#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৭.
ঐচ্ছি সরু চোখে তার সামনে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার এই দৃষ্টি বরাবরই রাফসান উপেক্ষা করছে। ঐচ্ছি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। হাত দিয়ে হিজাবটা একটু ঠিক করে বললো,
‘কি দরকার ছিল আরিফকে এইভাবে মারার?’
‘ও আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বলছিল।’
শক্ত কন্ঠে জবাব দেয় রাফসান। ঐচ্ছি চুপ। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে উঠে,
‘ও শুধু আপনাকে মোবাইলে কথাগুলো বলেছিল আর আপনি কিনা তার বাসায় গিয়ে তাকে মেরে এসেছেন? কি সাংঘাতিক!’
রাফসান কোনো জবাব দিল না। ঐচ্ছি বেশ বিরক্ত হলো, কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। সেও থম মেরে বসে রইল। চেয়ে রইল লেকের সেই লাল পদ্মগুলোর দিকে। তাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরেই এই লেক, সেখানেই তারা এসেছে। আসার পর থেকেই রাফসান চুপচাপ বসে আছে। চোখ মুখ তার গম্ভীর। তীক্ষ্ণ নাকের ডগাটা কিঞ্চিৎ লাল। রাফসান কি এখনো রেগে আছে? ঐচ্ছি ঠিক বুঝতে পারছে না। সেও ভীষণ আনকমফোরটেবল ফিল করছে। নিরবে কিছুটা সময় কাটল। ঐচ্ছি আড়চোখে রাফসানের দিকে তাকাল। সে আপন মনে লেকটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি হালকা কাশে, মিনমিনিয়ে বলে উঠে,
‘শুনলাম আরিফ নাকি আপনার মার খেয়ে না আপনার ভয়ানক রূপ দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে? না মানে এই যে এই রূপটা কি আপনার আসল রূপ না? আপনি কি দেখতে অন্যসব জ্বীনদের মত খুব ভয়ংকর?’
রাফসান এবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঐচ্ছির দিকে তাকাল। ঐচ্ছি তখন দাঁত কেলিয়ে বোকা বোকা হাসি দিল। ভয়ে ভয়ে বললো,
‘না মানে আপনি তো দেখতে খুব হ্যান্ডসাম, আর এত হ্যান্ডসাম ডেসিং কোনো জ্বীন হয় নাকি? সাদমান ভাইয়া বললো আরিফ নাকি আপনার ভয়ানক রূপ দেখেই সেন্স হারিয়েছে। আপনি যখন রেগে যান তখন নাকি দেখতে খুব ভয়ংকর হয়ে যান। তবে কি সেটাই আপনার আসল রূপ? আর এই যে এখন যেভাবে আমার সামনে বসে আছেন এটা কি নকল?’
রাফসান আলতো হাসে। ঠোঁট জোড়া নড়লেও আজ আর গালে গর্ত হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফসান বলে উঠে,
‘ছোটবেলা থেকেই আমার এই সমস্যা। প্রচন্ড রেগে গেলে আমি ভয়ানক রূপ ধারণ করি। তবে এই সমস্যার কথা আমি নিজেই জানতাম না। কয়েক বছর আগে এই কথা আমি জানতে পারি। একবার আমার ছোট মামু আমার মাকে সবার সামনে চড় মারে। সেদিনই আমি প্রচণ্ড রেগে যায়। আমার সামনে আমার আম্মাজানকে মেরেছে এটা যেন আমি কোনোমতেই সহ্যই করতে পারছিলাম না। সেই প্রথম আমার রূপের বদল ঘটে। বাড়ির সবাই সেটা দেখেছিল। মামাকে সেদিন আমি প্রচুর মারি। কেউ আমাকে আটকাতে পারেনি। আমার অমন ভয়ানক রূপ দেখে প্রথমে সবাই ঘাবড়ে যায়। পরে আব্বাজান সবাইকে বুঝিয়ে বলে, এটা কোনো ভয়ের ব্যাপার না। আমি স্বাভাবিকই। শুধু অতিরিক্ত রেগে গেলেই এমন হয়। সেদিন ছিল ফার্স্ট আর আজ আবার। ঐ ছেলেটার মুখে আপনাকে নিয়ে বলা বাজে কথাগুলো সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তখন সেই রূপে চলে গিয়েছিলাম। তবে ঐ জানোয়ারকে বেশি মারতে পারেনি তার আগেই সে সেন্সল্যাস হয়ে যায়। আর সাদমান ও আমাকে ফলো করতে করতে সেখানে চলে আসে। তারপর তো সাদমানই ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়।’
ঐচ্ছি খুব মনোযোগ দিয়ে রাফসানের কথাগুলো শুনছিল। তার মস্তিষ্ক তাকে ইতিমধ্যেই সতর্ক বাণী দিয়ে দিয়েছে যে, ‘ঐচ্ছি আর যাই করিস না কেন ভুলেও এই জ্বীনকে রাগাতে যাবি না। নয়তো এর ভয়ানক রূপ দেখলে তুই ডিরেক্ট উপরে চলে যাবি।’
ঐচ্ছি ভয়ে ভয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে। ফিচেল গলায় বলে,
‘আরিফের তো এখনো জ্ঞান ফেরেনি। জ্ঞান ফিরলে যদি ও সবাইকে সবটা বলে দেয়, তখন?’
মৃদু হেসে রাফসান জবাব দেয়,
‘সেই চান্স নেই। হসপিটালে সাদমান আছে। বাকি ব্যাপারটা ও সামলে নিবে।’
ঐচ্ছি কিছুটা ধাতস্থ হয়। গলার স্বর নামিয়ে বলে,
‘আচ্ছা আরিফ আপনার নাম্বার কি করে পেল?’
‘জানি না। সংগ্রহ করেছে হয়তো কোথাও থেকে।’
ঐচ্ছি উদাসী কন্ঠে বললো,
‘ওহহ’
আবারও চুপচাপ বসে রইল দুজন। লেকের পাশে সাড়ি সাড়ি সুপারি গাছ। সেখান থেকে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঐচ্ছি সেই ডাকের মনোযোগী স্রোতা। নীরবতা কাটল, রাফসান গম্ভীর সুরে বললো,
‘আপনার সাইভিদ ভাইয়া নয়তো?’
বড় বড় চোখ করে রাফসানের দিকে তাকায় ঐচ্ছি। ব্রু কুঁচকে বলে উঠে,
‘কি বলছেন এসব? সাইভিদ ভাইয়া কেন এমন করতে যাবে?’
রাফসান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে বেরিয়ে আসল তীক্ত এক অনুভূতি। তেতো মুখে বললো,
‘মনে হলো আরকি। যেহেতু উনি তোমাকে পছন্দ করেন। সেহেতু উনি আমাদের বিয়েটা ভাঙতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আর উনি তো জানেন না যে আমি জ্বীন, জানলে অবশ্যই এই বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করতেন। তাই হয়তো উনিই আরিফের মাধ্যমে কাজটা করিয়েছেন। হতে পারে, তবে আমিও সিউর না।’
রাগ হলো ঐচ্ছির। কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললো,
‘হতে পারে না সিউর হয়ে তবেই কাউকে কিছু বলিয়েন। অযথা কাউকে দোষারোপ করবেন না।’
রাফসান মৃদু হাসে। হেয়ালির সুরে বললো,
‘বাবা, ভাইকে বলাতে বোনের গায়ে লেগেছে।’
ঐচ্ছি চোখ পাকিয়ে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান হেসে ফেলে। ঐচ্ছি অবাক চোখে সেই হাসি দেখে। প্রেমে পড়ার জন্য এই হাসিটাই যথেষ্ট। ঘোর লাগে ঐচ্ছির। নিজের অজান্তেই সে বলে ফেলে,
‘আপনার হাসিটা খুব সুন্দর রাফসান।’
রাফসান স্মিত সুরে বলে,
‘আর আপনার কম্পিত অধররঞ্জনী।’
টনক নড়ে ঐচ্ছির। কি বলে ফেলেছে সে। ইশ, কি ঠোঁটকাটা মেয়ে সে। কি দরকার ছিল এসব বলার। ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়ে ধরে। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে সে। রাফসানের বলা কথাটাও কানে বাজতে থাকে তার। মৃদু শিহরণ বয়ে যায় সারা অঙ্গ জুড়ে। রাফসান এগিয়ে আসে ঐচ্ছির দিকে। ঐচ্ছির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
‘ঠোঁট কামড়ানোর অভ্যেসটা বাদ দিন মিস। নয়তো এর জন্য ভবিষ্যতে আপনাকেই বিপদে পড়তে হবে।’
কি শীতল এই কন্ঠস্বর। কাটা দিয়ে উঠে ঐচ্ছির গায়ে। ঠোঁট দুটো চেপে ধরে চোখ বুজে বড় করে একটা নিশ্বাস নেয় সে। উফফ, শ্বাস নিতে পারছে না। ঐচ্ছি সোজা হয়ে বসে। রাফসান ততক্ষণে ঐচ্ছির থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে বসে মোবাইলে মনোযোগ দেয়। ঐচ্ছি আড়চোখে তাকে দেখে। হালকা বেগুনী রঙের একটা টিশার্ট পরেছে সে। সাথে জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো, কপাল জুড়ে তাদের বিশাল রাজত্ব। ফর্সা গালে ছোট ছোট দাড়িগুলো যেন একটু বেশিই আকর্ষণীয় করে তুলে এই জ্বীনটাকে। আর তার নীল চোখ। তার কোনো উপমা হয়না। ঐচ্ছি তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তার মনে বাজতে থাকে এক সুর,
‘প্রেমে পড়া বারণ,
কারণে অকারণ,
আঙ্গুলে আঙ্গুল রাখলেও
হাত ধরা বারণ।’
ঐচ্ছি মৃদু সুরে রাফসানকে ডাকে,
‘রাফসান!’
রাফসান তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘জ্বি, বলুন।’
‘আমাকে ঐ পদ্মগুলো এনে দিবেন?’
রাফসান স্থির চোখে পদ্মগুলোর দিকে চেয়ে বললো,
‘আপনি চাইলে আনতেই পারি।’
খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে ঐচ্ছি বললো,
‘ঠিক আছে, তাহলে এনে দিন।’
রাফসান লেকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লাল পদ্মগুলো লেকের ঠিক মাঝখানে। ঐচ্ছিও উঠে রাফসানের পাশে এসে দাঁড়ায়। রাফসান একপলক ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে হুট করেই ঝাপ দিয়ে পড়ল পানিতে। ঐচ্ছি অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। রাফসান পুরো দমে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ঐচ্ছির এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। পদ্মগুলো আনতে যে রাফসান এইভাবে পানিতে ঝাপ দিবে, ঐচ্ছি সেটা ভাবতেও পারেনি। বেশি সময় লাগল না। পানিতে থেকে উঠে এল রাফসান। হাতে তার বেশ কিছু পদ্ম ফুল। ভিজে টইটম্বুর তার শরীর। চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়জে। গালের উপর ছোট ছোট দাড়িগুলোতেও লেগে আছে বিন্দু বিন্দু পানি। রাফসান জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে। তারপর মুচকি হেসে ঐচ্ছির দিকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এই যে নিন, আপনার পদ্মফুল।’
ঐচ্ছি ফুলগুলো হাতে নিল না। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রাফসানের দিকে। রাফসান আবারো বললো,
‘কি হলো, ঐচ্ছি? নিন।’
ঐচ্ছি এগিয়ে গেল, রাফসানের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁপাকাঁপা হাতে রাফসানের ভেজা গাল স্পর্শ করলো। রাফসান চোখের ভারি পল্লবগুলো নাড়িয়ে ঐচ্ছির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটার চোখে মুখে কেমন ঘোর লেগে আছে। ঐচ্ছি গাল থেকে হাতটা সরিয়ে রাফসানের ঠোঁটের উপর রাখতেই রাফসান হাতটা সরিয়ে নেয়। ঐচ্ছির কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। ঐচ্ছির মাঝে কোনো হেলদোলই নেই। রাফসান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, গম্ভীর গলায় বললো,
‘আমি আপনার ক্ষণস্থায়ী নেশা হতে চাই না ঐচ্ছি, আমি আপনার চিরস্থায়ী নেশা হতে চাই। যে নেশার ঘোর থেকে আপনি কখনোই বের হতে পারবেন না।’
কথাটুকু বলেই রাফসান ঐচ্ছির হাতে পদ্মফুল গুলো ধরিয়ে দিয়ে নিমিষেই সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। রাফসান চলে যেতেই ঐচ্ছির হুশ ফেরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাফসানকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু পায় না, হাতের মাঝে পদ্মগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সেও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
চলবে..