#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২০
ব্যস্ততা মানুষ কে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। আকাশীর ক্ষেত্রে ব্যাপার টা তাই হলো। আগে রাত জেগে নিজের জীবনের ভুল ভাবনা গুলো ভেবে সময় নষ্ট হতো। এখন রাত জেগে শাড়ির কাজ চলে। রঙ্গনার বিয়ের শাড়িগুলোর ডিজাইন, স্টুডেন্ট দের জন্য নোট তৈরী করা, নিজের পড়াশোনায় আকাশী মোহাম্মদপুরের ঝগড়াঝাটি মান অভিমানে পাতানো সংসার আর সেই মানুষ টাকে প্রায় ভুলতে চলল। শুভ কেমন আছে, কোথায় আছে এখন আর জানতেও ইচ্ছে করে না।
ওদিকে শুভকে মায়ের চাপে পড়ে জেসমিন খালার মেয়ে জেরিন কে বিয়ে করেছে। শুভ আসলে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না যে ওর সাথে ঠিক কী ঘটতেছে! আকাশী চলে গেল রাগ করে, এরচেয়ে বেশী ঝগড়াঝাটি ভাংচুর হয়েছে এর আগে ওদের সংসারে। আকাশী নিজেও জেদ দেখিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। আকাশী ভাত রেঁধে ডিম ভেজে শুভ কে নিয়ে থমথমে মুখে খেতে বসেছে। অথচ সেদিন তেমন কোনো ঝগড়াও না। স্রেফ কথা-কাটাকাটিই তো ছিলো। তবুও এমনভাবে চলে গেল যে একবার যোগাযোগের নাম পর্যন্ত করলো না।
জেরিনের পয়সা আছে ভালোই। পড়াশোনা এসএসসি পর্যন্ত। আগে গার্মেন্টসে চাকরি করতো এখন একটা প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করছে। টাকা পয়সা ভালোই জমিয়েছে। শুভ কে পাঁচ লাখ দিবে ব্যবসার জন্য। শুভর মা মূলত এই লোভেই জেরিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে শুভর।
জেরিন ঘরে ঢুকেছে। শুভ আগে থেকেই ঘরে ছিলো। জেরিন কে দেখেই ওর মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। এর আগে জেরিনের সঙ্গে দুই তিন বার দেখা হলেও তেমন কথাবার্তা হয় নি৷ শুভর তখনও ও’কে ভালো লাগতো না। বিবাহিত ছিলো তখনও এমন সব সস্তা রসিকতা করতো। শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে জেরিন পথ আটকালো। শুভ তাকালো জেরিনের দিকে। বাড়াবাড়ি রকমের সাজগোজ। কড়া লিপস্টিক ঠোঁটে, শাড়িটাও কেমন করে পড়েছে। সাজগোজে কমলতার পরিবর্তে উগ্র ভাব বেশী। শুভ হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে জেরিন বলল,
“তেজ একটু পর দেখাও। আগে আমার কিছু ক্লিয়ার কথা শুনবা। ”
শুভ আবারও হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। জেরিন জোর করে শুভ কে বসিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে বসে বলল,
“আগের বেডিরে ডিফোজ দেয়ার ব্যবস্থা করবা তাড়াতাড়ি। তারপর টাকা পাইবা। আর সেই বেডির লগে কথাবার্তা দেখা সাক্ষাৎ সব বন্ধ। ভুলেও এইসব করতে যাবা না। আমি কিন্তু সহজ জিনিস না। ”
শুভ আগুন দৃষ্টিতে তাকালো। জেরিন শব্দ করে হেসে বলল, পাঁচ লাখ টাকা দিয়া কিনলাম তোমারে। একটা দুইটা কথা তো শুনতেই হইবে।
শুভ বুঝতে পারলো সামনে আরও কঠিন এবং ভয়ংকর পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে।
***
রঙ্গনার গায়ে হলুদ আগামীকাল। আরও দুদিন আগে থেকেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরী হয়েছে। মালেক মামার বউ এসেছেন মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের নাম বর্ষা। বর্ষা কলেজে পড়ে। এই বাড়িতে এর আগে অনেকবার এসেছে। আগে তো একমাস দুইমাস থাকতোও এসে। লাস্টবার মায়ের বেঁফাস কথাবার্তার কারণে দাদু আসতে বারন করে দিলেন। বর্ষার আগে স্বপ্নীল কে ভালো লাগতো একটু একটু। ওর ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। ঘরে ঢোকার সাহস পেত না। একদিন গিয়েছিল ছুতোনাতায়। স্বপ্নীল তখন মুভি দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছিল। বর্ষা মিনিট দুয়েক ওখানে ছিলো। স্বপ্নীল এয়ারফোন খুলে ও’কে বলল,
“তুমি কিছু বলবে?”
বর্ষা মাথা নেড়ে না বলল। স্বপ্নীল অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তাহলে যাও এখান থেকে। ”
বর্ষা অভিমানে সেদিন অনেক কাঁদলো। এক তরফা প্রেম টা এগুতে পারলো না মায়ের কারনে। বর্ষার মা কঠিন গলায় বলল, সিধা বলদ পোলার সঙ্গে তোর বিয়ে আমি কোনোদিন দিমু না।
বর্ষা সুন্দর স্বপ্ন দেখা তবুও বন্ধ হলো না। একদিন এত বড় বাড়ির মালকিন ও হবে। দাদু তখন মরে যাবে। স্বপ্নীল চাকরি বাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। বাড়ি সামলাবে ও। স্বপ্নীলের মা মিউ মিউ করে ওর সঙ্গে কথা বলবে।
বর্ষার স্বপ্ন ভেঙে গেল স্বপ্নীলের বিয়ের খবর শুনে। দুদিন কান্নাকাটি করলো। ওর গায়ের রঙ ফর্সা। এখনই অনেক সম্বন্ধ আসে। ও রাজী হয় না৷ এমন বড় বাড়িওয়ালা কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে।
বর্ষা শ্রাবণ্য কে দেখে মন ছোট করে থাকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে। পাতলা ঠোঁট, তারমধ্যে গোলাপি। মাথাভর্তি সিল্কি চুল। ও যদি এমন সুন্দর হতো তাহলে ওর নিশ্চয়ই স্বপ্নীলের সঙ্গে বিয়ে হতো।
বর্ষার মায়ের নাম বীনা। বীনা মেয়েকে নিয়ে পটুয়াখালী থাকেন। তার আসলে এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে। কিন্তু আফতাব চাচা তাকে পছন্দ করেন না। তিনি বলেন বীনা নাকি অনেক কথা বলেন। শুধু কথাই বলেন না এর কথা ওকে আর ওর কথা একে বলে ঝামেলা সৃষ্টি করেন। সে কারনে এতদিন এই বাড়িতে আসা বন্ধ ছিলো। আসল ঘটনা অন্য। আফতাব চাচা কোনো কারণে বুঝে গেছেন যে বর্ষার স্বপ্নীল কে পছন্দ।
বীনা এই বাড়িতে এসে মিশুক কে দেখে পছন্দ করে ফেললেন। কী সুন্দর চেহারা। বাপ, মায়ের একমাত্র ছেলে। বর্ষার সঙ্গে যদি বিয়ে হয়! কী ভালো মানাবে দুজন কে।
***
স্বপ্নীল অফিসে কিছু কার্ড নিয়ে গেল। শিলা বললেন নিয়ে যেতে। সবাই কে দিতে৷ শ্রাবণ্য বলল,
“সবাই কে দেবার দরকার নেই। অল্প কিছু মানুষ কে দিয়েন। যারা আপনাকে পছন্দ করে। ”
স্বপ্নীল দেখলো পুরো অফিসে তাকে মোটে তিনজন মানুষ পছন্দ করেন। প্রোজেক্ট ইন চার্জ শাকুর ভাই, কল সেন্টারের রিনা দিদি আর একাউন্ট ম্যানেজার আংকেল। শ্রাবণ্যর হিসাব অনুযায়ী এই তিনজন ছাড়া আর কাউকে দেয়া উচিত না। কিন্তু ম্যানেজার কে দিতে হবে। তাছাড়া অফিসের চেয়ারম্যান কে দেয়া দরকার।
তিনজন কে কার্ড দিতে গিয়ে স্বপ্নীল বিপদে পড়লো। বাকীরাও ছুটে এলো। ওর পাশের ডেস্কে একটা ছেলে বসে নাদিম নামে। সে সবাই কে ডেকে জড়ো করলো। শেষমেস দেখা গেল কার্ড যা এনেছে তা শেষ। ওর বোনের বিয়ে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্ল্যান পরিকল্পনা হয়েও গেল কে কে যাবে! খেয়েদেয়ে আসবে! অনেক দিন বিয়ের বাড়ির খাবার খায় না।
***
মিশুক চাচ্ছিলো না বিয়েতে থাকতে। কিন্তুও চলেও যাওয়া যায় না আসলে। ব্যাপার টা তখন অন্য গসিপে চলে যায়। যদিও ওর মনে হয় ও একটু বেশি কিছু ভাবছে। এসব গসিপ টসিপ আসলে কেউই করবে না। শিলা আন্টি, তুলি আপু গসিপের মানুষ না। রঙ্গনা ওকে পাত্তা যতটুকু দেয় সেটা কেবল পেয়িং গেস্ট হিসেবেই। দাদু সবসময়ের জন্যই কঠিন চোখে দেখেন।
শিলা আন্টি মিশুক কে বলেছিল বাড়িতে কার্ড পাঠানোর জন্য। মিশুকের আগ্রহ হয় নি।
গায়ে হলুদের আগের দিন বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে। পিঠে বানানো হচ্ছে নানানরকম। দাদী বলেছেন জামাইর সামনে অন্তত দশ রকমের পিঠে দিতে। সেটা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। আকাশী আর শ্রাবণ্য মিলে মেহেদী পরানোর দায়িত্ব পালন করেছে। আকাশীর মনোযোগ মেহেদী পরানোর চেয়েও অন্যদিকে বেশী। কাল বাবা, মা’ও এখানে থাকবেন। ও কী করবে! সুযোগ বুঝে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে!
***
বারোটা নাগাদ মিশুক বেরিয়ে এলো। গেটের সামনে বিশাল প্যান্ডেল করে হই হট্টগোল হচ্ছিলো। ও’কে যেতে দেখে শ্রাবণ্য বলল,
“এই যে ভাইয়া খাবার সময় আপনাকে দেখলাম না। খাওয়া হয় নি তাই তো। ”
মিশুক অস্থির হয়ে আছে। বেশী কথা বলার সময় নেই। ও বলল,
“শ্রাবণ্য আমি খাব না। আমাকে বাইরে যেতে হবে। ”
শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা? ”
“হ্যাঁ, মানে আমার আপুর হাজবেন্ডের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ঢাকায় আনা হচ্ছে। অবস্থা ক্রিটিকাল। ”
শ্রাবণ্য ছুটে গিয়ে খবর টা দিলো সবাই কে।
সেই রাতে সবকিছু বন্ধ রেখে তুলি, রঙ্গনা, শ্রাবণ্য, স্বপ্নীল, শিলা সবাই মিশুকের সঙ্গে হসপিটালে গেল।
মিশুকের দুলাভাই কে চৌদ্দব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। সেই চৌদ্দ ব্যাগের দুই ব্যাগ রঙ্গনা আর স্বপ্নীলের। স্বপ্নীল রক্ত দিতে চায় নি। রক্ত দেবার পর বেচারা জ্ঞান হারালো। তবুও শ্রাবণ্য আর রঙ্গনার চাপে রক্ত দিতে হলো।
চলবে….
(ভীষণ হাতে ব্যথা নিয়ে লিখছি। কাটা জায়গায় আবার ব্যথা পাইছি। মায়া দয়া হইলে লাইক কমেন্ট টমেন্ট কইরেন। আর বইয়ের প্রি অর্ডার বাকী থাকলে ইনবক্সে নক দিয়েন।)