#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৩
মিশুকের হাতে রঙ্গনার নাম মেহেদী দিয়ে লিখে দিলো শ্রাবণ্য। ওর বিয়ে হয়েছে ফকিরের মতো। মানে রঙ্গনা যেমন বলে। বিয়েতে গায়ে হলুদ টাইপ কিছুই হলো না। মিশুকের হালকা আফসোস হচ্ছে। খুব বেশী না। চমৎকার একজন মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বলেই আফসোস বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না।
শ্রাবণ্য মিশুক কে দেখে বলল,
“আপনাকে ভীষণ খুশি লাগছে? আপনি আবার রাফাত ভাইয়া কে কিডন্যাপ করেন নি তো? ওনাকে পাওয়া গেল আপনাদের বিয়ের ঘন্টা তিনেক পর। ”
মিশুক শ্রাবণ্যকে দেখলো মিটিমিটি হাসছে। ও হেসে বলল,
“তুমি কী তাহলে আমার শালীর জায়গাটা নিচ্ছো?”
শ্রাবণ্য শব্দ করে হেসে ফেলে বলল,
“আপনি মনে মনে চাইছিলেন যেন বিয়েটা নাহয় তাই তো?”
“তুমি কী করে বুঝলে? ”
“আমি বেশ কিছু দিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করেছি। শুকিয়ে যাওয়া আপেলের মতো হয়েছিল আপনার চেহারা। দেখে মনে হতো কষ্টে আপনার বুক ফেটে যাবে এক্ষুনি। ”
মিশুক এবার শব্দ করে হাসলো। একটু সচেতন হলো অবশ্য। ওর বউ যে পরিমাণ রাগী। বেরিয়ে এসে আগুন চোখ তাকিয়েই সব কিছু ভষ্ম করে দিবে। শ্রাবণ্য ওর সঙ্গে এর আগে তেমন কথাবার্তা বলতো না প্রয়োজন ছাড়া। আর এখন কী সুন্দর কথা বলছে। এই বাড়ির মানুষজন কে মিশুকের ভালো লাগে, যাকে বিয়ে করেছে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশী ভালোই লাগে। তবে ওর একটু নার্ভাস লাগছে। যেভাবে সবকিছু হুট করে হয়ে গেল! এরপর কী কী হবে কে জানে! রাফাতের সঙ্গে এক্সাক্টলি কী হয়েছে জানে না ও। ভদ্রলোক এসে কী কোনো ঝামেলা করবে! সেরকম কোনো চান্স আছে কিনা!
শ্রাবণ্য বলল,
“আপনি ঘুমাবেন না?”
মিশুক ঘড়ি দেখলো। রাত প্রায় শেষ হতে চলল। চোখে ঘুম নেই অবশ্য, মাথাটা একটু ভারী লাগছে, এই যা।
মিশুক বলল,
“না ঘুমালেও হয়। তবে রেস্ট নেয়া দরকার। ”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“চলুন আপুর ঘরে নিয়ে যাই। ”
“নিয়ে যেতে হবে না। আমি যেতে পারব। তুমি ঘুমাতে যাও। ”
“শিওর? একা যেতে পারবেন?”
মিশুক হেসে বলল,
“হ্যাঁ আমি রঙ্গনার ঘর চিনি। ”
“আচ্ছা। ”
মিশুক হঠাৎ শ্রাবণ্যকে ডেকে বলল,
“শোনো শ্রাবণ্য, তুমি শালীর ভূমিকায় বেশ ভালো অভিনয় করছ। দশে দশ। ”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“কিছু ফকির মিসকিন খাইয়ে দিয়েন। আল্লাহ আপনার মনের আশা পূরন করছেন। ”
***
মিশুক ঘরে ঢুকলো ভয়ে ভয়ে। কিসের ভয় সেটা জানেনা। তবে বুক দুরুদুরু করছে। রঙ্গনা জানালার কাছে বসে ছিলো। দরজার শব্দ পেয়ে মিশুকের দিকে তাকালো। মিশুক বলল,
“হাই। ”
রঙ্গনা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বিছানার কাছে এলো। বিছানার মাঝখানে কিছু গোলাপের পাপড়ি রাখা। রঙ্গনা সেগুলো একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
“একটু রেস্ট নাও। তোমার অনেক প্রেশার যাচ্ছে। ”
মিশুক স্মিত হাসলো। যে নিজে আজ মহাযুদ্ধ সামলেছে সে ওর প্রেশার নিয়ে তটস্থ।
রঙ্গনা ব্যস্ত হাতে ফুলগুলো সরাচ্ছে। মিশুকের চোখ দেয়ালের পেইন্টিং গুলোর দিকে। কী সুন্দর! ভাবতেই ভালো লাগছে এগুলো ওর বউয়ের নিজের হাতে আঁকা।
“মিশুক শু’য়ে পড়ো। ”
মিশুক চমকালো এক সেকেন্ডের জন্য। রঙ্গনা কী সুন্দর করে মিশুক ডাকলো! রঙ্গনা সম্ভবত নরমালি নাম ধরে ডেকেছে। ওর কাছে শুনতে ভালো লেগেছে। যাকে ভালো লাগে, তার সবকিছুই বোধহয় ভালো লাগে। মিশুকের মনে হলো রঙ্গনার রাগ, ঝগড়াঝাটি এগুলোও ওর ভীষণ ভালো লাগবে।
“তুমি ঘুমাবে না। ”
রঙ্গনা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম পেলে শুয়ে পড়ব। আমার রাত জাগার অভ্যাস, এজন্য বোধহয় ঘুম আসছে না। ”
মিশুক রঙ্গনার হাত ধরলো। ধরে চমকে উঠলো।
“ইশ! তোমার এতো জ্বর!”
রঙ্গনা অপ্রস্তুত গলায় বলল,
“তেমন কিছু না।”
মিশুক তাকালো রঙ্গনার দিকে। এতো জ্বর নিয়েও বলছে তেমন কিছু না। মিশুক শ্রাবণ্য কে ফোন করে বলল কিছু খাবার আর ওষুধ নিয়ে আসতে। শ্রাবণ্য এলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। পুডিং, ফ্রুট কাস্টার্ড নিয়ে এলো। শ্রাবণ্য থাকতে চাইলেও মিশুক থাকতে দিলো না। ও নিজেই রঙ্গনাকে জোর করে খাবার খাইয়ে দিলো, ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষন পর বাতি নিভিয়ে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো।
রঙ্গনার মাথা ব্যথা করছিল। মিশুক কে সেটা বলে নি, তবুও ও মাথা টিপে দিচ্ছিলো। রঙ্গনা নিচু গলায় বলল,
“লাগবে না মিশুক। তুমি ঘুমাও।”
“লাগবে। জ্বর হলে তোমার মাথা ব্যথা হয়,আমি জানি।”
রঙ্গনা প্রশ্ন করলো না যে কিভাবে জানে ও। মিশুক জিজ্ঞেস করলো,
“এখন ভালো লাগছে? ”
“হু। ”
“স্ট্রেস নিও না আর।”
রঙ্গনা চুপ করে রইলো। মিশুকের ইচ্ছে ছিলো রঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি ঝোকের মাথায় বিয়েতে হ্যাঁ বলেছ নাকি রাগের মাথায় বলেছ। রাগের মাথায় বললে সমস্যা নেই। রাগের অপর পিঠে অনুরাগ থাকে। কিন্তু ঝোকের মাথায় হলে সমস্যা। আর দাদী বলল না বিয়ের জোড়া উপরওয়ালা ঠিক করেন। মানুষের হাত থাকে না। আমারও তাই মনে হয়। আমিতো দূরেই ছিলাম, তোমার বিয়ের কোনো ইভেন্টে ছিলাম না। তাই আমার নজর লেগে কিছু হয় নি।
এসব কিছুই মিশুকের বলা হলো না। রঙ্গনা ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের আলো ফুটে গেছে। জানালার পর্দা সরানো, বলে আলোটা ঘরে ঢুকেছে। মিশুক জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে মোবাইল টা হাতে নিলো। রঙ্গনা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোনো মন খারাপের চিহ্ন নেই, ক্লান্ত স্নিগ্ধ মুখ। মিশুক রঙ্গনার কপালে অনেকক্ষন ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে চুমু খেল। ভাগ্যিস মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। নাহলে এই কাজ টা করতে পারতো না।
***
শ্রাবণ্য ঘুমাতে এলো সকালের আলো ফোটার পর। না চাইতেও বিয়ের পর ও অনেক টা বড় হয়ে গেছে। বিয়ের পরের জার্নিটা মেয়েদের জীবনে এক অদ্ভুত জার্নি। অনেক অসাধ্য সাধনও কিভাবে যেন হয়ে যায়। সবকিছু সামলে ও এখন ঘুমাতে এলো। ঘরে ঢুকে দেখলো স্বপ্নীল গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। শীত লাগছে ভেবে কম্বল টা গায়ে তুলে দিতেই স্বপ্নীল বলল,
“আমি ঘুমাই নি শ্রাবণ্য।”
“কেন? অনেকক্ষন আগে এসেছেন ঘুমাতে। ”
স্বপ্নীল উঠে বসে বলল,
“আমার ভীষণ মন খারাপ।”
শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের মাথার কাছে বসে বলল,
“আর মন খারাপ করবেন না। আপুর বিয়েতে তো হয়ে গেছে। মিশুক ভাইয়াও অনেক ভালো। ”
“জানি, তবুও আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।”
শ্রাবণ্য আর কিছু বলল না। স্বপ্নীল আজ অনেক কেঁদেছে। ছোট আপু ও’কে শাসন করে বলে ওর অনেক রাগ। তবুও সেই রাগের চেয়ে ভালোবাসাটা অনেক বেশী দেখেছে।
শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে বলল, আপনি এদিকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম এসে যাবে।
স্বপ্নীল বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লো।
***
আজকের সকাল টা হতে পারতো রাফাতের জীবনের সুন্দর সকাল গুলোর একটা। কিন্তু কুচক্রী রা সেটা হতে দেয় নি। রাফাত বিশ্বাস করতে পারছে না যে মা, মামী এরা এরকম একটা কাজ করতে পারে। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাবার উপক্রম। মাথা চেপে ধরে বসে আছে। ঘরের চারদিকে বসা লোকজন কে ও এক এক করে দেখছে। এরা ওর ই আত্মীয় স্বজন, আপনজন। যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য একটুও অনুতপ্ত নয়। অন্তত মুখ দেখে তাই ই মনে হচ্ছে। রাফাতের বাবা, মামা এরা পরে জানতে পেরেছেন। তারাও তাদের স্ত্রী দের সাথে সহমত হয়েছেন। সাংসারিক ব্যাপার তারা কিবা বোঝেন। মহিলাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। তারা তাই ঠিক ই করেছেন। তবে রাফাতের খালু চিন্তিত। আফতাব সাহেব যতখানি সুবিধার লোক ততখানি অসুবিধার লোক। এই লোক নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। আবার থাকতেও পারে, মেয়ের পরিবার সবসময় তেজ দেখাতে পারেন না।
রাফাত অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“মা তুমি! তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। ”
রাফাতের মা অন্যদিকে মুখ করে বললেন,
“জানি চিনতে পারবি না। কারণ ওই বাড়িতে চিনি পড়া খাইয়েছে তোকে। ”
রাফাত অবাক গলায় বলল,
“তুমি অশিক্ষিত’র মতো কথা বলছ কেন?”
মামী মাঝখানে বলে উঠলো,
“মায়ের সাথে এইগুলা কেমন কথা বলো রাফাত। রঞ্জনা তোমার মাথা তো পুরাই খাইছে দেখতেছি। ”
রাফাতের মা অনুযোগের সুরে স্বামী কে বললেন,
“আমি যা করছি একদম ঠিক করছি। দশ মাস পেটে ধরছি আমি আর আমার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পাবে পরের বাড়ির মেয়ে! সে যা বলে তাতেই তাকধিনা ধিন করে নাচে। ”
রাফাতের খালাও এই মিটিং এ উপস্থিত। তিনি পান খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন এতক্ষন। এবার মুখ খুললেন। বললেন,
“আমরা তো চাইছিলাম একটা শিক্ষা দিতে। কিন্তু তারা এতো জলদি পাত্র পাইলো কোথায়! মাইয়ার চরিত্র ঠিক নাই। ”
রাফাত চিৎকার করে বলল,
“খালামনি চুপ করুন। আপনারা যা করছেন এরপর আপনাদের কেউ ভালো চরিত্রের লোক বলবে!”
রাফাতের মা ছুটে এসে ছেলের চুল ধরে কয়েকটা থাপ্পড় মারলো। মারা শেষ করার পর নিজে কাঁদতে শুরু করলো। রাফাত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রঙ্গনাকে ও কিভাবে ফেইস করবে! কিভাবে! ওর আসলে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। তুলি আপু সেদিন ও’কে বলেছিল, রাফাত আমার ব্যাপার টা ভালো লাগছে না। তোমাদের বাড়ির লোকজনকে একটু বেশি ই ডেস্পারেট মনে হলো। তারা চাইছেন কিছু একটা ঝামেলা করতে। রাফাত ব্যাপার টা হালকা ভাবে নিয়েছে। ওর পরিবার একটু এরকম সেটা ও জানে। রঙ্গনারা অন্যরকম। কিন্তু মায়ের এমন রূপ থাকতে পারে সেটা ও কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি।
ওর মান, সম্মান সব গেল। প্রফেশনাল, পার্সোনাল সব মানুষ কে বিয়েতে ইনভাইট করেছে। হোয়াটসঅ্যাপে একশর বেশী ম্যাসেজ। দশ বারোটা ম্যাসেজ দেখেই বুঝতে পারলো সবাই ও’কে শেইমলেস বলছে। আর রঙ্গনা! ও’কে কী জবাব দিবে!
রাফাতের দিশেহারা লাগলো। এতো খারাপ সময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। এসবের চেয়ে মা তো মামীকে দিয়ে বিষ খাইয়ে দিতে পারতো।
***
রাফাতের মা, মামী ভেবেছিল শিলার ওটা ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। বারোটার দিকে মামা, মামী, খালা, খালু, বাবা, মা আর রাফাত কে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। তাদের বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা আর জালিয়াতি মামলা করেছে। রাফাতের মা আর মামী যখন গুজগুজ ফিসফিস করে এবাড়ি থেকে কিছু দিবে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছিল তখন বর্ষার মা ওখানে ছিলো। তিনি কান খাড়া করে যা শুনলেন তারচেয়ে বেশি বানিয়ে বললেন শিলাকে।
থানায় গিয়ে রাফাতের মা বললেন,
“আপা আমরা যৌতুক কবে চাইলাম? বিয়েতে তো আমাদের কোনো দাবি ছিলো না। আর রাফাত রে আমরা কেন আটকায়ে রাখব? মান সম্মানের ভয় নাই আমাদের। ”
শিলা ঠান্ডা গলায় বললেন, সব প্রমাণ আদালতে দেব। আমরা অলরেডি মামলা করেছি। আশা করছি রাফাতের চাকরিটাও চলে যাবে। সেখানেও কমপ্লেইন করব।
রাফাতের মা চোখে শর্ষেফুল দেখতে লাগলেন।
শিলা রাফাত কে বললেন, আমি মানলাম তোমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুমি কী তোমার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে?
রাফাত এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল। শিলার মনে হলো এই ছেলেটি আসলেই এসব ঝামেলায় নেই। তাই রাফাত কে ছাড় দিলো।
রাফাতের স্বাক্ষীর কারনে হোক আর অন্য কোনো কারণে হোক কেউই জামিন পেল না।
ব্যাপার টা নিয়ে অনলাইন পোর্টালেও ভীষণ লেখালেখি হলো। কিছু পত্রিকায়ও লেখা হলো।
চলবে…..