#কাছে তুমি
পর্ব-০৬
#রোকসানা আক্তার
৮.
রিয়াশের ধমকাধমকির করাতলে চাপা খেয়ে সানা কুবল বলে ফেলে।তারপর কাবিন নামায় সই করেই একপাশে ছিটকে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল টেনে বাচ্চাদের মতো নাক টেনে টেনে কান্না জুড়ে দেয়।রিয়াশ তার সইটা শেষ করে সানার দিকে এগিয়ে এসে কঠিন গলায় বলে,
“এই একদম কাঁদবি না!গুম করে ফেলবো তাহলে!”
“গুমই করে ফেলুন!আপনার সংসার না করা চাইতে গুম হওয়াই ভালো।আপনি আমাকে জোর করে বিয়ে করে ফুপী,মা-বাবা সবার সামনে মুখটা ছোট্ট করে দিয়েছেন!এখন আমি সবার দাঁড়াবো কীভাবে!?”
“পা আছে পায়ের উপর দাঁড়াবি।ব্যাস্!”
“আপনি না আসলেই একটা জঘন্য!মানুষের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেন না!”
“আহা আর পটর পটর করিস না তো বউ!এমনিতেই তোর ভণিতা কমাতে কমাতে অনেক বেলা চলে গেছে।এখন বাসায় ফিরতে হবে।তারপর আবার বাসর করতে হবে আরো কত কিছু ! নো মোর টেক এগেইন।নাউ,লেটস গো ইউর হাবি হোম!”
“নির্লজ্জ!”
তুলি,আবেদ এবং রাহুল সেই প্রথমে কাজী অফিসে পা রাখতেই হাসির ঝুঁলি খুলছে। রিয়াশ এবং সানার এসব কান্ড দেখতে দেখতে বেচারাদের পেঁট এখন প্রায় ব্যথায় টনটন করছে।শত চেষ্টা চালিয়েও হাসি চাপাতে পারে নি।এখনোও হেসে যাচ্ছে।রাহুল কোনোমতে হাসির বেগ একটুখানি কমিয়ে এনে চাপা চাপা গলায় বলে উঠে,
“দোস্ত?আজ তোর বাসর ঘরটা আমি নিজের হাতে সাঁজামু!”
“তুই কি একা সাঁজাবি নাকি?সাথে আমিও সাজামু।” (তুলি)
“আচ্ছা সাজাস।সাজাস।তোরা দুজনেই সাঁজাস!”
“এ যেমন বান্দর,এর ফ্রেন্ডসগুলাও এক একটা বদের হাড্ডিসার!কুক্ষালের কারখায় এসে পড়লাম!ইয়া আল্লাহ রক্ষা করো তুমি!”(সানা)
সানার মনঃকথার মাঝেই রিয়াশ সানাকে বলে উঠে,
“কি বউ পথ মাপবা নাকি আগের মতো সেই একই কাজ করাতে বাধ্য করাবা!”
“আমি এখান থেকে কিছুতেই নড়বো না!আপনার ইচ্ছে হলে আপনি চলে যান!আমি যাবো না!”
“কাজী অফিসের চারদেয়ালে থাকতে আবার ইচ্ছে হলো নাকি!তা তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে কাজী সাহেব চাচার ছেলের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে এখানেই সারাজীবনের জন্যে রেখে যাই?কি বলেন চাচা?”
ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি চেপে কাজীর দিকে একফোঁড় তাকিয়ে কথাটা বললো রিয়াশ। কাজী সাহেব এ ‘কথার পিঠে কি বলবে তিনি নিজেই ইতস্ততায় পড়ে যান।হয়তো মনে মনে বলেন,”আপনার নিজের বিয়ে করা বউ আবার অন্যের কাছে বিয়ে দিবেন এটা হয় নাকি?এটা ত একদমই বেমানান!”কিন্তু কাজী সাহেব কথাটা বলতে পারলো না।দৃষ্টি নিচে রেখে চুপ করে রইলো।সানার ত রাগে পিত্তি জ্বলা অবস্থা!না পারে কলম দিয়ে এই ছেলেটার চোখদুটো ফুটো করে দেয়।এত অসভ্য কেন ছেলেটা!ম্যানার্স বোধ নেই!
” কাজী সাহেব মনে হয় রাজী নয়।থাক বউ তোমাকে কারো গলায় ঝুঁলতে হবে না।তুমি সারাজনম এই রিয়াশের গলায়ই ঝুঁলে থেকো!চলো এবার!”
বলেই সানাকে একহাতে জড়িয়ে পা বাড়াতে যায়।কিন্তু ,সানা নাছোরবান্দার মতো আগের জায়গায়ই দাড়িয়ে।না নড়ছে,না টড়ছে!রিয়াশ এবার গলার স্বরটা উঁচু করে ধমকের সুরে বলে উঠে,
“যদি নেক্সট বার বলার পরও কথা না শুনো তাহলে কোলে তুলে নিবো বলে দিলাম!”
সানা “কোল” শব্দটা শুনে কুঁকড়ে উঠে।তখন কোলে নিয়েছে আর কি না লজ্জা পেয়েছে।যদি আবার কোলে নেয় এবার ত লজ্জায় মরে যাওয়া অবস্থা হবে!আর কোলে না উঠতে চাইলেও এই নির্লজ্জ রিয়াশটা ত তাকে কোলে নিয়েই ছাড়বে!কি করবে? কি করবে?ভাবতে ভাবতে সানার পিটপিট চোখজোড়া মনের অজান্তে রিয়াশের চোখের উপর পড়ে।পড়তেই রিয়াশ চোখ রাঙ্গানি দিয়ে ইঙ্গিত করে পা চালাতে!আর কি তারপর বাধ্য/ভদ্র মেয়ের মতো সানা রিয়াশ,তুলি,আবেদ এবং রাহুলের সহিত গাড়ির দিকে পা চালাতে থাকে।তারপর বাড়িতে এসে পৌঁছালে তুলি,আবেদ এবং রাহুল রিয়াশ এবং সানাকে বাইরে রেখে এসে তারা আগে বাড়ির ভেতর ঢোকে।জিহবা দিয়ে গলা ভিঁজিয়ে আওয়াজস্ত গলায় তিন বন্ধু মিসেস রিমাকে ডাকাডাকি করতে থাকে,
“ও আন্টি আপনি কোথায়?”
মিসেস রিমা তখন ফোনে উনার স্বামী মিস্টার শওকত হোসাইনের সঙ্গে কথা বলতেছিলেন।নিচে কারো হৈচৈ শব্দ কানে আসতেই বলেন,
“আচ্ছা কে যেন এসেছে তোমার সাথে একটুপর কথা বলতেছি।”
বলেই ফোনটা রেখে নিচে নামেন।তুলি,আবেদ,রাহুলের চেখমুখে হাসি হাসি ভাব দেখে বলেন,
“আরেহ তোমরা হঠাৎ আমার বাসায়?কি মনে করে?”
তুলি এগিয়ে এসে,
“ওহ আন্টি কি বলবো আপনাকে আমরা খুশি মানে সেই খুশি!এতটাই খুশি যে আপনাকে সেই খুশির সংবাদটা দিতে এসেছি বাট কীভাবে আপনাকে বলবো সেই ভাষা জানা নেই আমাদের..!না আবেদ এবং রাহুল?”
“হুম।”
“তা খুশির খবরটা কি বলো?
“আন্টি,রিয়াশ নতুন বউ নিয়ে এসেছে!বউটা কি সুইট..উফফ!
“মানে?কোন রিয়াশের কথা বলতেছ?”
“আপনার ছেলে রিয়াশের কথা বলতেছি আন্টি। রিয়াশ বিয়ে করেছে!”
“হোয়াট!মজা করতেছ আমার সাথে!?”
“য়ু হু মজা নয় আন্টি! এখনই দেখবেন আপনার ছেলে এবং আপনার বউমাকে!”
বলেই তুলি পেছনে ঘুরে গলা উঁচিয়ে রিয়াশকে ডাকে,
“রিয়াশ? ভাবীকে নিয়ে ভেতরে আয়তো?”
বলার সাথে সাথে রিয়াশ এবং সানা ভেতরে ঢোকে!রিয়াশ বর সেঁজে আর সানা বধূ সেঁজে।রিয়াশের বউ হিসেবে সানাকে দেখে মিসেস রিমা বেগমের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল!ছেলে তার সানাকে বউ করে আনবে এটা যেন তিনি বাস্তবে নয় কল্পনাতে দেখতেছেন এখন!রাগে,ক্ষোভে,ঘৃণায় সিড়ির দুই ধাপ ক্রস করে দ্রুতপদে রিয়াশের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রচন্ড ঝাঁজ এবং উঁচু গলায় বলে উঠেন,
“রিয়াশ এসব কী !!”
“এখন যা দেখতেছো তাই ই মা!”
“তুই এই কাজটা কীভাবে করতে পারলি!তুই শেষপর্যন্ত আমাকে এই প্রতিদান দিলি!ছিঃ!”
“তোমার এতদিনে ইচ্ছে ছিল তোমাকে ভালো,সুন্দর এবং খুব লক্ষী একটা মেয়ে এনে দিতে।আজ তা এনে দিলাম!”
“রিয়াশ চরম বেয়াদব কথাবার্তা বলতেছিস তুই!তোর ধারণা আছে তুই কী কান্ড করেছিস!?এমন মেয়েকে বিয়ে করেছিস যে কিনা আমাদের ভরসায় থাকে আমাদের ভরসায় বাঁচে এবং তার পুরো পরিবারও!সমাজের লোক যদি শুনে তুই এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস তাহলে সমাজে আমি মুখ দেখাবো কী করে! মাথা হেইট করে আনলি তুই আমার!চিৎকার করতে ইচ্ছে করতেছে।অনেক চিৎকার!”
“করো চিৎকার যত ইচ্ছে হয়!অন্তত সানাকে নিয়ে আর আর কোনো কথা বলবা না মা!কারণ সানা এখন আমার কাজিন নয়,আমার স্ত্রী!আমার অর্ধাঙ্গিনী!আমার সোহাগিনী!আমার ভালোবাসা!আমি সানাকে ভালোবাসি,সেও আমাকে ভালোবাসে।তুমি বলেছিলে না সানা কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে?সানা কারো সাথে পালিয়ে যায় নি।আমি সানাকে জোর করে সে রাতে কিডন্যাপ করি সানার বিয়েটা ঠেকানোর জন্যে।আজ সানা আমার হয়েছে!সো কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট মম সানাকে বউমার চোখে দেখো!”
“এই স্বপ্ন তোর কখনোই পূরণ হবে না!এটা আমি কখনোই হতে দিব না!কখনোই না!তোর বাবা দেশে ফিরুক আগে!”
মিসেস রিমার চিৎকার চেঁচামিচি শুনে এরইমাঝে সাহেলা বেগম এবং লিয়াকত আলী এসে উপস্থিত হোন। মিসেস রিমা তাদের দিকে তাকিয়ে ব্যথাতুর গলায় বলে উঠেন,
“বাহ গর্বিত বাবা-মা আপনারা!মেয়েকে এমন শেখালেন শেষপর্যন্ত আমার ছেলেটাকে পটিয়ে পাটিয়ে তার গলায় ঝুলে গেলো!কি ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের! কি ক্ষতি!দয়া দেখানোর এটাই শেষ প্রতিদান দিলেন?এটাই!”
সাহেলা এবং লিয়াকত আলী নিশ্চুপ হয়ে যায় প্রায়!তারা এ’কথার পিঠে কি জবাব নিজেরাও বুঝতে পারছে না!তারা ভাবতেই পারে নি তাদের মেয়ে শেষপর্যন্ত রিয়াশকে বিয়ে করবে যারা কিনা তাদের সংসারটাকে শক্ত খুঁটির মতো খুব আগলে ধরেছে।এই বুঝি শেষ প্রতিদান উপহার দিল তাদের!লিয়াকত আলী নিজেকে এখন খুব ছোট্টলোক মনে হচ্ছে !খুব!মেয়েকে দেয়ালের সাথে ঝুঁলিয়ে যদি গাঁয়ে বারংবার বেত দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে পারতেন তাহলে কষ্টটা কমতো!রিয়াশ বলে,
“উনাদের কিছুই বলবে না মা।উনারা এখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ী!সো সম্মান দিয়ে কথা বলবা!”
ছেলের কথায় মিসেস রিমার মাথায় আগুন ধরে যায়!উনার এখন যে কি করতে ইচ্ছে হচ্ছে উনি তা নিজেই জানেন না!হাত পা ছুড়াছুড়ি হয়ে আসে।উনার নিজের পেঁটের ছেলে উনাকে না জানিয়ে বিয়ে করে আবার এমন উদ্ভট বিহেভ করছে খুব এবং খুব কষ্ট লাগছে মিসেস রিমার!একটা সেকেন্ডও দাঁড়ালেন না!সবার দিকে একবার আগুন চোখে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যান।ঠাস করে করে বন্ধ করে ফেলেন!
সাহেলা বেগম এগিয়ে আসেন।
“সানা,তুই এটা কি করলি?এটা কি করলি মা,কেন রিয়াশকে বিয়ে করলি!দুনিয়াতে আর কি ছেলের অভাব ছিল!” (কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাহেলা)
“একে ছোট্ট বেলায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা দরকার ছিল!নাহলে এরকম দিন আমাদের দেখতে হতো না।উপকার করা মানুষদের কৃতঘ্নতা ফিরিয়ে দিতে হত না! শ্যাম অন আওয়াসেলভস!আমরা এতদিন বেয়াদব একটা মেয়ে বড় করেছি!”(লিয়াকত আলী)
সানা চোখমুখ কুঁচকে।চোখের পানি তো বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে বের হচ্ছে!সানার এউ কষ্ট রিয়াশের একদম কষ্ট হচ্ছে না!বুকটা দাউদাউ করছে।রিয়াশ শান্ত গলায় লিয়াকত আলীকে বলে,
” সানার কোনো দোষ নেই,বাবা!সানার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ওকে বিয়ে করেছি!আপনারা খামোখা না জেনে ওমন মিথ্যে অপবাদ ওর উপর দিতে পারেন না!প্লিজ ওকে নিয়ে কিছু বলবেন না!ও এখন রিয়াশ রিদের বউ!”
“বাবা,তোমরা আমাদের অর্ধেক খরচ চালাও!সেই তোমাদের আমরা গলা কেঁটে দিলাম!?এটা কীভাবে মেনে নিব বলো?”
“ওসব ভেবে এখন আপনারা আমাকে ছোট্ট করেতেছেন!এত ভাববেন না প্লিজ!মনে করেন সব এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে বাবা!”
লিয়াকত আলী চোখের চশমা টা খুলে ফতোয়ার কোণা দিয়ে চোখের কোণার পানিটুকু মুছে নেন।তারপর চশমাটা আবার চোখে এঁটে সাহেলা কে উদ্দেশ্য করে কঠিন গলায় বলেন,
“সাহেলা চলে আসো!”
বলেই রুমের দিকে এগোন!সাহেলা বেগমের না যেতে ইচ্ছে হলেও পরিস্থিতি শিকারে বাধ্য হলেন স্বামীর পেছন পেছন যেতে।যেতে গিয়েও মেয়ের দিকে একফোঁড় তাকালেন!সানা খুব তীক্ষ্ণ চোখে তার বাবার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলো!তার বাবার চোখে আজ এই প্রথম পানি দেখলো সে!এর আগে কলুর বলদের ঘানির মতো সংসারটা টেনেছে অথচ এরআগে বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি!তাহলে সে কি আজ তার বাবাকে খুব বেশিই পীড়া দিয়ে ফেলেছে?খুব হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার!খুব!বাবার পায়ের তলায় গিয়ে পড়ে বাবার দুই পা জড়িয়ে “বাবা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও!প্লিজ বাবা!” কিন্তু তা আর হলো না। সাহেলা বেগম রুমে ঢুকা মাত্রই লিয়াকত আলী দরজা বন্ধ করে ফেলেন!
তুলি এগিয়ে আসে।সানার কাঁধে হাত রাখে!বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবী!প্রথম এরকম পরিস্থিতি হবেই দেখবে পরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে!এই কষ্টকে কষ্টই মনে হবে না!আর কষ্ট দিও না নিজেকে।অনেক রাত হয়েছে।এবার রুমে চলো।”
বলেই তুলি সানার হাত ধরে সানাকে রিয়াশের রুমের দিকে আস্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে নিয়ে যেতে থাকে!
চলবে…
(এ’কদিন দিতে পারি নি তারজন্যে দুঃখিত!আসলে আমি একটু অসুস্থতা বোধ আর ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম!)