#কাশফুলের_ভালোবাসা
#পর্বঃ২৫
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” কেন মেয়েটার জীবন নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলা খেলেছো?”
” কিসব বলছো তুমি?” ঘাবড়ে গিয়ে বলে মেহেকের মামা।
” আমি যা বলছি ঠিক বলছি।এমনিতেই তুমি মেয়েটার জীবন অনেক কষ্টদায়ক করে তুলেছো।তাহলে কেন আরো কষ্টকর করে তুলছো?”
” সোজাসুজি বলো কি বলবে।”
” তুমি এমনিকেই মেহেকের ফুলের মতো জীবনটাতে অন্ধকার করে দিয়েছে।ওর বাবা-মাকে কেড়ে নিয়েছো।তাহলে কেন আবার নক্ষত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করছো?”
” কিসব বলছো তুমি?”
” ঠিকই বলছি।আমি জানি মেহেকের বাবা-মাকে তুমিই মেরেছো আর ওনাদের সব সম্পত্তি পাওয়ার জন্যই তুমি মেহেকের বিয়ে নক্ষত্রের সাথে ঠিক করেছো।”
মেহের মামীর কথা শুনে মেহেকের মামা চুপ করে থাকে তারপর হুট করেই মেহেকের মামীর গলা চেপে ধরে।এতো শক্ত করে ধরে যে উনি কোন কথাই বলতে পারছেন না।
” প্রয়োজন থেকে অনেক বেশি কিছু জেনে ফেলেছো তুমি।চাইলেই আমি কিন্তু তোমাকেও মেরে ফেলতে পারি তবে আমি সেটা করবোনা।এখন তোমার কাজ চুপচাপ থাকা,যা ইচ্ছে মুখ বুজে তা সহ্য করা।নয়তো এর পরিণাম কিন্তু তোমার ছেলে-মেয়েকে ভুক্ততে হবে।বুঝতে পেরেছো?”
মেহেকের মামী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ ইশারা করে।মেহেকের মামাও উনার মুখ ছেড়ে দেয়।
” তুমি কেন আপু আর দুলাভাইকে মেরেছো?” ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে মেহেকের মামী।
” তুমি যখন সত্যিটা জেনেই গিয়েছো তাহলে কারণটাও শুনো।আমি ময়ূরীকে(মেহেকের মা) মেরেছি কারণ ওকে আমার হিংসা হয়,ছোটোবেলা থেকে আমার সবকিছুতে ও ভাগ বসাতো।জামা-কাপড়,খেলনা নামকি বাবা-মার ভালোবাসাও ওর ভাগটা বেশি থাকতো।বাবা-মা আমার থেকে ওকে বেশি ভালোবাসতো,আমার থেকে ওকে বেশি গুরুত্ব দিতো।আমি যদি কিছু জিনিস চাইতাম তারা নানা বাহানা দিতো কিন্তু ময়ূরীর একবার বলায় ওনারা সব এনে দিতো।এমনকি সম্পত্তির মধ্যেও ওর ভাগটা বেশি ছিল।ছোটবেলা থেকে ও আদরে আদরে বড় হয়েছে আর আমি অনাদরে।বিয়ের পরেও ও খুব সুখি ছিল।আমিও সব ভুলে নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু যখন জানতে পারলাম মরা যাওয়ার আগে বাবা সম্পত্তিতে ওকে ভাগটা বেশি দিলো তখন আর সহ্য করতে পারিনি।মেরে দিয়েছি ওকে।সেদিন ওর সাথে গাড়িতে ওর হাজবেন্টও ছিল,তাই সেও গেলো।হাহাহা……” কথাগুলো বলো পাগলের মতো হাসতো শুরু করলো মেহেকের মামা।মেহেকের মামার হাসি দেখে মেহেকের মামীর গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায়।
এতোক্ষণ এসব চলছিল সাউন্ড বক্সে,অডিও ক্লিপ ছিল এটা।ক্লিপটা শুনে সবাই অবাক দৃষ্টিতে মেহেকের মামার দিকে তাকিয়ে আছে আর মেহেকের মামা তাকিয়ে আছে সৌন্দর্যের দিকে কারণ এই ক্লিপটা সেই প্লে করেছে।উনার মনে একটাই প্রশ্ন আসছে যে ” সৌন্দর্য কিভাবে ওনাদের কথা রেকর্ড করলো?”
মেহেকের নানী এসে সজোরে মেহেকের মামাকে একটা থাপ্পড় মারে।
” কোন পাপ যে করেছিলাম যে তোর মতো একটা জানোয়ার আমার পেট থেকে জন্ম হলো।হে আল্লাহ তুমি আমাকে আমার কোন পাপের সাজা দিলে?আমি যদি জানতাম এসব হবে তোকে জন্মের সময় মেরে ফেলতাম।কেমন ভাই তুই যে নিজের বোনকে মেরে ফেললি।তোর কি একটুও বিবেকে বাঁধলোনা।তুই একবারের জন্যও ভাবলিনা যে ওরা মারা যাওয়ার পর এই মেয়ে দুটোর কি হবে।কিভাব তারা বাঁচবে।”
” না মনে হয়নি।কেন হবে?কেন বিবেকে বাঁধবে আমাকে বলো।ও হওয়ার পর থেকে তুমি আর বাবা সবসময় ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।আমার দিকে তো তোমাদের কোন খেয়ালই ছিলনা।সব আদর-যত্নতো ওকেই করতে,আমি খেলাম কি মরলাম তোমাদের তো কিছুই যায় আসতোনা।এমনকি ময়ূরীও আমার জিনিসে ভাগ বসাতো।তোমরা কি কেউ আমার কথা ভেবেছিলে?ভাবোনি তো,তাই আমিও ভাবিনি।মেরে দিয়েছি ওকে,মেরে দিয়েছি,মেরে দিয়েছি…..।” এরপর তিনি নিজে নিজেই কিসব বিররব করতে থাকে।
সত্যিটা জানার পর সৃষ্টি আর মেহেক প্রচুর ভেঙে পড়ে।নক্ষত্র আর নাইরা বিশ্বাসই করতে পারছেনা তাদের সহজ-সরল বাবার পেছনে এতদিন লুকিয়ে ছিল একটা খুনি।ইতিমধ্যে আশেপাশের সবাই বিভিন্ন কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছি।ছেলের কথা শুনে মেহেকের নানী তার ভুল বুঝতে পারে।এখানে আসলে তাদেরও দোষ কম নয়।তাদের উচিত ছিল দুই ছেলে মেয়েকে সমানভাবে দেখার কিন্তু তারা তা করেনি।আজ তাদের ভুলে জন্য একটা সুন্দর পরিবার নষ্ট হয়ে গেলো।
কিছুসময় পর পুলিশ আসে আর মেহেকের মামাকে ধরে নিয়ে যায়।কেউ পুলিশকে আটকাইনি।
মেহেকের নানী পাগলের মতো বিলাপ করে কান্না করছেন,তবে কেউ উনাকে আঁটকাছেন না।স্বচ্ছ সৃষ্টিতে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়।এই সময় এরকম একটা কথা শুনে মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে।আর মেহেক সেতো পাথরের ন্যায় এখনো স্টজেই দাঁড়িয়ে আছে।সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা যে মামাকে সে এতো শ্রদ্ধা করতো,সম্মান করতো,নিজের আপন ভাবতো সেই মামাই তাকে বাবা-মা হারা করে দিলো।মেহেকের নানী এসে মেহেকের কাছে দাঁড়ায়।তিনি মেহেকের হাত ধরে কান্না করতে করতে বললেন—
” আমাকে ক্ষমা করে দে নাতি ক্ষমা করে দেখে।আমি এতোদিন আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য তোকে দায়ী করেছিলাম,তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম।কিন্তু কে জানতো আমার জানোয়ার ছেলেটাই আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে খুন করেছে।আমাকে মাপ করে দে নাতি,মাপ করে দে।”
মেহেক নিজেকে শক্ত করে শান্তি গলায় বলে—
” না নানী তুমি ক্ষমা চাইছো কেন?আমি জানি তুমি মাকে খুব ভালোবাসো।তাই মায়ের এই হঠাৎ চলে যাও মেনে নিতে পারিনি।তোমার জায়গায় আমি হলে আমিও এরকমটাই ভাবতাম।তুমি আর নিজেকে দোষি মনে করোনা।”
” আমাকেও ক্ষমা করিস মা।আমি সব জেনে শুনেও এতোদিন চুপ ছিল।আমি যদি নিজের সন্তানদের কথা না ভেবে আগেই মুখ খুলতাম তাহলে হয়তো আজ এসব কিছু হতোনা।” মেহেকের মামী বলে।
” মামী তুমিও নিজের জায়গায় ঠিক ছিলে।আমি তোমাদের কাউকেই দোষ দিচ্ছিনা।”
” কিন্তু সৌ তুমি এসব জানলে কি করে?” মাঝ থেকে সৃষ্টি সৌন্দর্যকে প্রশ্ন করে।এতোক্ষণ সৌন্দর্য শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো,একটা কথাও সে বলে।এবার সৌন্দর্য সামনে এসে দাঁড়ায়।
” ভাবী এবার আমি নয় বরং ও আমাকে বলেছো।” স্পর্শের দিকে ইশারা করে বলে সৌন্দর্য।সবাই বড় বড় চোখ করে স্পর্শের দিকে তাকাই।
” স্পর্শই আমাকে এই অডিও ক্লিপটা দিয়েছে।আমিতো শুধু প্লে করেছিম।বাকিসব ওই জানে।”
” আদু,তুমি?তুমি আগে থেকেই জানতে?।”অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সৃষ্টি।
” আরে সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?” বিরক্ত নিয়ে বলে স্পর্শ।” আচ্ছা বাবা বলছি বলছি।আমি যখন কাল গেস্ট রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনি শুনতে পাই ওনাদের কথা আর রের্কড করে নিয়
কারণ আমি জানতাম কেউ আমার মুখের কথায় বিশ্বাস করবেনা।”
মেহেক এবার স্টেজ থেকে নেমে ধীর পাশে স্পর্শের সামনে এসে দাঁড়ায়।সে কিছু না বলে চুপচাপ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে থাকে।
” কি?” ভ্রু-কুচকে প্রশ্ন করে স্পর্শ।
” থ্যাঙ্ক ইউ।” শান্ত কন্ঠে বলে মেহেক।
” কেন?”
” সবকিছু্ জন্য।আজ আপনি না থাকলে হয়তো সত্যিটা কোনদিনই সামনে আসতোনা।”
” ওকে ওকে,এতো থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হবেনা।” এটিটিউট নিয়ে বলে স্পর্শ।তারপর মুচকি হেসে মেহেকের মাথায় হাত রেখে বলে —- ” তোমার মতো আমারো একটা বোন আছে।আজ যদি তোমার জায়গায় রিফু থাকতো তখনো কি আমি চুপ করে থাকতে পারতাম?পারতাম না।তাহলে তোমার বেলায় কেন মুখ বুজে থাকবো?রিফার মতো তুমিও আমার একটা মিষ্টি বোন।”
স্পর্শের কথা শুনে মেহেকের চোখে পানি জমে যায়।
” আরে পাগলি মেয়ে কান্না করছো কেন?”
” জানেন আমার না সবসময় একটা বিষয় নিয়ে খুব আপসোস হতো।কেন আমার একটা বড় ভাই নেই।সবাই যখন তার বড় ভাইয়ের কাছে আবদার করতো তখন আমার খুব কষ্ট হতো।তবে আজ আমিও একটা বড় ভাই পেয়েছি।হবে আমার বড় ভাই?”
” হুম অবশ্যই হবো পুচকি।তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়ের ভাই হতে কে না চাই।” মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে স্পর্শ।স্পর্শের কথা শুনে মেহেক আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারেনা,স্পর্শ জরিয়ে ধরে কান্না করে দেয়।এই কান্না যেমন সুখের তেমনি দুঃখেরও।মেহেকের কান্না দেখে বাকি সবাইও ইমোশনাল হয়ে পড়ে।
চলবে…..
(কেমন দিলাম জটকা?আপনারা হয়তো ভাবছেন সবার কথা ভেবে আমি এরকম করে দিয়েছি,জোর করে মিলিয়ে দিয়েছি।যদি এরকমটা ভাবেন তাহলে এটা ভুল।আমি যেভাবে ভেবে রেখেছি সেভাবেই এগোছি।আমি কারো জন্য গল্পের থিম চেঞ্জ করিনি।আর অনেকের মনে হয়তো এখন প্রশ্ন জাগবে “তাহলে কেন স্পর্শ মেহেককে ইগনোর করতো?”তো আপনারা আরো কিছুটা ধৈর্য ধরুন,বাকিসব রহস্যও আস্তে আস্তে ক্লিয়ার করবো।)