কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -৭

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী

সেই কাক ডাকা ভোরে কান্তার ঘুম ভাঙ্গলে, ফজরের নামাজ আদায় করে, বারান্দায় এসে বই নিয়ে বসে।
কিছুক্ষণ পড়ার পর পড়ায় আর মনযোগ দিতে পারেনা। ওর মন রান্নাঘরে পরে আছে।
আরমান ভার্সিটি যাবে, কি রান্না হবে, সেই চিন্তাই করছে কান্তা। গত রাতের পর থেকেই চিন্তা জেঁকে বসেছে কান্তার মনে। রাতে যখন দেখল খাবার টেবিলে আরমানের জন্য কোন খাবার ছিলনা, তখন থেকেই কান্তার মনে হচ্ছে মানুষটা বড্ড একা। তার যত্ন নেয়ার কেউ নেই।

সকাল সাড়ে সাতটায় আরমান ঘুম থেকে উঠে দেখল কান্তা রুমে পায়চারী করছে৷ ওর চোখেমুখে উদ্বিগ্ন ভাব আরমানের নজর এড়ায়না।

” এই যে চিন্তাবতী, একরাত পড়াশোনা করেই কি মাথা হ্যাং হয়ে গেছে? বাপরে ছাত্রী! রাত একটায় তাকে রুমে ডেকে নিয়ে আসতে হয়! কিন্তু সকাল হতেই সে আবার মাথার জ্যাম কা’টা’তে দুইশো মাইল স্পিডে হাঁটছে! ”

আরমানের কথার কি জবাব দিবে তা কান্তা ভেবে পায়না। তাই ও কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
আরমানও সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে।
কান্তা এবার রান্নাঘরের দিকে যায়।
কিন্তু সেখানে যেয়ে ওকে অবাক হতে হয়। কোন রান্নাই হয়নি এখনও! এদিকে একটু পর আরমান ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে যাবে।
কান্তা কাজের খালাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, আকলিমা খানম হুকুম দিলেই তবে সে রান্না শুরু করবে। কারন তাদের খেতে খেতে একটু বেলা হয়। এখন রান্না করলে খাওয়ার সময় সেগুলো ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই সে প্রতিদিন দেরি করে রান্না করে।

কান্তা কাজের খালার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মানুষটা খালি পেটে বাড়ি থেকে বের হবে!
ততক্ষণে আরমান পরিপাটি হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে।
শহিদ আহমেদ সোফায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন। ছেলেকে বের হতে দেখে কপাল কুঁচকে তাকান।

” তুমি এখনই বের হচ্ছ? আরেকটু পর বের হলে অন্তত খেয়ে যেতে পারতে। শেষ কবে পরিবারের সবার সাথে খেয়েছ, তা মনে পরে? যাই হোক সকাল বেলা না খেয়ে বের হওয়া ঠিক নয়। ”

” না খেয়ে বের হওয়া ঠিক নয়, এটা আমিও জানি। কিন্তু এখন অলরেডি সকাল আটটা বাজে। ভার্সিটি পৌঁছাতে আমার পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। এখন যদি পরিবারের সবার সাথে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি, তবে আমার আজকের প্রথম ক্লাস মিস হয়ে যাবে। কারন নয়টায় আমার প্রথম ক্লাস নিতে হবে। আমার জন্য এত চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবেননা। আমি আবার এত চিন্তায় অভ্যস্ত নই। ” আরমান এদিক-ওদিক তাকিয়ে কান্তাকে খুঁজছে। মেয়েটাকে রান্নাঘরের দরজায় মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু হেসে বিদায় নেয়।

সেইদিন আর কান্তার খাওয়া হলনা৷ সারাটাদিন আরমানের চিন্তায় অস্থির থাকে। শ্রীজা ভার্সিটি যাওয়ার আগে কান্তাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছে। কিন্তু কান্তা ওকে মানা করে দেয়। মুখের সামনে বই নিয়ে বসে থাকলেও পড়ায় মনযোগ দিতে পারেনা। বারবার ওর মনে হচ্ছে মানুষটা সারাদিন না খেয়ে থাকবে।
দুপুরের পর কান্তা রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে আসে। সেখানে কাজের খালা টুকটাক কাজ করছে। সবাই যে যার মত খেয়ে নিজেদের রুমে আছে।
কান্তা খালার কাছে এসে বসে।

” ওমা, নতুন বউ, আপ্নের কিছু লাগব, আম্মা? দুফুরে তো কিছু খাইলাইনওনা। এম্নে না খাইলে শরিল টিকব? কি খাবাইন কইন, আমি কইরা দিতাছি। ” খালা উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

” আমি কিছু খাবনা, খালা। আমার ক্ষুধা পায়নি।আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি আমার মায়ের বয়সী, আমাকে আপনি করে বললে খারাপ লাগবে। আচ্ছা খালা, আপনি এই বাড়িতে কতদিন ধরে কাজ করেন? ”

” আইচ্ছা আম্মা। আমি তুমি কইরাই কমু। আমি এই বাইত্তে পেরায় বিশ বছর ধইরা আছি গো, আম্মা। আমার যহন পঁচিশ বছর বয়স, স্বামী ফালাইয়া গেলগা। তহন তোমার শ্বশুর এই বাইত্তে আমারে আনছে। তহন থাইকাই আমি এইহানে। ”

কান্তা খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে বয়সে তার স্বামীর ঘরে থাকার কথা, সেই বয়স থেকেই অন্যের বাড়িতে কাটছে তার জীবন। হায়রে নারীজন্ম! কোথাও একদণ্ড শান্তি নেই, সম্মান নেই।

” আপনার ছেলে-মেয়ে নেই, খালা? ”

” দুইডা পোলা হইছিল গো, আম্মা। কিন্তু ম’ই’রা গেল। পরে আর হইলনা। হের লাইগাই জামাই আরেকটা বিয়া কইরা, বউ নিয়া নিরুদ্দেশ হইল। ” খালার চোখে পানি। বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।

কান্তা কি বলবে ভেবে পায়না। বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ওর মত কত দুঃখিনীর বাস এই দুনিয়ায়!

” তয় তুমি খুব ভালো গো, আম্মা। এক্কেরে আমার বাপজানের লাহানই। বাপজান আমারে খুব ভালো পায়। আমি যহন এই বাইত্তে আসি, বাপজানের বয়স তহন আট কি নয় বছর। আমি কতদিন তারে মুখে তুইলা খাওয়ায় দিছি। হেয় সুযোগ পাইলেই আমার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ” খালা যেন ফিরে গেছে সেই দিনগুলোতে।

” আচ্ছা, খালা তিনি কি প্রতিদিনই না খেয়ে বেরিয়ে যান? ” সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” আইজ যেম্নে দেখলেন, এম্নেই হেয় প্রতিদিনই যায়গা। রাতে আইসা একবারে খায়। তয় আইজ রাইতে হের আইতে দেরি হইব। রাইত দশটার পর আইব। পোলাডার খাটুনি হয় খুব, কিন্তু হেয় তুলনায় খাওন হয়না। ”

কান্তা বুঝতে পারে আজ আরমানের কোচিংএ পরীক্ষা আছে, তাই তার ফিরতে রাত হবে।

” খালা, আমার শ্বাশুড়ি তো জানে, তার ছেলে সকালেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তাও কেন সকালে আপনাকে রান্না করতে নিষেধ করে? তার ছেলে না খেয়ে বাইরে যায়, এতে তার খারাপ লাগেনা? ” কান্তা প্রশ্নটা করেই ফেলে৷

খালা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। এরপর কথা বলে।

” তুমি সব জানতে পারবে গো, আম্মা। বাপজানই তোমাকে সব কইব। ইক্টু ধৈর্য্য ধর। তয় আর যাইহোক তুমি আমার বাপজানরে রাইখা কোথাও যাইওনা কইলাম। তার যত্ন কইরো। ”

” আমি সকল অবস্থায়ই তার পাশে থাকব, খালা। তাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ”

আরও কিছুক্ষণ খালার সাথে কথা বলে নিজের রুমে আসে কান্তা।
ও সারাদিন কি খেয়েছে না খেয়েছে তার খোঁজ কেউই নেয়নি। শ্রীজা সেই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছে, ওর আসতে সন্ধ্যা হবে। কান্তার শ্বাশুড়ি কিংবা দাদি শ্বাশুড়ি কেউই ওর খোঁজ নেয়নি। কান্তা এ বাড়ির মানুষদের যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।

শ্রীজা বাসায় আসার পর বেশ কিছু সময় কান্তার সাথে কাটায়। এরপর নিজের রুমে যায়। কয়দিন পর ওর পরীক্ষা, তাই ইচ্ছে থাকলেও কান্তাকে সময় দিতে পারছেনা।

এ বাড়িতে নিয়ম রাত নয়টার মধ্যেই রাতের খাবার খায়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। সবাই যে যার মত খেতে বসেছে। শহিদ আহমেদ কয়েকবার কান্তাকে ডেকেছেন একসাথে খাবেন বলে। কিন্তু কান্তা সসম্মানে তাকে জানিয়ে দিয়েছে এখন খাবেনা। আরমান যেখানে সারাদিন না খেয়ে কাটাচ্ছে, সেখানে কান্তা কখনোই খেতে পারবেনা।
কান্তা একটা কথাই ভাবছে, বিয়ের মাত্র তিনদিনেই কারও প্রতি এতটা মায়া কিভাবে জন্মাতে পারে!

রাত সাড়ে নয়টা।
সবার খাওয়া শেষ হলে, কান্তা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
সোজা ডাইনিং টেবিলে এসে দেখল ওদের জন্য খাবার আছে কি না। ডাইনিং টেবিলে কিছু না পেয়ে রান্নাঘরে যায়। সেখানেও খুঁজে কোন খাবার পাওয়া গেলনা।
কান্তা সিদ্ধান্ত নেয় আজ ভাত রান্না করবে। কারন সারাদিন পর হয়তো রুটি খেতে আরমানের ভালো লাগবেনা।
ঝটপট চাল ধুয়ে রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দেয়। এরপর ফ্রিজ থেকে মাছের প্যাকেট বের করে পানিতে ভিজিয়ে রেখে, সবজি কা’ট’তে শুরু করে। আজ ও আলু, পটল দিয়ে বড় মাছের ঝোল করবে আর পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে শুঁটকি ভুনা করবে। ভাগ্যিস দুপুরে খালার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল আরমান কি খেতে পছন্দ করে।

সবজি কে’টে, ধুয়ে, মাছ ধুয়ে চুলায় কড়াইয়ে মসলা কষাতেই রান্নাঘরে এসে হাজির হয় আকলিমা খানম।

” এই মেয়ে, এসব কি করছ তুমি? এখন রান্নাঘরে এসেছ কার হুকুমে? তোমার সাহস তো কম নয়! ”

” আম্মা, আপনার ছেলে সকালে না খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে। হয়তো সারাদিন না খেয়েই আছে। আমি খুঁজে দেখলাম তার জন্য কোন খাবার রাখা হয়নি। তাই তার জন্য রান্না করছি। ” কান্তা কোন ভনিতা ছাড়াই উত্তর দেয়।

” আরমান আজ না খেয়ে বাইরে গেছে, এটা নতুন কিছু নয়। ও সব সময়ই এটা করে। সেজন্য ওর জন্য রান্না করতে হবে? ও বাইরে থেকে খেয়ে আসবে। তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! তুমি আমাকে না জিজ্ঞেস করেই রান্নাঘরে ঢুকেছ? ” আকলিমা খানম ঝাঁঝের সাথে বলে।

” এতদিন তার বউ ছিলনা, তাই সে বাহির থেকে খেয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তার খোঁজ রাখার জন্য বউ এসেছে। সে কি খাবে, কোথায় খাবে সে চিন্তা তার বউয়ের। আজ থেকে সে বাসায় খাবে। তার জন্য রান্না আমি করব। আর আমি যতদূর জানি প্রত্যেক বউয়েরই তার স্বামীর বাড়িতে পূর্ণ অধিকার আছে। সেই অধিকার বলে আমি রান্নাঘরে এসেছি। এটাতে সাহসের কিছু আমি দেখছিনা। ” কান্তা কাজ করতে করতে উত্তর দেয়।

” আকলিমা, আমি তোকে বলেছিলাম, যে কোন হাভাতে ঘরের মেয়েকে এ বাসায় আনিসনা। কিন্তু তুই আমার কথা শুনিসনি। তুই বললি, এতিম মেয়েরা ভালো হয়, তাদেরকে যা বলা যায় তাই শোনে। কিন্তু এই এতিমের অবস্থা তুই দেখলিতো? চাপার জোর কত দেখলি? এ বাসায় আসতে না আসতেই তোর সাথে গলাবাজি করছে! ” আকলিমা খানমের পেছনে যে দাদিমা দাঁড়িয়ে ছিল তা কান্তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ দাদিমার কথা শুনে একটু চমকে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এই তিনদিনে কান্তা এতটুকু বুঝেছে, এই বাসায় থাকতে হলে লড়াই করেই থাকতে হবে। কেউ ওকে অধিকার দিতে চাইবেনা, বরং অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে।

” আমি কোন হাভাতে ঘরের মেয়ে নই, দাদিমা। আমার বাবারও সম্পত্তি, বাড়িঘর সবই আছে। আর এতিম হয়েছি বলেই কি সত্যি কথা বলতে মানা আছে? জানেনতো আমার মুখটা একটু বেশিই চলে। আর যেখানে নিজের অধিকারের ব্যপারস্যাপার আছে সেখানে আরেকটু বেশি চলে৷ তাই অযথা আমাকে ঘাঁটাবেননা। উচিত কথা শুনতে আপনাদেরও ভালো লাগবেনা আবার আমি না বলেও থাকতে পারবনা। ” আর কিছু না বলে কান্তা নিজের কাজে মন দেয়।
এদিকে আকলিমা আর দাদিমা সুবিধা করতে না পেরে গজগজ করতে করতে ড্রয়িং রুমে যেয়ে বসে।

তরকারি বসিয়ে দিয়ে কান্তা শুটকির জন্য পেঁয়াজ, রসুন কা’ট’তে শুরু করে। তরকারি রান্না শেষ হতে হতে ওর পেঁয়াজ, রসুন কা’টা’ও শেষ হয়। এরপর শুটকির তরকারি চুলায় বসায়।

আরমান বাসায় ফিরে সাড়ে দশটায়। কান্তা ওর জন্য ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিল। অবশ্য শ্রীজাও ওর সাথে ছিল।
আরমান বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে যায়। শ্রীজা কান্তাকে বলে নিজের রুমে চলে যায়।

আরমান রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে। কান্তা ভেতরে এসে দেখল আরমান সেখানে নেই। এরপর সে ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পায়। বুঝতে পারে আরমান সেখানে আছে।
হঠাৎ কান্তা দেখল ড্রেসিংটেবিলের ওপর দুইটা প্যাকেট রাখা। ও এগিয়ে যেয়ে প্যাকেট হাতে নিয়েই বুঝতে পারে সেগুলোতে খাবার আছে। প্যাকেটগুলো যেখানে ছিল সেখানেই রেখে বাইরে যায়।

আরমান গোসল সেরে বেরিয়ে এসে দেখল কান্তা টি টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু খাবার থেকে মাছ আর শুটকির গন্ধ আসছে। কিন্তু ও-তো মাংস আর পোলাও এনেছে!

আরমান টি টেবিলের সামনে এসে দেখল সত্যিই মাছের ঝোল আর শুটকি ভুনা। ও অবাক চোখে তাকায় কান্তার দিকে।

” এভাবে তাকিয়ে থাকলে পেট ভরবে? বসুন, খেয়ে নিন। ” কান্তা ভাবলেশহীন ভাবে বলে।

” তুমি রান্না করেছ? আমি বোধহয় বলেছিলাম, যেদিন কিছু খেতে করবে, সেদিন আমাকে বলবে। আমি সবকিছু এনে দিব। আর আমার যেদিন আসতে দেরি হবে, সেদিন আমি রান্নাঘরে বসব আর তুমি রান্না করবে? কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলেনা! তুমি যে রান্না করেছে, কেউ কিছু বলেনি? ”

” আপনাকে বাড়ির টুকিটাকি বিষয়ে নাক গলাতে হবেনা। কেউ কিছু বললে সেটা আমি বুঝে নিব। এখন খেয়ে নিন। আর আজকের পর থেকে খাবার কিনে আনবেননা। সারাদিন পর এসব বাইরের তৈলাক্ত খাবার খাবেন! শরীর টিকবে এতে! প্যাকেটগুলো ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। কাল ওগুলোর ব্যবস্থা করব। আর কথা না বলে বসে পরুন। ”

অনেকদিন পর আরমান পেটপুরে খায়। শেষ কবে কেউ ওকে এভাবে যত্ন করে খাইয়েছে তা মনে পরেনা।
আরমানের সাথে কান্তাকেও খেতে হয়। কান্তা চেয়েছিল পরে খেতে। কিন্তু আরমান নিজের সাথে কান্তাকে খেতে বাধ্য করেছে।

কিছুক্ষণ রেষ্ট নেয়ার পর কান্তাকে ডেকে নিয়ে পড়তে বলে আরমান। ও আজ থেকে কান্তাকে পড়াবে।
কান্তা যেটুকু সময় পড়েছে, মনোযোগ দিয়ে পড়েছে।
আরমান ওকে পড়তে দিয়ে ভার্সিটির কাজ সেরেছে।

সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে কান্তা কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে। খানিকক্ষণ পড়ার পর রান্নাঘরে আসে।
এরপর একে একে চারটা পরোটা, ডিম ভাজি, আলু ভাজি করে। এরপর সে ভাত বসিয়ে দেয়৷ তারপর রুই মাছের দোপেয়াজা, করলা-আলু ভাজি করে, খালার কাছ থেকে টিফিনবাক্স চেয়ে নেয়। সেগুলো টিফিনবাক্সে সযতনে তুলে রাখে। ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাতটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। কান্তা ঝটপট একটা প্লেটে পরোটা, আলু ভাজি, ডিম ভাজা নিয়ে নিজের রুমে আসে। আরমান তখন রেডি হচ্ছিল।
কান্তা রুমে এসে পরোটার প্লেট টি টেবিলে রেখে আরমানকে খেতে ডাকে।

” তারাতারি আসুন। পরোটা বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেল। ”

” তুমি এসব কি শুরু করেছ! এসব করতে যেয়ে পড়াশোনা শিকেয় তুলবে দেখছি! সকালে খেতে আমার ভালো লাগেনা। তুমি এসব আর করোনা।”

” আপনি কথা না বলে খেয়ে নিন। আর আমি পড়াশোনার পাশাপাশি এসব করে অভ্যস্ত। ভালো না লাগলেও আপনাকে এখন থেকে সকালে খেয়ে যেতেই হবে। এ নিয়ে আপনার কোন কথা আমি শুনবনা। ”

আরমান আর তর্ক না করে খেতে বসে। ও দুইটা পরোটা নিয়ে কান্তাকে দুইটা পরোটা দেয়।

” আমি এখন খাবনা। আপনি খেয়ে নিন। আমি সবার সাথে বসে খেয়ে নিব। ”

” সবাই যে তোমাকে খেতে ডাকবেনা, এটা তুমি খুব ভালো করেই জান। তাই বেশি কথা না বলে খেয়ে নাও। প্রতিদিন যদি আমাকে এভাবে খেতে হয়, তবে তোমাকেও আমার সাথে খেতে হবে। এ কোন কথা শুনতে চাইনা। ”

কান্তা বুঝল এই মানুষের সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। তাই চুপচাপ তার নির্দেশ পালন করে।

খাওয়া শেষে আরমান ভার্সিটির জন্য বের হয়। ড্রয়িং রুমে প্রতিদিনের ন্যায় শহিদ আহমেদ বসে পত্রিকা পড়ছেন। দাদিমা আর আকলিমা বসে বসে চা, নাস্তা খাচ্ছেন। আরমান তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে আসতেই, কান্তা তাকে ডেকে টিফিনবাক্স ধরিয়ে দেয়৷
কান্তার এমন কান্ডে আরমান তব্দা খেয়ে যায়।

” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন! আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো৷ আজ থেকে প্রতিদিন খাবার নিয়ে যাবেন। ভার্সিটিতে না পারলে কোচিং-এ যেয়ে খেয়ে নিবেন। ”

” আর যাই কর এটা করনা। আমি এটা ভার্সিটিতে নিতে পারবনা। স্টুডেন্টরা আমাকে খেপিয়ে মা’র’বে। তাছাড়া সকালে খেয়েই যাচ্ছি, দুপুরে না খেলেও চলবে। ”

” ভার্সিটিতে না নিতে চাইলে নিবেননা। আমি শুনেছি ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে কোচিং পরে। কোচিং-এ টিফিনবাক্স রেখে তারপর ভার্সিটিতে যাবেন। এতে আপনার সম্মানের দফারফাও হলোনা আবার পেটও ভরল। ”

ওদের দুজনের কথপোকথন ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলে শুনছে, সে খেয়াল ওদের নেই।
কান্তা জোর করে আরমানের হাতে টিফিনবাক্স ধরিয়ে দেয়। বেচারা কাঁচুমাচু মুখে সেটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here