#কাশফুলের_ভালোবাসা
#পর্বঃ২৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” হয়েছে বোন আর কান্না করিসনা।এতো কান্না করলে তো তোর চোখের জলে এখানে বড় একটা সুইমিংপুল তৈরি হয়ে যাবে।” স্পর্শ বলে।
স্পর্শের কথা শুনে মেহেক কান্না করতে করতেই হেসে দেয়।
” এই মেহু তুই আমার ভাইয়ের আদরে ভাগ বাসাচ্ছিস কেন?” কোমড়ে হাত দিয়ে বলে রিফা।
” এটা এখন আমারো ভাই।” স্পর্শের একটা হাত ধরে বলে মেহেক।
” যা নিয়ে যা,লাগবে না।” ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বলে রিফা।রিফার বাচ্চাপনা দেখে সবাই হেসে দেয়।হঠাৎই স্পর্শের চোখ পড়ে নাইরার উপর,নাইরাকে দেখে তার মুখের হাসি উবে যায়।সবাই কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে স্পর্শ সবার আড়ালে নাইরার কাছে এসে দাঁড়ায়।তার গম্ভীর গলায় বসে—
” আমাদের সম্পর্ক আজ এখানেই শেষ।আমি কোন খুনির মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা।”
স্পর্শের কথা শুনে নাইরার চোখে পানি জমে যায়।স্পর্শ একপলক নাইরার দিকে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যায়।নাইরা একদৃষ্টিতে স্পর্শের যাওয়া দিকে তাকিয়ে থাকে তবে স্পর্শ একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাই না।আসলে স্পর্শ আর নাইরার ৩ বছরের রিলেশন ছিল।তাদের একটা অনুষ্টানে দেখা হয়েছিল।এরপর মেসেঞ্জারে কথা হয় আর একজন আরেকজনকে ভালোবেসে ফেলে।তবে ১ বছর আগে স্কলারশিপ পেয়ে নাইরা সিওল চলে যায়।তবে তাদের সম্পর্ক ঠিকই ছিল।কিন্তু নাইরার বাবার সত্যিটা জানার পর স্পর্শ তা মেনে নিতে পারেনি।
” আমাকে ক্ষমা করে দিস মেহু।বাবার লালসার জন্য তুই তোর বাবা-মাকে হারালি।” মাথা নিচু করে নক্ষত্র বলে।
” তুমি কেন ক্ষমা চাইছো ভাইয়া।যা হয়েছে তা হয়ে গিয়েছে।এখন আর কিছু পালটানো যাবেনা।”
নক্ষত্র আর কিছুনা বলে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে যায়।একে একে সবাই অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যায়।মেহেক একবার তার বোনের দিকে তাকাই।মেহেকের তাকানো দেখে সৃষ্টি চোখ নামিয়ে নেয়।মেহেক কিছু না বলে নিজের রুমে চলে আসে।এতোক্ষণ দূর থেকে মেহেককে দেখছিল সৌন্দর্য।মেহেক চলে গেলে সেও তার পেছন পেছন নিজের রুমে চলে যায়।
শাড়িটাড়ি খুলে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসে মেহেক।সে এমন একটা ভাব করছে যেন কিছু হয়নি,সব নরমাল আছে।আসলে মেহেক কিছুক্ষণ আগে যা হয়েছে তা ভুলে নরমাল থাকার চেষ্টা করছে।
পড়তে পড়তে হঠাৎ মেহেকেন মনে হয় কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।মেহেক তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে তাকাই।মেহেকের পেছনে তার বোন সৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে।সৃষ্টিকে দেখে মেহেক মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।
” আপুনি,তুই এসময় এতো কষ্ট করে আসতে গেলি কেন?আমাকেই ডেকে পাঠাতে পারতি।”
” এতো কিছু হওয়ার পরেও তুই বই পড়ছিস।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সৃষ্টি।
” আপুনি তুই তো জানিসই বই পড়লে আমার স্ট্রেজ কমে।দাঁড়িয়ে আছিস কেন?বস।”
” আমি জানিনা আমি তোকে কি বলবো,তবে আমাকে ক্ষমা করেছ দিস।তোর উপর যদি আমি বিয়ের জন্য প্রেশার না দিতাম তাহলে এতোসব কিছু হতোনা।আজ যদি আদু সত্যিটা না জানাতো তাহলে হয়তো আমি তোকেও হারিয়ে ফেলতাম।” মেহেকের হাত ধরে বলে সৃষ্টি।
” চুপ কর আপুনি।যা হয়েছে তা হয়েছে।ভুলে যা ওসব।তুই এখন শুধু তোর বেবিকে নিয়ে ভাব।বুঝতে পেরেছিস।”
” হুম।চল খেতে যাবি।”
” আমার এখন ক্ষিদে নেই।তোরা খেয়ে নে।”
” বেশি কথা বলছিস।চল,আজ তোকে আমি নিজের হাতে খাইয়ে দেবো।”
মেহেককে সৃষ্টি নিয়ে যায়।খাবার টেবিলে কেউ কোন কথা বলেনা।সবাই চুপচাপ নিজের খাবার খেয়ে চলে যায়।
খাবার খেয়ে নিজের রুমে আসার মন মেহেক গিটারে টুংটাং শব্দ শুনতে পাই।মেহেক ভালো করে কান পেতে দেখে শব্দটা সৌন্দর্যের রুম থেকে আসছে।মেহেক দরজায় কান দিয়ে শব্দ হওয়ার চেষ্টা করে।হঠাৎ সে গানের শব্দ শুনতে পাই।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
” কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহ-মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না,
মোহ-মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না,
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না,
মাঝে মাঝে তব।”
মেহেক আর শোনেনা,দরজা থেকে কান সরিয়ে নিয়ে সে নিজের রুমে চলে আসে।রুমে এসে মেহেক আবারো বই খুলে বসে।হঠাৎ বইয়ের পাতায় একফোঁটা পানি পড়ে।মেহেক তাড়াতাড়ি পানির ফোঁটাটা মুছে নেয় আর নিজের চোখ মুছে একটা বড় নিশ্বাস নেয়।আসলে সৌন্দর্যের গান শুনে তার আবারো মুগ্ধের কথা মনে পড়ে গেলো।মুগ্ধও প্রায় সময় তাকে এই গানটাই শোনাতে।মেহেক দরজা বন্ধ করে এসে কাঁথা গায়ে জরিয়ে শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন সকালে,
রেডি হয়ে ভার্সিটির ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসে মেহেক।মেহেককে তৈরি দেখে সৃষ্টি প্রশ্ন করে—
” আরে কোথায় যাচ্ছিস?”
” ভার্সিটিতে।” খাবার খেতে খেতে উওর দেয় মেহেক।
” আজ না গেলে হয়না।আরো কিছুদিন পর…..”
” কেন?ভার্সিটি গ্যাপ দেবো কেন?আমার কি হাত-পা ভেঙে গিয়েছে নাকি?শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকতে আমার ভালো লাগবেনা।আর আপুনি তুই চিন্তা করিসনা যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি,তুইও ভুলে যায়।”
” এই না হলে আমার বোনু।” উপর থেকে নামতে নামতে বলে স্পর্শ। ” সবসময় এরকমই স্ট্রং থাকবি বোনু,কোন কিছুতেই ভেঙে পড়বিনা।” মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে স্পর্শ।
” হুম।আচ্ছা তোমরা বসো আমি একটা জিনিস রুমে রেখে এসেছি ওটা নিয়ে আসছি।”
মেহেক তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।সিঁড়ি দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মেহেক উপর উঠতে থাকে।সৌন্দর্য নিচে নামার সময় এই দৃশ্য দেখে।
” আস্তে,পড়ে যাবে তো।”
কিন্তু মেহেক কোন কথা না শুনে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে আসে আর দরজা বন্ধ করে দেয়।মেহেক তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিতে থাকে।অনেক্ষণ মুখে পানি দেওয়ার পর মেহেক আয়নায় থাকায়।মেহেকের পুরো মুখে পানি লেপ্টে আছে,তবে তার চোখগুলো লালবর্ণ ধারণ করেছে।ঠিক মেহেক নিজের কান্না আটকানোর জন্য মুখে পানি দিচ্ছিলো।আসলে মেহেক সবার সামনে যতটা স্বাভাবিকই দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন আসলে কাল ঘটনায় সে অনেকটা ভেঙে পড়েছে।আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে অজোরে কান্না করতে থাকে মেহেক।
ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে মেহেক,রিফা,অথৈ,সৌন্দর্য,স্পর্শ আর বাকি সবাই।সবাই কথা বলছে আর হাসিমজা করছে।মেহেকেও তাদের সাথে হালকা-পাতলা কথা বলছে।হঠাৎ লিজা বলে উঠে,
” মেহেক তোমার সাথে যা হয়েছে তা আমরা সবাই জানতে পেরেছি।আমার জেনে খুব খারাপ লেগেছে।এরকম কিছু হবে হয়তো তোমরা কখনো আশা করেনি।”
লিজার কথা শুনে সবাই কথা বন্ধ হয়ে যায় আর মেহেকের মুখ কালো মেঘে ঢেকে যায়।মেহেক মাথা নিচু করে ফেলে আর বাকি সবাই রেগে লিজার দিকে তাকাই।বিশেষ করে সৌন্দর্য।
” এভাবে সবাই তাকিয়ে আছিস কেন?খেয়ে ফেলবি নাকি।”
লিজার কথা শুনে সবার বিরক্ততে কপাল ভাজ করে।
” এই মেয়েটা কি জানেনা কখন কোথায় কি বলতে হয়।পালতু মেয়ে।কোথায় আমরা সবাই চেষ্টা করছি মেহুর মন ভালো করার কিন্তু এই মেয়েতো সব বন্ড করে দিলো।” বিরক্ত নিয়ে বলে অথৈ।
” কি করছিস অথু!আস্তে কথা বল।ওরা শুনলে খারাপভাবে।”
রিফার কথা শুনে অথৈয়ের বিরক্তবোধ আরো বেড়ে যায় আর সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।এদিকে অথৈয়ের চেহারা দেখে শান্তও বুঝে যায় অথৈ প্রচুর বিরক্ত লিজার কাজে।তবে সে কিছু বলেনা।
” লিজা তোমার কি কখনো জ্ঞান শক্তি হবেনা যে কখন কি বলতে হয়।” লিজার কানে কানে বলে আদিব।
আদিবের কথা শুনে লিজা বুঝতে পারে আদিবার তা উপর রেগে আছে বা সে বিরক্ত কারণ রাগলে বা বিরক্ত হলেই সে লিজাকে “তুমি” করে বলে।
” তুমি আমাকে এভাবে বলছো কেন?আমি কি ভুল কিছু বলেছি?যা সত্যি তাই তো বলেছি।এতে এতো রেগে যাওয়ার কি আছে?”
” আসলেই তোমার কোনদিন বোঝার শক্তি হবেনা।” বলে বিরক্ত নিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নেয় আদিব আর শান্তের সাথে কথা বলতে থাকে।আদিবের এই আচরণে লিজা প্রচুর ক্ষেপে যায়।সে উঠে চলে যেতে নিলে কেউ তার হাত ধরে তাকে আটকিয়ে নেয়।লিজা দেখে আদিবই তার হাত ধরেছে।কথার বলতে বলতেই আদিব চোখের ইশারায় লিজাকে বসতে বলে।লিজা বুঝতে পারে আদিব তার উপর প্রুচর রেগে আছে।তাই সেও আর কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে পড়ে।সৌন্দর্য,স্পর্শ,রিফা আর অথৈ মেহেকের মন ভালো করার জন্য তাকে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে।এদিকে সব চুপচাপ দেখছে মহুয়া।সে কঠিন মুখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে,বিশেষ করে মেহেকের দিকে।তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে কি ভাবছে।
চলবে……