#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১৩)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২২.
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নামাযটা পড়েই ঘুম দিলাম। উঠলাম আসরের আযান পড়েছে যখন তখন। অযু করে নামায পড়ে এবার দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। বাহিরে অনেকগুলো গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চেনা পরিচিত যেমন- আপা, মা, মৈত্রী আপু। পুরুষ গলা একটাও শোনা গেল আবছা আবছা। তাই সঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে ঠাওর করলাম মিফতা ভাই হয়তো।
ক্ষুধা লেগেছে বিধায় প্রথমে ডাইনিংরুমেই গেলাম। দেখি আপারা সবাই বসে আছে আর কথা বলছে। টেবিলে দেখলাম পিৎজার বক্স। আর আপাদের সাথে কোল্ড ড্রিংক্স। যাহ্ বাবা! এখানে বোধ হয় ছোট খাটো একটা পার্টি হয়েছে আর আমি মিস করে গেলাম। অবশ্য এসব ছোট খাটো পার্টির থোড়াই কেয়ার করি আমি! আমি যেতেই মা বললেন,
-‘নবাব নন্দিনী! তা আপনার পেটে ক্ষিদের উদয় হলো! আমি তো ভাবলাম আপনার ক্ষদি টিদে সব মরেই গেছে।’
মায়ের এসব ঠেস মারা কথা শুনতে ভালো লাগল না। নিজেই প্লেটে ভাত বেড়ে নিলাম। গুঁড়ো মাছ রেঁধেছে ঝাল ঝাল করে। আমার প্রিয় মাছ। দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। প্লেটে নিয়ে মৈত্রী আপুর পাশে বসে পড়লাম। আপু আমার দিকে তাঁকিয়ে হাসল, বলল,
-‘কী করছিলি এতক্ষণ? ঘুমাচ্ছিলি!’
-‘হুম। কখন এসেছ তোমরা?’
-‘আমি বহ্নি সহ সকালেই এসেছিলাম। আমাদের বাড়িতে আগে গিয়েছি পরে এখানে এলাম। বহ্নি বদমাইশ কে বললাম চলতে আমার সাথে গেল না। তোদের বাসায় নাকি কী একটা হয়েছিল। তোর বাবা বারবার ফোন করছিলেন।’
আমার তখনকার সবার কথপোকথনের দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। আমি স্মিথ হেসে বললাম,
-‘ওহ আচ্ছা।’
আপা বললেন,
-‘তুই এসেছিলি কখন!’
-‘দুপুরেই।’
-‘দেখলাম না দেখাও করলিনা।’
-‘তোমরা সবাই কথা বলছিলে তখন।’
আপা আর মা আমার কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। হয়তো ভাবছেন তাদের কথা শুনে ফেলিনি তো! শুনেছিই তো। তবুও ভাবভঙ্গি রাখলাম এমন যে কিছুই বুঝতে দিলাম না। আমি খাচ্ছি আর ভাবছি আমি এখন কোনো বিয়ে টিয়ে করব না। বললেই হলো! বিয়ে করার মত বয়স বা প্রস্তুতি কিছুই নেই এখন আমার। আমি একদমই চাইনা এখনই কিছুতে জড়াতে। আমি জানি আমার বাবা এখনই আমায় বিয়ে দিবেন না। তবুও মনের ভেতর কিছুটা ভয়ের খচখচানি চলতে থাকে।
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে হঠাৎ মিফতা ভাই এসে হাজির। আমার সামনে বরাবর চেয়ারটায় বসলেন। আমার দিকে চেয়ে প্রশস্ত হেসে বললেন,
-‘কীরে এখন আবার ডায়েট শুরু করেছিস!’
-‘কই না তো।’
-‘খাবারের অনিয়ম হচ্ছে যে!’
-‘সেটা এমনেই। ভালো লাগলে খাই না লাগলে খাইনা।’
মা ফোঁড়ন কেটে বললেন,
-‘তোর আবার কেমন ভালো লাগার কথা বলছিস!’
-‘মা প্লিজ! চুপ থাকো। ভালো লাগছেনা আমার এখন কোনো কথা বলতে।’
-‘লাগবে কেন? এখন তো ফেসবুকে কথা বলতে বেশি ভালো লাগে।’
-‘ফেসবুক নয় মেসেঞ্জার হবে।’
-‘সেটাই। ঐসব এ তো ভালো লাগে।’
মিফতা ভাই বোধ হয় ভীষণ অবাক হলেন। অবশ্য হবারই কথা। সবাই জানে আমার কোনো ফেসবুক আইডি নেই। তবে আছে। এবং সেই আঠারো সন থেকেই আছে। সেটা আমি আর বাসার বাহিরে বলতে আমার দুই তিনটা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছাড়া কেউ জানেনা। সবাই জানবেও বা কীভাবে! আমি তো আইডি খুলেই সব কয়টারে ব্লকে ফেলছি। নাম ছিল এতদিন মায়ের নামে। তবে গতবছর নাম, পরিচয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব সেট করে ফেলেছি। এখন আর গোপন নেই আইডিটা। তবে এরা ব্লকে ছিল বিধায় জানেনা। মা ও জানে তবে আমি বলতে মানা করায় এতদিন কাউকে বলেনি। আর আজ! বলে দিল। অবশ্য এখন আর বলে দেওয়া নিয়ে ভয় কাজ করেনা। করবে কেন? বাবা নিজে ফোন কিনে দিলেন। বাবার সাথেও এড হলাম। বাবা-মা, বোন সবাই জানে। তো আর ভয়ের কী আছে! মিফতা ভাই কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,
-‘বলিস নি তো কখনো।’
-‘জিজ্ঞেস করলে বলতাম।’
-‘জিজ্ঞেস করাও লাগে! এমনি বলতি না?’
-‘আমার কী এখন আমার এফবি আইডি আছে এই কথা এলাকায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে মিফতা ভাই?’
-‘না সেটা নয়। রেগে যাচ্ছিস কেন?’
-‘রাগছি না। তবে রাগ উঠে যাচ্ছে।’
মিফতা ভাই আমার মুখের দিকে নির্বিকার চেয়ে রইলেন। আমি পাত্তা দিলাম না। মন মেজাজ ভালো না থাকলে মুখের কথাও ভালো থাকেনা। ভাত খেয়ে উঠে পড়লাম। ছাদে যাব একটু। একাকী থেকে হাঁটব, গান গাইব।
২৩.
বাসায় রমরমা পরিবেশ। আজ খালু আর খালামণির বিবাহ বার্ষিকী। ছয়ত্রিশ বছর তাদের একসাথে পথচলা। সেই সুবাদেই আজ বিরাট আয়োজন রেখেছেন মিফতা ভাইরা। ডেকোরেশন এর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বলতে গেলে আমাদের মায়েদের বা খালামণিদের এবার কোনো কাজের চাপই নেই। সবাই এবার একটু আরাম করতে পারবে। তবে সেই একটুই পারবে। কেন না, তারা এসব দায়িত্ব কারো উপর ছেড়ে থাকতে পারেনা। তো কতক্ষণ পর পরই গিয়ে খবর নেয় যে সব ঠিক আছে কিনা। তো এই টেনশন টাই তাদের আর ফ্রী থাকতে দেয়না। আর আমার মায়ের চিন্তার বড় কারণ আমি। আমার চিন্তায় সে অস্থির থাকবে। অবশ্য এতে আমারই দোষ। আমি তাকে চাপে রাখি বলেই তো সে চিন্তা করে। এই যে আমি জামা কাপড় পরিধান করতে ঘন্টা লাগাই, খাবারের প্রতিও অনিহা জন্মেছে। সবচেয়ে বড় কথা হুটহাট হারিয়ে যাই। মানে মা আমার খোঁজ যখন করেন তখন আমি আশেপাশে থাকিনা বলে তার বিপি হাই হয়ে যায়। আপা বারবার বলে দিয়েছেন,
-‘অর্নি! কোনো রকম দুষ্টুমি করবিনা। মায়ের সাথে না থাকলেও আমাদের সাথে থাকিস। আজ আর খালামণির বাসায় এলোপাথারি বিচরণ ঘটাতে পারবিনা। অনেক লোকজন আসবে। তোর তো ছেলে দোষ আছে আবার! হুটহাট ক্রাশ খেয়ে বসে থাকিস। আর সেসবের চক্করে হারিয়েও যাস। তাই বারবার বলে দিচ্ছি! সাবধানে কিন্তু।’
সবই ঠিক ছিল। শেষের কথাগুলো শুনে লজ্জায় দাঁত কা’টা গেল। নিজের বড় বোন যদি এসব বলে লজ্জা লাগবেনা?
আপার কথা মত আমি সারাদিন বাধ্য মেয়ের মতই চলছি। কোনো প্রকার আবোল তাবোল কাজ করছিনা।
আজ আমি শাড়ি পড়েছি। আমি একা নই সবাই পড়েছে। তবে আমার, আপার, মৈত্রী আপুর শাড়ি পুরো একরকম। আপারা সেদিন বিকেলে গিয়েই জম্পেশ কেনাকাটা করেছেন। তখন তিন বোনের জন্যই একরকম শাড়ি এনেছেন। হালকা বেগুনীর উপর পিউর কটন শাড়ি এনেছে। কী যে সুন্দর! আপা ব্লাউজের কাপড় কে’টে নিজে আমাদের সবার সুন্দর পার্ফেক্ট মাপ নিয়ে শেলাইও করেছে। আমার আপা শেলাই করে খুব ভালো। আমি মন মত ব্লাউজ এর ডিজাইন করে দিয়েছিলাম। সেই মতই আপা তৈরি করে দিয়েছে। তখন তো সুন্দর লাগছিল তবে আজ পড়ার পরে আরো বেশি ভালো লাগছে। আপা তো সুন্দর বলছেই আমার মা’ও কানের লতির পিছনে কাজল লাগিয়ে দিয়েছে যাতে নজর না লাগে। বাবা তো দেখেই হেসে ফেললেন। স্নেহ মিশিয়ে বললেন,
-‘আমার সোনা মা! কী সুন্দর লাগছে তোমায়। আসো আমরা একটা সেলফি তুলি।’
বাবা কিছুদিন হলো সেলফি তোলা শিখেছেন। হুটহাট সেলফি তোলেন। তারপর ফেসবুকে ছাড়েন। প্রথম প্রথম সেলফি গুলো অপরিপক্ক হলেও এখন অনেক ভালো তুলতে পারেন। বাবার সাথে আমি, আপা, মা আমরা সবাই একটা গ্রুপ সেলফি নিলাম। তারপর সবাই রওনা হলাম খালামণিদের বাসার উদ্দেশ্য। আজ বাবা সহ যাচ্ছি তো আর তাছাড়া আজকের পরিবেশটাও ভিন্ন তাই বাবার গাড়িতে করেই রওনা হলাম।
বাসার সামনে গাড়ি এসে থামতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর করে সারা বাড়ি সাজিয়েছে! দিনেই এত সুন্দর রাতে লাইট গুলো যখন জ্ব’লবে তখন না জানি কত সুন্দর হবে! আহা! কী দারুন!
চারিদিকে অনেক মানুষ এর অধিকাংশই ডেকোরেশনের লোক। আত্মীয় স্বজন বলতে মিফতা ভাইয়ের এক ফুপাকে দেখলাম আর আমাদের মামা আর বাকি খালামণিদের পিচ্চি দের দেখলাম। আমি আর আপা যেতেই ওরা হৈ হৈ করে এদিকে ছুটে এলো। আমার ছোট দুইটা কাজিন আছে একটা নাইনে একটা টেনে পড়ে। সমবয়সী হলেও আমার আর আপা এবং মৈত্রী আপুর যতটা মিল আছে তাদের সাথে ততটা নেই। কারণ একটাই! তারা থাকে দূর দূরান্তে আমরা তিনজন কাছাকাছিই আছি। নাইনে যে পড়ে সে হলো নাঈমা। সে একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল,
-‘তোমরা সবাই সেম শাড়ি পড়েছ? মৈত্রী আপুও এমন পড়েছে। তোমরা সবাই এক রকম পড়বে সেটা আমাদের আগে থেকে জানালা না। বাহ্! নিজেদের মধ্যে এত মিল মহব্বত আর আমরা গণাতেও পরিনা? বহ্নি আপু? তোমরা এমনটা করতে পারলে!’
-‘আরে সেইরকম কিছু মাথায় রাখিনি রে। আসলেই আমাদের ভুল। তোরাও যে শাড়ি পড়বি সেটা জানতাম না। সরি রে! রাগ করিস না!’
-‘রাগ অলরেডী করেই ফেলেছি।’
নাঈমা চলে গেল ধপাধপ পা ফেলে। আমি ভ্যাবলার মত কেবল তাঁকিয়েই রইলাম। পরমুহূর্তে তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবলাম আসলেই আপাদের চরম ভুল হয়েছে। নাঈমা হলো আমাদের ছোট মামার মেয়ে। আর তার পাশে যেটা ছিল মানে বিথী সে হলো আমাদের ছোট খালার মেয়ে। বিথী ঠাই দাঁড়িয়ে ছিল। সে আমার হাত ধরে বলল,
-‘যদিও তোমরা ভুল করেছ তবুও আমি রাগ করে শুধু শুধু সময়টা নষ্ট করতে চাইনা। নাঈমার কথা ভেব না। একটুপরেই রাগ কমে যাবে। চলো অর্নিপু ভেতরে যাই। যেই দারুন সাজানো হয়েছে! আমি কত গুলো ছবি তুলেছি। তিনটা সেল্ফি জোন রেখেছে। ইভেন, কালার কোড করে সাজিয়েছে। সাদা আর বেগুনী একদম তোমাদের শাড়ির রংটার মত।’
আমি তো শুনেই খুশি হয়ে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি আসলেই অসাধারণ! পরে জানলাম প্ল্যানটা মৃদুল ভাইয়ের। তার অবশ্য প্রচুর মেধা। সেইসব দিন দিন বিকশিত হয়েই চলেছে। তাতে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মূলত তার ব্যবহারটাই আমার অপছন্দ। বাজে ব্যবহারটা সে আমার সাথেই করে। এই যে, নাঈমা, প্রিয়ন্তী, নুপূর, মিথিলা, বিথী এদের সাথে সে একদমই বাজে ব্যবহার করেনা। তাদের মধ্যে দুজনের সাথে ফ্ল্যার্ট ও করে। একটা আমার সাথেই মানে সেম ক্লাসেই পড়ে। একই কলেজ না অবশ্য। সে আবার অনেক ব্রিলিয়্যান্ট। সাইন্স নিয়ে পড়ছে। ভিকারুন নিসা তে। তাই সে মৃদুল ভাইয়ের আরো বেশিই প্রিয়। আমাদের বড় মামার মেয়ে কর্নিয়া। আমার সাথে তার সখ্যতা নেই তেমন একটা। আমি সবচেয়ে বেশি ক্লোজ আমার আপাদের সাথে তারপর নাঈমা, বিথীর সাথে। আর বাকিগুলোর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক। আহামরি কিছু নেই। কর্নিয়া কখনোই আমাকে তেমন একটা সহ্য করতে পারত না। তাই আমি আর তার দিকে যাইনি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম লিভিং এড়িয়াই মামা-মামি, খালু-খালামণিরা, সব গুলো কাজিন এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মা আর আপা গিয়ে সবার সাথে যোগ দিলেন। আমি সালাম দিয়েই সটকে পড়তে চাইলাম কিন্তু তা হলো না। কারণ বড় মামার ছেলে বড়টা মাথে ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,
-‘কীরে অর্নি? তুই শাড়ি পড়েছিস? বাহ্ অসাধারণ লাগছে।’
তার এই কথাতে সবার একটা বিশেষ নজর পড়ল আমার উপর। আমার ইচ্ছে করছে এই ইমতিয়াজটাকে এখন গিয়ে ময়লার ড্রামে চুবিয়ে দেই। কিন্তু ইচ্ছে পূরণ আমার কখনোই হয়না। চুপচাপ ছিলাম সবাই প্রশংসা করলেন। ভালো লাগছে নাকি খুব। এই সেই, হেনতেন!
কেবল কর্নিয়াই মুখ চোখ কেমন করে বলল,
-‘বহ্নি আপু! তোমরা তো দেখি তিনজন একরকম শাড়ি পড়েছ। তো আমাদেরও বলতে। আমরা নিজেদের টাকাতেই কিনে নিতাম তবুও একটু জানাতে। সবাই একইরকম পড়তাম। সেম পোশাকের জন্য তোমরা তিনজন আজ আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে যাবে। আমাদেরই ফাঁটা কপাল।’
আমার আপা চুপচাপ এবং বুদ্ধিমতী। তাই সে রাগেনা। কারণ তার মস্তিষ্কে একদম ভালো করে সেঁটে রাখা আছে,
-‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন!’
আপা কর্নিয়ার ঠেস মারা কথার বিপরীতে সুন্দর করেই বললেন,
-‘কর্নিয়া! আসলে কী বল তো! এখানে একরকম ড্রেস শাড়ি এসব পড়া টা মুখ্য না। আমার ভালো লেগেছিল নিয়ে নিয়েছি। মৈত্রী আপুও পছন্দ হয়েছে বলে নিয়েছে। আর আমি তাই অর্নির জন্যও আর আলাদা নিলাম না। ভালো শাড়ি যেহেতু পেয়েছি নিয়ে নিয়েছে। একরকম পড়ব এরকম নয় ব্যাপারটা। আর তাছাড়া ড্রেস কোড তো এইটাই। তোরা ড্রেস কোড মেইন্টেইন করিস নি হয়তো এই ভেবে যে তোরা আরো বেটার কালার পড়বি। যাতে তোদের আকর্ষনীয় লাগে। সেটা একান্তই তোদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আর শুন! আমরাও না সবাই যার যার পোশাক নিজেদের টাকাতেই নিয়েছি। গিফ্টেড কিছুই নেই। বুঝলি?’
কর্নিয়ার মুখটা চুপসে গেল। আমার এতে হাসি পাচ্ছিল তাও চেপে গেলাম। এখন এখানে হাসা ঠিক হবেনা। মামারা আছেন। আপা খালামণি কোথায় জানতে চাইলে ছোট খালামণি বললেন যে উপরে মৈত্রী আপার রুমে। নানু সহ আছেন নাকি। মা আর আমরা চললাম উপরে তাদের সাথে দেখা করতে আর বাবা মামা আর বাকি দুই খালুর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। আসার আগেও একবার আড়চোখে কর্নিয়াকে দেখলাম তার চোখে মুখে রাগের তীব্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমি বুঝি না এই মেয়েটা এমন কেন?
উপরে উঠতেই মিফতা ভাইয়ের বাবা অর্থাৎ খালুর সাথে দেখা হয়ে গেল। আমরা সালাম দিলাম উইশ করলাম। তিনি খুবই অমায়িক। মিফতা ভাই একদম তার বাবার ডুপ্লিকেট। খালুর সবচেয়ে ভালো দিক হলো সুন্দর ব্যবহার করা। আর মিফতা ভাইয়ের মধ্যেও সেটা বিদ্যমান। আমাকে কখনো মামনি ছাড়া কথা বলেন না। আমার খালু তিনজন। ইনি হলেন বড়, তারপর আছেন মেজো খালু- মিথিলাদের আব্বু, উনি অবশ্য বিদেশে আছেন বর্তমানে। এরপরই আমার বাবা অর্থাৎ আমার মা হলেন সেজো জন বোনদের মধ্যে। ছোট খালু হলেন বিথীর আব্বু। মজাদার লোক বোঝেন? যারা অন্যকে হাসি খুশি রাখতে ভালোবাসে উনি হলেন সেই দলেরই লোক। সব মিলিয়ে আমার নিজের গোষ্ঠী টা প্রিয় কেবল অপ্রিয় হলো দুইজন। এক নম্বরে মৃদুল ভাই, দুই নম্বরে কর্নিয়া। এদের আমার ভালোই লাগেনা।
মৈত্রী আপুর রুমে প্রবেশ করতেই তো সবাই হা করে উঠল। নানুকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। নানু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সব ঠিকই ছিল। তবে হঠাৎ করেই মৈত্রী আপা বললেন,
-‘এই অর্নি? চুল খোপা করবিনা?’
-‘হু করব তো। ভেজা চুল ছিল তাই খোলা রেখেছি।’
-‘শুকিয়েছে তো। আয় বেধে দেই। সবাই আজ একদম বউ বউ সাজব।’
-‘তোমরা তো বউ-ই। তোমরা সাজো আমাকে কেন টানছো?’
-‘বেশি কথা বলিস চুপ থাক। এই দ্যাখ! আমার হাতে চুড়ি এগুলো হচ্ছেনা বেশি বড় তো। তোর হাতে একদম সুন্দর করে মানিয়ে নেবে। পড়ে নে।’
-‘আমি চুড়ি পড়িনা তো।’
-‘আজকে পড়বি। সমস্যা কোথায়?’
-‘না আছে সমস্যা! আমার ভালো লাগেনা একটুও।’
-‘আজকের জন্য পড় না বাচ্চা! সব বোন একটু সুন্দর সেজেগুজে ছবি তুলব। তুই এই রকম নরমাল থাকলে হবে? অর্নামেন্টস পড়বি না বুঝি! আয় এদিকে পড়িয়ে দেই আমি।’
অবশেষে জোর জবরদস্তিতে আমাকে গহনা পড়িয়ে দিলেন। আমি চুড়ি আর গলার হার এসব পড়তে অভ্যস্ত নই। তবুও আজকে এদের জোরোজুরিতে পড়তে হলো। কাঁচের চুড়ি আর সুন্দর সিম্পল একটা লকেটের মত হার পড়িয়ে দিলেন। রঙটা শাড়ির সাথে মানিয়েছে। রূপালি পারের শাড়ি তো পড়েছিই। সেই সাথে রূপালি জুয়েলারিও।
মিফতা ভাইয়ের সাথে ঐদিন রুঢ় আচরণ করেছিলাম। ভাবতেই মন ছোট হয়ে গেল। না থাক! একটা স্যরি বলেই আসি। আপুর রুম থেকে বের হয়ে মিফতা ভাইয়ের রুমের দিকেই রওনা হলাম। তবে,
মিফতা ভাইয়ের রুমে আর যাওয়া হলো না। তার বন্ধু-বান্ধব, কলিগ চারপাশে গিজগিজ করছে। আমি একটু উঁকি দিয়েছিলাম শুধু। মিফতা ভাই তখন বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাচ্ছিলো। আমি তাঁকানোর সাথে সেও এদিকেই তাঁকালো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে একটু জোরে বলল,
-‘অর্নি? কিছু লাগবে!’
আমি কিছু বলার অবকাশ পেলাম না। কারণ কয়েক জোড়া চোখও আমার উপর পড়ল। সেই অস্বস্তিতেই মাথা নাড়িয়ে দ্রুত চলে এলাম। পাশেই ঐ বদ মৃদুলটার রুম। আসার সময় ভাবলাম দেখে আসি কী করছে অসভ্যটা! তার রুমেও উঁকি মারলাম। তবে তাকে কোথাও দেখলাম না। রুমটা একদম জনশূন্য। যাক! পুরো বাড়িতে এই একটা রুম তো একটু ফাঁকা পেলাম। কী মনে করে যে ভেতরে ঢুকে গেলাম খেয়ালই ছিল না। আমি ভেতরে ঢুকে এদিকে ওদিক নজর বুলিয়ে চলেছি হঠাৎ করেই ঠাস করে দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে চমকে পেছনের দিকে তাঁকালাম। দেখলাম মৃদুল ভাই দরজায় ছিটকিনি দিচ্ছেন। আমি আৎকে উঠলাম। অসভ্যটা দরজা লাগালো কেন? গর্জে উঠে বললাম,
-‘দরজা লাগালেন কেন? মাথায় ছিট আছে!’
উনি প্রথমে কিছুক্ষণ আমার উপর চোখ বুলিয়ে বললেন,
-‘আমার মাথা ঠিকই আছে। তোর মাথা ঠিক নেই বোধ হয়। ছিট যা থাকার সব তোর মাথাতেই। না হলে একা একটা ছেলের রুমে ঢুকতি? নাকি ইচ্ছে করেই ঢুকেছিস অর্নি!’
তার কথার মর্মার্থ বুঝতে সময় লাগল না। চোখে মুখে বিতৃষ্ণা এনে বললাম,
-‘বাজে কথা বলছেন কেন? আমি এমনিই এসেছি।’
-‘সেটা তুই আসতেই পারিস। তবে এমন সেজেগুজে এলি যে? আমাকে দেখাতে এসেছিস?’
-‘আহারে! শখ কত? আপনাকে সেজেগুজে দেখাতে আসব আমি? জীবনেও না!’
-‘জীবনেও না? তো সেজেগুজে এসেছিস তো!’
-‘আপনার জন্য আসিনি। মিফতা ভাইয়ের কাছে এসেছিলাম।’
মৃদুল ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর বলল,
-‘ভাইকে কী দেখাতে এসেছিলি?’
-‘কী দেখাতে এসেছিলাম সেটা আপনাকে কেন বলব মৃদুল ভাই! আপনার আর কোনো কাজ নেই? উদ্ভট কথা নিয়ে পড়ে আছেন কেন? নিচে গিয়ে দেখুন, আপনার প্রিয় কর্নিয়া এসেছে।’
-‘কর্নিয়া এসেছে?’
-‘হুম খুব সেজেগুজে।’
মৃদুল ভাই আমার একটু সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
-‘সুন্দর লাগছে?’
-‘অনেক!’
-‘তোর মত?’
-‘আমার মত! মৃদুল ভাই আপনি আমার প্রশংসা করলেন?’
বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছিনা। মৃদুল ভাই আমার প্রশংসা করলেন! মৃদুল ভাই! আদৌ সম্ভব তো?
আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে তিনি বললেন,
-‘না মানে তুইও তো সারা মুখে কত কিছু মাখলি এখন তোকে যেমন বাজে লাগছে তেমনি লাগছে নাকি?’
এত বড় অপমান! আবারও বড় অপমান? এই লোক আমার জন্মগত শত্রু। এক নম্বরের বদমাইশ! এই বেয়াদবকে কী আমি কখনোই হারিয়ে দিতে পারব না? সবসময় কেন তাকে এমন জিতে যেতে হবে! কেন?
মৃদুল ভাই সরে গেলেন। সোজা নিজের কাবার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাবার্ড খুলে সেদিনের সেই শার্টটা আমার মুখের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। আমি আকস্মিক হামলা সামলে উঠলাম। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললাম,
-‘এটা কী হলো!’
মৃদুল ভাই এবার কাবার্ডের পাশের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
-‘আমিও তো বলতে চলেছি এটা কী হলো! তোকে বলেছিলাম শার্টটা ভালো ভাবে ধুঁয়ে দিতে। আর তুই কি করলি? শার্টে রঙ চঙ মেখে আপার হাতে ধরিয়ে দিলি! এতবড় সাহস তোর! আমার সাথে বাটপারি!’
-‘না ভাই! আপনার সাথে বাটপারি করার সেই সাহস কী আমার আছে?’
-‘তোরই আছে। একমাত্র তোর আছে।’
-‘ছিঃ কি বলেন না! আপনি গুরুজন আমি কীভাবে! না না এটা সম্ভব নয়।’
-‘থাপ্পড় না খেতে চাইলে আসল কথাতে ফিরে আয়। শার্টে রঙ মাখলি কেন?’
-‘ওটা রঙ নয় আই শ্যাডোস।’
-‘হোয়াট! এই এই, তুই আমার শার্টের উপর কীসের এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েছিলি?’
-‘এক্সপেরিমেন্ট না শুধু একটু প্রতিশোধ..’
-‘কী বললি! এত স্পর্ধা তোর? আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছিলি? কীসের প্রতিশোধ নিতে চাইছিলি হ্যাঁ!’
এবার আমি আর নিজের রাগ গোপন করলাম না। জোর গলাতেই বললাম,
-‘আপনি সেদিন আমাকে দুইজন মানুষের সামনে অপমান করেছেন। আমি ময়লার ড্রাম? আমার গায়ে গন্ধ?’
-‘মিথ্যে বলেছি নাকি!’
-‘কী! এত বড় কথা!’
-‘দিব এক থাপ্পড়। গলা নামিয়ে কথা বল। এটা আমার বেডরুম। আমার বেডরুমে আমিই চেঁচাব।’
-‘আচ্ছা আপনি চেঁচান ষাঁড়ের মত। আমি গেলাম।’
চলে আসতে নিতেই আমার হাত খপ করে ধরে ফেললেন তিনি। বললেন,
-‘কই যাস? তোর শাস্তি তো এখনো বাকি আছে।’
-‘শাস্তি! কীসের শাস্তি?’
-‘আমার শার্ট নষ্ট করেছিস তারপর আমার সাথে জোর গলায় কথা বলেছিস। এই সব এর শাস্তি। ওহ আরেকটাও আছে! আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছিলি না? সেইটার জন্যও শাস্তি। নেহাৎ আমি ভদ্র মানব তাই শাস্তি কমিয়ে দিচ্ছি।’
-‘মানে?’
-‘মানে হলো তোর সাজা খুবই সোজা। আমার কয়েকটা শার্ট আর প্যান্ট ধুঁয়ে দিলেই হবে।’
-‘কী! আমি আপনার চাকর নাকি?’
-‘জামা কাপড় ধুঁয়ে দিতে হলে চাকর হতে হয় নাকি?’
-‘আমি সেটা বলছিনা।’
-‘তাহলে তো কোনো কথা নেই। যা তোর কাজ কম। আমি আগেই সব কাপড় বালতিতে পাউডার দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছি। তুই শুধু কেচে দে।’
-‘অসম্ভব!’
আমি চলে আসতে পারলাম না। মৃদুল ভাই পথ আটকালেন। তবে হাতে পায়ে ধরে নয়, আমাকে রীতিমত ব্ল্যা’ক’মে’ই’ল করেছেন। সেদিন আমি অভ্রর গাড়িতে করে এসেছিলাম সেটা মাকে বলবে। এবং! এমনভাবে বলবে যেন মা এটা বিশ্বাস করে আমি কোনো আকাম কুকাম করেছি। তার এসব কথা শুনে তো আমি সেখানেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথা ঝিম ধরে গেছিল। একটা মানুষ এতটা বেয়াদব কীভাবে হয়?
অগত্যা কোমরে আচল টা গুজে কাজে লেগে পড়লাম। সবগুলো জামা কাপড় ডলে ডলে ধোঁয়ার পর আমার হাত মশাই কেমন একটা মলিন হয়ে গেলেন। দেখে আমারই কান্না পেল। শেষ কবে যে এত জামা কাপড় ধুয়েছি খেয়াল নেই। সব ধুঁয়ে বারান্দায় মেলে দেওয়ার জন্য বালতিতে ভরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। দেখি বদমাইশটা পাঞ্জাবি পড়ে একদম তৈরি! এখন চুলে কিছু করছে হয়তো জেল মাখছে। মুখ ভেংচি দিলাম একটা। বদমাইশটার জন্য আমার সব সাজ শেষ! ভাগ্যিস! ভাগ্যিস আমি ভারী মেকআপ দেইনি আজ। মৈত্রী আপু জোর করছিলেন খুব তবুও দেইনি কারণ শাড়ি একদম সিম্পল। গর্জিয়াস হলে এক কথা ছিল ভারী সাজ দেওয়া যেত। বারান্দায় গিয়ে সাবধানে সবগুলো জামা মেলে দিলাম। সাবধানে বলছি কারণ কেউ যদি দেখে ফেলে আমি মৃদুল ভাইয়ের বারান্দায় তার কাপড় মেলছি তাহলে কী ভাববে?
রুমে এসে দেখি মৃদুল টা আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। এতক্ষণ হয়তো বারান্দার দরজার দিকেই তার দৃষ্টি তাক করা ছিল। আমি প্রচন্ডে গরমে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। এসি অন করা ছিল সেটা বন্ধ করে জোরে ফ্যান চালু করলাম। এসির বাতাস আমার ভালো লাগেনা। আবার কেমন দমবন্ধকর লাগে। গন্ধ একটা সবসময় নাঁকে হানা দেয়। জানালার কাঁচ খুলে দিলাম। এই এতসব কাজ করতে করতে মৈত্রী আপু শক্ত করে যেই খোপাটা বেঁধে দিয়েছিল সেটা খুলে গড়িয়ে কোমর পর্যন্ত গেল। ধুর! বিরক্তিকর! আয়নার সামনে গিয়ে চুলটা আলগোছে কোনোরকমে বেঁধে নিলাম। শাড়ির কয়েক ভাজ পড়েছে। চোখ মুখ কুঁচকে ভাজটাও ঠিক করলাম। তারপর আয়নার দিকে তাঁকিয়ে দেখলাম সাজ ওতোটাও নষ্ট হয়নি। চলা যায়! অতঃপর চোখ গেল মৃদুল ভাইয়ের দিকে। সে একদৃষ্টিতে এদিকে তাঁকিয়ে ছিল। তার চোখে মুখে কত কথা বোধ হয়! আমি এবার আয়না থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তাঁকালাম তার দিকে। রাগ কোনো মতে চেপে বললাম,
-‘সব কাজ শেষ। এবার কী আমি যেতে পারি!’
তিনি মৃদু হাসলেন। তারপর আয়েশ করে বিছানায় বসলেন। বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ফ্লোরের দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। তাতে আমার মেজাজ আরো খারাপ হলো। আমি কিছু বলব তার আগেই তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাঁকালেন। তার চোখমুখ কেমন সুখময় দেখতে লাগছিল। নাকি আমিই ভুল দেখলাম! তিনি বললেন,
-‘জামা কাপড় ধুঁয়ে আনা, বারান্দায় মেলে দেওয়া এবং তারই সাথে চুড়ির ঝনঝন শব্দ, এসি অফ করে ফ্যান চালু করা, জানালার কাঁচ খুলে দেওয়া, অপরিপক্ক ভাবে চুলের হঠাৎ খুলে যাওয়া খোপাটা আবার বেঁধে নেওয়া, আয়নায় নিজেকে দেখে ত্রুটি গুলো ঠিক করা, সবই কেমন যেন বউয়ের মত লাগল। মনে হলো আমার বউ। আমার সব অর্ধেক কাজ সে নিজ দায়িত্বে সম্পূর্ণ করেছে। এবং এইভাবে বিচরণ করা তার রোজকার কাজ। এইঘরে আমার যতটা অধিকার ততটাই তার। সব কাজেই কী সুন্দর স্পষ্ট অধিকারত্বের ছাপ! মনে হচ্ছিল এই সবই তার। আমিও তার’
বুকের ভেতর একটা ধাক্কা এসে লাগল। অভদ্রটা কী বলছে? বউ? পাগল হলো নাকি! আবার হাসেও তো! পাগলই হয়েছে। নইলে এমন কথা সে বলবে কেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-‘বুঝলাম আপনার বিয়ে করার শখ হয়েছে। তো করেই ফেলুন। আমি খালামণিকে বলে ম্যানেজ করে দিব। কিন্তু এখন আমি যাই। আমাকে সবাই খুঁজছে হয়তো।’
তড়িগড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বদমাইশটা এবার কোনো বাঁধা দিল না। শুধু হাসছিল। আমি নিশ্চিত এটা পাগল হয়েছে আর নাহলে এটাকে জ্বিন পরী কিছু ধরেছে। এর থেকে দূরে থাকাই উত্তম।
সিঁড়ি বেয়ে সোজা নিচে নেমে এলাম। ভাগ্য ভালো উপর তলায় কেউ ছিল না তখন। নইলে এই বদ্ধ কামড়া থেকে আমাকে বের হতে দেখে কী না কী ভেবে ফেলত!
নিচে এসে সুবিধা করতে পারলাম না। মিফতা ভাইয়ের বন্ধুরা সব আমার কাজিনদের সাথে ব্যস্ত রসিকতা করতে। আরো কয়েকটাকেও দেখলাম। এই মেয়ে গুলো মিফতা ভাইয়ে চাচাতো বোন আর ফুপাতো বোন। আমি শুধু চেহারা চিনি নাম জানিনা। সেইদিকে গেলাম না কারণ দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে কর্নিয়া হলো ঐ আসরের মধ্যমণি। আর সেই আসরে আমি নেই যেখানে ঐ বেয়াদব মেয়েটা মূখ্য থাকে। বাহিরে একটু ঘুরে আসা ভালো এর থেকে। শাড়িটাও নিচে দিয়ে একটু ভিজে আছে সেটা এই কড়া রোদে শুকিয়ে যাবে। দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে আরেকবার ড্রয়িংরুমে তাঁকিয়ে দেখলাম অভ্রও সেখানে উপস্থিত। কর্নিয়ার পাশেই যে সিঙ্গেল সোফা আছে সেটায় বসে আছে। তবে দৃষ্টি একদম দরজার দিকেই। তবে ঠিক বুঝলাম না আমাকেই কী দেখছে? মিফতা ভাইয়ের দিকেও আরেকবার তাঁকালাম দেখলাম সে আমার দিকে তাঁকিয়ে আবার হঠাৎ করেই অভ্রর দিকে তাঁকালো। জানিনা সে কী ভাবছে বা ভাবতে চলেছে। আমি বর্তমানে সেসবের কোনো তোয়াক্কাও করছিনা।
২৪.
বাহিরের উত্তপ্ত রোদের রশ্মিতে আমি হেঁটে চলেছি দিকবিদিগ্। এতক্ষণে আমার শাড়ির নিচের অংশটা কিছুটা শুকিয়েও এসেছে। তবে আমি বোধ হয় এই গরমে কালো কয়লা হয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে যে কখন মিফতা ভাইদের গেট পেরিয়ে এসেছি খেয়াল নেই। এখন রাস্তাতেই আছি। রাস্তাঘাট শুনশান। এইদিকটা আবাসিক এলাকা তাই আর রোডের অন্যসব গাড়ির আনাগোনা নেই বললেই চলে। ফাঁকে কয়েকটা রিকশা বা সিএনজি যায়। তাও অতি নগন্য সেই সংখ্যা। বেশিরভাগ প্রাইভেট কার গুলোই আসা যাওয়া করে। এই ভরদুপুরে সেগুলোও খুব একটা দেখা যাচ্ছেনা। কেউ কেউ অফিসে, নানা রকম কর্ম সংস্থানে, আবার কেউ কেউ নিজেদের বাসাতেই অবস্থান করছে হয়তো। অভ্রদের গেটের দিকে তাঁকিয়ে দেখলাম অভ্রর গাড়ি। নতুন টা না আগে যেটা ব্যবহার করত সেইটা। মানে ঐ আর্মিম্যানের গাড়ি। কি মনে করে আয়নায় গিয়ে মুখটা দেখলাম। ভাবলাম কালো হয়ে গেছে বা স্কিন পুঁ’ড়ে গেছে। কিন্তু না! কেমন টমেটোর মত লাল হয়ে আছে। ফর্সা গালে কী দারুন দেখতে লাগছে। আমার মেকআপের কেলমার থেকেও সুন্দর লাগছে এই প্রকৃতি থেকে পাওয়া বর্তমান রূপটা। আপা প্রায় সময় বলত,
-‘অর্নি? সবাই রোদে গেলে চেহারা নষ্ট করে ফেলে আর তুই! তুই তো আরো বেশি সুন্দর হয়ে যাস।’
আমি পাত্তা দিতাম না কারণ আমার সেই রৌদ্রময়ী চেহারাটা আমার কখনোই দেখা হয়নি। আজ সেই সুযোগ টা হয়েছে। নিজেকে দেখছিও! এবং একদম মুগ্ধ হয়ে। নিজেরই আবার নজর না লেগে যায় সেজন্য মা শা আল্লাহ্ ও বললাম। বেশিক্ষণ আর না তাঁকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। পেছনে ফিরতেই ভয় পেয়ে গেলাম। আর্মিম্যানটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই তীক্ষ্ণ চাহনি। আমি একটু নার্ভাস হয়ে পড়লাম। উনি বললেন,
-‘নিজেকে দেখা শেষ হলো?’
তার কথায় লজ্জা পেলাম। সে আবারও লজ্জা দিয়ে বলল,
-‘তোমাদের বাসায় আয়না নেই? কী যেন নাম তোমার! অর্না নাকি স্বর্না?’
এবার লজ্জার সাথে সাথে রাগটাও হলো ভীষণ। গম্ভীর স্বরে বললাম,
-‘জ্বি অর্নি ভাইয়া।’
-‘কে তোমার ভাইয়া? আমি তো এইখানে আর কোনো মানুষকে দেখতে পারছিনা।’
-‘না আপনাকেই তো বলছি।’
-‘আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই?’
-‘না না। সেটা কেন হবে?’
-‘সেটা যদি না হয় তো ভাইয়া ডাকছ কেন?’
-‘না আসলে আপনি বড় তো। সবাইকেই ভাইয়া ডাকি যারা বড়। অভ্র ভাইয়াকেও তো ভাইয়া ডাকি।’
-‘ডাকতেই পারো। তাদের ডাকতেই পারো। তবে আমাকে নয়।’
-‘তো কী ডাকব? আপনি তো আর আমার ছোট না বয়সে যে আয়ান বলে ডাকব।’
এইবার বিরক্তি এসে গেছে তাই আর ভদ্র ভাবে কথাটা বলতে পারলাম না। আর্মিম্যানটাকে দেখলাম ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল,
-‘এইতো নিজের ফর্মে এসেছ। ভদ্রতা তো তোমার থেকে কাম্য নয়। তোমাকে অতি দ্রুত ভদ্র সভ্য করে গড়ে তুলতে হবে।’
এবার যা একটুও ভদ্রতা ছিল সব হারিয়ে ফেললাম। বললাম,
-‘আপনার কী ধারণা আমার বাবা-মা আমাকে ভদ্রতা শেখায়নি?’
-‘শিখিয়েছে। তবে তুমি তা গ্রহণ করতে পারো নি।’
-‘তাহলে এখন আমি কী করব? খাতা কলম নিয়ে আপনার কাছে ভদ্রতা শিখতে বসব?’
-‘হ্যাঁ দরকার পড়লে বসবে।’
-‘কখনোই না।’
-‘তাই?’
-‘হ্যাঁ!’
আমি ভাবলাম চলে আসব। কিন্তু এতক্ষণ ঝগড়ায় খেয়াল করিনি আর্মিম্যানটাকে অনেক সুন্দর লাগছে। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টে একদম জেন্টেলম্যান লাগছে। শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখাতে বলিষ্ঠ হাতটাও সুন্দর উঁকি মারছে। ইশ! এই মাত্রই তো ঝগড়া করলাম। আর এখনই দিওয়ানি হয়ে যাচ্ছি! ছিঃ কী লজ্জার কথা!
আমি তার মুখের দিকে তাঁকালাম দেখি সেও একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তাঁকিয়ে আছে। আমি ভাবলাম এই ব্যাটাকে এভাবে তো শিক্ষা দিতে পারছিনা। একটু টিজ করি। তারপর ঘাবড়ে যাবে, তবেই না মজা হবে! আমি এবার গলার স্বরে মধু মাখলাম। বললাম,
-‘ইশ! কী সুন্দর লাগছে আপনাকে আগে তো খেয়াল করিনি।’
তার চোখটা হাট করে মেলে গেল। এই তো বাঁচাধন ঘাবড়েছে। হা হা হা!
-‘ইশ! আপনার এত সুন্দর বডি আছে? দেখি একটু বডি বিল্ডাররা যেমন অঙ্গভঙ্গিমা গুলো দেখায় সেইরকম করে একটু দেখান তো!’
লোকটা এবার ক্রুদ্ধ নয়নে তাঁকালো। বলল,
-‘এম আই লুক আ জোকার টু ইউ?’
-‘না না! আপনাকে তো দারুন লাগছে। আমার ক্রাশ ক্রিস ইভানসের মত। সেইরকম হট!’
-‘হোয়াট!’
-‘হোয়াট না হট। আপনি আর্মির ক্যাপ্টেন নাকি এমনিতেই সৈনিক পদে আছেন?’
-‘আমি একজন মেজর।’
-‘ওহ্! সাচ্ আ হট মেজর! মেজর মশাই, গরম লাগে আমার দুপুরে শিহরিত আপনার এই রূপে! ঝাপ দিব আমি প্রেমের পুকুরে কিন্তু ডুববো না।’
-‘সিরিয়াসলি? মেয়ে তুমি বুঝতে পারছ যে তুমি কার সাথে কথা বলছ?’
-‘শুধু কী বুঝতে পারছি? দেখতেও তো পারছি! আপনার মত একটা হট মেজরের সাথে কথা বলছি।’
-‘তুমি একটা অসভ্য মেয়ে। আমার সাথেই এভাবে কথা বলছ তারমানে আরো কতজনের সাথেই বলেছ।’
আমি এবার তাকে একটু তব্ধা খাওয়াতে চাইলাম। তাকে একটু ফিসফিসিয়ে বললাম,
-‘আপনার ভাইকেও তো কতবার কতকিছু বলেছি। হিসেব নেই।’
এবার লোকটার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। ভাইকে টিজ করেছি বলে কী রাগ করল?
-‘তুমি সত্যিই অভ্রকে এমন কথা বলেছ?’
-‘হ্যাঁ বলেছি তো।’
-‘অভ্র বকেনি!’
-‘কখনোই নাই। সে আপনার মত এত গম্ভীর আর রাগী না।’
-‘ওকে তোমার ভালো লাগে?’
-‘না লাগার কিছু নেই। তবে আপনাকেও লাগে। সুন্দর কাউকে দেখলেই ভালো লাগে। আমি আবার সুন্দর বলতে সাদা বোঝাইনি! সুন্দর মানেই সুন্দর। সাদা কালো কোনো ফ্যাক্ট না। আমি তো রাইমার ভাই রাজনের উপরেও ক্রাশ খেয়েছি। সে কালো, কুচকুচে কালো। তবুও খেয়েছি। কারণ তার ব্যক্তিত্ব! আর কথা বলার ধরণটাও সুন্দর। ব্যস ক্রাশ খেয়েই গেলাম।’
-‘তুমি ভাতের থেকেও ক্রাশ বেশি খাও দেখছি।’
-‘না সেটা কেন হবে? ভাতই তো বেশি খাই।’
-‘সাথে ক্রাশটাও খাও। এই তোমার লজ্জা শরম নেই? তুমি যে আমার সামনে এত কিছু বলছ?’
-‘লজ্জা শরমের কি আছে? কথা বলতে শরম কীসের!’
-‘এই জন্য এইসব কথাও বলবে? বড় ছোট বোঝোনা? তাছাড়া যাকে তাকে এমন কথা বলাও তো ভালো না।
-‘কে বলেছে ভালো না? মনে আসলে মুখে বলতে ক্ষতি কোথায়? আমার মনে এসেছে আমি মুখে বলেছি। আপনি হট।’
-‘তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।’
-‘অবাক হচ্ছেন মানে! অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
খেয়াল করলাম লোকটা চরম রেগে গেছে। আমি এবার ভয় পেয়ে গেলাম। এরা তো আর্মি মানুষ সাথে পি’স্ত’ল থাকে। যদি হঠাৎ করেই আমাকে শ্যু’ট করে দেয়? এরা কী রাগ উঠলেই শ্যু’ট করে দেয়? মানে মানে কে’টে পড়াই ভালো। কিন্তু কীভাবে! আমি একটু ঘরে চলে আসতে নিতেই লোকটা এবার আম হাত শক্ত করে চেপে ধরল। আজব! আমার এই হাত কী পাবলিক প্রোপার্টি? যে যখন চাইবে এভাবে ধরে ফেলবে? একদমই না! আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম কিন্তু উনি ছাড়লেন না। আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন। আমার রাগ উঠল বললাম,
-‘হাত ধরেছেন কেন? ছাড়ুন! আমি বাসায় যাব।’
-‘এত কিছু বলে এখন বাসায় যাবে? তোমাকে একটা শিক্ষা দিতে হবেনা? কার সাথে ফ্লার্ট করেছ তুমি তো তা এখনো বুঝতে পারোনি।’
এবার আমার পেটে কামড় পড়ল। ভয় বুকে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তখনিই লোকটার ফোন ক্রিক ক্রিক করে বেজে উঠল। সে তবুও আমার হাত ছাড়েনি। শক্ত করে চেপে ধরে বাম হাতে ফোন রিসিভ করে কানে দিল। তারপর ঐপাশ থেকে কতক্ষণ কিছু শুনল। এরপর শক্ত গলায় বলল,
-‘ক্র’স’ফা’য়া’র করে দাও!’
ব্যাস! এই একটা কথা শোনার পর আমার হাত পা বলতে গেলে সারা শরীরই কাঁপতে থাকে। কী ভয়ানক কথা। সে ফোনটা পকেটে রেখে আমার দিকে পুনরায় দৃষ্টিপাত করল। বলল,
-‘চলো।’
-‘কোথায়?’
তাকে ঘাবড়ে দিতে গিয়ে এখন নিজেই চরম ঘাবড়ে গেলাম। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-‘তোমার একটা শিক্ষা পাওয়া দরকার বলেছিলাম না? সেটাই দিতে চলেছি।’
-‘মানে? কী করবেন!’
উনি কিছু বললেন না। আবারও কল আসল তার ফোনে। রিসিভ করলেন ওপাশের কথা শোনার পর বললেন,
-‘হ্যাঁ আমি বাসার সামনেই আছি, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।’
ওমা! কারা আসবে? আমাকে সত্যি মে’রে টে’রে দিবেনা তো! এবার আমি ছলছল নয়নে তার দিকে তাঁকালাম। সে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ করল না। আমি তাই বললাম,
-‘প্লিজ! আমাকে ক্র’স’ফা’য়া’র করবেন না! আমি আর এইরকম ভুল করব না। আমি ভালো হয়েই থাকব। আপনি যা বলবেন সব শুনব। তাও মা’রবেন না।’
লোকটার ঠোঁটের কোণে এবার একটা হাসির ঝলক দেখা গেল। বলল,
-‘যা বলব করবে তো?’
-‘হুম করব। সব করব। তাও যেতে দিন।’
-‘আচ্ছা আগে আমার কাজটা কমপ্লিট করবে তারপর যাবে।’
-‘কী কাজ?’
-‘গেলেই দেখতে পারবে। এখন চুপ থাকো।’
-‘মা’রবেন না তো?’
-‘তুমি চুপ থাকলে মারব না।’
-‘আচ্ছা বলুন কী করতে হবে!’
-‘আমার সাথে যাবে।’
-‘আচ্ছা মা’কে বলে আসি। নাহলে টেনশন করবে।’
-‘মজা পাইছ? কী বলবা তোমার মা’কে? যা বলার সব পরে বলবে। কাজ শেষে। এখন চুপ থাকো।’
-‘কথা বললে কী সত্যিই ক্র’স’ফা’য়া’র করে দিবেন।’
আর্মিম্যানটা আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে বলল,
-‘হ্যাঁ। করে দেব।’
এবার ভয়ে আতঙ্কে এমনিতেও চুপ হয়ে গেলাম। তারপর হঠাৎ মনে হলো ভয়ের সময় ঘাবড়ে যাওয়া চলবেনা। এমনভাবে থাকতে হবে যেন আমি ভয় পাইনি। সেকেন্ড কয়েক পেরোতেই একটা আর্মি জীপ হাজির। সেদিনের টাই হয়তো। দেখলাম দুই তিনটা আর্মি ভেতরে বসা। একজন বের হয়ে এলেন। এসেই আয়ান কে সালাম দিলেন। তারপর বললেন,
-‘স্যার? চলুন! এইতো দুই তিন জনকে সাথে করে নিয়ে এলাম।’
-‘ভালো করেছ। এবার চলো।’
-‘জ্বি স্যার। তবে ইনি!’
আমার দিকে ইশারা করেই বললেন কথাটা। আয়ানও বলল,
-‘কাজ আছে। আপনি চলুন। আমার গাড়ির ড্রাইভারের কাজটা করুন আজকে।’
-‘জ্বি স্যার!’
-‘শুনুন! ফজলুলের বাসার সামনের রোডটাতে যাব। আপনি তো চেনেন!’
-‘জ্বি স্যার।’
বাহ্! লোকটা দেখি তাকে ভালোই সম্মান দেখাচ্ছে। আমি বেকুব বেশি করতে গিয়ে এখন মজা বুঝছি। আমার উচিত ছিল শুরু থেকেই তাকে আসতেও হুজুর হুজুর করা যেতেও হুজুর হুজুর করা। তবেই আজকের প্যারায় পড়তাম না!
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আর এদিকে ভয়ে আমি কাতর। কী হবে এই ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধকধক করছে। রাস্তায় একপাশে গাড়ি থামানোর পর নামতে বলল ঝটফট নেমে গেলাম। নেমে তো মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছে। এইখানে লেখা আছে, “কাজী অফিস” সেই যে লোকটা পাশে ছিল সেও কেমন অবাক হয়ে আছে। তারও ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার মত। সে বলল,
-‘স্যার আপনার কোনো আত্মীয়ের বিয়ে আছে নাকি?’
-‘না।’
-‘স্যার তবে!’
-‘আমার বিয়ে।’
লোকটা একপ্রকার চেঁচিয়েই বলল,
-‘কী!’
-‘চিৎকার করবেন না এনামুল সাহেব। জীপে কে কে আছে?’
-‘ক্যাপ্টেন সাদিক আর হানিফ।’
-‘ওদেরকে ডেকে আনুন।’
-‘জ্বি স্যার।’
লোকটা তড়িগড়ি করে ডাকতে গেলেন। আমি তো হতভম্ব হয়েই দাঁড়িয়ে আছি। এবার তিনি কাউকে ফোন করলেন। ঝটফট বললেন,
-‘তোর বাসার অপজিটের কাজী অফিসটায় চলে আয়। ফাস্ট!’
আমার এবার চোখ ফেটে পানি পড়ার উপক্রম। নিজের হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। লোকটি তাঁকাতেই বললাম,
-‘হাতটা ছাড়ুন। ব্যাথা করছে।’
-‘করুক।’
-‘আপনি কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন?’
-‘তোমাকে।’
কী সহজ স্বীকারোক্তি! আমি এবার কোনোমতে কান্না গলায় আটকে বললাম,
-‘কী বলছেন! আপনি এটা করতে পারেন না।’
-‘কেন?’
-‘আমি বিয়ে করব না আপনাকে।’
-‘আমি করব তোমাকে।’
-‘আমার এইটুকুই তো ভুল! মাফ করুন। বিয়ে টিয়ে কোনো শাস্তি নাকি!’
-‘ভুলটা আর কারো সাথে কর সেটা চাইনা। আর আমার সাথে অসভ্যতামি করলে আমি শাস্তি দিব।’
-‘তাই বলে যাকে তাকেই বিয়ে করবেন? যে কেউ এমন করলেই সোজা বিয়ে করে নিবেন?’
-‘আর কেউ করেনি।’
সেই লোকটা এবার বাকি দুইজনকে নিয়ে এলো। তারা আর্মিম্যানটাকে সালাম দিল। তারপর পেছনের দিক থেকে একজন এলো। এসে বলল,
-‘কীরে! ভর দুপুরে কাজী অফিসে তোর কী?’
তখনিই আমার দিকে তাঁকালো। বলল,
-‘এই মেয়ে কে? তোরা এখানে কেন?’
-‘বিয়ে করতে এসেছি। তুই স্বাক্ষী দিবি।’
-‘মানে? মজা করছিস?’
-‘আমি মজা করি? তোর কী মনে হয়?’
এবার এই লোকটিও চুপ হয়ে গেল। উনি আমার হাত ধরেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কাজী একসাথে এতজন কে ঢুকতে দেখে একটু তব্দা খেয়ে গেলেন। তাও আবার আর্মি ইউনিফর্ম পড়া লোক দেখে ভয়ও পেলেন। পরবর্তীতে ব্যাপারটা সামলে নিলেন। আয়ান বলল,
-‘বিয়ের কাজ শুরু করুন। আমরা পাত্র পাত্রী।’
ভয় দেখিয়ে ধমকে আমাকে দিয়ে নিজের নাম বাবা-মায়ের নাম এসব লিখিয়ে নিলেন। মাঝখানে কাজী বলল বাবা মায়ের অমতে বিয়ে হয়না। উনি উনার মাকে দূরে গিয়ে কল করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ঐপাশ থেকে কী বলল জানিনা। তবে উনি বললেন,
-‘আমার মা সম্মতি দিয়েছেন।’
-‘কন্যার পিতা-মাতা?’
-‘কন্যার বাবাও দিয়েছেন।’
এবার আমি আকাশ থেকে ঠুস করে পড়ে গেলাম। বাবা! বাবা কীভাবে সম্মতি দেয়? এটা তো খাঁটি মিথ্যা কথা। আমি মানিনা। শত নাকোচ করেও লাভ হলো না। শেষে ঐ এনামুল সাহেবের পি’স্ত’ল এর ভয় দেখিয়ে কবুল আমার মুখ থেকে উচ্চস্বরে শুনিয়ে তবেই ক্ষ্যান্ত হলেন।
বর্তমানে আমার মস্তিষ্ক ফাঁকা! কী বলব বা কী করব কিছুই বুঝছিনা। ভাবতেই পারিনি এই ফ্লার্টের চক্করে আমার এই হাল হবে। জীবনের চরম শিক্ষা দিয়ে দিল এই আর্মিম্যানটা। মিনিটের মধ্যেই আমি হয়ে গেলাম, “মিসেস আয়ান শেখ।”
#চলবে।
(প্রথম থেকে শেষটা আমি শুরুতেই ভেবে রেখেছিলাম। তাই অযাচিত মন্তব্য না করে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।)