#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী
পরদিন সকালে খাবার পর আরমান নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে।
কান্তা সব গোছগাছ করে রুমে আসে।
” এইযে মেয়ে, শুনছ? তারাতারি করে তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব। ”
” কোন কাজ আছে? হঠাৎ বাইরে যেতে চাচ্ছেন যে! ”
” আগামী একমাস অথবা দুইমাসের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। আমি কবে আসতে পারব, তা এখনই বলতে পারছিনা। যা যা লাগবে তার একটা লিষ্ট কর। কোন কিছু যেন বাদ না যায়। কোন অযুহাতে বাইরে যাওয়া চলবেনা। ”
কান্তা দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষ বলছে কি! বাইরে যাওয়ার জন্য আমি অযুহাত দিব!
ও কিছু না বলে লিষ্ট করতে থাকে।
এগারোটার দিকে ওরা দুজন বাইরে বের হয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু কেনাকাটা করে। কেনাকাটা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে যায়। তখনও ওদের খাওয়া হয়নি। ওদের সাথে শ্রীজাও আছে। বেচারি ক্ষুধায় নড়তে পারছেনা।
” ভাইয়া, এভাবে আর কতক্ষণ না খাইয়ে রাখবে? তুমি এত কিপ্টুস কেন! এতবড় পোস্টে জব পেয়েছ, তবুও এত কিপ্টামি! ”
” আগে সব বোঁচকা বুঁচকি গাড়িতে তুলতে হবে। তারপর খাওয়ার চিন্তা করিস। এত খাইখাই না করে কাজ কর। ” আরমানের ধমকে মুখ কালো করে শ্রীজা।
আরমান বাইরে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করেছিল। ড্রাইভারের সহযোগিতায় ওরা জিনিসপত্র সব গাড়িতে তোলে। এরপর রেস্টুরেন্টে ঢোকে। আরমান প্রথমেই ড্রাইভারের জন্য খাবার প্যাক করে, তাকে গাড়িতে দিয়ে আসে।
খাওয়া শেষ করে শ্রীজা গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে।
আসলে ও চাচ্ছে ভাই-ভাবী কিছুক্ষণ নিজেদের মত সময় কাটাক।
ওরা দু’জন সারা বিকেল এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। একটু পরই মাগরিবের আজান দিবে। কান্তা বাসায় যাওয়ার জন্য আরমানকে তাড়া দেয়।
আরমান একটা রিক্সা ডাক দেয়। ওরা রিক্সায় উঠতে যাবে, ঠিক তখনই কান্তার চোখ যায় রাস্তা পার হয়ে এপারে আসা এক ব্যক্তির দিকে।
কান্তার মনে হচ্ছে সে ঐ ব্যক্তিকে চেনে। তাকে কোথাও দেখেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেনা। এদিকে ঐ ব্যক্তি রাস্তা পার হয়ে এদিকেই আসছে।
” কি ব্যাপার, তুমি এমন স্থির হয়ে গেলে কেন? একটু আগেই তো বাসায় যাওয়ার জন্য লাফালাফি করছিলে। ”
” ঐ যে ঐ ভদ্রলোককে দেখছেন? অ্যাশ কালার শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা মাঝবয়সী উনি। তাকে মনে হয় আমি কোথাও দেখেছি। ” কান্তা আঙ্গুল দিয়ে সেই ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেয়।
” এতে এমন উত্তেজিত হওয়ার কি হয়েছে! তাকে দেখতেই পার। কোচিং-এ যাওয়ার পথে হয়তো তাকে দেখেছ। এবার রিক্সায় ওঠ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
আরমান তাড়া দিলে কান্তা রিক্সায় ওঠে। কিন্তু ও সামনের ভদ্রলোকের কথা চিন্তা করছে।
রিক্সাওয়ালা সবেমাত্র প্যাডেল চালিয়েছে তখনই কান্তার কথা বলে।
” চাচা, রিক্সা থামান। শুনুন আমি উনাকে চিন্তে পেরেছি। আপনাকে বলেছিলামনা, একজনকে দাদিমা অপমান করেছিল। সেই মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়েছিল? ইনিই সেই। ”
” কার কথা বলছ? এখানে ঐ ভদ্রমহিলা কোথায় থেকে আসল? ”
” আরে বাবা, ঐ বাসায় যখন থাকতাম, তখন এই ভদ্রলোক সেই বাসায় গেয়েছিলেন। আর তাকেই দাদিমা যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিল। ভদ্রলোক সেই অপমানে কেঁদেছিলেন। আমি দাদিমাকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার সম্পর্কে, কিন্তু দাদিমা উল্টো আমাকেই গালি দিয়েছিল। তবে সেদিন দাদিমার চোখেমুখে আমি ভয় দেখেছিলাম। আজ তাকে পেয়েছি। আমি তার পরিচয় জেনেই ছাড়ব। আপনিও নামুন। উনি চলে যাচ্ছেনতো। ” কান্তা তড়িঘড়ি করে রিক্সা থেকে নেমে ঐ ভদ্রলোকের পেছনে যায়।
তাকে পেছন থেকেই ডাক দেয়।
কান্তার ডাক শুনে ভদ্রলোক পেছন ফিরে তাকায়। কান্তা তাকে সালাম দিলে, তিনি উত্তর দেন।
” কে মা তুমি? তোমাকে তো চিনলামনা! ” ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
” আপনি আমাকে চিনবেননা। কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছিলাম আমার শ্বশুর বাড়িতে। কিন্তু আপনার পরিচয় জানিনা। তাই এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করছি। ” কান্তা নম্রভাবে উত্তর দেয়। ততক্ষণে আরমানও ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
” তোমার শ্বশুর বাড়ি! কে তোমার শ্বশুর? ”
” শহিদ আহমেদ আমার শ্বশুরের নাম। আপনি সেখানে কয়েকমাস আগে গিয়েছিলেন। তখন আমার দাদি শ্বাশুড়ি আপনাকে অসম্মান করেছিল। ” কথাটা বলেই কান্তা মাথা নিচু করে।
” শহিদ আহমেদ তোমার শ্বশুর! তার কোন ছেলের বউ তুমি? নাম কি তার? ” ভদ্রলোকের চোখেমুখে বিস্ময়।
” আমি তার বড় ছেলের বউ। তার নাম আরমান আহমেদ। ” কান্তাও অবাক হয়েছে ভদ্রলোকের চেহারা দেখে।
” তুমি আরমানের বউ! কোথায় আরমান? তাকে একটু দেখতে দিবে, মা? আমি কতদিন ঐ বাড়িতে গেছি, আরমানকে দেখার জন্য। কিন্তু একবারও ওকে দেখতে পাইনি। প্রতিবারই অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছি। ”
এবার কান্তা ও আরমানের অবাক হওয়ার পালা। কি বলছেন এই ভদ্রলোক! তিনি কেন আরমানকে দেখতে ঐ বাড়িতে যাবেন!
” আমিই আরমান। কিন্তু আপনি কে? আমিতো আপনাকে চিনিনা! আমার জন্য আপনি ঐ বাড়িতে যান, কিন্তু কেন? ”
” তুমি আরমান! আমার সেই ছোট্ট আরমান! যে আমার কাঁধে চড়ে ঘুরতে ভালোবাসত! যে আমার সাথে নদীতে ঝাঁপাঝাপি করার জন্য বায়না করত! তুমি এত বড় হয়ে গেছ! কি কর তুমি? কোথায় থাক? কতদিন তোমাদের বাসায় গেছি কিন্তু তোমার দেখা পাইনি। ” ভদ্রলোক আরমানের মাথা, মুখ ছুঁয়ে ওকে বুকে টেনে নেয়।
কান্তা আরমান ভদ্রলোকের এহেন কান্ডে হতবাক হয়ে গেছে।
” আপনার পরিচয় কিন্তু এখনও দেননি। আপনি আমাকে চেনেন কেমন করে? আমি কিন্তু আপনাকে এখনও চিনতে পারিনি। আমাকে এভাবে অন্ধকারে রাখবেননা। ”
” সেই ছোটবেলায় আমাকে দেখেছ, এখন চিনতে পারার প্রশ্নই উঠেনা। আইরিন সুলতানার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ? যে তোমার মা। আমি তার ছোট ভাই আতিক। সম্পর্কে তোমার ছোট মামা। ” ভদ্রলোক নিজের ওয়ালেটে থাকা দুইটা সাদা-কালো ছবি বের করে আরমানের দিকে এগিয়ে দেন।
আরমান ছবি হাতে নিয়ে দেখল, একটাতে ও আর এই ভদ্রলোক। আর আরেকটায় একটা সুন্দরী মহিলার কোলে সে। দুটো ছবিই অনেক পুরোনো। যেখানে আরমানের বয়স পাঁচ কি ছয়। এই মহিলা আর কেউ নয়। ওর মা।
আরমানের পা যেন রাস্তার পিচের সাথে সেপ্টে গেছে। এ কি শুনছে সে! সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক তার মামা! এত বছর পর সে তার মায়ের দিকের কাউকে খুঁজে পেয়েছে!
” আমার মা কোথায়? আর আপনারা নিজের গ্রাম ছেড়ে কোথায় থাকেন? ” অনেক কষ্টে এতটুকুই উচ্চারিত হল আরমানের মুখ দিয়ে।
” তোমার মা’কে এত বছর ধরে আমরা খুঁজে চলেছি। কিন্তু তার দেখা এখনও পাইনি। আপার শোকে দুই বছরের মধ্যে আম্মা স্ট্রোক করে দুনিয়ার মায়া কাটাল। এর পাঁচ বছর পর আব্বাও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আর আমরা তিন ভাই আমাদের শহরের বাসায় গিয়ে উঠলাম। বড় বোনদের আগেই বিয়ে হয়েছিল। তারা তাদের শ্বশুর বাড়িতে থাকত। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে, আমরা গ্রামে থাকিনা?
” আমি এইচএসসি পরীক্ষার পর দাদুর বাড়িতে গিয়ে আপনাদের ঠিকানা নিয়েছিলাম। এরপর একদিন সময় করে সেখানে গিয়ে দেখি আপনারা সেখানে নেই। এরপরও কয়েকবার সেখানে গিয়েছি কিন্তু একজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম, আপনারা সেখানে আসেননা। আপনাদের ফোন নম্বর, শহরের বাসার ঠিকানা জোগাড় করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। ”
” তুমি সেখানে গিয়েছিলে! কিন্তু আমাদের নম্বর তো অনেকের কাছেই আছে! তাদের কাছে আমাদের ঠিকানা, ফোন নম্বর চাইলেই পেয়ে যাবে। আমাদের দুর্ভাগ্য তোমার কাছে এতদিন পৌঁছাতে পারিনি। ”
রাস্তার মাঝখানে তিনজন মানুষের আবেগ, অনুভূতি কিংবা ক্রন্দন গমনরত পথিকদের দৃষ্টি এড়ায়না। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের পানে তাকায়।
” মামা, আপনি বাসায় চলুন। অনেক কথা জমা আছে। আজ আমার বাসায় থাকবেন। সেখানেই সব গল্প হবে। আপনি বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিন, রাতে আমার বাসায় থাকবেন। ”
আরমান সেই রিক্সাওয়ালা চাচাকে আগেই পুরো ভাড়া দিয়েই রিক্সা ছেড়ে দিয়েছিল। এবার ও সিএনজি ডেকে নেয়।
খাদিজা খালা দরজা খুলে আরমানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে দেখে অবাকের চূড়ায় পৌঁছে।
” ভাইজান, আপ্নে এহানে! আপ্নে বাপজানের খোঁজ পাইলেন ক্যাম্নে? আহেন আগে ভিতরে আহেন। ”
ড্রয়িংরুমে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। এরপর সকল নীরবতা ভেঙে কথা বলে আরমান।
” মামা, মা চলে যাওয়ার পর আপনাদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ করেনি? সে কেন এমন নিকৃষ্ট কাজ করল? আপনার কি জানতেন সে কারও অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে? ” কথাটা বলার সময় আরমানের গলা কেঁপে ওঠে।
” তুমি তোমার মা সম্পর্কে জাননা, তাই এমনভাবে বলতে পারছ। আপা আর আমার বয়সের ব্যবধান পাঁচ বছরের ছিল। ও কোথায় কি করেছে তার সবটাই আমি জানতাম। এমনকি শহিদ ভাইয়ের সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়েছিল তাও আমি জানতাম। আপা আমার কাছে কিচ্ছুটি লুকায়নি। সে তোমাকে আর শহিদ ভাইকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসত। তোমাকে চোখের আড়াল হতে দিতনা। তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার সাথে আমরা ভাইয়েরা রীতিমত যুদ্ধ করতাম। সেই মানুষ তার ছেলেকে একা রেখে কখনোই যেতে পারেনা। তাই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সে অন্য কারও সাথে যায়নি। এখানে ঘটনা অন্য কিছু আছে। ”
মামার কথা শুনে ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলে স্তব্ধ। আরমানের হাত-পা কাঁপছে।
” আপনি কি বলতে চাইছেন, মামা? আপনি কি সন্দেহ করছেন? ” আরমানের গলার স্বর বেরোচ্ছেনা।
” হয়তো আপাকে কেউ তোমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সে চাইলেও আর তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারছেনা। হয়তো সে জেনে গেছে, তাকে নিয়ে কুৎ’সি’ত রটনা রটেছে। সেই লজ্জাতেই আপা দূরে আছে। ”
” মা’র সাথে কে এমনটা করবে? তার সাথে কার শ’ত্রু’তা ছিল! ”
” আপার সাথে কারও কোন শ’ত্রু’তা ছিলনা। সে-তো শান্ত, নম্র একটা মানুষ ছিল। সাত চ’ড়ে একটাও রা কাটতনা। তোমার দাদীর শত অ’ত্যা’চা’রেও তাকে কখনও অসম্মান করেনি। ”
” রাজিয়া খানম মা’কে অ’ত্যা’চা’র করত! কিন্তু কেন? কি দোষ ছিল মা’র? ”
” তার একটাই দোষ ছিল, সে শহিদ ভাইকে ভালোবেসেছিল। তোমাদের বাড়িতে বউ হয়ে গিয়েছিল। তোমার দাদীর ইচ্ছে ছিল তার ভাইয়ের মেয়েকে শহিদ ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবে৷ সে যেই দেখল তার ইচ্ছে পূরণ হলোনা, তখন তার সব আ’ক্রো’শ গিয়ে পরল আপার উপর। সেসব কথা আপা কাউকে জানায়নি। কিন্তু একদিন আমি তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, তোমার দাদী আপার সাথে খুব ব্যাবহার করছিল। আপাও হাসিমুখে সব সহ্য করছে। কিন্তু আমি সেসব সহ্য করতে পারলামনা। বাড়িতে এবং শহিদ ভাইকে সব জানিয়ে দিলাম। সেসব শুনে আমার আব্বা, বড় ভাই তোমার দাদীকে এসে চুড়ান্ত অ’প’মা’ন করেছিল। শহিদ ভাইও তার মা’কে ছেড়ে কথা বলেনি। সে-ও তাকে অ’প’মা’ন করেছিল। এরপর থেকে আর কখনও শুনিনি তোমার দাদী আপার সাথে দূর্বব্যহার করেছে। তার কিছুদিন পর তো আপা হারিয়েই গেল। ”
কথা বলতে রাত দশটা বেজে গেছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই।
চলবে…