুরী বাড়ি ছাড়ল। ন্যায়রার এমন বিহেভ আদ্রের কাছে একটু বেশিই অস্বাভাবিক মনে হলো। সে মনে মনে বিষয়টা খতিয়ে দেখতে চাইল। মৃধার মা ও বেশ চিন্তিত হয়ে গেল এই ব্যাপারটা নিয়ে। এই ন্যায়রা বলে মেয়েটাকে তার একদম সুবিধার মনে হলো না।

——————–

ঘড়ির কাঁটার এখন রাত নয়টা। মৃধা তার ফ্যামিলি নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেছে। আফরোজ চৌধুরী অনেক করে বলেছেন ও বাড়িতে আর না যেতে কিন্তু মৃধা বলেছে তার বিয়েটা ওই বাড়ি থেকেই হবে। বিয়ের পর সপরিবারে চৌধুরী বাড়িতে আসবে।

আয়ানের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন আফরোজ চৌধুরী। হঠাৎ কী মনে করে নক করল আয়ানের রুমে। ভেতর থেকে আয়ান বলল,
–‘ ইয়েস কাম ইন।’

আফরোজ চৌধুরী ভেতরে ঢুকলেন। আয়ান তখন বিছানায় শুয়ে ফোন স্ক্রল করছিল। দাদুকে দেখা মাত্র বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,

–‘ আরে দাদুভাই তুমি এসময় আমার ঘরে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?’

আফরোজ চৌধুরী এক গাল হেসে জবাব দিলেন,

–‘ কী কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? এবার আমার রিটার্ন গিফট চাই।’

আয়ান প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে বলল,
–‘ কীসের সারপ্রাইজ আর কীসের গিফট?’

আফরোজ চৌধুরী বললেন,
–‘ উহুম,উহুম একদম অভিনয় করলে চলবে না দাদুভাই। গিফট কিন্তু আমার চাই ই চাই।’

আয়ান কপাল চাপড়ে বলল,
–‘ আগে বলবে তো কীসের গিফট?’

আফরোজ চৌধুরী বললেন,
–‘ কেন তোমার মনের রানিকে যে এতো সহজে তোমার করে দিলাম তার গিফট।’

আয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,
–‘ এসব তুমি কী বলছ দাদুভাই কে আমার মনের রানি, ওই মৃধা? অসম্ভব ওকে তো আমার সহ্যই হয় না।’

আফরোজ চৌধুরী চোখ ছোট করে বললেন,
–‘ ওহ এজন্যই বুঝি রোজ রাতে তার ছবিতে ডুব দিয়ে কল্পনা রাজ্যে হারাও, তার অগোচরে তাকে লুকিয়ে প্রটেক্ট করো,তাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে জেলাস হও, তার ছবির সঙ্গে নির্জনে প্রেমালাপ করো?’

আফরোজ চৌধুরীর কথা শুনে আয়ানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে,
–‘ তোমাকে এসব কে বলেছে দাদুভাই?’

আফরোজ চৌধুরীর সাবলীল উত্তর,
–‘কাউকেই বলতে হয় না। ছবির সঙ্গে কল্পনায় ডুব দিতে তুমি এতই মশগুল থাকো যে তখন দরজা লক করতেও ভুলে যাও।সেই সুযোগে শুধু আমি নই অনেকেই ফায়দা লুটে নেয়।’

আয়ান উত্তেজিত হয়ে বলল,
–‘ মানে আর কে জানে?’

–‘ তেমন কেউ জানে না। শুধু আমি আর আদ্র দাদুভাই জানে।সেও তোমার এই কান্ড সম্পর্কে অবগত।’

আয়ান লাফ দিয়ে দাদুর এক হাত ধরে বলল,
–‘প্লিজ দাদুভাই, এসব যে তোমরা ছাড়া আর কেউ না জানে তাহলে কিন্তু আমি শেষ।’

–‘হুম কেউ জানবে না। কিন্তু তাকে কেন বলছ না যাকে ঘিরে তোমার এতো অনুভূতি?’

–‘ বলব দাদুভাই একেবারে বাসর ঘরে বলব।তার আগে একটু ভাব নিয়ে চলতে দাও। ‘

আয়ান আর আফরোজ চৌধুরী একসঙ্গে হেসে উঠল। তারপর আয়ান বলল,

–‘ ভাইয়ার জন্য কাকে পছন্দ করেছ আমাকে তার ছবি দেখাও?’

আফরোজ চৌধুরী বললেন,
–‘ সে হলো আমাদের মৃধা রানির সবথেকে কাছের বান্ধবী। আয়েশার সঙ্গে তোমার আর মৃধার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার পর আদ্রের কথা আলোচনা করি। তখন সে আমাকে বলে মৃধার একটা বান্ধবী আছে। মেয়েটির নাম আহিবা। মেয়েটি দেখতে এবং ব্যবহার অতন্ত্য মার্জিত। মেয়েটির বাবার ক্যান্সার। বেশি দিন বাঁচবে বলে মনে হয় না। তাই খোঁজ খবর নিয়ে আমি নিজে গিয়ে মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলি। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ফাইনাল। মৃধা দিদিভাই এখনো জানে না। ভাবছি তাকে বিয়ের দিন সারপ্রাইজ দিবো।’

আয়ান সবটা শুনে ভীষণ খুশি হয়েছে। আফরোজ চৌধুরীও আজ ভীষণ খুশি। তার কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে এখন থেকে তার
সংসারে সুখের দিন শুরু হতে চলেছে। সকল অন্ধকার দুর হয়ে আলোর দিশা উঁকি দিচ্ছে।

চলবে,

(প্রিয় পাঠকমহল, আপনাদের মনে এই পর্ব পড়ে প্রশ্ন জাগতে পারে, আয়ান যখন মৃধাকে ভালবাসে তাহলে কেন কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করল?এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা বিয়ের পর্বগুলো চলাকালীন সময়ে বুঝতে পারবেন আর বাকিটা ধীরে ধীরে কয়েক পর্ব গেলে জানতে পারবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here