#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৮
আকাশী আছে হ্যাপি আপার বাসায়। পার্লারের ম্যানেজার সে। মালিক মাসে একদিন আসে। তাছাড়া আর এদিকে পা রাখার সময় পায় না। ঢাকা শহরে তার আরও চার টা পার্লার আছে।
হ্যাপি আপা লোক ভালো। বয়স তেত্রিশ বলে, কিন্তু দেখলে আটত্রিশ উনচল্লিশ মনে হয়। একটু স্বাস্থ্যবতী অবশ্য। তার একটা ভালো গুন হচ্ছে সে যেকোনো মানুষের সঙ্গে দুই মিনিটে মিশে যেতে পারে। আকাশীকে সে পছন্দ করে। অনেকবার ই ও’কে বলেছে তার বাসায় গিয়ে থাকতে। তাহলে শুভর একটা শিক্ষা হবে। কাজকর্ম, সংসারে মন আসবে। আকাশী সেসব কানে নেয় নি। সেদিন বাসা থেকে বেরোনোর পর মনে হয়েছে হ্যাপি আপার কাছে যাওয়া যায়।
হ্যাপি আপার বাসাটা বড়ই। তিন রুমের বিশাল ফ্ল্যাট। দুটো বাচ্চা নিয়ে হাজবেন্ডের সঙ্গে থাকে। উনি আকাশীকে বললেন,
“তোর যত দিন মনে চায় থাক, নিজের বাসা মনে করে থাক। ”
আকাশী নিশ্চিন্ত হলো। ওর কাছে টাকা আছে। মাসের এই সময়ে খুঁজলে হয়তো হোস্টেলও পেয়ে যেত। কিন্তু সেখানে অনেক খরচ। লালমাটিয়ায় একটা হোস্টেলে থাকা খাওয়া সহ সাত হাজার চাইলো। ওর সাহস হয় নি। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে হ্যাপি আপার এখানেও টাকা দিবে। বেশীদিন থাকবেও না, একটা মোটামুটি মানের হোস্টেল কিংবা মেস পেয়ে গেলে উঠে যাবে।
আর শুভর কাছে আপাতত ফেরার ওর ইচ্ছে নেই। শুভ দুদিন আগে পার্লারের সামনে এসেছিল। আকাশী যে সময় বেরোয় তখন রাস্তা আটকে বলল,
“তোমার নাটক শেষ হয়েছ?”
আকাশী রাস্তাঘাটে ঝামেলা করতে চাইলো না। বলল,
“যাও এখান থেকে। ”
“কার বাসায় আছ? ওই মহিলার বাসায়! যে শরীর ভাড়া দেয়?”
আকাশীর মেজাজ খারাপ হলো মুহুর্তেই। এক থাপ্পড় দিয়ে শুভর গাল লাল করে দিতে পারলে ভালো লাগতো। ও চাপা গলায় বলল,
“মুখে লাগাম দাও। মানুষের সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলবে না। ”
শুভকেও ভীষণ ক্ষিপ্ত দেখালো। বলল,
“লাস্ট টাইম বলছি, এখন ফিরে গেলে আমার বাসায় তোমার জায়গা হবে। নাহলে এরপর পা ধরে কান্নাকাটি করেও লাভ হবে না। ”
আকাশীর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল,
“পা ধরার মতো পাগল আমি না। অনেক হয়েছে….
শুভ কথা শেষ করতে দিলো না। বলল,
“কয়টা পয়সা হাতে আসায় তোর ডানা গজিয়েছে সেটা তো দেখেছি। এখন নিজেকে রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছিস! ছি:! ”
আকাশী চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলল,
“আগে নিজেকে ভালো করে দেখো। তুমি নিজে কী সেটা আগে ভাবো। ”
শুভকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় নি ও। সেখান থেকে চলে এসেছে। হ্যাপি আপা এসব জানেন। তিনি বলেছেন,
“ভালো করছিস। এমন পুরুষ মানুষের সংসার করার দরকার নেই। তুই এইখানে থাক। ”
***
মিশুক ছুটির দিনগুলোও বাসায় থাকে। ঢাকায় ওর বন্ধু, পরিচিত যারা আছেন তারাও ওর মতোই। সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকার পর নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। ও বাসায় থাকলেও আরাম করার সুযোগ পায় না। চাকরির পাশাপাশি বিজনেস করার প্ল্যান আছে। বিভিন্ন আর্টিকেল, সাবজেক্ট নিয়ে রিসার্চ করছে। কোথায় ইনভেস্ট করলে ভালো হবে, এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
বাতাসী খালা সকালের খাবার নিয়ে আসে। রাতে ও সবার সঙ্গে খেতে যায়। বাড়ির লোকজন মোটামুটি ভালোই। স্বপ্নীল সহজ সরল ভালো ছেলে। দাদু মানুষ টা গম্ভীর এবং বাঁচাল টাইপ। তাকে ভালো লাগে নি। শিলা আন্টি আন্তরিক, তুলি আপুও তেমন। শ্রাবণ্যকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারে নি। বাচ্চা টাইপ মেয়ে, শান্ত বোধহয়। বাচ্চা দুটো ইচড়ে পাকা। রঙ্গনার সঙ্গে সেদিন আলাপের পর দেখা হলেও কথা হয়েছে আর একদিন। সিড়িতে দেখা। ও নামছিল, আর রঙ্গনা উঠছিল। দুজনের পায়ের স্টেপ একই রকম ছিলো। মিশুক ই বলল,
“আপনি আগে যান। ”
রঙ্গনা উঠে চলে গেল। ওর দিকে ফিরেও তাকালো না। এই মেয়েটা বোধহয় ওর উপর ক্ষেপে আছে। প্রথম দিনের আলাপের কনভার্সেশন সম্ভবত পছন্দ হয় নি। তবে মিশুকের পাশের রুম টায় থাকে। রাতে উচ্চশব্দে হিন্দি গান চালায়। ফোনে কথা বলার সময় প্রায় ই শব্দ করে হাসে। বাচ্চা দুটোর সঙ্গে প্রায় ই রুমের মধ্যে হৈচৈ মারামারি করে। মিশুক না চাইতেও সেগুলো শোনে।
আজ সকালে বাতাসী খালা এসেছেন খাবার নিয়ে। গরম ধোঁয়া ওঠা সবজি খিঁচুড়ি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা। এই বাসায় রান্না করে দুজন। শিলা আর তুলি। দুজনের রান্নার হাত ই ভালো। ছুটির দিনে রান্না করেন শিলা। তবে মাঝেমধ্যে কোনো আইটেমে লবন বেশী হয়। সেটা নাকি দাদীর কাজ, সে নাকি রান্নাঘরে ঢোকেই লবন দিতে। কেউ না থাকলে এক চামচ লবন দিয়ে আসে। শেষ বার এই নিয়ে ঝগড়া হয়েছে দাদুর সঙ্গে। শ্রাবণ্যর বাবা, মা এসেছিলেন। মাংস টা মুখে তুলতেই টের পেলেন অতিরিক্ত লবন। দাদু তুলিকে বললেন,
“এই মহিলাকে হয় দশবার কান ধরে ওঠবস করাবি, নাহলে এক কেজি লবন খাওয়াবি। তা নাহলে আমি ভাত খাব না। ”
দাদির হয়ে রঙ্গনা খানিকক্ষণ ঝগড়াঝাটি করে শেষমেস সোনাডাঙ্গার বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছে। দাদির বাপের বাড়ি সেখানে। প্রায় ই রাগ করে সেখানে যায়, দাদু গিয়ে মান ভাঙিয়ে নিয়ে আসেন।
বাতাসী খালা মিশুকের সঙ্গে এসে রাজ্যের গল্প করেন। তার ছেলের বউ কেমন পি*শাচ। সেদিন একশ বিশ টাকা দিয়ে একটা লাউ কিনে আনছে। এই সিজনে লাউয়ের কোনো স্বাদ, টাদ কিছু নাই। কতগুলো টাকি মাছ দিয়ে সেই লাউ রানছে। একটুও মজা হয় নি। মিশুক এসব গল্প না শোনার ভান করে। ভদ্রমহিলা গল্প করতে ইচ্ছে হয়েছে করুক।
কিন্তু এই ভদ্রমহিলার একটা সমস্যা অবশ্য আছে। সে ইনিয়ে বিনিয়ে ছোট মনি মানে রঙ্গনার গল্প বলে। সেগুলো ভালো গল্প।
“বুঝলেন ভাইজান, এমন মেয়ে ঘরে থাকা ভালো। ছেলের কাজ সাড়ে। বাজারে গিয়া কী সোন্দর মাছ কিনা আনে। একটা মাছও পঁচা হয় না। এমন মাইয়া থাকলে পোলার দরকার হয় না। পোলা যেটা আছে ওইটা তো বাদাইম্যা। মায়ের কাছ থিকা রিকশা ভাড়া নিয়া বউরে কলেজে দিয়াসে। আর ছোট মনিরে দেখেন, তার তো মেলা টাকা। কীসব ছবিটবি আঁকে, সেগুলান বেঁচে। ”
মিশুক প্রথমে এইসব গল্প না শোনার ভান করে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই গল্পে অন্য টুইস্ট আছে। দাদু লোকটা অতি চালাক। এইসব গল্পে তার হাত থাকলেও থাকতে পারে।
***
হ্যাপি আপার হাসিখুশি ভদ্রমানুষের আড়ালে আরও একটা রুপ আছে সেটা আকাশী জানতে পারলো দশ বারো দিন পর। তার বাসায় এক ভদ্রলোক এসেছেন। বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে অল্প বয়সী এক মেয়ে। তারা এক রুমে ঢুকে গেছে। বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক পর। এই তিন ঘন্টা ও অন্যরুমে ছিলো। ও’কে যে ঘর টায় থাকতে দিয়েছিল তারা সেই ঘরে গেছেন। হ্যাপি আপা ও’কে একটা আজগুবি গল্প শুনিয়ে দিলেন। ও বিশ্বাস করলো না। এই তিন বছরে ও অনেক কিছু দেখেছে, এসব ব্যাপার এখন আর ও’কে বলে বোঝানোর দরকার নেই। এগুলো ও বোঝে।
চলবে….
(যারা পড়ছেন প্লিজ কমেন্ট করবেন। ফেসবুক দিন দিন রিচ কমিয়ে দিচ্ছে।)