কুসুম_কাঁটা #পর্ব-২৮

0
448

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৮
শ্রাবণ্য আজ অনেক দিন পর নরসিংদী এলো। একাই এসেছে, কাউকে জানায়ও নি। রেহানা, মুনসুর দুজনেই ভীষণ অবাক হলো। শ্রাবণ্য এই বাড়িতে আসতে চায় না। পড়াশোনার অজুহাত ছাড়াও আরও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায়। মুনসুর বুঝতে পারেন শ্রাবণ্যর অভিমান আছে। তবে রেহানা সেটা বুঝতে চায় না। তার ধারণা মেয়ে সবকিছু অতিরিক্ত বোঝে। রেহানা বললেন,

“ঝগড়াঝাটি করে আসলি? জানালি না আগে কিছু? ”

শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“ঝগড়াঝাটি করে এখানে কেন আসব? আর না জানিয়ে আসলে সমস্যা কী! ”

রেহানার মেজাজ খারাপ হলেও তিনি শান্ত রইলেন। মেয়েদের কাছে তিনি এমনিতেই দূরের মানুষ৷ মুনসুরও আজকাল তাকে দোষারোপ করতে ছাড়ছেন না। মেয়েরা, ছেলের বউ কারও সঙ্গে তেমন সদ্ভাব নেই এই দোষ যেন রেহানার একারই কেবল। কেন সে তো চেয়েছে সবার সাথে মিশতে। শ্রাবণ্যকে প্রতিদিন ফোন করে। শ্রাবণ্যই তো বিরক্ত গলায় বলে, আমি প্রতিদিন ই খাই মা, ভালোও থাকি। আর খারাপ থাকলেও সেটা তোমাকে জানাব না। প্রতিদিন ফোন করার দরকার নেই।

রেহানা আবারও প্রশ্ন করে,

“ব্যাগপত্র কিছু আনো নাই? থাকবি না?”

“না। বাবার সাথে আমার কথা আছে। আজ সন্ধ্যের বাসেই ফিরে যাব। ”

“এইভাবে কেউ আসে? দুটো দিন থাকলে কী হয়!”

“আমার ভালোও তো লাগতে হবে। আমার ভালো লাগে না। ”

রেহানার এবার খারাপ লাগলো। শ্রাবণ্য তার সাড়ে নয় মাস পেটে ধরা মেয়ে। এই মেয়ে কেন তার সাথে এভাবে কথা বলবে! কই অন্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় তো ওর চোয়াল শক্ত হয় না। রেহানা আবারও বলল,

“শিউলিকে ফোন করি, ও আসুক। আজ থেকে যা। ”

শ্রাবণ্য জবাব দিলো না।

শ্রাবণ্য মুনসুরের সঙ্গে কথা বলল ঘরের দরজা বন্ধ করে। বন্ধ ঘরে কী কথা চলছিল সেটা রেহানা জানে না। তিনি শ্রাবণ্যর জন্য রান্না চাপিয়েছিল। বড় চিংড়ি নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না করলে শ্রাবণ্য খুব পছন্দ করে। শ্রাবণ্য সেসব কিছু খেল না। ঠিকে কামলাদের জন্য বাসার সামনে বড় হাড়িতে গরুর মাংস, পাতলা ডাল রান্না হলো সেটা দিয়ে ভাত খেল। রেহানা রাগে, দু:খে বললেন,

“কী সমস্যা তোর? আমার সাথে এমন কী কারনে করতেছিস?”

শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“ছোট আপুর বিয়ে নিয়ে বর্ষার মা’কে তুমি কিছু বলেছিলে?”

রেহানা এক সেকেন্ডের জন্য থম মেরে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে বলল,

“নাহ। ”

“বর্ষার মা মামী যদি ওই কথাগুলো বানিয়েও বলে থাকে তবে তোমার নাম কেন বলল? ”

রেহানা রঙ্গনাকে নিয়ে কিছু কথা বলেছিল। রঙ্গনার স্বভাব, মেজাজ এসবের কারণে বিয়েতে ঝামেলা হয়েছে। এমন মেয়েকে কেই বা ঘরের বউ বানাতে চাইবে। কিন্তু বর্ষার মা সেটা আবার বলে দিলো! তিনি নিজেও তো তখন রেহানার কথায় সায় দিয়েছিল!

শ্রাবণ্য বলল,

“ওই বাড়ির সবাই তোমার বলা কথাগুলো জানে। প্লিজ মা, এতোটা ঘৃনায় কাউকে আর দেখো না। খুব খারাপ লাগে। তোমার যেটা অপছন্দ সেটা বেঠিক, আর যেটা পছন্দ সেটা ঠিক এটা ভাবা বন্ধ করো। ”

রেহানা কথা বলছে না। মেয়ের মুখে জ্ঞানের কথা শুনতেও ভালো লাগছে না। তবুও চুপচাপ রইলেন।

***
শ্রাবণ্য বাবার কাছে বড় অংকের টাকা চাইতে এসেছে। এই টাকাটা আকাশীকে দিবে, ও গুছিয়ে ব্যবসা দাঁড় করুক। পরিশ্রম করার মানসিকতা আছে, ঠিক পারবে। বাবার টাকা এরপর ফিরিয়ে দিলেই হবে। শ্রাবণ্য পারতো মায়ের কাছ থেকে নির্লিপ্ত থাকা শিখতে। আকাশীর জন্য ও অনেক কিছু সহ্য করেছে। সেই রাগে হিংস্র হতে পারতো। কিন্তু ও জানে হিংস্রতা রাগ দিয়ে আসলে কিছু লাভ হয় না। বরং কাছের দূরের মানুষ গুলোকে হারাতে হয়। এই উপলিব্ধি এসেছে শিউলি আর শিলার থেকে। দুজনেই ও’কে বুঝিয়েছে ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু হয় না। সত্যিই কিছু হয় না।

***
রঙতুলিতে আজ একজন নতুন মানুষ এসেছে। রিন্টি, মন্টির বাবা। ভীষণ মেধাবী এই ভদ্রলোকের নাম তৌহিদ। তৌহিদ কে এই বাড়ির অনেকেই পছন্দ করে না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রঙ্গনা আর দাদু। তৌহিদ খুব ডমিনেটিং স্বভাবের। তুলির মতো শান্ত, লাজুক মেয়ের জন্য কোনোভাবেই ঠিক চয়েজ না। তবুও তুলি তাকে পছন্দ করলো। তুলির বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করেছিল দাদু। বেচারি লজ্জায় তার পছন্দের কথা কাউকে বলতে পারলো না। রঙ্গনা তখন তুলির সঙ্গে একসাথে ঘুমায়। গায়ে গা মিশিয়ে। পর পর কয়েকদিন টের পেল তুলি কাঁদছে। দাদু সেটা শুনে বিয়ে ভাঙলেন। তুলির পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করলেন। পাত্র সব দিক থেকে ভালো। তার পরিবারও সবাই শিক্ষিত। বিশেষ অনুষ্ঠান কিংবা মিলাদে সবাই একত্রিত হয়। এছাড়া যে যার মতো থাকে। বিয়ের রাতে রঙ্গনা বন্ধু, কাজিন দের সঙ্গে আড্ডা টাইপ একটা আয়োজন করেছিল। সেখানে হঠাৎ বলে উঠলো,

“এক্সকিউজ মি রঙ্গনা। তোমাদের এসব খ্যাচর ম্যাচর কবে শেষ হবে? আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।”

রঙ্গনা হতভম্ব হয়ে গেল। নতুন দুলাভাই কে নিয়ে ওর সমস্ত আগ্রহ নিভে গেল। এই কথা শিলা শুনে খুব হেসেছে। বলেছে, তোর এতো রাগ কেন লাগছে? তুই নিজেও তো এমন।

এরপর আর কোনোভাবেই রঙ্গনার তৌহিদ কে ভালো লাগে নি৷ আর দাদুর অপছন্দের কারণ অন্য। তৌহিদ তুলিকে কানাডা নিয়ে যেতে চায়। সেই কারণে তার অপছন্দ।

তৌহিদ ফেরার পর পর ই দাদুর ঘরে গিয়ে বলল,

“দুই দুইটা বিয়ে আমাকে ছাড়াই হচ্ছে? আমার কোনো গুরুত্ব নেই?”

দাদু চশমার ফাঁকে একবার দেখে বললেন,

“আসছ বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে। ”

“বিশ্রামের তো কিছু নেই৷ আমি তো প্লেনে আসছি। বাস, ট্রেনে আসি নাই৷ ”

দাদু বই সামনে ধরে বসে আছেন। এই ছেলেটাকে দুটো থাপ্পড় দিতে পারলে স্বস্তি লাগতো। কিন্তু তুলি মন খারাপ করবে তাই করা যায় না।

দাদুকে তৌহিদের হাত থেকে বাঁচালেন শিলা। শিলাকে আবার তৌহিদ সমীহ করে। তৌহিদ ঘরে গেল, ও না জানিয়ে এসেছে। তেমন কারোর মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। রিন্টি, মন্টি ও’কে দেখে বলল,

“বাবা আমরা বিদেশ যাব না। তুমি মা’কে নিয়ে যেও। আমাদের মনি আর মিশুক বাবার কাছে রেখে যাও। ওরা আমাদের দত্তক নিবে। ”

তৌহিদের মেজাজ খারাপ হলো। তুলিকে দেখেও মনে হচ্ছে খুশি না। তুলিকে বলল,

“তুমি খুশি হও নাই?”

তুলি বিস্মিত গলায় বলল,

“হ্যাঁ খুশি তো৷ এভাবে কেন বলছ?”

“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না। তোমার মুখে আলগা হাসি। আমাকে দেখে তোমার অট্টহাসিতে ফেটে পড়া উচিত ছিলো। ”

তুলি অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অট্টহাসিতে কিভাবে খুশি প্রকাশ পায় সেটা বুঝতে পারছে না।

***
তৌহিদের মেজাজ ঠিক হলো মিশুক কে দেখে। হ্যান্ডসাম, জেন্টেলম্যান মিশুক কে দেখে নিজের মাথায় হাত চলে গেল আপনাআপনি৷ টেনশন, প্রেশারে চুল কমতে শুরু করেছে। মিশুক কে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বলল,

“রেগুলার জিম করো?”

মিশুক একটু খুঁতখুঁতে টাইপ। প্রথম দর্শনে তুমি ব্যাপার টা হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে হবে। এই বাড়ির মানুষজন অন্যরকমই। এই যেমন দাদী ও’কে দেখলে লজ্জা পায়। লাজুক হেসে মুখ ঢেকে রাখে। এই লজ্জা রঙ্গনা পাবার বদলে উনি কেন পাচ্ছেন মিশুক সেই লজিক খুঁজে পায় নি। তবে তার মধ্যে সুইট একটা ব্যাপার আছে৷ শ্রাবণ্য কে ভাবী আর মিশুক কে দুলাভাই বলে ডাকেন। এই ডাক টা আন্তরিক।

তৌহিদ একে একে মিশুকের খোঁজ খবর নিলো। মিশুকের ইনকাম, সম্পত্তি সবকিছু শুনে শেষমেস বুঝলো যে না জামাই হিসেবে সে এগিয়ে। একদম দশে দশ পাবার মতো। মিশুকের চেয়ে চারগুণ ইনকাম তার। ঢাকায় বাবার সম্পত্তি থেকেও ভালো কিছু পেয়েছে। তাছাড়া নিজেও কিছু প্রোপার্টি করার চেষ্টায় আছে। এরপর ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেল। মেজাজ এতোটাই ফুরফুরে ছিলো যে আটজনের রান্না মাংস একা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো।

****
ফোনের ওপাশ থেকে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নার শব্দ আসছে।

“রাফু, আমার সোনা বাবা। আমার ময়না পাখি আর কত রাগ করে থাকবি? তুই কী চাস আমি মরে যাই।”

রাফাত চুপ করে আছে। মায়ের নতুন নাটক শুরু হয়েছে ইদানীং। এতো সুন্দর, কোমল গলায় সে কখনো কথা বলে না। এর আগে যেকোনো ব্যাপারে রাফাতের সাথে না মিললে বিভিন্ন প্রানীর বাচ্চা বলে গালিগালাজ করে অসুস্থ হবার নাটক করতেন। এইবার ব্যতিক্রম ব্যাপার ঘটছে।

রাফাত হাই তুলে বলল,

“তুমি কী চাও মা পরিষ্কার করে বলো। টাকা, পয়সা নেই। পথের ভিখিরি আমি। ”

রাফাতের মা কান্নার সুর আরেকটু বাড়িয়ে বলে, বাসায় আয় কতদিন দেখি না তোরে।

রাফাতের মনে দুশ্চিন্তা। মা আবার কী প্ল্যান করছে! ওর জন্য এতো আদর, ভালোবাসা যার সে তো বিয়ের দিন ক্রিমিনালের মতো আচরণ করবে না।

রাফাত গম্ভীর গলায় বলল,

“মা আমি আর তোমার মিষ্টি কথায় ভুলছি না। তোমাকে ক্ষমা করতে সময় লাগবে। আমাকে সময় দাও। সীতা যেমন অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিল তেমন তোমাকেও পরীক্ষা দিতে হবে। ”

রাফাতের মা গুনগুন করে কান্নাকাটি করলেন আরও কিছুক্ষন। তার দোষ নাই, সব দোষ রাফাতের মামীর। সে এতো খারাপ না। রঙ্গনাদের বাড়ির সবার পা ধরে বসে থাকবে তিন দিন।

রাফাতের হালকা একটু মন নরম হলো। সেই সময় ঘটলো বিপত্তি। ডোর বেল বাজলো। আকাশী এসেছে। রাফাত ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“তুমি?”

আকাশী মিষ্টি হেসে বলল,

“খাবার নিয়ে আসছিলাম। খাওয়া হয় নি তো?”

“না, না। এসো এসো। ”

রাফাতের মা পুরো কনভার্সেশন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিলো।

চলবে….

(বইমেলায় অন্যধারার স্টলে পাওয়া যাবে রোমান্টিক উপন্যাস কী করিলে বলো পাইবো তোমারে। স্টল নং ৪১-৪৪। অনলাইনে সংগ্রহ করতে পারবেন রকমারি থেকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here