#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৬ ও ৩৭
তুলি নিজের ঘরে চলে গেল। যাবার আগে শান্ত গলায় বলল,
“আমি ঘরে যাচ্ছি। খাবার সময় ডেকো প্লিজ। আর আজ আমি আকাশীর সঙ্গে থাকব। ”
তৌহিদ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সবার আগে ও গেল রঙ্গনার কাছে। বলল,
“এই রঙ্গনা, ও কী বলে গেল এসব? ওর কী আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ”
রঙ্গনা তৌহিদ কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। স্বপ্নীল ছুটে গেল পানি আনতে। রঙ্গনা বলল,
“আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। এতো প্যানিক করবেন না প্লিজ।”
দাদু গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুলি যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই সই। এর বাইরে আর কোনো কথা হবে না। ”
তৌহিদ হতভম্ব চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। শিলা রিন্টি, মন্টিকে নিয়ে ঘরের দিকে গেল। বড়দের এমন নিষ্ঠুর আচরণ দেখে তৌহিদ বিকট শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। স্বপ্নীল পানি নিয়ে এলো বালতিতে করে। যে অবস্থা তাতে দুলাভাই অজ্ঞান হয়ে পড়বে কিছুক্ষনের মধ্যে। রঙ্গনা তৌহিদ কে সামলানোর চেষ্টা করছে। দাদী এমনিতে নাতজামাইদের সামনে ভীষণ লাজুক তবে এখন তিনি এসে তৌহিদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গনা বেশ কয়েকবার বলল,
“আমরা আছি তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
তৌহিদের কান্নাকাটি পর্ব আরও চলল কিছুক্ষন। ঘরের দরজা আটকে কাঁদতে গেল কিন্তু সেটা ওরা হতে দিলো না,স্বপ্নীল সঙ্গেই থাকলো। বেচারা যদি একটা কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনেও ভাটা পড়লো। একটা মানুষ কাঁদছে আর সবাই এভাবে খাবে ব্যাপার টা খারাপ দেখায়। বারবিকিউ ঠান্ডা হয়ে যাবে ভেবে সবাই খেতে গেল। শ্রাবণ্য মিশুক কে বলল,
“সবকিছু কেমন একটু অন্যরকম লাগছে না? আমি ব্যাপার টা সিরিয়াসলি নিতে পারছি না আসলে। ”
মিশুকও ব্যাপার টা ভেবেছে। বড়রা এই ব্যাপারটায় নির্লিপ্ত থাকছে বলে দুশ্চিন্তা একটু বেশী হচ্ছে। মিশুক শ্রাবণ্য কে বলল,
“ডিভোর্স পেপার টা আমি দেখলাম তো। ওটা সত্যি। ”
শ্রাবণ্য পরোটার টুকরো মুখে দিতে দিতে বলল,
“আপনার বউয়ের পেট থেকে কথা বের করুন তো। আমার কেমন যেন সন্দেহ লাগছে সবকিছু। স্বপ্নীল ছাড়া বাকীদের আচরণ একটু অন্যরকম। ”
মিশুক হেসে বলল,
“আমাদের আচরণও তো অন্যরকম। আমরা রিলাক্স ম্যুডে খাচ্ছি। ”
ঘুমানোর সময় হয়ে গেল বলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেল। এমনিতেই সারাদিন ঘুরেফিরে সবাই ক্লান্ত। কিন্তু সমস্যা হলো তৌহিদের চিৎকার করে কাঁদার ব্যাপার টা থামার পরিবর্তে আরও বাড়তে লাগলো। সেই সঙ্গে আহাজারি, কেউ ওর কষ্ট বুঝছে না।
স্বপ্নীল যখন বেরিয়ে এলো তখন ও রীতিমতো ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। বেরিয়ে এসে শ্রাবণ্যকে বলল,
“ছোটপা কে গিয়ে বলো মিশুক ভাইয়া কে পাঠাতে। ওনাকে সামলানো আর পাগলা গরু সামলানো একই কথা। আমি পারব না।”
শ্রাবণ্য এই সিরিয়াস সময়েও হেসে ফেলল। আগে স্বপ্নীলকে দাদু গরু বলতো, আর এখন ও অন্য একজন কে বলছে। স্বপ্নীলও হেসে ফেলল। নত মুখে লাজুক গলায় বলল,
“তাছাড়া আমি ওনার সঙ্গে ঘুমুতে পারব না। আমার ঘুম হবে না। আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।”
শেষ বাক্যটা বলল ছোট করে। শ্রাবণ্য শুনতে পেল। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখমন্ডলে। শ্রাবণ্য জিজ্ঞেস করলো,
“যখন আমি ছিলাম না?”
স্বপ্নীল চোখ তুলে তাকালো। বলল,
“আমি তো ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। দিতি আপাকে ফোন করো, আপা প্রতিদিন ই বলতো আমার চোখ লাল, আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে শরীর খারাপ করবে। ”
শ্রাবণ্য হাসলো শব্দ করে।
আজ রাতেও ওদের ঘুমের জায়গার ব্যতিক্রম হলো। শ্রাবণ্য শুয়ে পড়লো আগে, স্বপ্নীল এক হাত দূরত্বে। দুজনের যখন চোখাচোখি হলো তখন স্বপ্নীল অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল,
“অভ্যাস হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে তাই না! পাশাপাশি কদিন ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। ”
শ্রাবণ্য মিষ্টি হেসে পাশ ফিরলো। স্বপ্নীল বলল,
“তোমার যদি হাত, পা ছোড়ার অভ্যাস থাকে, তাতে কিন্তু আমার সমস্যা নেই। ”
শ্রাবণ্য নি:শব্দে হেসে বলল,
“আমার হাত পা ছোড়ার অভ্যাস নেই। ”
মাঝরাতে শ্রাবণ্য আবিষ্কার করলো স্বপ্নীল ওর গায়ে একটা হাত রেখেছে। দূরত্ব আগের মতোই একই, একহাত সমান। শ্রাবণ্য আরেকটু এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসার ব্যাপার টা স্বপ্নীল তো কম করলো না, বাকীটুকু নাহয় ও করলো।
***
তুলি শুয়েছে আকাশীর সঙ্গে। কিন্তু একেকবার তৌহিদের কান্নার শব্দে ঘুম টা চটে যাচ্ছে। তুলিকে অস্থির হয়ে এপাশ ওপাশ করতে দেখে আকাশীও ঘুমাতে পারলো না। তুলি বলল,
“কী করা যায় বলো তো? ঘুমানো তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ”
“কানে হেডফোন গুজে গান শোনো আপু। ”
আকাশীর একবার অন্যকিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু থেমে গেল। কিছু ব্যাপার একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে ওর কিছু বলা অনুচিত।
তুলি বলল,
“ভালো কমেডি মুভি সাজেস্ট করো তো। আমার ঘুম চটে গেছে। ”
আকাশী নিজেও উঠে বসলো। রিভিউ দেখে মুভি দেখতে বসলো। আকাশী চা করে নিয়ে এলো, ঘরে কুকিজ ছিলো কিছু। সবকিছু ভুলে ওরা মুভিতে মনোযোগ দিলো।
***
রিন্টি, মন্টি দুজনের ই মন খারাপ। আজকে ওদের বাবার জন্য ভীষণ খারাপ করেছে। খ্যাপাটে, পাগল বাবাকে ওদের একটু অপছন্দ হলেও দু:খী বাবাকে ওদের একদম ভালো লাগে নি। তার উপর একটা নতুন শব্দ শুনেছে। ডিভোর্স! এই শব্দটার সঙ্গে পরিচিত নয়। নিশ্চয়ই পঁচা একটা ওয়ার্ড নাহলে বাবা ওরকম কাঁদবে কেন! দুই বোন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো ওরা বাবার সঙ্গে বিদেশে যাবে। মা ওদের ছাড়া থাকতে পারবে না। ওরা গেলে মাও যাবে, তাহলে দুজনের আর ঝগড়া থাকবে না।
***
মিশুক রঙ্গনাকে বলল,
“আমাকে ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলো তো?”
রঙ্গনা হ্যান্ডক্রিম মাখছিল। মিশুক কে এক পলক দেখে বলল,
“কী?”
“কী চলছে তোমার মাথায়? ”
“অনেক কিছু। ”
“তুলি আপু আর ভাইয়ার বিষয় টা আগে থেকে তোমরা জানতে? মানে তোমাদের এক্সপ্রেশন দেখে আমার কেমন যেন লাগছিল। ”
“হ্যাঁ জানতাম। ”
মিশুক রঙ্গনার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
“এখানে কী সেজন্য এসেছ?”
রঙ্গনা অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,
“হতে পারে। ”
মিশুক চোখ কপালে তুলে বলল,
“কী ভয়ংকর! এখানে এসে একটা মানুষ কে এভাবে শায়েস্তা করছ!”
রঙ্গনা বলল,
“শায়েস্তা, টায়েস্তা কিছু না। তার আসলে একটা শিক্ষার দরকার। অনেক দিন ধরেই সে এরকম। কোথায় কী বলতে হয় এটা সে বুঝেও ইচ্ছে করে ঝামেলা করে। আমরা ভাবছিলাম ব্যাপার টা আস্তেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হবার নাম নেই। তাই একটা ছোটখাট শক দেয়া। ”
মিশুক শুয়ে পড়লো। রঙ্গনাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“এরকম ভয়ংকর প্ল্যান তোমার কাছেই আশা করা যায়, সিরিয়াসলি। ”
রঙ্গনা মিষ্টি হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ। ”
মিশুক দুহাতে চেপে ধরলো রঙ্গনার গাল। রঙ্গনার নি:শ্বাস ভারী হতে শুরু করলো। মিশুক ফিসফিস করে বলল,
“তুমি কী জানো, তুমি অনেক স্পেশাল ”
রঙ্গনা মিশুকের চোখে চোখ রেখে বলল,
“হ্যাঁ জানি। ”
মিশুক হাসলো। আরেকটু এগিয়ে এসে ঠোঁটজোড়া ধখল করে নিলো। রঙ্গনা এক হাতে মিশুকের চুল খামচে ধরলো।
****
আরেকটি সুন্দর সকাল শুরু হলো। এই সকাল টা অবশ্য তৌহিদের কাছে বিশ্রী রকম অসুন্দর। কাল রাতে ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল তুলি ওর সাথে প্রাঙ্ক করছিল। কিন্তু মাঝরাতে তুলির ঘরের সামনে কান পেতে শুনলো হাসির শব্দ । কিছু একটা হাসির জিনিস দেখছিল। আবার কিচেনে এসে চা নিয়ে গেল। এসব তো মিথ্যে হতে পারে না। তৌহিদ পুরো ব্যাপার টায় হতভম্ব। যতটা দু:খ পেয়েছে তার চেয়ে বেশী এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করেছে। স্বপ্নীলও একসময় বিরক্ত হয়ে চলে গেল। অন্যরা কেউ তেমন এটেনশন দেয় নি। রঙ্গনাকে ধরতে হবে। এই মেয়েটাই পারে একটা ব্যবস্থা করতে।
শিলা এসে তৌহিদ কে বলল,
“খেতে চলো তৌহিদ। ”
তৌহিদ অসহায় গলায় বলল,
“আপনার কী মনে হয় আমি খাওয়ার অবস্থায় আছি আসলেই?”
শিলা বললেন,
“কাল রাতে খাও নি। এসো খাবে। খাবার পর তোমার কথা শুনব। ”
তৌহিদ আর কথা বাড়ালো না। খেতে বসলো। এদের সাথে আর তর্ক করা যাবে না। এরা চাইলে ওর সংসার টা বাঁচতে পারে।
খাবার সময় তুলি একবারও তৌহিদের দিকে তাকালো না। তৌহিদ তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার।
খাওয়া দাওয়া শেষে একঘরে সবাই একত্রিত হলো। দাদু শিলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“বৌমা তুমি কথা বলো। আমি তো আগেই আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলাম। তুলি যা চাইবে তাই হবে। ”
শিলা তুলিকে বললেন,
“তুমি এই সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিয়েছ?”
তুলি নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ। ”
তৌহিদ অধৈর্য্য গলায় বলল,
“তুমি একা একা এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারো না…. আমার ডিসিশন ছাড়া…
শিলা তৌহিদ কে প্রায় ধমকের সুরে বলল,
“তুমি চুপ করো। আর ও’কে কেন সবসময় তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে? অর্থনৈতিক ভাবে তোমার উপর ডিপেন্ডেন্ট বলে! তোমার কী মনে হয় ওর নিজের কিছু করার যোগ্যতা নেই?”
তৌহিদ অসহায় গলায় বলল,
“আমি তো সেরকম কিছু বলিনি মা। আমি তো যা কিছু করি সব ওদের জন্যই করি। ”
“এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তুমি দিনরাত এটা শোনাও যে তুমি অনেক কিছু করো, তুলি কী কিছু করছে না। মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব কী শুধু ওর? সেটা নিয়ে ও কখনো কিছু বলেছে?”
তৌহিদ চুপ করে রইলো। তুলি বলল,
“কোথায় কী বলতে হয়, কাকে কী বলছ এগুলো তুমি আসলেই বোঝো না, নাকি বুঝতে চাও না এটা জানিনা। কিন্তু আমার খারাপ লাগে। তুমি যেমন আমার হাজবেন্ড তেমনি বাকীরাও আমার আপনজন। রঙ্গনাকে কাল যা বলেছ তাতে ও যতটা হার্ট হয়েছে তারচেয়ে বেশি আমি হয়েছি। আমার এসব ভালো লাগে না। কাউকে আমি বদলাতে চাই না, আর যদি প্রাপ্তবয়স্ক একজন নিজেকে বদলাতে না চায় তাকে নিয়ে আর এক্সপেক্টেশন রাখা ঠিক না। ”
তৌহিদ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“আই এম সরি রঙ্গনা। আসলে আমি বুঝতে পারি নি…
তৌহিদ কে কথা শেষ করতে না দিয়ে তুলি বলল,
“তুমি সব বোঝো। ”
রঙ্গনা দুজনের হতে যাওয়া ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ইটস ওকে। আমিও আসলে দু:খিত। আমিও ভাইয়াকে অতো সিরিয়াসলি নেই না। ”
রঙ্গনার স্বীকারোক্তি শুনে মিশুক হাসিটা আড়াল করলো।
শিলা বললেন,
“তৌহিদ তুমি কী মন থেকে সরি ফিল করছ? তুলি কে বলতে চাও?”
তৌহিদ দাঁড়িয়ে উঠে বলল,
“আই এম সরি। আমি কথা দিচ্ছি, বেস্ট হাজবেন্ড হয়ে দেখাব। তুমি যা বলবে তাই শুনব। সব শুনব। ”
শিলা তুলির দিকে তাকালেন উত্তরের আশায়। বাকীরাও তাকিয়ে আছে। তুলি একটু সময় নিয়ে বলল,
“ভালো হাজবেন্ড হবার আগে ভালো মানুষ হওয়া জরুরী। ”
তৌহিদ সহ বাকীরা কেউ ই কিছু বললেন না। দাদু এতক্ষন চুপ ছিলেন। এবার বললেন,
“তোমরা বাবা, মা নিজেদের ব্যাপার ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের কথাও ভাববে। ”
তৌহিদ কথা দিলো ও এবার সত্যিই পালটে যাবে। অকারণে মেজাজ খারাপ করবে না, কাউকে ছোট করেও কিছু বলবে না।
রিন্টি, মন্টি মিমি আর আকাশীর সঙ্গে ছাদে ছিলো। ফ্যামিলি মিটিংয়ে ওরা থাকে নি। ছাদ থেকে আসার পর মন্টি বলল,
“বাবা চিন্তা কোরোনা, আমরা তোমার সঙ্গে যাব। মা তো আমাদের ছাড়া থাকতে পারে না তাই মাও কাঁদতে কাঁদতে ঠিক চলে যাবে। ”
তৌহিদের মন আদ্র হলো। মেয়েদের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখলো অনেকক্ষন। আরেকটুর জন্য সবকিছু হারাতে বসেছিল।
***
পাথর বাড়িতে আজকেই শেষ রাত। আজ আবার আয়োজন করা হলো। সবাই মিলে বিরিয়ানির আয়োজন করলো। শিলা রান্নার দায়িত্ব নিলো। স্বপ্নীল রঙ্গনাকে জানালো কালকের খেলা বুবুর জন্য নষ্ট হয়েছে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারিনি। রঙ্গনা আবার খেলা শুরু করলো। দাদু, দাদী নেই, তিনি বিরিয়ানি রান্নার ওখানে আছেন। স্থানীয় একজন কে পেয়েছেন তার সঙ্গে গল্প শুরু করেছে৷ খেলার নিয়ম অনুযায়ী লটারিতে নাম পড়লো এবার শ্রাবণ্যর। শ্রাবণ্যকে একটু নার্ভাস দেখালো। রঙ্গনা বলল,
“যেটা শুনলে স্বপ্নীলের মন খারাপ হবে সেটা বলার দরকার নেই। তোমার জীবনের কোনো ভালো গল্পও বলতে পারো। ”
তৌহিদ আজ রসিকতার ম্যুডে আছে। বলল,
“স্বপ্নীল কে নিয়ে দুটো রোমান্টিক কথা বলতে পারো। ও খুশি হবে, আমরাও আনন্দ পাব।”
শ্রাবণ্যকে তবুও নার্ভাস দেখাচ্ছে। আকাশীও তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। শ্রাবণ্য বুদ্ধিমতি মেয়ে। তবুও আকাশী সবসময় খেয়াল করতো বোন কে। এই বাড়িতে ও ভালোই ছিলো বলে মনে হয়েছে। ওর জীবনে এমন কী সিক্রেট থাকতে পারে যেটা বলতে গিয়ে অপ্রস্তুত হচ্ছে।
শ্রাবণ্য গভীর নি:শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার জীবনে আসলে কোনো গল্প নেই। মানুষ হিসেবে বাড়িতে আমাকে কখনো দেখেনি৷ বাবা, মা আমাকে দেখেছে মেয়ে হিসেবে। আপুর চলে যাবার পর তারাও ভেবেছে আমি ওই পথে যাবে। বেশ একটা চাপের জীবন গেছে। আমার আসলে একটা না, বেশ কয়েকটা সিক্রেট আছে। আমি ছোট আপুকে ভীষণ হিংসে করি, হিংসা না ঠিক ঈর্ষা। তাকে দেখে ভাবতাম ইশ আমারও এমন একটা ঘুরে বেড়ানো জীবন হতো! হাল ফ্যাশনের জামা কাপড় গুলো যদি আমিও পরতে পারতাম। ”
সবাই চুপচাপ। তুলি প্রথমে মুখ খুলল। বলল,
“আমাদের বাড়িতে সবার স্বাধীনতা সমান শ্রাবণ্য। মা তো বলেছে তুমি যা খুশি তাই করতে পারবে৷ তোমার যা ভালো লাগবে তাই পরবে।”
স্বপ্নীল তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। ওর সব অভিমান, দু:খের গল্প যার কাছে জমা হয় তার অভিমান, দু:খের খবর তো ও কখনো নেয় নি৷
শ্রাবণ্য এবার সহজ। বলল,
“জানি, এই বাড়িতে যে আদর সম্মান, ভালোবাসা পাচ্ছি তা কখনো পাই নি। এমনকি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার যে পার্টনার হবে সে হিরোর মতো হবে। একদিন জয় করে আমাকে নিয়ে যাবে।
স্বপ্নীল মাথানিচু করলো। শ্রাবণ্য বলল,
“স্বপ্নে দেখা হিরোর সন্ধান আমি পাই নি ঠিক ই৷ তবে আমার জীবনে যে সহজ সাধারণ হয়ে এসেছে সে হিরোকে টেক্কা দিতে পারবে। ”
স্বপ্নীল চোখ তুলে তাকালো। সবার মুখ হাসি, হাসি। রঙ্গনা বলল,
“একদম ঠিক। তবে সে কিন্তু আজকাল হিরো হয়ে যাচ্ছে শ্রাবণ্য। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে না কাঁদলে পুরোপুরি হিরো হয়ে যাবে।”
শ্রাবণ্য আবার নার্ভাস হয়ে গেল। কপাল, মুখ ঘামছে। চোখ ছলছল করছে। স্বপ্নীলের উদ্দেশ্যে বলল,
“স্বপ্নীল তুমি যেমন আছ, তেমনই থাকো। বেশী জটিল হওয়ার দরকার নেই। শুধু কেউ পিষে ফেলতে চাইলে শক্ত হলেই হবে। তুমি যেমন, তেমন তোমাকেই আমি ভালোবাসি। ”
সবাই একসঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো। তুলি স্বপ্নীলের পিঠে হাত রাখলো। স্বপ্নীলের চোখে মুগ্ধতা। খুব খুশি হলে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না তেমন অনুভূতি।
মিশুক স্বপ্নীলের হাত ধরে বলল,
“শ্রাবণ্যকে যা বলতে চাও বলে ফেলো। ”
স্বপ্নীল অনেক কিছু সাজিয়েছে মনে মনে। সেসব ভুলে গেল। কী বলবে ও! ভেবেছিল নীলা ওর জীবনে প্রথম ভালোবাসা। স্বপ্নীল তো আসলে প্রেম, ভালোবাসা বুঝতোও না। নীলা একমাত্র বাইরের মানুষ ছিলো যে ও’কে বোকা, গাধা ভাবতো না। ও যখন আবোলতাবোল, হাবিজাবি কথাবার্তা বলতো নীলা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। এমন গুরুত্ব কেউ ও’কে দেয় নি। কোনো মেয়েও না। এইটাকে ও ভালোবাসা ভেবে নিলো। কিন্তু ভালোবাসা তো শিখিয়েছে শ্রাবণ্য। অনেকবার ও শ্রাবণ্যকে বলতে চেয়েছিল যে তুমি নীলার মতো। কিন্তু না, শ্রাবণ্য নীলার মতো না। নীলার থেকে ভালো। ওর দূর্বলতা নিয়ে কখনো মজা করে নি। অদৃশ্য হাতে সোজা, ভঙ্গুর পথ চিনিয়েছে৷ স্বপ্নীল আদ্র কন্ঠে বলল,
“মা আমাকে যে সুন্দর পরীর গল্প বলতো। তুমি সেই সুন্দর পরীর থেকেও সুন্দর। আমি তোমাকে পাহাড়, জঙ্গল সব জায়গায় নিয়ে যাব। তুমি শুধু আমার হাত ধরে থেকো। পথ হারিয়ে যেতে দেব না কোথাও। ”
চলবে….
(শেষ পর্বটা দুদিন পর পোস্ট করব ইনশাআল্লাহ।)