কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -৪

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী

জাবেদ সন্ধ্যার পর বাসায় আসলে, কেউ তাকে বাহির থেকে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। জাবেদ বাইরে এসে দেখল ঐ পাড়ার শাহজাহান আলী।
জাবেদ তাকে সালাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে। উঠানের একপাশে পেতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে তাকে বসতে দেয় জাবেদ।

কান্তা নিজের ঘর থেকেই বুঝতে পারছিল উঠানে বড় ভাইয়া কারও সাথে কথা বলছে।
এমন সময় জাবেদ কান্তাকে ডাক দেয়।
কান্তা ডাক শুনে বাইরে এসে দেখল, ওর সেই বান্ধবীর বাবা এসেছে। যে বান্ধবীর বাড়িতে ও মাঝেমধ্যেই যায়।
কান্তা শাহজাহান আলীকে সালাম জানিয়ে রান্নাঘরে যায়।

রাতে জাবেদ আর শিখা মিলে কান্তার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করছে।
শাহজাহান আলী কান্তার বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছিল। ছেলের পরিবারের লোকজন কান্তার ছবি দেখেই পছন্দ করেছে। ছেলেও রাজি।

” শোন আমার মনে হচ্ছে তোমার এখানে আপত্তি করা উচিত হবেনা। তোমার ছোট ভাই নিজের কাঁধে এই বোঝা টানতে চায়না। আর আমরাই বা কতদিন একে পালব? ধীরে ধীরে আমাদের সংসারও বড় হবে, তখন তুমি এতকিছু সামাল দিবে কেমন করে? আর যেহেতু ছেলে পক্ষের কোন দাবিদাওয়া নেই, তাই আমার মনে হয় এখানে বিয়ে দেয়াই ঠিক হবে। ”

” তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে একটামাত্র বোনের বিয়ে দিব, ছেলের কিংবা তার পরিবার সম্পর্কে কোন খোঁজ না নিয়েই সামনে এগোব এটা কেমন যেন লাগছে। ”

” রাখো তোমার ভাবাভাবি। এমন সুযোগ আর যদি না পাও? তাছাড়া শুনলাম ছেলেও শিক্ষিত। ভালো চাকরি করে। তোমার বোনের সাত কপালের ভাগ্য, এমন ছেলে পাবে। চেহারার তো ঐ ছিড়ি। কোন ভাগ্যে যে এরা পছন্দ করেছে, এতে আলহামদুলিল্লাহ বল। তুমি আর অমত করোনা। তোমার ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বল। সে-তো বোনের কোন দ্বায়িত্বই পালন করলনা। বোনের বিয়েতে অন্তত তোমার সাথে হাত মিলাক। জাহিদের কাছে আজই ফোন করে সবটা জানাও। এরপর ছেলেপক্ষকে আসতে বল। ” শিখা সাতপাঁচ নানান বুঝ দিয়ে জাবেদকে রাজি করায়। সে চাচ্ছে কান্তাকে যত দ্রুত পারে বাড়ি থেকে বিদায় করতে।

জাবেদ তার ছোট ভাই জাহিদকে ফোন করে কান্তার বিয়ের বিষয়ে আলাপ করে। সব শুনে জাহিদ বড় ভাইকে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে বলে। তার ছুটি নেই তাই সে আসতে পারবেনা। তবে বিয়েতে কিছু টাকাপয়সা সে দিতে চেয়েছে।

চারদিন পর বিকেলে কান্তা বারান্দায় বসে কয়েকজনকে পড়াচ্ছে, এমন সময় শাহজাহান আলীর সাথে দুইজন ভদ্রলোক বাড়িতে প্রবেশ করে। সাথে ওর ভাই জাবেদও আছে।

জাবেদ তাদের নিয়ে বড় মাটির ঘরটায় নিয়ে যায়।
একটু পর শিখা এসে কান্তাকে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলে। কান্তা কলের পুতুলের ন্যায় শিখার হুকুম পালন করে।

মাটির ঘরের একপাশে শাল কাঠের খাট, কয়েকটা কাঠের চেয়ার একটা টেবিল আর অনেক আগের একটা শাল কাঠের নক্সাকরা আলমারি এবং একটা পুরোনো আমলের ড্রেসিংটেবিল রাখা আছে। কান্তা ওর মায়ের কাছে শুনেছে এই খাট আর আলমারি, ড্রেসিংটেবিল ওর দাদার আমলের। এটা নাকি ওর দাদার ঘর ছিল। কান্তার দাদা – দাদি মারা যাবার পর থেকে এই ঘর কেউ ব্যবহার করেনা। আগে কান্তার মা নিয়মিত পরিষ্কার করত, এখন কান্তা পরিষ্কার করে। কোন আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসলে তাদের এই ঘরে থাকতে দেয়া হয়।

শিখা কান্তাকে নিয়ে বড় মাটির ঘরে প্রবেশ করে। কান্তার মাথায় ঢুকছেনা, হঠাৎ বড় ভাবি ওকে এখানে কেন নিয়ে আসল।
ঘরে ঢুকেই কান্তা সবাইকে সালাম দেয়। ওর মন মস্তিষ্কে তখনও হাজার প্রশ্নের আনাগোনা।

মেহমানরা বিদায় নেয়ার পরই কান্তা জানতে পারে তাকে দেখতে এসেছিল। কান্তা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটাবারও তাকে কেউ কিছুই জানালনা!
বেঁকে বসে কান্তা। ভাইকে জানায় এখন সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা। যাদের সে জানেনা, চিনেনা, এর আগে কখনোই দেখেনি, এমন মানুষকে সে কখনোই বিয়ে করবেনা।
কান্তার কথা শুনেই শিখা চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে। মুখে হাজার গা’লি’র তুবড়ি ছুটিয়ে কান্তাকে নিষ্পেষিত করছে। তার একটাই কথা এ বিয়ে কান্তাকে করতেই হবে। কান্তা না চাইলেও ধরে বেঁ’ধে এই বিয়ে দিয়েই ছাড়বে সে৷

কান্তা কোন উপায় না দেখে ছোট ভাইকে ফোন করে সব জানায়। ওর বিশ্বাস ছোট ভাই অন্তত ওকে বুঝবে। কিন্তু ছোট ভাইও ওকে নিরাশ করে। সে জানায় তারা সবাই চায় এই বিয়েটা হোক।

বাধ্য হয়ে কান্তা ছুটে যায় ওর বান্ধবীর বাড়িতে। ওর বান্ধবী শায়লাকে সব কিছু খুলে বলে।
শায়লা সব শুনে ওর খালার কাছে ফোন করে ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চায়। শায়লার খালা সবকিছু জানায় শায়লাকে। সেই সাথে এ-ও জানায়, ছেলে খুব ভালো, ভদ্র এবং শিক্ষিত।
শায়লা খালার কাছে শোনা কথাগুলোই কান্তাকে বলে। তবুও কান্তা নিশ্চিন্ত হতে পারেনা।
শায়লার মা কান্তাকে কাছে ডেকে ওকে বুঝিয়ে বলে। তিনিও কান্তাকে জানান ছেলে ও ছেলের পরিবার সম্পর্কে।
বিমর্ষ মনে কান্তা বাড়িতে ফিরে। কেউই ওর কথা শুনছেনা। ওকে তাড়াতে পারলেই সবাই বাঁচে একথা বেশ বুঝতে পারছে।

কয়েকদিন অক্লান্ত চেষ্টা করেও ভাই-ভাবিদের বোঝাতে ব্যর্থ হয় কান্তা। সবাই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
কি আশ্চর্য! ওর নাকি আর পাঁচদিন পরই বিয়ে! কিন্তু ওকে কেউ কিছুই জানায়নি!
নিজের ভাইদের কাছে এতটা বোঝা হয়ে গেছে তা আজ বুঝতে পারছে সে।
এভাবে নিজের মায়ের পেটের ভাইরাও যে পর হয়ে যায়, তা এদের না দেখলে বুঝতে পারতনা কান্তা।

মাঝরাত, আকাশে থালার মত চাঁদ নিজেকে উজার করে ধরনীকে শোভিত করছে।
ঝিরিঝিরি হাওয়ার মিষ্টি স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। চাঁদ ও হাওয়ার পরশে গরবিনী ধরনীও নিজের রুপ বিলাতে ব্যস্ত। গাছ, রাতচোরা পাখি, হাওয়া আর চাঁদের আলোর মাখামাখি সৌন্দর্যও কান্তার মনকে ছুঁতে পারেনা।
এক দুঃখিনী কন্যা, যে ছোটবেলা থেকেই বাবার ভালোবাসা পায়নি। আবার কৈশোরে পা দিতেই মা-ও ফাঁকি দিল। তারপর থেকে শুরু হল সংসারের ঘানি টানা। নিজের হাতে এতবড় সংসারকে আগলে রেখেছে। ভাইদের কাছে তখনও তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল। তারাও ভালোবাসত তাদের বোনকে। প্রয়োজনিয় সবকিছুই না চাইতেও পেয়ে যেত। তিন ভাই-বোন মিলে সুখের সংসার ছিল। কিন্তু এরপর বড় ভাবির সংসারে আগমন। সেদিন থেকেই ওর সকল সুখ ঘুচেছে। বড় ভাবির সংসারে সে উচ্ছিষ্টে পরিনত হয়েছে । এরমাঝেই ছোট ভাই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছে। ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। নিজে নিজে বিয়েও করল। বড় ভাবি আসার পর এই ছোট ভাইয়ের থেকে ভালোবাসা পেয়ে সকল কষ্ট ভুলে থাকত। কিন্তু ছোট ভাবি তা মানতে পারলনা। ধীরে ধীরে ভাই-বোনের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকে। একসময় ছোট ভাইও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কান্তা ফোন করলেই তবে কথা বলে। কিন্তু কয়েকটা কথা বলার পরেই ফোন কেটে দেয়। ওরা মনে করে, কথা বললেই বুঝি ওদের বোন টাকা চাইবে। তাই ইনিয়েবিনিয়ে নিজের দুরাবস্থার কথা বোনকে শোনায়। একসময় কান্তাও ছোট ভাইয়ের সাথে যোগ্যতা কমিয়ে দেয়। নিজেই টুকটাক টিউশনি শুরু করে। আস্তে আস্তে ছাত্র-ছাত্রী বাড়তে থাকে। কান্তার আর ভাইদের আশায় থাকতে হয়না। প্রয়োজনীয় সকল কিছুই নিজের উপার্জনের অর্থে কিনতে পারে। আবার পড়াশোনার খরচটাও হয়ে যায়।
আজ রাতে কত কথাই মনে পরছে কান্তার। এক জীবনে কম কষ্ট সইতে হলোনা। কত অপমান, অসম্মান, ভাবির হাতের মা-র, আরও কত কিছুই সইল। না জানি সামনে আরও কতকিছুই অপেক্ষা করছে। যে মেয়ে বাবার বাড়িতেই অবহেলিত, সে স্বামীর বাড়িতে মর্যাদায় থাকবে এটা ভাবা বোকামি।
ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরতে থাকে কান্তার দু-চোখ বেয়ে। এই অশ্রুই ওর সকল দুঃখের সঙ্গী।

আজ কান্তার বিয়ে। কিন্তু বাড়িতে তেমন কোন আয়োজন নেই, নেই কোন সানাইয়ের সুর। কেউ হলুদ, মেহেদি বাটছেনা। কান্তা নিজে নিজেই গোসল সেরে নিজের ঘরে এসে শুয়ে থাকে।

দুপুরের দিকে হুড়মুড় করে একটা মেয়ে ঢোকে কান্তার ঘরে। পেছন পেছন ঢোকে আরও একটা মেয়ে। ওদের হাতে দুটো ন্যাপসাক।

কান্তার একটু ঝিমুনি এসেছিল। মেয়ে দুইটা কান্তাকে টেনে তুলে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দেয়। কান্তা চুপচাপ ওদের কথা মেনে নিয়ে কলপাড়ে যায়।

কলপাড় থেকে ঘরে এসে কান্তা দেখল এলাহী কান্ডকারখানা। মেয়ে দুইজন ন্যাপসাক খুলে সকল জিনিসপত্র বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। কান্তা ঘরে ঢুকতেই ওরা কান্তার হাতে ব্লাউজ, পেটিকোট তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কান্তা ব্লাউজ, পেটিকোট পরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর ওর বড্ড অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে কিন্তু কান্তা দরজা খুলছেনা। একসময় সেই মেয়েরা দরজায় টোকা দেয়। কান্তা দরজা খুলে দিলে ওরা এসে কান্তাকে শাড়ি পরাতে শুরু করে।

মেয়েরা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কান্তাকে সাজায়। তবে কান্তার চুল বাঁধতে গিয়ে একটা মেয়ে চমকে উঠে। কান্তাকে জিজ্ঞেস করে, চুল ছোট কেন?
কান্তা জবাব না দিয়ে কাঁদতে থাকে।
মেয়েটাও আর ওকে ঘাঁটায়না।

কিভাবে নিজের বিয়ে হয়ে গেল কান্তা বুঝতেই পারলনা। বিয়ে পড়ানোর সময় জানতে পারে, ওর স্বামীর নাম ‘ আরমান আহমেদ ‘।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here