#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৬
আজকের সকাল টা রঙ মহলে খুশি খুশি সকাল। শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো দশটার পর। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো দাদী আর আম্মু ছাড়া আর কারোর ঘুম ভাঙে নি। শিলা শ্রাবণ্য কে বলল, তুমি বা কেন এতো তাড়াতাড়ি উঠলে!
শ্রাবণ্য হাসলো। সকালে ওঠার অভ্যাস বলে, ছুটির দিনে বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। শিলা শ্রাবণ্য কে বলল,
“তোমাকে আগে রুটি দিয়ে দেই। তারপর আমার একটা কাজ করবে?”
“কী কাজ আম্মু?”
শিলা একটা ব্যাগ দেখিয়ে বলল, এই ব্যাগ টা নিয়ে আকাশীর কাছে যাবে। কালকের কিছু খাবার, কেক, মিষ্টি এগুলো দিয়েছি। আর ও’কে বলবে যে আমরা ভীষণ রাগ করেছি ওর উপর। রাগ ভাঙাতে হলেও একদিন আসতে হবে আমাদের কাছে।
শ্রাবণ্য হাসলো। বলল,
“আচ্ছা যাব। ”
শ্রাবণ্যর খুশি লাগে, আবার রাগও হয়। ওর পরিবারে এতো গুরুত্ব ওর মা কখনো ও’কে দেয় নি। শিউলিকেও দেয় না, খুব ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। তিনি মনে করেন খবরদারি করাই তার একমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য। আর এই একজন মা! যিনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে চোখ তুলে পর্যন্ত কথা বলেন না। কী সুন্দর ভুল গুলোও বুঝিয়ে বলেন।
শ্রাবণ্য আর মন খারাপ করতে চায় না সকাল সকাল। দুটো রুটি খেয়ে ও তৈরী হতে গেল। ভালোই হলো, এই ফাঁকে নিজেও একটু ঘুরে আসতে পারবে।
শ্রাবণ্য বেরোনোর সময় দেখলো স্বপ্নীল গুটিশুটি মেরে এক কোনে ঘুমিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে শীত লাগছে। এখন তো তেমন ঠান্ডাও নেই৷ শ্রাবণ্য চাদর টা ভালো করে ওর গায়ে টেনে দিলো। স্বপ্নীল কাল কী নিয়ে যেন ওর সাথে রাগ করেছে। রাতে শ্রাবণ্য দুবার কথা বললেও জবাব দেয় নি। হতে পারে ছোট আপুর সঙ্গে রাগ করেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে কেন কথা বলল না সেটা বুঝতে পারলো না।
***
শুভ আকাশীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলো না। একদিন গিয়েছিল হ্যাপি আপার কাছে। হ্যাপি আপা এক গাল হেসে বলল,
“আকাশী কই আছে তার আমি কী জানি! মনে হয় নতুন কোনো ভা*তার খুঁজে পাইছে। ”
শুভর ভীষণ রাগ হলো। আকাশী অমন ধরনের মেয়ে নয় সেটা ও জানে। তবুও হ্যাপিকে কিছু বলতে পারলো না। ওদিকে বাড়ি ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালি মহিলা আসে। তিনি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে যান প্রতিবার। গার্মেন্টসে একটা কাজ জুটিয়েছিল সেখানেও টিকতে পারলো না। বাড়িতে মায়ের প্যানপ্যানানি আছে। তিনি কিছুতেই আকাশীকে মেনে নিতে রাজি নয়। আশেপাশের মানুষ নানান কুমন্ত্রনা দেয়, মা সেগুলো কানেও নেয়। একদিন বলল, আকাশী যদি আসে তাইলে বলবি পাঁচ লাখ নিয়ে আসতে বাপের থেকে। নাহলে ঘরে ওর জায়গা নেই। সব মিলিয়ে শুভর জীবন টা দূর্বিষহ৷ আকাশী এতদিন আছেই বা কোথায়! ও তো শ্রাবণ্যর ঠিকানাও জানেনা।
শুভ বাসার সমস্ত ফার্নিচার, হাড়িপাতিলসহ সব জিনিস বিক্রি করে দিলো। আকাশীর নিজের অতি কষ্টে টাকা জমিয়ে কেনা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, র্যাক, টিভি সবকিছুই পানির দামে বিক্রি করে বাড়িওয়ালার টাকা শোধ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল৷ সেখানে অন্তত নিশ্চিন্তে কটা দিন ডাল ভাত খাওয়া যাবে। পরের চিন্তা নাহয় পরে করবে৷
মোহাম্মদপুরের ছোট্ট রুমটায় আকাশী আর শুভ যে সংসার শুরু করেছিল সেখানে এখন হয়তো অন্য কেউ সংসার সাজাবে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার উঠবে অন্য কারোর হাতের। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সবকিছু হবে অন্য কারোর। শুভ আর আকাশীর সংসারের আর অস্তিত্ব থাকবে না।
***
রেহানা আকাশীকে ফোন করে অনেক গালমন্দ করলেন। কেন শ্রাবণ্যকে সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে ও। আকাশী জবাবে শান্তস্বরে বলল, মা হয়তো এমন কোনো দিন আসবে না যে আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে আমি আমার একমাত্র বোনের কোনো ক্ষতি চাই না। ও খারাপ থাকুক সেই কাজ করার আগে যেন মরে যাই।
রেহানার কাছে আকাশীর সব কথাই বিষের মতো লাগে। এই এক মেয়ের জন্য তিনি অনেক লাঞ্চিত হয়েছে। জা’য়েদের কাছে তার মাথা নত হয়েছে। দেবরের মেয়েদের দুই কথা বলার আগেও তাকে ভাবতে হয়। কারণ তার মেয়েই হাত থেকে ছুটে গেছে। তারচেয়েও বড় কথা হলো শ্রাবণ্যর দু:সাহস। একবারও তাকে কিংবা বাবাকে জিজ্ঞেস না করে ও আকাশীকে সাহায্য করতে গেল! আবার বড় বড় কথা বলছে, বলে স্বপ্নীল দের বাড়িতে কোনো সমস্যা নেই এই ব্যাপারে। রেহানার আসল রাগ টা সেখানেই। স্বপ্নীলের মা টিচার। তার ব্যক্তিত্ব অন্যরকম। কথা বলেন সুন্দর গুছিয়ে। শ্রাবণ্য তাকে পছন্দ করে, বাড়ির অন্যান্যদেরও ভালোই পছন্দ করে। করুক তাতে রেহানার সমস্যা নেই। কিন্তু মা’কে কেন গুরুত্বহীন ভাবছে। রেহানা ভেবেছিল বিয়ের পর শ্রাবণ্য হাজার টা সমস্যার সমাধান চাইতে তাকে ফোন করবেন। তার কাছে ছুটে আসবে৷ সেটা করছে না। ও ভালো আছে নাকি খারাপ আছে সেটা জানতে চাইলে রুক্ষ গলায় বলে, সেটা তোমার না জানলেও চলবে। রেহানা অবাক হন। এই মেয়ে কখনো এভাবে তার মুখের উপর কথা বলে নি। রেহানা হেরে যান নিজেই নিজের কাছে। শিউলিকে সে বশে আনতে পারছে না। রেহানার একমাত্র ছেলে বাবু কানাডায় থাকে। বছরে দুমাসের জন্য আসে। শিউলি এতদিন এখানে থাকলেও এবার স্বামীর কানে মন্ত্র পড়ে বাপের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছে। মুনসুর তাতে সায় দিয়েছেন। বলেছেন মাঝেমধ্যে আসলেই হবে। মেয়েরাও কেউ তার দলে নেই। শ্রাবণ্যর সংসার কন্ট্রোল করা তো দূরে থাক, মেয়ের কাছে নিজেকে এখন পর লাগে।
রেহানা তবুও সাহস করে স্বামীকে বলেছে, আকাশীকে এখানে আনার দরকার নেই। মানুষ ছি: ছি: করবে। কাজের লোকগুলো পর্যন্ত মুখ চেপে হাসে।
মুনসুর গম্ভীর গলায় বললেন,
“তোমাকে এসব না ভাবলেও হবে। তুমি কম ভাবো। অবশ্য তোমার ভাবনা সীমিতই। তোমার ভাবনা আরেকটু বেশী হলে আকাশী শ্রাবণ্য কে ফোন করে সাহায্য না চেয়ে তোমার কাছেই চাইতো।”
রেহানার কান দিয়ে যেন আগুন বের হয়। নিজেকে সবদিক থেকেই যেন গুরুত্বহীন লাগে।
***
“শ্রাবণ্য দাঁড়াও। ”
শ্রাবণ্য দাঁড়ায়। সাকিব ছুটে আসে। শ্রাবণ্যর মুখোমুখি হবার সাহস সঞ্চার করতে ওর অনেক সময় লেগেছে।
“কেমন আছ সাকিব?”
সাকিব অপ্রস্তুত হয়। বলে,
“তুমি কেমন আছ?”
“খুব ভালো। ”
সাকিবের অনেক কথা বলার ছিলো। কিন্তু ও দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে।
“কিছু বলবে?”
“পরীক্ষা কেমন হলো? ”
“ফার্স্ট, সেকেন্ড না হলেও টপ ফাইভে থাকব। ”
“চা খাবে?”
শ্রাবণ্য হেসে বলে, না আমি বাড়ি ফিরব।
“তোমার সাথে একটু কথা আছে। ”
“সরি বলবে? ”
সাকিব অপ্রস্তুত হয়। শ্রাবণ্য হেসে বলে,
“তোমার গুরুত্ব আমার জীবনে তেমন কিছুই না। তাই তোমার সরি বলাতেও কিছু যায় আসে না, না বলাতেও কিছু যায় আসে না। ”
সাকিব মাথা নিচু করে থাকে। শ্রাবণ্য চলে আসে। একা রিকশায় নীরবে চোখের জল ফেলে।
হয়তো শ্রাবণ্য একদিন এই চোখের জলের জন্য আফসোস করবে। সাকিবের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের জন্য ও স্বপ্নীলের মতো প্লাটিনামের দেখা পেয়েছে। যেদিন সেই প্ল্যাটিনামের মূল্য বুঝবে………!
চলবে……!
(পাঠক সাড়া দিয়ে আমাকে এক্টিভ রাখবেন। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। ঠান্ডা কমলে বড় পর্ব লিখে সবাইকে যেন খুশি রাখতে পারি সেজন্য বেশী বেশী সাড়া দিন।)