কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১২)

#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১২)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

অভ্রর গাড়িটা তো এমন নয় তাই আকস্মিক বুঝতে পারিনি। এই গাড়িটি নতুন ঝকঝকা ফকফকা। অভ্র নতুন গাড়ি কিনল নাকি! থাক সেটা আমার ভাবার বিষয় না। আমি আরেকটু ভালো করে তাদের দিকে খেয়াল করতেই অভ্র বলল,
-‘গাড়িতে উঠে এসো অর্নি। এই অবস্থায় হেঁটেও যেতে পারবেনা কোনো রিকশাও পাবেনা। ভিজে যাচ্ছো তো!’

আমি ভেবে দেখলাম ভুল তো বলেনি। তবুও উঠতে সংকোচ বোধ হচ্ছিল। অন্য সময় হলে উনার বলা লাগত না আমি নিজেই উঠে পড়তাম আগে ভাগে। তবে ওনার ঐ আর্মিম্যান ভাইটা কেমন করে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সেটা দেখে ইতস্তত বোধ করছি। অভ্র হর্ন বাজাতেই আর কিছু না ভেবে গাড়িতে উঠে বসলাম। বিপদে এত কিছু না ভেবে যা কপালে আছে তা সয়ে নেওয়াই উত্তম!
অভ্র বসেছে আমার হাতের ডান পাশে অর্থাৎ সামনের ড্রাইভিং সিট টা তে। আর আমার সামনেই আর্মিম্যানটা বসা। আমার আজ কয়দিন অভ্রকে জ্বালানো হয়না। ভাবলাম এখন একটু জ্বালাই। কিন্তু ভাইটার জন্য নড়ে বসতেও সংকোচ হচ্ছে। ধুর বাবা, কী এক জ্বালাতন!

গাড়ি কিছুটা সামনে যেতেই অভ্রর ফোনে কল আসে। গাড়ি থামিয়ে সে রিসিভ করে বলল, -‘হ্যাঁ এটাই আসো।’
আমার বিরক্ত লাগল! আবার কাকে ডাকছে? এটা কী পাব্লিক কার হয়ে গেল নাকি? অভ্র ডাক্তারি পেশা ছেড়ে ডাইভ্রার এর পেশা বেছে নিল নাকি!
ক্ষণিক বাদেই আমি খেয়াল করলাম মৃদুল ভাই আসছেন। তাও আবার এই গাড়ির দিকেই। অভ্র আমাকে বলল,
-‘এই পাশে এসে বস অর্নি। মৃদুল আসছে।’
এবার বুঝতে পারলাম কলটা কে করেছে। মৃদুল ভাই আসছে শুনে রাগে, দুঃখে আমার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পারছিনা কিছু করতেই। সরে এলাম এই পাশে। লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখলাম সামনে বসা আর্মিটা মানে আয়ান এক ধ্যানে সেখানেই তাঁকিয়ে আছে। যার ফলে আমাদের চোখে চোখ পড়ে। আজব! সে কী আমাকেই দেখছিল নাকি! দেখতেও পারে তার চোখে মুখে কেমন রাগ রাগ ভাব। হয়তো সেদিনকার কথা ভাবছে। ভাবলে ভাবুক। আমিও তো মৃদুল ভাইকে নিয়ে ভাবছি। সে এসে যদি এই দুই ভাইয়ের সামনে আমাকে পঁচানি দেয় তো! মান সম্মান বলতে আর কিছুই থাকবেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। মৃদুল ভাই গাড়ির দরজা খুলেই বসতে বসতে বলল,
-‘তাহলে এই গাড়িটাই নিলে অভ্র ভাই। যাক! দুই মাসের কষ্ট করাটা সফল হলো। কত ছুটেছিলাম দুইজনে এই গাড়ির জন্য।’
-‘হুম।একদম! আমি এইরকম জিদ বোধ হয় এই প্রথম করলাম! এমনিতে তো ভাইয়ার গাড়ি এতদিন চালাতাম এখন ভাইয়া এসেছে যাওয়ার সময় নিয়েও যাবে। এদিকে হঠাৎ করেই ফোন কল এসেছে যে আমার গাড়ি শো-রুমে এসে গেছে। ব্যাস এখন নিয়ে এলাম। তবে হুট করে বৃষ্টি আসায় একটু বিরক্ত লাগছে।’
-‘হুম বৃষ্টিটা হুটহাট শুরু হয় আমারও একদম বিরক্ত লাগে। আমার বই গুলোও অনেকটা ভিজে গেছে।’
এই কথা বলে দরজা লক করে সে এই পাশে তাঁকাতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল। কিছুটা চেঁচিয়েই বলল,
-‘এই তুই এইখানে কী করস! হ্যাঁ!’
আমি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেলাম। এর যা মুখ দেখা যাবে কি না কি বলে দেয়! আবার এই মানুষটা তো একটা বিবিসি নিউজ! যা কিছুই আমার সাথে ঘটে বা আমি ঘটাই সেই সবই আমার মায়ের কাছে আরো সুন্দর করে লবণ, মরিচ মাখিয়ে বলবে। আর মা তখন তার মুখের সুন্দর সুন্দর কবিতা আমার দিকে ছুড়ে মারবে। এই লোকটাকে আমি একটুও সহ্য করতে পারিনা। একটুও না।

অভ্র মৃদুল ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়ে ড্রাইভ করতে করতেই বললেন,
-‘দেখছ না বাহিরে কি বৃষ্টি! ও হেঁটে যাচ্ছিল। সাথে ভিজছিল তাই আমি পিক করে নিলাম। আরেকটা কথা আমার নতুন গাড়ির প্রথম ফিমেইল প্যাসেঞ্জার কিন্তু অর্নিই।’
এই কথা বলেই তিনি হেসে দিলেন। আমি ভ্যাবলার মত খালি শুনে যাচ্ছি আর সবাইকে দেখছি। মৃদুল ভাই আমাকে চোখ রাঙানি দিলেন। বুঝতে পারলাম আমি এবার সুনামির সম্মূখীন হতে চলেছি। হতাশার শ্বাস ফেলে আমি গ্লাসের গা ঘেষে গড়িয়ে পড়া পানি কণা গুলো দেখতে থাকি। এই সময় একটা গান শুনলে মন্দ হয় না। আমি এত সংকোচ করছিই কেন! অভ্রর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে আরো আগেই। আমি তার গাড়িতে তাই আর আমার এত টেনশন করার দরকার নেই। সে তো ভালো মানুষ। আমাকে কখনো বকেনা। আমি অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-‘ভাইয়া! গান চালানো যাবেনা?’
-‘যাবেনা মানে! অবশ্যই যাবে। এইটার সাউন্ড সিস্টেম অস্থির। দাঁড়াও আমি একটা গান প্লে করি।’
-‘না না আপনি করবেন না। আমি করি। ব্লু ট্যুথ ব্যবস্থা আছে না!’
-‘হ্যাঁ এইতো!’

আমি ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করতেই মৃদুল ভাই চেঁচিয়ে বললেন,
-‘এই এই! তুই ফোন কই পাইছস? তাও আবার সাথে করে কলেজে নেস!’
-‘গত সপ্তাহে বাবা কিনে দিল। আর বাবা পারমিশনও দিয়েছে কলেজে ফোন আনার। হুহ।’
-‘তোর কলেজে ফোন আনতে দেয়?’
-‘না নিয়ম নেই। তবে ম্যাম বা দিদিদের কাছে রাখা যায়। পরে আবার আসার সময় তাদের থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। আমি আজকেই শুধু এনেছি।’

ব্লু টুথ কানেক্ট করার পর ভাবলাম কিছু বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিক গান দেই। কিন্তু এরা আবার কী না কী ভাবে তাই আমার ঝাকানাকা গান চালু করে দিলাম। গানটা চালু হতেই সারা গাড়িতে ঝংকার তৈরি হলো যেন! তিন জোড়া চোখই বড় বড় হয়ে গেল। তবে আমার কী! আমি তো সাউন্ড সিস্টেমে খুব খুশি হলাম। বান্ধবীগণ থাকলে নাঁচতাম রীতিমত। গানটা কি ঝাকানাকা আওয়াজ করছে,

“দয়াল তর লাইগা রে,
ফয়েজি, তর লাইগা রে
আমার অঙ্গ ঝরঝর
মনে লয় উড়িয়া তামাম,
ছাইরা বাড়ি ঘর
ফয়েজি তরলাইগা রে.দয়াল বাবা

ও মুরশিদ ও ওও… ওরে বাট
খেয়া ঘাটের কাছে কাছে,
পাড় হয় আশে

এ হে, খেয়া ঘাটের কা”
এইটুকু বাজতেই মৃদুল ভাই এক থাবা দিয়ে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে গানটা বন্ধ করে দিল।
-‘এটা কোনো গান না গানের জাত! কী সব বা’ল ছাল শুনিস!’
-‘গানই তো।’
-‘দিব এক থাপ্পড়। বদমাইশ। এখানে বড় ভাইরা বসে আছে দেখস না! এসব কী হাবিজাবি বাজাই তাদের মাথা গরম করস?’

আমি রেগে গেলাম। অভ্রকে বললাম,
-‘ভাইয়া আপনারা কী মাথা গরম হচ্ছে!’
তিনি মিটিমিটি হাসছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে জবাব দিল,
-‘কই না তো! আমার হয়না তবে আয়ান ভাই এসব পছন্দ করেনা।’

আমি আয়ান নামক প্রাণীর দিকে তাঁকালাম। দেখলাম সে চোখ বন্ধ করে দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে চলেছে। আবারও রাগিয়ে দিলাম! এবার কী হবে? যদি আমাকে ক্র’স’ফা’য়া’র করে দেয়! তাহলে কী হবে! না না আর রাগানো যাবেনা। আমি চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষণ পর অভ্র বললেন,
-‘বৃষ্টির দিনে একটা বৃষ্টির গান শুনলে মন্দ হয় না কী বলো অর্নি!’
পেছন ফিরে তিনি মুঁচকি হাসলেন। আমার মন খারাপ নিয়েই আমি মৃদু হেসে বললাম,
-‘হুম।’

তিনি সাথে সাথে একটা গান চালু করে দিলেন।

“শীতল বাতাসে দেখেছি তোমায়
মেঘমিলনে চেয়ে রাগ করো না
মন চায় তোমায় আজই রাতে
শীতল বাতাসে, দেখেছি তোমায়
মেঘ মিলনে চেয়ে রাগ করো না
মন চায় তোমায় আজই রাতে

বৃষ্টি তো থেমেছে অনেক আগেই
ভিজেছি আমি একাই
আসতো যদি বিভীষিকা
খুঁজেও পেতে না আমায়

মেয়েলি এই সুরটা যখন চারিদিকে এক অসাধারণ মুহূর্ত সৃষ্টি করে তখন মৃদুল ভাই তার ব্যাগ থেকে আমাকে একটা শার্ট দিয়ে বলল,
-‘গায়ে টেনে দে। তোর ঠান্ডা লাগছে মনে হচ্ছে।’
আমি ভাবলাম আসলেই শীত শীত লাগছে। শার্টটা নিব দেখি আর্মিম্যানটা আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। এবার আর লুকিং গ্লাসে নয়। পেছন ফিরেই তাঁকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাগ নেয়। তবে এমন ভাবে তাঁকাচ্ছেন বোধ হয় আমাকে খেয়াল করে দেখছেন মৃদুল ভাইয়ের কথার সত্যতা কতটুকু! আমার ঠান্ডা কী আসলেই লাগছে? হয়তো আমার ভিজে কাঁপড় দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তারপর চোখটা সরিয়ে সামনের দিকে নিবদ্ধ করে। মৃদুল ভাই ব্যাগের চেইন লাগাতে ব্যস্ত তাই ব্যাপারটা খেয়াল করেন নি। অভ্রও গাড়িই চালাচ্ছেন। আর গানটা শুনছেন একদম মন দিয়ে।

মেঘ মিলনে চেয়ে রাগ করো না
মন চায় তোমায় আজই রাতে
রাতে… রাতে…

ঝুম ঝুম পাতালি হাওয়ার সাথে
খুঁজেছি শুধুই তোমায়
পিছাতে পারেনি ঝড়ো হাওয়া
খুঁজেই নিয়েছি তোমায়

ভুলে গিয়েছি মন শত অভিমান
মন চায় তোমায় কাছে পেতে
শীতল বাতাসে, দেখেছি তোমায়
মেঘ মিলনে চেয়ে রাগ করোনা
মন চায় তোমায় আজই রাতে
রাতে… রাতে…

শার্টটা পড়ে নিতেই ভালো লাগল। একটু হলেও তাপ লাগছে। আর বেশিক্ষণ ভিজে পোশাকে থাকা লাগবেনা। কারণ আমার বাসা সামনেই। ঐ তো দেখা যাচ্ছে উঁচু দালানটা। বাসার সামনে গাড়ি এসে থামতেই আমি চট করে নেমে গেলাম। অভ্রকে বললাম,
-‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
-‘ড্রাইভ টা আরো লং হলে ভালো হতো অর্নি। কী বলো?’
আমি আবার কী বলব! তবুও মাথা দুলিয়ে বললাম,
-‘জ্বি হ্যাঁ।’

মৃদুল ভাইয়ের শার্ট খুলতে নিলেই মৃদুল ভাই ভেতর থেকে বাজখাই গলায় বললেন,
-‘তোর থেকে আমি শার্ট চেয়েছি এখন? এটা আমি আর এমনি এমনি নিব! লন্ড্রি থেকে ধোঁয়া শার্টটা এনে ময়লার ড্রামে চুবিয়ে আবার না ধুয়েই হাতে নিব নাকি! এটা ভালো করে সারফ্যাক্সল দিয়ে ধুয়ে দিবি।’

এত বড় অপমান! এত টা বড় অপমান! তাও আবার আমার দু দুটো ক্রাশের সামনে! রেগে গিয়ে কিছু বলব তার আগেই মৃদুল ভাই অভ্রকে তাড়া দিয়ে বললেন,
-‘চলো ভাই দেরি হচ্ছে। ময়লার ড্রাম থেকে বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবেনা। কদাপি নহে!’
অভ্র হেসে দিলেন। শুধু হাসলেন না আয়ান। তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে ঈগলের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছেন। অদ্ভুত! সে আমায় এমন করে দেখে কেন? আমি কী কোনো আ’সা’মি নাকি! তারা সেখান থেকে যাওয়ার আগেই আমি সোজা গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে এলাম। যত্তসব!

২১.
বাসায় এসে শুনলাম বাবা আর মা কী নিয়ে কথা কাটাকাটি করছেন। আপার গলাও শুনতে পেলাম। আপা কখন এলো! আমি মৃদু পায়ে সামনে এগোতেই শুনতে পেলাম মা বলছেন,
-‘তিয়াসের সাথে রাজি হচ্ছো কেন তাহলে? তিয়াসও তো অর্নির থেকে বড় হয় বয়সে। তাহলে মিফতা বা মৃদুল কেন নয়?’
-‘তুমি বোঝোনা কেন? এইখানে বড় ছোট ভাবছিনা আমি। আত্মীয়ে আত্মীয়ে বিয়ে হলে কত সমস্যা পোহাতে হয় তা কী তুমি জানো না! আমার বড় আপার আর তার স্বামী অর্থাৎ বড় দুলাভাই তো মামাতো বোন ফুপাতো ভাই। তাদের দুইটা সন্তানই প্রতিবন্ধী হয়েছে। এক জ্বিনের জন্যই তো সব হয়েছে নাকি! কিছু কিছু সময়ে সবদিক টা ভেবে নিতে হয়। এসব বাদ দাও। তিয়াসের সাথে না হলে না হবে। তবুও আমি মেয়েকে আত্মীয়ের মধ্যে দিব না।’
-‘আমি যে আপাকে কথা দিলাম! অর্নিকে তার যে কোনো এক ছেলের জন্য দিব। সেই কথার কী হবে?’
-‘আমি বুঝিয়ে বলব তাদের। তারা তোমার মত এত অবুঝ নয়।’

আমি এসব শুনে আর ডাইনিং স্পেসের দিকে আগালাম না। সোজা রুমে এসে দরজায় খিল দিলাম। দুই দিন আগেও বিয়ের প্রস্তাবের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। এখন শুনেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। তার মানে আমার ধারণা সত্যিই। তিয়াস ভাইয়ের আমাকে পছন্দ।
তবে কী আমার স্বপ্নের পুরুষ তিয়াস ভাই?

#চলবে।
(সবাই রেসপন্স করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here