#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৯
রঙতুলিতে আসার পর আকাশীর ভাগ্য খুলে গেছে বলা যায়। রঙ্গনা সাত টা শাড়ি ডিজাইনের অর্ডার দিয়েছে। হানিমুনে সাত রঙের শাড়ি পরবে। সেই সঙ্গে সাত টা পাঞ্জাবী। আকাশীর জন্য ব্যাপার টা ভীষণ চাপ ও আতঙ্কের হয়ে গেল। রঙ্গনা ব্যাপার টাকে ভীষণ সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো। ও পার্লারের কাজ জানে শুনে বাড়ির সবাই মেহেদীর জন্য বুকড করে রাখলো। তুলি সহ রঙ্গনার অন্যান্য বন্ধুরা।
রঙ্গনা শাড়ির জন্য ও’কে এডভান্স টাকাও দিয়ে দিয়েছে। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে যে ও নিজেও অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
শ্রাবণ্য আকাশীকে বলল,
“তুই এখানে থাকবি এই ক’দিন। তোর ভালো লাগবে। মন খারাপ করে থাকিস। ”
আকাশী রাজী হলো না। বলল,
“নারে। আমি মাঝেমধ্যে আসব। ”
শ্রাবণ্য বলে,
“মা তোকে কিছু বলেছে?”
আকাশী বুঝতে না পেরে বলল,
“কোন ব্যাপারে? ”
শ্রাবণ্য বুঝলো যে রেহানা তার ভয়ংকর কথাগুলো আকাশীকে বলেন নি। শ্রাবণ্য এড়িয়ে যায়। আকাশী তবুও জোর করে। শ্রাবণ্য বলতে চায় না। মা যে ভয়ংকর কথাগুলো আকাশীকে নিয়ে বলেছে সেগুলো কোনো মা মেয়েকে নিয়ে বলে না। ওদের মা ব্যতিক্রম। ব্যাপার টা এমন নয় যে তিনি খারাপ। ঘরে যারা কাজ করেন তাদের কে না দিয়ে কোনো ভালো জিনিস খান না। কারও অসুখ, বিসুখ কিংবা সংসারে টানাটানি শুনলে টাকা পয়সা ধার দেন। তার রুক্ষতা, নির্মম আচরণ টের পায় শুধু ওরা। আকাশী এই বাড়িতে এসেছে এই খবর টা শ্রাবণ্য বাবাকে বলেছিল। ওর উদ্দেশ্য ছিলো বাবার সঙ্গে বোনের মিল করিয়ে দেয়া। আকাশী মন ছোট করে থাকে। ও আফরিনের কাছেও শুনেছে যে সারাক্ষন মন খারাপ করে থাকে। মাঝেমধ্যে খাবার টা টেবিলে ডাকা পড়ে থাকে, আকাশী না খেয়ে ঘুমায়। মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখ হচ্ছে মন খারাপের অসুখ। এটা এমন অসুখ যে না সাড়া অবধি সবকিছুতেই বিতৃষ্ণা লাগে।
রেহানা যখনই জানলো আকাশী এই বাড়িতে এসেছে তখনই শ্রাবণ্যকে ফোন করে বলল,
“আকাশীকে ডেকে নিয়ে মাথায় ওঠাচ্ছিস না। দেখবি এখন কী হয়! তোর সংসার ধ্বংস করবে। দেখ তোর স্বামীকে না আবার ওর মনে ধরে। ”
শ্রাবণ্য হতভম্ব গলায় বলল,
“কিসব আবোল তাবোল বলছ মা। আপু কী তোমার নিজের মেয়ে না? ”
“এইজন্যই তো বললাম যে কী বিষ পেটে ধরছি তা কেবল আমিই জানি৷ তুই তো মহান সাজার চেষ্টা করছিস। এরপর কাঁদতে কাঁদতে চোখে ঘা হবে। ”
শ্রাবণ্য রাগী গলায় বলল, ফোন রাখো মা। এরপর থেকে মেজাজ ঠান্ডা থাকলে ফোন করবে। নাহয় করবে না।
আকাশী আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলেছে মা?”
শ্রাবণ্য হেসে বলে, মায়ের কথা বাদ দে। জানিস ই তো মা ভিনগ্রহের মানুষ। বাবা ছাড়া সবাইকে তার অসহ্য লাগে।
আকাশী আর কথা বাড়ায় না। স্মিত হাসে। বলে,
“এই বাড়ির মানুষজন ভালো। তুই মানিয়ে নিতে পারছিস তো?”
“কেন আমি কী খারাপ? ”
আকাশী হাসলো। বলল,
“নাহ! তোর অনেক বুদ্ধি। আমার মতো বোকা না তুই। ”
শ্রাবণ্য হাসে। আকাশীকে পৌছে দেবার জন্য শীলা স্বপ্নীল কে যেতে বলে। শ্রাবণ্য বারন করে। নিজের আচরণে বিরক্ত হয়। মায়ের কথার প্রভাব পড়লো নাকি৷ খারাপ জিনিসের প্রভাব বেশী পড়ে।
***
স্বপ্নীল প্রতিদিন এসে সিদ্ধান্ত নেয় আজকেই ওর অফিসে শেষ দিন। এরপর আর অফিসে যাবে না। ওই অফিসে একদল বজ্জাত লোক থাকে। যারা ও’কে মুরগী বলে ডাকে। যে গ্রুপে কাজ করে সেই গ্রুপের টিম লিডার শাফি ভাই৷ শাফি সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। তৃষা নামে একটা মিথ্যুক মেয়ে আছে, তার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে যেন মধু বেরোয়। আর ওর সঙ্গে কথা বলে ধমক দিয়ে। তৃষা নামে যে মেয়েটা আছে স্বপ্নীল কে উঠতে বসতে অপমান করে। সামান্য জিনিস নিয়েও অনেক কিছু শুনিয়ে দেয়। স্বপ্নীল চুপচাপ হজম করছে সবকিছু। দুটো মাস প্রায় হয়ে গেছে। আর একমাস বাকী।
সেদিন সফটওয়্যার আপডেট নিয়ে মিটিং হচ্ছিলো। সব কাজ গুছিয়ে ও করলো অথচ ক্রেডিট নিলো তৃষা। শাফি ভাই ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত, মুখ খিচিয়ে বলল,
“খাওয়া, আর হাগা ছাড়া তুমি আর কী পারো? এইখানে যে তুমি কোনোভাবে পার্মানেন্ট হইতে পারবা না সেইটা কী বুঝতে পারছ!”
স্বপ্নীল তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ও ভিজতে ভিজতে বাসায় চলে এলো। মা, ছোটপা, বুবুরা শপিংমলে গেছে। বাসায় শ্রাবণ্য আর দাদী ছিলো। দাদী স্বপ্নীল কে ভেজা দেখে অস্থির হয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে গেলেন। ও সরিয়ে দিয়ে চলে গেল। এমন কখনো করে না। শ্রাবণ্য দাদীকে বলল,
“দাদী বম দেখি। ”
শ্রাবণ্য ঘরে গেল। স্বপ্নীল ওয়াশরুমে। শাওয়ারের শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে। এতটা ভেজার পরও শাওয়ার ছেড়ে ভিজছে! এরপর তো জ্বর হবে৷ এমনিতেই ম মাস্বপ্নীলের ঠান্ডার ধাত আছে৷
শ্রাবণ্য ডাকলো,
“স্বপ্নীল শুনছেন? বেরিয়ে আসুন। কী হয়েছে আপনার? ”
স্বপ্নীল বেরিয়ে এলো দশ মিনিট পর। চুল ভালো করে মুছে বের হয় নি। শ্রাবণ্য বলল,
“এতো ভিজে এসেছেন তার উপর এত সময় ধরে শাওয়ার নিলেন। ”
স্বপ্নীল উত্তর দিলো না। শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“চা খাবেন? ”
“না।”
“কিছু হয়েছে মন খারাপ? ”
স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। ওর চোখ লাল। ভাঙা গলায় বলল,
“শ্রাবণ্য, আমি কী সত্যিই লুজার?”
শ্রাবণ্য তাকিয়ে রইলো। এতবড় একটা ছেলে এভাবে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। ও স্বপ্নীলের কাঁধে হাত রাখলো। স্বপ্নীল কাঁদছে, বাচ্চাদের মতো। শ্রাবণ্যর ভীষণ অসহায় লাগলো। মা কিংবা বুবু কেউ একজন থাকলে ভালো হতো। স্বপ্নীল কে সামলাতে পারতো। শ্রাবণ্য দুর্বল গলায় বলল,
“কাঁদবেন না…. প্লিজ কাঁদবেন না। ”
স্বপ্নীল শ্রাবণ্য কে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ্যর মনে হয়তো কোনো অনুভূতি তৈরী হয় নি, কিংবা অজান্তেই তৈরী হয়েছে যেটা ও বুঝতে পারছে। স্বপ্নীলের আলিঙ্গনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
***
রাফাত ছেলে হিসেবে সাধারণ পর্যায়ের। সাধারণেরও সর্বনিম্ন স্তরের। ওর এর আগে তিনজন গার্লফ্রেন্ড ছিলো তারা কেউই স্থায়ী হয় নি ওর স্বভাবের কারনে। যেমন ওর ইনকাম ছয় ডিজিটের। তবুও সারাবছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনটা শার্ট, প্যান্ট আর চারটা টিশার্টে চালিয়ে নেয়। একটা জুতাই সব পোশাকের সঙ্গে পরে। এমন না যে ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমাচ্ছে। টাকা পয়সা বিভিন্ন জন কে দিয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় কোনো ফকির কে খালি হাতে ফেরায় না। ওর মা ছাড়াও অন্যান্য মানুষজনকেও টাকা পয়সা দিয়ে রাখছে। আত্মীয়দের কারো বিপদ শুনলে আগ বাড়িয়ে টাকা দিয়ে আসে। তাদের আসলেই দরকার কিনা সেটার হিসাব করে না।
প্রথম গার্লফ্রেন্ড ও’কে ছেড়ে গেছে কারন রিলেশনশিপে ও নাকি পজেসিভ ছিলো না। দিনে আট, নয়বার ফোন করা উচিত কিন্তু সেটা ও করে না।
দ্বিতীয়জন একটু বেশী সাজুগুজু করতো। সে চাইতো ও একেক দেশ থেকে ব্র্যান্ডেড মেকাপ প্রোডাক্ট আনুক। ডেটে আসলে তার প্রধান কাজ ছিলো একটু পর পর কম্প্যাক্ট লাগানো। ব্যাপার টা রাফাতের খুব ই বিরক্ত লাগতো। আরে আল্লাহ যে চেহারা দিয়েছেন সেটা নিয়ে এতো অসন্তুষ্টি কিসের।
তিন নম্বর জন অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না। মা, খালারা মিলে বিয়ে ঠিক করেছিল। মেয়েটা সাউথ ইস্টে পড়ে। রেস্টুরেন্টে ইচ্ছেমতো খাবার নষ্ট করতো। রাফাতের সেটা ভালো লাগে নি। একদিন বলল, যতটুকু খেতে পারবে ততটুকু খাবার নিবে। মেয়েটা মাইন্ড করলো। মা, খালারা খুব রাগ করলেন। ওর মা রেগে গিয়ে অনেক কিছুর বাচ্চা বলেও গালি দিলো।
মেয়েটার সঙ্গে তারপরও কথাবার্তা এগোলো। মেয়েটা একদিন জানালো ওর ফোন টা পুরোনো হয়ে গেছে। এটার মানে হলো তাকে একটা ফোন কিনে দেয়া উচিত। কিন্তু রাফাত দেখলো ওর ফোন টা ঠিক ই আছে। ওর নিজের আগের ফোন টাই ছয় বছর ব্যবহার করেছে।
একদিন সেই মেয়েটাকে নিয়ে শপিংমলে গেল। সাড়ে তিন ঘন্টা লাগিয়ে জুতা, জামা, জুয়েলারি কিনে বিল দেবার সময় রাফাতের দিকে তাকালো। রাফাত ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমার দিকে কেন তাকাচ্ছ? তুমি বিল পে করো। ”
বিয়েটা ভেঙে গেল। রাফাত কে ফকিরের বাচ্চা বলেও মেসেজ করেছিল মেয়েটা। তার কিছুদিন পর রাফাত শীতে গরীব দু:খীদের কম্বল দিচ্ছিল। সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পর কমেন্টে লিখলো, ওদের একজন কে বিয়ে করে রাস্তায় থাকুন। বন্যরা বনে সুন্দর, রাফাতরা রাস্তাঘাটে।
রঙ্গনাকে বিয়ে করতে চাওয়ার একমাত্র কারণ, স্বাধীন, আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ় স্বভাবের কারনে। প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হলো সেদিন তিন ঘন্টা বিরক্তিহীন আলাপে শাড়ি, গয়না, মেকাপের আলাপ হয় নি। একবারও রঙ্গনা আয়নায় নিজেকে দেখে নি। খাবার পর বাকী খাবার টা ফয়েল পেপারে মুড়ে বিড়াল, কুকুর দের জন্য।
রাফাত অমন সংসারী টাইপের ছেলে না, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে বাড়ির কথা মনে পড়লে আসে। রঙ্গনাও প্রায় তেমনই। টিপিক্যাল বউ সেও হতে পারবে না।
এদিকে রাফাতের বাড়ির লোকের ধারণা রঙ্গনাই একমাত্র মেয়ে যে রাফাত কে সাইজ করতে পারবে।
এখন দেখা যাক এদের বিয়ের গল্প কতদূর এগোয়…..!
চলবে….
(কী করিলে বলো পাইবো তোমারে বইটার প্রি অর্ডার চলছে। সুহাস, শাওন দের বাকী গল্পটা জানতে বইটি অর্ডার করুন পছন্দের বুকশপে।)