শ্রাবণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে বাবা নাম রাখলেন শ্রাবণ্য। বাড়িতে অবশ্য সবাই নানান নামে ডাকে। আজ ওর বিয়ে। এতো তাড়াতাড়ি কারো বিয়ে হতে পারে সেটা শ্রাবণ্য কল্পনায়ও ভাবতে পারে না। অবশ্য নাটক, সিনেমায় হরহামেশাই ঘটে এমন। নায়িকাকে জোর করে বাবা অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। এদিকে নায়ক তার ভালোবাসার জোরে কিভাবে কিভাবেআ নায়িকা কে বিয়ে করে সিনেমার কাহিনীআ শেষ করে হ্যাপি এন্ডিং এর পর্দা টানেন।
শ্রাবণ্যর বিয়েটা আসলে হ্যাপি এন্ডিং হপবে নাকি স্যাড এন্ডিং হবে বোঝা যাচ্ছে না। ওর বিয়ে ঠিক করা হয়েছে তিন দিন আগে। সেটা ও’কে কেউ জানায় নি। এমনকি ওর মা’ও না। শ্রাবণ্যর মা অবশ্য স্বামীভক্ত ভদ্রমহিলা। স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই যেন তার আসল ধর্ম।
শ্রাবণ্য একটা গুরুতর অপরাধ করেছে। যেটার শাস্তিস্বরূপ এই না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করা। শ্রাবণ্য ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেছে বাড়িতে না জানিয়ে। বাবা সেটা জানতে পারেন। এই মীরজাফরি কাজ টা কে করেছে সেটা ও এখনো জানেনা। বাবা গতকাল লোক পাঠালেন। লোক বলতে শ্রাবণ্যর ফুপাতো ভাই। সে গিয়ে নিয়ে আসলো। ঘরে ঢুকে ও এক গ্লাস পানি খাবার পর ই জানতে পারলো সন্ধ্যেবেলা ওর বিয়ে৷ বাড়িতে সবাই সেটা নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত এখন। এখনো পর্যন্ত বাবার সঙ্গে ওর দেখা হয় নি।
শ্রাবণ্য বসে আছে শিউলির ঘরে। শিউলি ওর একমাত্র ভাইয়ের বউ। মায়ের মতো ভাইটাও বাবাভক্ত। বাবার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে সবসময়। ভাবীকে শ্রাবণ্য পছন্দ করে। শিউলিও একমাত্র ননদ কে খুব স্নেহ করে। শিউলি একটা প্লেটে পিঠে নিয়ে এলো। এই পিঠে টা শ্রাবণ্যর পছন্দ৷ ওর খেতে ইচ্ছে করলো না এখন।
শ্রাবণ্য দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,
“আমাকে কী বিয়ে দিয়ে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ভাবী?”
শিউলি হেসে বলল,
“ধুর বোকা মেয়ে! বিয়ে শাস্তি হবে কেন?”
“তাহলে এটা কী হচ্ছে? আমার বিয়ে অথচ জানলাম কিছুক্ষন আগে। আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব কী কেউ দিচ্ছে!”
শিউলির মন খারাপ লাগছে। শ্রাবণ্য কে সেটা অবশ্য ও বুঝতে দিতে চায় না। মেয়েটার কতই বা বয়স হলো! শিউলিও অবশ্য এই বয়সেই বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল।
“শ্রাবণ্য তোর ভালো ঘরেই বিয়ে হচ্ছে। ছেলেটাও চমৎকার। দেখতে সুন্দর আছে কিন্তু। তুই তো সবসময়ই চাইতি সুন্দর দেখতে একটা ছেলে যেন তোর বর হয়।”
শ্রাবণ্য শিউলির দিকে অসহায় চোখে তাকালো। এই চাওয়া ছিলো আরও বছর পাঁচেক আগের চাওয়া৷ তখন ও কতটুকু ছিলো। এই পাঁচ বছরে ওর মানসিকতা, চিন্তাভাবনা সবকিছুই তো বদলেছে৷ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাবা কেন বদলাচ্ছেন না! তাদেরকার সময়ে যেমন বিয়ে হতো তেমন বিয়ে নিজের মেয়ের জন্যও ভাবছেন।
শ্রাবণ্য হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাবী আমি যদি এই বিয়েতে না বলি! যদি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। ”
“তারপর কী হবে? কিভাবে চলবি?”
“একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি টিউশন পড়িয়ে নিজের ব্যবস্থা করে নেব। দুটো বছর কষ্ট হবে৷ তারপর চাকরি হয়ে যাবে একটা না একটা। ”
“তারপর তোকেও আকাশীর মতো এই সংসার থেকে দূরে সরিয়ে দিবে শ্রাবণ্য৷ জীবন এতোও সহজ না, যতটা তুই ভাবছিস। ”
শ্রাবণ্য বসে পড়ে বিছানার উপর। বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড টা দ্রুত গতিতে চলছে। এতো অস্থির লাগছে। শিউলি ওর পাশে বসে বলল,
“ভয় পাস না। যার সঙ্গে তোর বিয়ে হবে সেই ছেলেটা ভালোই। তারচেয়েও বড় কথা হলো ওদের বাড়ির মানুষজনও ভালো। তুই তো তাদের কে চিনিস একটু। ”
শ্রাবণ্যর আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আসলে দোষ টা ওর। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ও নিজের সীমা ভুলে গিয়েছিল। বাবা ও’কে বাড়ির বাইরে রেখে ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে চায় নি। কিন্তু ওর চোখের পানি দেখে নরম হয়েছেন। মা’কে বলেছিল, একবার চুন খেয়ে মুখ পুড়ে গেছে। এবার যেন তা না হয়।
বাড়িতে ঢুকতেই মা কঠিন গলায় বলেছেন,
“দুটো ডানা গজিয়েছিল তোর না? এখন বুঝবি কেমন লাগে। শ্বশুর বাড়ি কিন্তু মামাবাড়ির মতন মধুর হাড়ি না। ”
***
সত্যি সত্যিই সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ্যর বিয়ে হয়ে গেল। আটপৌরে বেনারশী, গয়নাগাটি পরে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর মা মেয়ের জন্য এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেললেন না। আকাশী তাকে কঠিন বানিয়ে দিয়ে গেছেন নাকি জগতে স্বামী ছাড়া আর কারোর প্রতিই তার সেরকম অর্থে মায়া কাজ করে না এই ব্যাপার টা কেউই জানে না। তবে শিউলি নীরবে কাঁদলো। আহারে এভাবেও বিয়েটা হতে হলো। এই মেয়েটা যেন ভীষণ ভালো থাকে।
***
বাড়ির নাম রঙতুলি এই বাড়িতে শ্রাবণ্য এর আগেও একবার এসেছিল বাবার সঙ্গে। বাবার প্রিয় বন্ধুর বাড়ি এটা। সেই বন্ধু বেঁচে নেই। তবে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে শ্রাবণ্যর বাবার সম্পর্ক এখনো আন্তরিক। শ্রাবণ্য আজ এই বাড়ির বউ। যেদিন এসেছিল সেদিনও ভাবতে পারে নি এই বাড়িটা একদিন ওর স্থায়ী ঠিকানা হবে।
শ্রাবণ্য এসেছে সকালে। প্রাথমিক বধূবরণ শেষ হবার পর শ্রাবণ্যকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলো। ভালো করে ঘুমিয়ে নিক একটু। বউ দেখতে সবাই বিকেলে আসবে। নতুন জায়গায় শ্রাবণ্যর একটুও অসুবিধে হলো না ঘুমের। বালিশে মাথা দিতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। সব জল্পনা কল্পনা, মন খারাপ একপাশে রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
***
স্বপ্নীল তাকিয়ে আছে সামনের মাখন রঙের বাড়িটায়। ওর হাতে দিয়াশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট। এর আগে কখনো ও সিগারেট ছুঁয়েও দেখে নি। দাদু এই বিয়েটা করিয়েছে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ও তো ভালোবাসতো নীলা কে। নীলা ওর বয়সে চার বছরের বড়, এক মেয়ের মা। শুধুমাত্র এই কারণে কেউ রাজী হলো না। স্বপ্নীল তবুও নিয়ম ভাঙতে রাজী ছিলো। কিন্তু নীলা রাজী হলো না। সিগারেটের শেষ অংশের মতো অযত্ন, অবহেলায় ফেলে দিলো ও’কে। তীর্যক হেসে বলল,
“বড়লোকদের এসব আদিখ্যেতায় আমি ভুলি না স্বপ্নীল। যা ভাগ এখান থেকে। থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব নাহলে। ”
স্বপ্নীল আহত চোখে তাকিয়ে ছিলো। দুটো মানুষের এক হওয়ার জন্য সমাজ কেন বাঁধা হবে! কেন কিছু যুক্তিহীন নিয়ম বেঁধে দেয়া হয় সেটা আজও স্বপ্নীল বোঝে না।
***
শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো দুপুরের পর। তুলি এসে ঘুম ভাঙালো।
“এই শ্রাবণ্য ওঠো। ”
শ্রাবণ্য ঘুমের মধ্যে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেকটু ঘুমাই। ভাত ঢেকে রাখো। ”
তুলি তবুও জোর করে ওঠায়। শ্রাবণ্য উঠে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে যে ও এখন অন্য জায়গায় আছে। ক্লান্ত পায়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। পাটভাঙা নতুন শাড়ি পরে। ঘরে বসেই তুলির আনা ভাত খেতে বসে যায়। আলু দিয়ে মুরগীর মাংসের তরকারি টা দিয়ে অল্প একটু ভাত খায়। হঠাৎ যেন ওর কী হলো। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। সেই সময় ঘরে ঢুকলো স্বপ্নীল। অপ্রস্তুত গলায় বলল,
“তুমি খাচ্ছিলে? ”
শ্রাবণ্য জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলো। স্বপ্নীল নরম গলায় বলল,
“খাও। আমি এখানে থাকলে সমস্যা আছে?”
শ্রাবণ্য মৃদু হেসে মাথা নেড়ে না বলল।
স্বপ্নীলও একটু হাসলো। উল্টোদিকে মুখ করে চেয়ারে বসলো। শ্রাবণ্যকে ও নীলার কথা বলতে এসেছে। ও নীলাকে বিয়ে করতে চেয়েছে বলেই দাদু এতো তাড়াহুড়ো করে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন।
স্বপ্নীল আরও একটা কথা বলতে চায় ও’কে। আমি তোমাকে জীবনেও বোধহয় ভালোবাসতে পারব না শ্রাবণ্য। কিন্তু ভেতর থেকে একটা বাঁধা আসছে। অবচেতন মন বলছে, একথা বলা ঠিক না, উচিত ও না।
চলবে….
#কুসুম কাঁটা
#পর্ব-১
(ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করলাম আবারও। পাঠকদের সাড়া পেলে নিয়মিত চলবে ইনশাল্লাহ। সবাই কে পাশে থাকার অনুরোধ।)
সাবিকুন নাহার নিপা