#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২.
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসতেই ঐচ্ছির ফোনটা বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। তাই আর কলটা রিসিভ না করে ফোনটা বিছানার এক কোণে রেখে দিল। বিছানার যেই জায়গাটাতে সে বসেছে তার বরারবর উল্টো পাশে আছে তার ড্রেসিংটেবিল। এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে সে। মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। নিজেকে নিজেই গভীর ভাবে পরখ করে দেখছে সে। তার উপর এক জ্বীনের নজর পড়েছে কিভাবে রক্ষা পাবে সে এখন সেই নজর থেকে। কোনো বড় হুজুরের সাথে কথা বলে দেখবে? ভাবছে ঐচ্ছি। ফর্সা কপালে দীর্ঘ ভাজ পড়েছে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে চলছে। তখনই আবারো তার ফোনটা বেজে উঠে। ক্ষুব্ধ নয়নে ফোনটার দিকে তাকাল সে। সেই আননোন নাম্বার। ক্রমাগত বেজেই চলছে। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে অগত্যায় সে কলটা রিসিভ করে,
‘আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি রাফসান বলছি।’
এতক্ষণের বিরক্তিটা নিমিষেই রাগে পরিণত হলো। প্রচন্ড রাগে ঐচ্ছি দাঁতে দাঁত পিষছে। ঐচ্ছিকে চুপ থাকতে দেখে ওপাশ থেকে রাফসান বলে উঠে,
‘কি ব্যাপার ঐচ্ছি, কোনো কথা বলছেন না যে?’
ঐচ্ছি এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো,
‘কলটা তো আপনি দিয়েছেন তার মানে আপনার আমাকে প্রয়োজন তাই কোনো কথা থাকলে আপনি বলুন। আমার কিছু বলার নেই।’
ওপাশে থেকে কিছুক্ষণ নিরব থেকে রাফসান ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠল,
‘আপনি নাকি এই বিয়েতে রাজি না, কথাটা কি সত্যি ঐচ্ছি?’
‘জ্বি, একদম সত্যি। আমাকে কি পাগলে পেয়েছে নাকি যে আমি একজন মানুষ হয়ে জ্বীনকে বিয়ে করবো?’
রাফসান বেশ শান্ত কন্ঠে বললো,
‘কিন্তু ঐচ্ছি বিয়েটা করা ছাড়া যে আপনার কোনো উপায় নেই। আপনার মতে কিংবা অমতে বিয়েটা হবেই। আর তাছাড়া..’
রাফসানকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েই ঐচ্ছি চেচিয়ে উঠে বললো,
‘এই মি. জ্বীন আপনার তো সাহস কম না, আমি রাজি না থাকা সত্ত্বেও আপনি জোর করে আমাকে বিয়ে করবেন। কত বড় কথা! শুনেন মি. জ্বীন আমি যদি একবার আয়তুল কুরসি পড়ি না তবে আপনি কেন আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউই আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবেন না। সো বি কেয়ারফুল ওকে!’
ঐচ্ছির এমন থ্রেড শুনে রাফসান সশব্দে হেসে ফেলে। রাফসানের হাসির মৃদু ঝংকারে ঐচ্ছির বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠে। এই জ্বীনটার হাসিটাও তার মতোই সুন্দর। হাসির শব্দ বন্ধ হতেই ঐচ্ছির বুক চিরে স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ রাফসানের এই ভয়ানক সুন্দর হাসির শব্দগুলো তার বুকের নিশ্বাসকে ভারি করে তুলছিলো। রাফসান হাসি থামাতেই ঐচ্ছি রাগি গলায় বললো,
‘ঐ আপনি হাসলেন কেন?’
‘ভীষণ মজার কথা বলেছেন আপনি ঐচ্ছি, তাই হাসি পাচ্ছে।’
ঐচ্ছির রাগটা এবার আকাশ ছুঁলো। বেটা জ্বীনের বাচ্চা জ্বীন কত বড় সাহস, তার কথা নিয়ে মজা করে? ঐচ্ছি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘কোনটা মজার কথা ছিল,হুম?’
রাফসান স্মিত হেসে বললো,
‘ঐ যে বললেন না আয়তুল কুরসি পড়লে আমরা আপনার ধারে কাছেও যেতে পারবো না সেটা। অবশ্য আপনার ধারণা ঠিক তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। আয়তুল কুরসি কে শুধুমাত্র খারাপ জ্বীনেরাই ভয় পায়; যারা আল্লাহ্র ইবাদত করে না, যারা সারাদিন শুধু মানুষের ক্ষতি করার কথাই ভাবে, এই আয়তুল কুরসি কেবল তাদেরই কাবু করতে পারে। আমাদের কেন কাবু করতে পারবে না জানেন কারণ আমরা হলাম ইদ্রিসে জ্বীন। আমরাও আপনাদের মতো আল্লাহর ইবাদত করি,পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি,আমরাও আয়তু কুরসি পড়ি। তাই আমাদেরকে আয়তুল কুরসির ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বুঝতে পেরেছেন ম্যাডাম?’
রাগে ঐচ্ছির চোখ মুখ কুঁচকে এলো। কোনোভাবেই কি এই জ্বীনকে সে দমাতে পারবে না? কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়িয়ে ঐচ্ছি বিনয়ের সুরে বললো,
‘দেখুন আপনি বুঝতে কেন চাইছেন না এটা কোনোভাবে পসিবল না। আমি মানুষ আর আপনি জ্বীন, আমাদের দুজনের কোনোভাবেই বিয়ে হতে পারে না। প্লিজ মি. জ্বীন বোঝার চেষ্টা করুন।’
রাফসান মুচকি হাসল। বললো,
‘চাইলেই সব কিছু সম্ভব। আপনাকে আমি ভালোবাসি,ঐচ্ছি। পুকুর পাড়ের সেই পিচ্চি মেয়েটাকে দেখে ভীষণ ভাবে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলাম না তাকে। আপনি যখনই গ্রামে যেতেন আমি পুরোটা সময় অদৃশ্য হয়ে আপনার পেছন পেছন ঘুরতাম। আপনাকে যেদিন পুকুরের পানিতে গোসলরত অবস্থায় দেখলাম বিশ্বাস করুন সেই মুহুর্তে নিজের সবকিছু গুলিয়ে ফেলছিলাম। আপনার ভেজা চুলগুলো আমাকে উন্মাদ করে তুলছিল। আপনার ঠোঁট গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ জলগুলো দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল কিছু একটা করে বসি। মারাত্মক কোনো কিছু। কোনোরকমে নিজেকে সেদিন সামলে নিয়েছিলাম আর প্রহর গুণছিলাম কখন আপনি প্রাপ্ত বয়স্ক হবেন আর কখন আপনাকে নিজের করে পাবো। এখন যে সেই সময় চলে এসেছে ঐচ্ছি। আপনার উনিশ বছর চলছে নেক্সট মান্থে বিশ হবে। বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন আর নিজেকে আমি আটকাতে পারবো না ঐচ্ছি। আর না অন্য কেউ পারবে। বিয়েটা আপনাকে করতেই হবে ঐচ্ছি। যদি ভালোভাবে রাজি হয়ে যান তো ভালো আর তা না হলে আপনার মা বাবাকে যেভাবে রাজি করিয়েছি আপনাকেও সেভাবেই রাজি করাবো।’
কথাটা বলেই ঐচ্ছিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দেয় রাফসান। ঐচ্ছির শরীরটা হালকা পাতলা কাঁপছে। এক ভয়ানক অনুভূতি তার মন চিরে ভেতরটা গ্রাস করে নিচ্ছে। রাফসানের শীতল কন্ঠস্বরে বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। তার মানে তার ধারণাই ঠিক এই রাফসানই তার মা বাবার সাথে কিছু একটা করেছে তাই উনারা এত সহজে এই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছে। ঐচ্ছির চোখে মুখে মারাত্মক ভয় ঝেঁকে বসে। রাফসান যে প্রয়োজনে তার শান্তশিষ্ট চরিত্রের খোলসটা খুলে ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে সেটা সে তার কথার ধরণেই বুঝেছে। ঐচ্ছির কাঁদো কাঁদো মুখ করে আয়নায় ফুটে উঠা তার প্রতিবিম্বটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,’শেষ পর্যন্ত কি এই সুদর্শন ভয়ানক জ্বীনটাকেই তার বিয়ে করতে হবে? বাঁচার কি আর কোনো উপায়ই নেই?’
_____________________________________
রাতের খাবার শেষে রুমে এসে দরজা আটকে দিল ঐচ্ছি। খাবারের পর মা বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করার অভ্যাস আছে তার। তবে আজ সে ইচ্ছে করেই সেই অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে রুমে চলে এলো। তার মা বাবা এখন তার বিয়ে নিয়ে বিশদ আলোচনা জুড়ে দিয়েছে, আর এই আলোচনার মাঝে থাকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার। তাই রুমের দরজা আটকিয়ে বারান্দায় এসে বসে সে। বারান্দার এক কোণে রাখা রকিং চেয়ারটাই হেলান দিয়ে বসে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়। আকাশের দলা পাকানো মেঘের কারণে রুপালি চাঁদের কোনো দেখাই আজ মিলছে না। রকিং চেয়ারটা মৃদু দুলছে। ঐচ্ছি চোখ বুজে ভাবছে কি করা যায়? কিছু একটা তো করতেই হবে? সে কোনোভাবেই একটা জ্বীনকে বিয়ে করবে না। বাইরের ঠান্ডা বাতাস ঐচ্ছির শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। দূরে কোথাও কুকুরের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। ঐচ্ছি চোখ মেলে বাইরের দিকে তাকায়। যতদূর চোখ যায় নিকষ কালো অন্ধকার। দূরের রাস্তায় কিছু সোডিয়ামের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাটা এখন একদম নিরব। রাত হলে এইদিকে তেমন একটা গাড়ি আসা যাওয়া করে না। মাঝে মধ্যে এক দুটো গাড়ি আসা যাওয়া করে হয়তো তবে এর সংখ্যাও খুবই নগণ্য। ঐচ্ছি রকিং চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার গ্রিলটাতে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াল। একাগ্রচিত্তে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে পড়ল তার নাজমুল হুজুরের কথা। যার কাছে ঐচ্ছি তার কোরআন খতম দিয়েছিল। তবে সেটা অনেক আগের কথা। উনি তখনই একজন বড় মাপের হাফেজ ছিলেন। বাবার কাছে একদিন শুনেছিল উনি নাকি এখন বড় মাওলানা হয়েছেন। আচ্ছ, উনার কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়? ঐচ্ছির ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। একটু হলেও আশার আলো দেখতে পেয়েছে সে। এটাকেই এখন সে কাজে লাগাবে…
চলবে..