#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১০
সকাল হতেই শ্রাবণ্য তৈরী হয়ে নিলো। আকাশীকে দেখতে একবার যাওয়া দরকার। স্বপ্নীল একটু ঘুমিয়েছিল। শ্রাবণ্যর আর ঘুম হয় নি টেনশনে।
স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে বলল,
“পাঁচ টা মিনিট বসো শ্রাবণ্য, আমি একটু রেডি হয়ে নেই।”
“আপনি ঘুমান। আমি একাই যেতে পারব। ”
“না না। আমি অবশ্যই যাব।”
শ্রাবণ্য অপেক্ষা করলো৷ স্বপ্নীল পাঁচ মিনিটের জায়গায় সাতাশ মিনিট নিলো। শ্রাবণ্য কিছু বলল না। ও চটজলদি তৈরি হতে পারে। স্বপ্নীলের সব কিছুতে সময় লাগে। ভাত খাওয়ার সময়ও এতো সতর্ক হয়ে কাটা বাছে যে শ্রাবণ্যর মায়া লাগে।
শিলা দুজন কে একসঙ্গে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমরা এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ?”
শ্রাবণ্য জবাব দেবার আগে স্বপ্নীল বলল,
“আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি মা। একটু ঘুরতে আর কী। ”
শিলা হাসলেন। বললেন,
“একটু বসো। চা করে দেই। ”
শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের দিকে তাকালো। স্বপ্নীল মা’কে বলল,
“থাক না মা। এখন যাই। ”
শিলা আর আটকালেন না। বললেন,
“আচ্ছা। ”
শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্বপ্নীল এবার বড় হচ্ছে। ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেও মায়ের হাতে ভাত খেত। গুছিয়ে ভাত খাওয়া তখনও শিখে উঠতে পারে নি। শিলা যখন অসুস্থ থাকতো তখনও তুলিকে বলতো, বুবু ভাত টা মাখিয়ে দাও। আমি মাখলে মজা হয় না।
শ্রাবণ্যর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে সহজেই। অবশ্য এটার ক্রেডিট শুধু স্বপ্নীল কে একা দেয়া উচিত না। শ্রাবণ্যও ভীষণ ভালো মেয়ে। এই যুগের স্মার্ট মেয়েদের কাতারে ও’কে অনায়াসেই রাখা যায়। স্বপ্নীল সেই কাতারে পুরোপুরি পড়ে না। কিছুটা সহজ, সরল বোকা টাইপ। কোথায় কিভাবে বলতে হয় ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। বন্ধু সংখ্যাও তেমন নেই, আত্মীয়মহলে আজও স্বপ্নীল কে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। ছেলেটা চুপচাপ নত মস্তকে সব টা মেনে নেয়। কাউকে ঠোঁট কাঁটা জবাব দিতে পারে না। সেটা তুলিও পারে না, রঙ্গনা পারে। তবে তুলির বিশেষ গুন আছে, হাসি, ঠাট্টা অপমান গুলো হাসিমুখে মেনে নিয়ে নীরব জবাব দিতে পারে।
সেদিন নাশতার টেবিলে স্বপ্নীল কে নিয়ে কী একটা হাসির কথা হলো। সবাই হাসছে, শ্রাবণ্যর মুখে হাসি নেই। ও আড়চোখে স্বপ্নীল কে দেখলো একবার। স্বপ্নীল তখনও চুপচাপ মাথানিচু করে খাচ্ছে। শিলার ব্যাপার টা ভালো লাগলো ভীষণ। এমন একটা মেয়েকেই স্বপ্নীলের জীবনে দরকার ছিলো আসলে৷ যে সবার আগে ওর বন্ধু হয়ে উঠবে। মায়ের সঙ্গে যতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক, সব কথা বলা যায় না। কিছু গোপন অনুভব, একান্ত অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্যও একজন লোক লাগে। একজন নিজের মানুষের দরকার হয়। স্বপ্নীলের জীবনে শ্রাবণ্য নামের মেয়েটা তেমনই একজন হোক।
***
সকালের বাতাস টা বেশ ঠাণ্ডা। রিকশা চলছে মাঝারি গতিতে। বসন্তের শুরু কেবল। পুরোপুরি শীত যায় নি। স্বপ্নীল বলল,
“তুমি কী তোমার আপুর উপর রেগে ছিলে?”
শ্রাবণ্যর মনে পড়লো গত রাতের কথা। আমতাআমতা করে বলল,
“না মানে…
“বুঝতে পারছি। পরিবারের মানুষজন ভুল করলেও তাদের উপর রেগে থাকতে নেই। ছোটপা এতো অকাজ করে তবুও আমরা কেউ তার উপর রেগে থাকি না।”
স্বপ্নীলের কথার ধরন দেখে শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। স্বপ্নীলও হাসলো। শ্রাবণ্যর সঙ্গে কথা বলার সময় ও একটু বেশী কথা বলে ফেলে।
***
বাতাসী খালা উপরে আসতেই মিশুক বলল,
“খালা একটু তুলী আপুকে আসতে বলুন তো জরুরী কথা আছে।”
বাতাসী খালা বুঝলেন পরিবেশ ভালো না। তার বেঁফাস কথাবার্তা না বলাই ভালো। তাই মিশুকের কথামতো তুলিকে ডেকে আনলো। তুলি এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা? ”
“হ্যাঁ আপু। এজন্যই আপনাকে ডাকা। আপনার দাদুর কী মাথায় একটু সমস্যা আছে? মানে বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকের হয়।”
তুলি হেসে ফেলল। বলল,
“তা বোধহয় আছে। ”
মিশুক নিজেও হাসলো। বুঝতে পারলো ও যে টপিকে কথা বলতে চাচ্ছে সেটা তুলি জানে। মিশুক বলল,
“খালার কথাবার্তায় আন্দাজ করলাম, খুব সম্ভবত আমাকে কারোর জন্য পাত্র বানানো হচ্ছে।”
তুলি বিস্মিত গলায় বলল,
“খালা আবার কী বলল?”
“তেমন কিছু না। তার গল্প শুনে আন্দাজ করলাম। আসলে আপু আমার এই মুহুর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আর আমার পছন্দও একটু অন্যরকম। সরি টু সে, আমি কথাটা কাউকে ছোট করে বলছি না। আসলে আমার এখন কী করা উচিত? দাদু তো ছয়মাসের এগ্রিমেন্ট করেছিল। আমার কী বাসা ছাড়া উচিত?”
তুলি জবাব দেবার আগেই দরজার ওদিক থেকে আরেকটি প্রশ্ন ভেসে এলো।
“এই বুবু, কিসের বিয়ের কথা হচ্ছে? দাদু কার বিয়ের কথা বলছে?”
তুলি আর মিশুক একসঙ্গেই রঙ্গনার দিকে তাকালো। রঙ্গনা উত্তরের অপেক্ষা না করে ঝড়ের বেগে ছুটলো। তুলিও পেছনে পেছনে গেল। মিশুক কে বলল,
“আপনি রিলাক্স থাকুন। আমি এই বিষয়ে পরে কথা বলব। আগে নিচের ঝড়টা সামলে আসি। ”
মিশুকের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এই বিবাহঘটিত নাটক টা কে ও সিরিয়াস ইস্যু ভেবেছিল। ওর ধারণা ছিলো রঙ্গনাও জানে। এখন মনে হচ্ছে সবই ওই বৃদ্ধ লোকটার কারসাজি।
***
আকাশী রাতে এসে হোস্টেলে পৌছেছে। শ্রাবণ্যর বন্ধু আফরিন সাহায্য করেছে। এই হোস্টেল টা সুন্দর। এক রুমে তিনটা করে সিট। স্টিলের সিঙ্গেল খাটের সঙ্গে একটা করে টেবিল চেয়ার। আর দেয়াল আলমারি আছে একটা। যেটা সবাই ই ব্যবহার করে।
আকাশী তোশক, বালিশ সব পেল। শ্রাবণ্য ওগুলো রেখে গেছে। বিছানায় শুয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিনের টেনশন, ধকল কিছু মনে রইলো না।
আকাশীর ঘুম ভাঙলো শ্রাবণ্যর ডাকে। চোখ খুলে দেখলো শ্রাবণ্য ওর মাথার কাছে বসে আছে। ঠান্ডা হাত টা কপালে ধরে রেখেছে। ও’কে বলল,
“ওঠ। হাত, মুখ ধুয়ে খেয়ে তারপর ঘুমা। তোর কপাল টা গরম লাগছে। দাঁড়া দেখি আমার কাছে ওষুধ আছে কি না।”
আকাশীর ভীষণ কান্না পেল। শেষ কবে এমন আদর পেয়েছে মনে পড়ে না। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখার মানুষের অভাব টা বুঝতে পেরেছে এই কয় বছরে। শুভ দিন দিন এতটা পাল্টে যেতে লাগলো যে আকাশীর অসুস্থতায়ও ওর মন নরম হতো না।
শ্রাবণ্য ওর জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। গরম পরোটা, নেহারি, হালুয়া। আকাশী খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই খাবি না?”
“আমরা খেয়েছি।”
“আমরা? আর কে?”
“স্বপ্নীলও এসেছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ”
আকাশীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল,
“কই? আমি একটু দেখি।”
শ্রাবণ্য আকাশীকে জানালার কাছে এনে দাঁড় করালো। ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়না। শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে ফোন করে ঠিকঠাক জায়গায় দাঁড় করালো। আকাশী চশমা পরা ফর্সা, রোগা ছেলেটাকে দেখে বলল,
“ও তো মনে হয় আগের মতোই আছে। অনেক আগে দেখেছিলাম। তখন কলেজে পড়তো। ”
শ্রাবণ্য কিছু বলল না। আকাশী বলল,
“ছেলেটা ভালো? ”
শ্রাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আকাশী হাসলো। একটা কথা বলতে গিয়েও বলল না। শ্রাবণ্য বলল,
“আজ তুই রেস্ট নে। অন্য আরেকদিন তোর সঙ্গে সামনাসামনি আলাপ করিয়ে দেব।”
****
মিশুকের মন টা খারাপ হলো। রঙ্গনা ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরনে ছাই রঙা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার ঢোলা জিন্স। দেখে মনে হচ্ছে ব্রাশও করে নি। তবে ও’কে কাঁদতে দেখে ওর মন টা খারাপ হলো। দাদুর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি টের পেয়েছে ও। দাদু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। তুলি সামলানোর চেষ্টা করছে। রিন্টি, মন্টিও কাঁদছে।
“ও মনি তুমি যাইয়ো না। আমাদের কে ভুতের গল্প শোনাবে মনি। ডাল দিয়ে ভাত কে খাওয়ায়ে দিবে। মা তো ভাতে লবন নেয় না, তাই মজাও লাগে না। ”
রঙ্গনা চলে গেল সিএনজি করে একাই। মিশুক নিচে এসে তুলিকে বলল,
“আপু আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি আপু। ”
তুলি হাসার চেষ্টা করে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মন্টি বলল,
“আপনি কথা বলবেন না। আপনি মনিরে বিয়ে করলে মনি আজকে যাইতে পারতো না।”
মিশুক তাকিয়ে আছে বাচ্চাটার দিকে।
চলবে….
(লাইক কমেন্ট করুন বেশী করে। পরের পর্ব জলদি দেব ইনশাআল্লাহ।)