কুসুম_কাঁটা #পর্ব-৩৩

0
457

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৩
শ্রাবণ্য ট্রেন থেকে নামলো। ভোরের ট্রেন, শহরে এখন একটু একটু শীত নেমেছে। ওর গায়ে পাতলা চাদর চাপানো। শ্রাবণ্য প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক খুঁজলো। স্বপ্নীল কোথায়! কাল রাত থেকে অন্তত দশবার ফোন করে বলেছে। আসব, আসব! এখন কোথায়! শ্রাবণ্য অস্থির নয়নে এদিক ওদিক খুঁজছিল। ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করার আগেই স্বপ্নীল তারস্বরে ডাকলো,

“এই শ্রাবণ্য, এই যে আমি!”

শ্রাবণ্য পেছনে ফিরে তাকালো। স্বপ্নীল ছুটে আসছে। ছুটে আসার ধরন টা সন্দেহজনক। ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে না তো আবার! ওহ মাই গড! হালিশহরের সেই মোমেন্ট রিক্রিয়েট হতে যাচ্ছে! শ্রাবণ্য এদিক ওদিক তাকালো। ব্যাচমেট রা এখনো প্ল্যাটফর্মে আছে। তাদের সামনেই ঘটতে যাচ্ছে কেলেঙ্কারি ঘটনা। শ্রাবণ্য ভীষণ নার্ভাস হলো, এই তো স্বপ্নীল কাছাকাছি এসে গেল!

স্বপ্নীল ছুটে এসে সত্যি সত্যিই শ্রাবণ্যকে জড়িয়ে ধরলো। এবার আর হুমড়ি খেয়ে পড়লো না। শ্রাবণ্যও সতর্ক থাকার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে স্বপ্নীল কে ধরলো। প্ল্যাটফর্মে মানুষজনের অভাব নেই। কেউ কেউ দেখলো দৃশ্যটা। কেউ কেউ বিরক্তও হলো। শ্রাবণ্য হাসলো, স্বপ্নীল ও’কে ছেড়ে দিলো প্রায় মিনিট খানেক পর। ব্যস্ত প্ল্যাটফর্মে ওই মিনিট খানেক একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরে রাখলো। শ্রাবণ্যর ফ্রেন্ডরা কেউ কেউ ছবি তুলে, ভিডিও করে রাখলো।

কমলাপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা রিকশা ধরলো। সকালের মিষ্টি রোদ টা উঠেছে কেবল। স্বপ্নীলের চোখে, মুখে বাচ্চাদের মতো ঈদ আনন্দ। স্বপ্নীল হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে।

“জানো কী হয়েছে, রিন্টির একটা দাঁত পড়ে গেছে। সেকি ভয়ংকর কান্না! মা ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল, তবুও বুঝতে চায় না। মন্টির কেন পড়লো না, ওর একার কেন পড়েছে এই নিয়ে ভীষণ ঝামেলা করেছে পা*জি দুটো।
এদিকে ভাইয়ার সঙ্গে ছোটপার আবার তর্কযুদ্ধ হলো। খুব ই সিরিয়াস!

শ্রাবণ্য হঠাৎ স্বপ্নীলের হাত চেপে ধরে গাঢ় গলায় বলল,

“তুমি আমাকে কী যেন বলতে চাইছিলে না! বলো নি কিন্তু…!

স্বপ্নীল সুন্দর করে হাসলো। এই সুন্দর সকালে ওর একটা ভয়ংকর কাজ করতে ইচ্ছে করলো।

***
শ্রাবণ্য বাড়ি গিয়ে দুটো খবর পেল। প্রথম খবরটাতে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। তুলির পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা শেষ হয়ে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে রিন্টি, মন্টিকে নিয়ে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয়ত খবর টি হলো বাড়ির সবাই মিলে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছে। শুধু বাড়ির লোক না সঙ্গে মিশুকের বোন, দুলাভাই, বাবা, মা আর আকাশীও যাবে। শ্রাবণ্যকে সারপ্রাইজ দেয়া হবে বলে আগে থেকে কিছু জানায় নি।

তুলির চলে যাবার খবরটায় শ্রাবণ্যর ভীষণ মন খারাপ হলো। শিলা হেসে বললেন, এই মন খারাপ অমূলক না। সবার ই ভীষণ খারাপ লাগবে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। দিনশেষে ছেলে মেয়েরা আনন্দে আছে, হাসিখুশি আছে এটাই আসল। আমি মন খারাপ করব না, তোমরাও করবে না কেমন!

রিন্টি তার দু:খের গল্প মামীকে শোনালো। শোনাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। চিপসের প্যাকেট দাঁত দিয়ে ছিড়তে গিয়ে ওর দাঁত টা ভেঙে গেছে। আর ওই চিপস ও খাবে না। এমন ভাঙা দাঁত নিয়ে বিদেশে যেতে ওর খুব লজ্জা লাগবে। কী করবে ও! মন্টিকে মা, বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে ও মনির কাছে থেকে যাবে।

শ্রাবণ্য হাসলো রিন্টির কথা শুনে। এই বাড়িটা সত্যিই নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে ওদের ছাড়া। দাদুও ভীষণ কষ্ট পাবে। তুলিকে সে অন্যরকম পছন্দ করে, এটা টের পাওয়া যায়। অনেক সিদ্ধান্ত সে মেনে নেয় শুধু তুলির জন্য।

শ্রাবণ্য সারা দুপুর শুয়ে কাটালো। স্বপ্নীল অফিসে আছে। এতদিন পর বাড়িতে ফিরে মন টা খারাপ হয়ে গেল। নানান ভাবনারা এসে মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয়। এই বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিনও ভাবেনি একদিন এটাকে নিজের বাড়ি ভাববে। এখন এটাই ওর বাড়ি। স্বপ্নীল ওর জীবনের ব্যক্তিগত মানুষ। বাড়ির মানুষগুলো ওর ই আপনজন। সকালে ওর ক্লাশ থাকে, ঘুম ভাঙতেই কোনোরকম তৈরী হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ওর জন্য আলাদা করে খাবার বানানো থাকে। এই কাজ টা কেউ না কেউ করেই। হয় তুলি নাহয় শিলা। একদিন দেখলো দাদী ওর জন্য খাবার বানাচ্ছেন। কী সুন্দর একটা ব্যাপার! একবারও মনে হয় না এটা শ্বশুর বাড়ি, মানুষগুলো ওর নিজের নয়।

শ্রাবণ্য উঠে ল্যাপটপ টা খুলল। এলোমেলো কিছু মনের কথাটা লিখছে। দু’হাতে টাইপ করছে। লিখছে বাবাকে, এই কথাগুলো বাবার জানা উচিত। বাবা, মায়ের সঙ্গে ও যে নীরব দেয়াল টা তুলে দিয়েছিল সেটা মা বুঝতে না পারলেও বাবা বুঝেছেন। তিনি হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিল। কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে নি শ্রাবণ্যকে। হতে পারে শ্রাবণ্যর মনের ভুল। তবুও ওর মনে যে কথাগুলো অব্যক্ত ছিলো, সেগুলো বাবার জানা উচিত।

বাবা,

সামনাসামনি এই কথাগুলো বলতে পারব না বলেই এভাবে বলা। তোমার প্রতি আমার আসলে কোনো অভিমান নেই। যা আছে সব ই রাগ। রাগ আর অভিমান শব্দ দুটো যেমন আলাদা তেমনি অর্থও আলাদা। স্রেফ তোমার অবাধ্য হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাবার মতো তুচ্ছ ঘটনায় যে শাস্তি হিসেবে আমার বিয়েটা হতে পারে সেটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো সবসময় ই। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার সঙ্গে সত্যিই ওরকম কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর জীবন টা দূর্বিষহ হয়ে উঠবে। সেটার জন্য অনেকটা আমিও দায়ী থাকব। কোনো বিধিনিষেধ মানামানির ধারে, কাছে যাব না। আমার যা ভালো লাগবে করব। কেউ যদি না মানতে পারে তাহলে সেটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপও থাকবে না। বিয়ে নামক শেকল তো আর আমি নিজে গলায় জড়াই নি।

বাবা আমার সেই ভাবনা ধূর হলো কয়েক মাসেই। আমি যেটাকে শেকল ভেবেছি সেটা আসলে ফুলের মালা। যা ইচ্ছে হয় সেটা আমি করতে পারি। কেউ প্রশ্ন করে না। কোনো বিধিনিষেধ না মেনেও দেখেছি, কিছুই বদলায় নি। এই বাড়ির মানুষ গুলো ভালো, তাই না? বাবা আমিও কিন্তু একেবারে খারাপ নই। এঁরা সেটা জানে, কিন্তু তোমরা সেটা কখনো জানার বা বোঝার চেষ্টা করো নি। রাত করে বাড়ি ফিরলে এই বাড়ির মানুষজন শুধু অস্থির হয় বিপদে পড়েছি কিনা সেটা ভেবে। এক ফোঁটা অবিশ্বাসও করে না। আপু আর আমি দুজন আলাদা মানুষ বাবা। আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ধ্যান, জ্ঞান, পছন্দ অপছন্দ সব আলাদা। চরিত্রও আলাদা। যে ভুল আপু করেছে সেটা আমিও করতে পারি ভেবে তোমরা তটস্থ থাকতে। অথচ আমরা দুজন আলাদা সব দিক থেকেই। বাবা, তোমাদের মেয়ে বলেই কিনা জানিনা, আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল খুব বড়সড় একটা ভুল করতে বিয়ের পর। যাতে তোমাদেরও আফসোস হয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত আপনাআপনিই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। স্বপ্নীল ভীষণ ভালো সৎ একজন মানুষ। মনে যা, মুখেও তাই। এমন মানুষ ঠকে বেশী। আমার তাই আর ও’কে ঠকাতে ইচ্ছে করে নি। বরং এখন মনে হচ্ছে আমি নিজেই জিতে গেলাম।

আমি যতটুকু ভালো আছি তার সব কৃতিত্ব আমার। আমি এখানে তোমাদের কোনো ক্রেডিট খুঁজে পাচ্ছি না আসলে। কথাটা স্বার্থপরের মতো হলেও এটাই সত্যি যে স্বপ্নীল আর ওর পরিবার কে আমি ডিজার্ভ করি বলেই ওরা আমার ভাগ্যে আছে। আমার এই কথাটা আপুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঠিক, ভুলের হিসাব কী মানুষ করতে পারে! ভাগ্য নির্ধারণ তো করেন উপরে যিনি আছেন তিনি।

আপুকে তার মতো ছেড়ে দাও। তোমরা দেখেশুনে বিয়ে দিবে বলে ভাগ্য খুলে যাবে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

শ্রাবণ্য লেখা শেষ করে চোখ ভুলিয়ে নিলো একবার। অনেক দ্বিধা দ্বন্দের পর লেখাটা বাবাকে পাঠিয়ে দিলো। কিছু কথা, কিছু ব্যাপার জানা উচিত।

***
আকাশী দিন রাত এক করে পরিশ্রম করছে। ব্যবসায়ে সময় দিতে হয় সারাক্ষণ। এক, দুই ঘন্টা কাজ করলে হয় না। নিজের একটা ইয়ারের পড়া শেষ হলো এসব ব্যস্ততার মধ্যে। বিজনেস টাকে আরেকটু বাড়ানোর প্ল্যান আছে৷ অনলাইনের দিক টা সামলানোর জন্য একজন লোক রাখলো। অফলাইনেও একজন লোক রাখা আবশ্যক হয়ে গেছে। তাহলে যদি একটু দম ফেলার সুযোগ পায়। দিনশেষে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন অন্য কিছু ভাববার সময় পায় না। চোখে ক্লান্ত ঘুমেরা এসে ভর করে। তবুও হঠাৎ এক উদাস দুপুরে আকাশীর মনে হলো অবেলার কফিটা শেয়ার করার জন্য একজন লোক জীবনে থাকা দরকার৷ ওর ক্লান্ত গল্প, স্বপ্ন, পরিশ্রম সবকিছুর মন্ত্রমুগ্ধ একজন শ্রোতা থাকলে ভালো হতো। এমন ভাবনা কেন মাথায় আসে কে জানে! রাফাতের কথাও মনে পড়ে ওর! সেই বেচারা কতো অভিমান পুষে রেখেছে। আকাশী বুঝতে পারে। ফোনের ওপাশে হ্যালো বলার ধরনে বুঝে যায়। আকাশী তবুও স্বার্থপর ই থেকে যায়৷ নিজের সীমা অতিক্রম করতে চায় না৷ বড় হতে চায় নিজের ছায়ার চেয়েও বেশী।

সেই উদাস দুপুরে আকাশী রাফাত কে ফোন করলো। একবা, দুবার, তিনবার! রাফাত ফোন টা ধরলো না। হয়তো উড়ছিল ওই মাঝ আকাশে। তবুও আকাশী ফোন করেছিল বারবার। রাফাত ফোন করলো ঘন্টা চারেক পর। আকাশী তখন ফেসবুকে লাইভ করছিল। বেশ কিছু টিশার্ট কালেকশন দেখাচ্ছিল। রাফাতের ফোন পেয়ে লাইভ টা বন্ধ করে দিলো। ফোন রিসিভ করে কথা বলল। রাফাত যখন জিজ্ঞেস করলো কেমন আছ! তখন আকাশীর মনে হলো ওর অবস্থাও ঠিক রাফাতের মতো। কয়েকমাস আগে রাফাত যেমন ছিলো। ছুটে আসতো বারবার ওর কাছে। বটবৃক্ষেরও মনে হয় মাঝেমধ্যে ছায়ার দরকার হয়।

চলবে….

(পরের পর্ব লেখা হলেই দিয়ে দেব। ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here