#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৯
শ্রাবণ্যর কাছ থেকে টাকা পেয়ে আকাশী প্রথমেই একটা বাসা ভাড়া নিলো। এটা করতে অবশ্য ওর খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। একলা মেয়েকে কেউ বাসা ভাড়া দিবে না, এদিকে ওর বাসা দরকার। হোস্টেলের ছোট জায়গায় জিনিসপত্র রাখার জায়গা কম, সবাই ঘুমিয়ে গেলে রান্নাঘরে চুপি চুপি শাড়িতে লাগানোর জন্য রঙ জ্বাল দিতে হয়। এরপর ডিজাইন শেষ করে শুকানোর জন্য বড় স্পেস লাগে।
আকাশী আফরিন কে সঙ্গে নিয়ে নিলো। দুজন মিলে দুই রুমের ফ্ল্যাট নিলো। সেখানে নিজের ঘরে গুছিয়ে কাজ শুরু করলো। অনলাইনে অর্ডার কম হলেও অফলাইনে অর্ডার ভালোই পাচ্ছে৷ রঙ্গনার বন্ধুদের কারণে কাজের পরিমাণ বেশী। তারা অনলাইনে পজিটিভ রিভিউও দিচ্ছে। আকাশী শাড়ির পেজের নাম দিলো রঙ্গনা। রঙ্গনা প্রথম দেখায় ও’কে বিশাল এমাউন্ট এডভান্স দিয়েছিল। রঙতুলির মানুষজন ও’কে এপ্রিশিয়েট করেছে। পেজের নাম এটা হলেই ভালো হয়।
দ্বিতীয় কাজ টা করলো শুভ রিলেটেড। শুভ কে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠালো। এখানেও জীবন টাকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা। শুভ হুটহাট চলে আসে। জীবনে আরেকবার পা হড়কে খাদে ও পরতে চায় না। শুভ নিজের জীবনে যে ভুল করেছে সেটার মাশুল ও গুনুক। আর কোনো দায় ও নিতে চায় না।
আকাশীর সকাল হয় ব্যস্ততা দিয়ে, দুপুরে খাবার খায় কাজের মধ্যে, রাতেও তেমন। এখন আর ঘুমের সমস্যা নেই। ঠিক, ভুল ভেবে রাত পাড় হয় না।
***
রাফাত নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। বাড়ির সঙ্গে যে দূরত্বটা আছে সেটা এমনই থাকুক। মা, বাবা, আত্মীয়দের আসলেই একটা শিক্ষার দরকার। নাহলে একই ভুল বারবার করবে। হতে পারে এরচেয়ে বড় ভুল করে বসে রইলো। তার চেয়ে এই দূরত্ব ঠিক আছে।
রাফাতের এই নির্বাসনে ও ছোট বড় অনেক ব্যাপার শিখেছে। ইউটিউব দেখে কিছু রান্না শিখেছে, ঘর গোছানো, নিত্য নৈমিত্তিক কাজের শর্টকাট কিছু টেকনিক শিখেছি। আসলে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব না থাকলেও জীবন অতো কঠিন হয় না। শুধু ভালো থাকার পদ্ধতিটা জানতে হয়। প্রচুর মুভি, সিরিজ জমেছিল ওগুলো শেষ করে। ভালো মন্দ মিলিয়ে বেশ কিছু বইও পড়া হয়েছে। এই লাইফ টাকে আরেকটু উপভোগ করার জন্য অফিসে মেইল করেছে আরও তিন মাস ছুটির জন্য। পুরোপুরি মেন্টালি ফিট হয়ে ফিরতে চায়। অফিস এখনো এপ্রুভাল মেইল পাঠায় নি। পাঠালে আরও কিছু প্ল্যান বাড়বে।
তবে রাফাতের একটা জায়গায় এসে ভীষণ সমস্যা হয়। একজন মানুষের অভাব তখনই ফিল করে যখন কথা বলতে ইচ্ছে করে। দুর্দান্ত সিরিজ টা শেষ করে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য একজন মানুষের দরকার হয়। পছন্দের বইটার শেষটুকু ভালো না লাগলে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য একজন মানুষ কে লাগে। রাফাতের সেই একজন মানুষের জায়গাটা আকাশী পূরন করে ফেলল। কিন্তু মেয়েটা মারাত্মক ব্যস্ত থাকে। রাফাতের মতো না। টিউশন পড়িয়ে, ব্যবসার কাজে ছুটছে। তারপর রাত জেগে পড়াশোনা করছে।
রাফাত প্রায় রাতেই ফোন করে। দুটো, তিন টে যখন ফোন করে মেয়েটা জেগে থাকে। হয় কাজ করে নাহয় পড়াশোনা করে। কাজ করলে রাফাতের লাভ, ও কিছুক্ষন মন খুলে কথা বলতে পারে। পড়াশোনা করলে লস, তখন সৌজন্যতা দেখিয়ে ফোন রাখতে হয়।
এই অভ্যাস দিন দিন খারাপ অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। রাফাতের বোধহয় উচিত এটাকে বাড়তে না দেয়া, কিন্তু সেটা পারছে না। আকাশী যেদিন দেখা করবার সময় দেয়, সেদিন ওর অন্যরকম লাগে। ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে যাবার আগে আনন্দ অনুভব হতো ঠিক তেমন অনুভূতি।
রাফাত আজ এসেছে আকাশীর সঙ্গে দেখা করতে। আকাশী এলো মিনিট দশেকের মধ্যে। সব চুল একসঙ্গে উঠিয়ে উঁচু করে বাঁধা, রোদে পুড়ে ফর্সা রঙ টা তামাটে লাগছে, ঠোঁটও শুকনো। মুগ্ধ হবার মতো কিছু নেই, তবুও ওর মনে হলো এখানেই আসল মুগ্ধতা! মুগ্ধতা ব্যাপার টা বোধহয় এমন ই হওয়া উচিত। যেখানে কোনো ভান নেই, বাড়াবাড়ি, ছড়াছড়ি নেই। ঠিক যেমন এই মেয়েটা আসার সময় ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে পাউডার ঘষে আসে নি। ও জানে যে যেমন ও, তেমনই ঠিক। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাকে আলাদা করে মুগ্ধ করার প্রয়োজন নেই।
রাফাত আকাশীকে নিয়ে রাস্তার পাশে আলুর চপ, বেগুনি, ডালপুরি খেল। চা খেতে গেল টঙ দোকানে। বেশী চিনি দিয়ে ঘন দুধের চা। রাফাত আকাশীকে বলল,
“আমি তো অলমোস্ট বেকার ই। তুমি চাইলে আমাকে জব দিতে পারো। ”
আকাশী হাসলো। রাফাত এই কথাটা ও’কে প্রায় ই বলে। আকাশী কথাটা মজা হিসেবে নেয়। রাফাত আবারও বলল,
“সিরিয়াসলি আকাশী… তোমার কিছু কাজ আমি করে দিলাম। এই যেমন ধরো ডেলিভারি ম্যান হলাম, অল্প কিছু বকশিস দিলেই হবে। ”
“আপনি সত্যিই সিরিয়াস?”
“হ্যাঁ। আবার তোমার সঙ্গে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কাপড় কেনাও দেখতে পারি। এতে দুটো লাভ, আমি তোমার কাছ থেকে বিজনেস শিখতে পারি, আবার বেকারও রইলাম না।”
“আপনি জয়েন করবেন না?”
“না, ছুটির মেইল করেছি। ওরা এপ্রুভাল মেইল পাঠাবে আশা করছি। ”
“তাহলে এই সময় টা আপনি নিজের মতো কাটান। ভালো লাগবে, কোথাও ঘুরেটুরে আসুন। ”
“তোমার সাথে কাজ করলেও ভালো লাগবে। তাছাড়া তোমার নিজেরও একটু সুবিধে হবে। অন্তত নিজের একটু যত্ন নেবার সময় পাবে।”
আকাশী অন্যরকম চোখে তাকালো। নিজের একটু যত্ন! নিজের মানুষ তো কখনো ও’কে এভাবে বলে নি। কতো পরিশ্রম করেছে, তবুও রান্নার এদিক সেদিক হলে কথা শুনিয়েছে! আকাশীর মন কেমন করে উঠলো। কেন আমাদের জীবনে আমাদের মতন একজন আসে না!
****
তৌহিদ খেয়াল করলো মিশুক এই বাড়িতে প্রায় সকলের ই প্রিয়৷ দাদুও ভীষণ পছন্দ করছেন। ব্যাপার টা ওর জন্য পীড়াদায়ক, কারণ ও’কে সেভাবে কেউ গুরুত্ব দেয় না। সেটা অবশ্য ওর একার ধারণা। যেমন মেয়েরা ও’কে পছন্দ করে না। দুটো মেয়ে ফাজিলের চূড়ান্ত। ধমক দেয়ায় একজন বলল, তুমি যাবা কবে বাবা, আর গেলেও আসবা না। কী ভয়ংকর কথাবার্তা। এই মেয়েদের বাপ ও, তার সঙ্গে এমন কথা বলছে। অথচ রঙ্গনা এসে দুটোকে পিঠে ধড়াম ধড়াম দিলেও বলে, মনির মা*ইরে ব্যথা নেই।
তুলিকেও কেমন যেন বিরক্ত মনে হচ্ছে। বাড়িতে এতসব ঘটনা ঘটে গেল অথচ কাউকে জানালোই না। রঙ্গনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল একজনের সঙ্গে, অথচ বিয়ে হলো আরেকজনের সঙ্গে এসব ব্যাপার ও’কে কিছু জানায় নি৷ তাছাড়া ও এই বাড়ির বড় জামাই ওর মতামত নেয়া উচিত সবকিছু তে। এটা শুনে তুলি শক্ত মুখে বলল,
“কেন? দাদু কী মরে গেছে? আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মা তো আছেন!”
তৌহিদ বেশ অপমানিত বোধ করলো এই কথায়। তার চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো ডাইনিং টেবিলে। সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছে। টুকটাক গল্প করতে করতে খাওয়া এগুচ্ছে। তখন বলল,
“কি স্বপ্নীল, তুমি তো বলদ থেকে একদম মানুষ হয়ে উঠলা। তোমার বউয়ের এলেম আছে। ”
স্বপ্নীলের মন খারাপ হলো। একবার বুবুর দিকে তাকালো, আরেকবার শ্রাবণ্যর দিকে৷ শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে ইশারায় খেতে বলল। বাকী কেউ কিছু বলল না। রঙ্গনা মুখ খুলতে যাবে সেই মুহুর্তে মিশুক হাত চেপে ধরলো।
আজ দুপুরে আকাশী এসেছিল। শ্রাবণ্য পরিচয় করিয়ে দিলো। তৌহিদ বলল,
“তোমার নাম আকাশী! আমি এক মুহুর্তের জন্য ভাবলাম বাতাসী খালার মেয়ে তুমি!”
শ্রাবণ্য বিরক্ত হলো। আকাশী মিষ্টি করে হেসে বলল, না আমি তার মেয়ে নই। তবে মেয়ের মতোই। বাতাসী খালা শুনলেন তার আবার শ্রাবণ্য দের দুই বোন কে পছন্দ। সেদিন ই শ্রাবণ্য ওর একদম নতুন একটা শাড়ি তাকে দিয়ে দিয়েছেন। বাতাসী খালা শাড়িটার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ছিলেন। শ্রাবণ্য সেটা দিয়ে দিলো৷ ওর আলমারিতে অসংখ্য শাড়ি। একটা দুটো মানুষ কে দিতেই পারে। খালা সেই শাড়ি নিয়ে তাদের লোকাল মার্কেটে গেল। দোকানদার রা জানালো এই শাড়ির দাম বেশি। হাজার পাঁচেক তো হবেই। আকাশী মেয়েটাও ভালো, এই বাড়িতে যখন ছিলো তখন অমায়িক ব্যবহার করেছে। দুলাভাই যে আকাশীকে সূক্ষ্ম খোঁচা দেবার জন্য কথাটা বললেন সেটা উনি বুঝলেন৷ বললেন,
“দুলাভাই, আপনের ঢং আছে ভালোই৷ আপনে তো জানেন আমার নাম ফাতিমা। মা ফাতিমার নাম টারে মানুষ ফাতু, ফাত্তু কইয়া ডাকে তাই আমি বাতাসী নামে চলি। ”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। তৌহিদ বিব্রতবোধ করলো। ও আসলে একটু রসিকতা করার চেষ্টা করেছিল। ব্যাপার টা অন্যদিকে গেল।
খাবার টেবিলে এবার মিশুক কে ধরলো। বলল,
“তুমি কী এখানে থাকবে রঙ্গনাকে নিয়ে?”
মিশুক অপ্রস্তুত হলো না। এই ভদ্রলোক কে ওর চেনা হয়ে গেছে৷ ও হেসে বলল,
“জি। মা চাইছেন ঘরজামাই থাকি। আমার সমস্যা নেই, অন্যদেরও সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। তবে ঘর জামাই দের কেউ ভালো চোখে দেখে না। ”
রঙ্গনা জবাব দিলো,
“না দেখলে না দেখবে তাতে আপনার সমস্যা কী?”
তৌহিদ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আরে না না সমস্যা না। আর ভালোই হইছে তোমরা থাকবে। তুলি থাকবে না, মাকে কে সামলাবে। স্বপ্নীলের তো বুদ্ধি কম। ”
স্বপ্নীল এবার রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল,
“আপনার বুদ্ধি কম, আপনার মাথা ভরা গু। ”
তৌহিদ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলো। রঙ্গনা বলল,
“ঠিক বলছিস। ”
এরপর একটা ছোটখাট ঝগড়াটাইপ হয়ে গেল। শিলা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন তিনি এসে সামলালেন। দাদু সব শুনেও এলেন না। তবে স্বপ্নীলের উপর খুশি হলেন। তার মনের কথাটা বলে দিয়েছে।
শেষমেস ঝগড়াঝাটি থেমে যে যার মতো ঘুমাতে গেল। তুলি একটা কথাও বলল না। ভয়ংকর চাহনী দিতেই তৌহিদ ঠান্ডা হলো।
মিশুক রঙ্গনার ম্যুড ভালো করতে ও’কে নিয়ে মাওয়া যাবে। সাথে শ্রাবণ্য আর স্বপ্নীলও। কিভাবে যেন রিন্টি, মন্টিও টের পেল। তারাও যাবে। সবাই রেডি হয়ে গেছে। তৌহিদ এসে রিন্টি, মন্টিকে বলল,
“এই তোমরা ঘুমাতে যাও, কোথাও যাবে না। ”
মন্টি দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“বাবা, এভাবে কথা বলবে না। আমি আর আমার বোন কী তোমার চাকর?”
তুলি রঙ্গনাকে বলল, ওদের খেয়াল রাখিস।
রঙ্গনার মেজাজ খারাপ । বলল,
“পারব না। ”
এরপর তুলিও ওদের সঙ্গে যাবার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। তৌহিদ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। শিলাকে বলল,
“দেখছেন মা, কেউ একবার আমাকে যেতেও বলল না। আমার কিন্তু যাবার ইচ্ছে ছিলো। ”
শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“থাক তুমি ঘুমাতে যাও। তোমার এমনিতেই শরীর ভালো না.. হসপিটাল ঘুরে এলে।”
তৌহিদ ভীষণ মন খারাপ করে বসে রইলো। তুলি, রঙ্গনা, মিশুক কে ফোন করলো৷ ওরা কতদূর গেল, যদি ও’কেও নিয়ে যেত।
চলবে….
(বইমেলায় কী করিলে বলো পাইবো তোমারে পাওয়া যাবে অন্যধারার স্টলে। স্টল নং ৪১-৪৪)