কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ১৮.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

১৮.
বাসায় এসে ঐচ্ছি দেখল, সায়মা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ঐচ্ছি মুচকি হেসে তার পাশে গিয়ে বসে। সায়মার গাল টেনে আদুরে কন্ঠে বলে,

‘আমার সামু বেবিটার কি হয়েছে?’

সামু নাক ছিটকে অন্যদিকে মুখ ঘুরায়। ঐচ্ছি ঠোঁট চেপে হাসে। সায়মা যেদিকে মুখ ঘুরিয়েছে ঐচ্ছি উঠে গিয়ে সেদিকে বসে। আহ্লাদের সুরে বলে,

‘আমার বাবুটা বুঝি রাগ করেছে? কেন বাবু? কেন তুমি আমার উপর রাগ করে আছো? বলনা প্লিজ।’

সায়মা তেরছা চোখে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে,

‘আমাকে তোর সাথে নিলি না কেন? জানিস আমি বাসায় বসে বসে কত বোর হচ্ছিলাম!’

ঐচ্ছি সায়মার ধুতনিটা হালকা নাড়িয়ে বলে উঠে,

‘আহারে আমার কিউট বেবিটা খুব বোর হচ্ছিলো বুঝি? এই যে বেবি আমি এখন চলে এসেছি না, তুমি আর বোর হবে না। এই যে দেখ আমার হাতে কি?’

সায়মা ছোট ছোট চোখ করে ঐচ্ছির হাতের দিকে তাকালো। হাতের মুঠে জ্বলজ্বল করছে একগুচ্ছ পদ্মফুল। সায়মা ঠোঁট উল্টে নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,

‘এইগুলো নিশ্চয় তোর ঐ রোমান্টিক জ্বীন বরটাই তোকে দিয়েছে তাই না?’

ঐচ্ছি মুচকি হেসে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। সায়মা চোখে মুখে দুঃখি দুঃখি ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,

‘আহা, আমার যে কবে এমন ভাগ্য হবে?’

ঐচ্ছি হাসে। ফুলগুলো খুব যত্ন করে তার ড্রেসিংটেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখে। এক সময় হয়তো এই ফুলের সৌন্দর্য আর থাকবে না। এই কোমল শরীরটাতে তার পচন ধরবে। কিন্তু এই ফুলের মাঝে যে ভালোবাসাটা আছে তার সৌন্দর্য কখনোই বিলিন হবে না, বরনচো সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোবাসা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলবে।
.

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা মেলে দেয় ঐচ্ছি। তার পাশেই বসে সায়মা কোনো এক উপন্যাসের পাতায় নিচের দৃষ্টি বিচরণ করছে। ঐচ্ছির চোখ জুড়ে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। চোখের পাতাগুলো মিঁইয়ে যাবে তখনি তার রুমে আসেন তাহেরা বেগম। রুমে ঢুকেই তিনি ঐচ্ছিকে তাড়া দিয়ে বলে উঠেন,

‘এই ঐচ্ছি উঠ, তোর ছোট খালামনিরা আসছে। ঘর দোর গুছাতে হবে। উঠ জলদি।’

ঘুমের ঘোরেই কথাটা কানে যায় ঐচ্ছির। তাই কথাটার মানে বুঝতে কিছুটা সময় নেয়, কিন্তু যখনই তার মস্তিষ্ক কথাটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে তখনই শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে সে। বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠে,

‘ছোট খালামনিরা আসছে মানে?’

তাহেরা বেগম ব্রু কুঁচকালেন, বিরক্তির সুরে বললেন,

‘মানে আবার কি? তোর না কালকে এংগেইজমেন্ট? তাই আমি ওদের আসতে বলেছি। আর সেদিনের আচরণের জন্য ক্ষমাও চেয়েছি। যতই হোক আমার তো একটা মাত্র বোন; ওকে ছাড়া কি আমি কোনো অনুষ্ঠান করতে পারি বল?’

ঐচ্ছি হতভম্ব। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রথমবার তার মা যা ঝামেলা করেছিল, ঐচ্ছির তো মনে হয়েছিল তার খালামনিরা আর এই বাড়ির চৌকাঠও কোনোদিন মারাবেন না। আর বিশেষ করে সাইভিদ ভাইয়া। উনার যা ইগো, ঐচ্ছি তো ড্যাম সিউর ছিল যে এই মানুষটা আর তাদের সাথে কোনো সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু এত সহজেই যে উনারা সবটা মেনে নিবেন সেটা ঐচ্ছি কল্পনাও করেনি। তবে এটা দারুণ একটা ব্যাপার। এক বোন অন্য বোনকে ক্ষমা করে দিয়েছে। খালামনিরা আবার তাদের বাসায় আসবে। উফফ, কি আনন্দ! ঐচ্ছি খুশিতে লাফিয়ে উঠে। উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে, এত সহজে সবকিছু মিটমাট করিয়ে দেওয়ার জন্য। তাহেরা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ঐচ্ছি সায়মাকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলে,

‘নাম সামু, বিছানা গুছাতে হবে। ছোট খালামনিরা আসছে।
ইয়াহু, কি মজা। আমার তো নাচতে ইচ্ছে করছে।’

চুপসানো মুখ নিয়ে এক কোণায় দাঁড়ায় সায়মা। ঐচ্ছি ঐদিকে তাড়াহুড়ো করে সব রুম গোছাচ্ছে। সায়মাও তাকে একটু আধটু সাহায্য করছে। তাহেরা বেগম হরেক রকম নাস্তা বানাচ্ছেন। মনে মনে এক বিশাল অপরাধ বোধ কাজ করছে তার। বোন আসলে বোনের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইবেন বলে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন তিনি। সাইভিদের কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে। ছেলেটাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন।

.

সব কাজ শেষ করে বিছানার উপর পা গুটিয়ে বসে ঐচ্ছি। আড়চোখে সায়মার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন যেন চুপসানো বেলুনের মতো হয়ে আছে। ঐচ্ছি বেশ কিছুক্ষণ ব্রু কুঁচকে সায়মার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সায়মার মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটে না। ঐচ্ছি এবার তার হাত দিয়ে সায়মার মুখটা তার দিকে ঘুরায়। ব্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করে,

‘হুয়াট হ্যাপেন?’

সায়মা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

‘দোস্ত আমি বাড়ি চলে যাই?’

ঐচ্ছি চোখ কুঁচকে গম্ভীর সুরে বলে,

‘বাড়ি কেন যাবি? কি হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে তোর?’

সায়মা মাথা হেলিয়ে না বলে। ঐচ্ছি ফিচেল গলায় বলে,

‘তবে বাড়ি যেতে চাচ্ছিস কেন?’

সায়মার মুখটা আরো মিঁইয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলে সে বলে,

‘তোর সাইভিদ ভাইয়া আসছে। ঐদিন উনি ফোনেই আমাকে যা ঝারা ঝেরেছেন না জানি এখন সামনে পেলে কি করেন। ভয় করছে দোস্ত। তাই বলছি, উনি আসার আগে আগেই কেটে পড়ি। নয়তো পরে বিপদে পড়তে হবে।’

সায়মার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে ঐচ্ছি। হাসিটা যে বিদ্রুপের সেটা সায়মা বেশ বুঝতে পারছে। সায়মা তাই মুখ কালো করে অন্য দিকে ঘুরে বসে। ঐচ্ছি এবার হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে। আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘ধুরর, তোকে বলেছে? সাইভিদ ভাই বোধ হয় এতদিনে সব ভুলেও গিয়েছে, উনার যা ভুলো মন। এইসব নিয়ে তুই এত ভয় পাস না। আর আমি আছি তো, সাইভিদ ভাইয়া তোকে কিছু বলতে এলে আমি তোকে বাঁচাবো। তবে হ্যাঁ তুই কিন্তু ভুলেও উনাকে সত্যিটা বলতে যাস না, নয়তো কিন্তু অনেক বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছিস তো কি বলেছি?’

সায়মা শুকনো হেসে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তার
মানে সে বুঝতে পেরেছে।

_____________________

ঘড়ির কাটায় সাতটা বেজে বিশ মিনিট। অপেক্ষার প্রহর অবশেষে শেষ হলো। দরজায় কলিং বেল বাজতেই ছুটে যায় ঐচ্ছি। দরজা খুলেই খালামনির বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। তানিয়া জুবায়েরও পরম যত্নে ঐচ্ছিকে নিজের বুকে আগলে নিলেন।

‘মা, তোমার আর তোমার বোনের মেয়ের ভালোবাসা শেষ হয়ে থাকলে এবার একটু সাইড হয়ে দাঁড়াও। আমি আর কতক্ষণ এইভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো?’

ঐচ্ছি মাথা উঠিয়ে সাইভিদের দিকে তাকায়। সাইভিদের কথা শুনে সে বেশ বুঝতে পারছে, সাইভিদ এখনো রেগে আছে। রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। ঐচ্ছি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে স্মিত সুরে বলে,

‘কেমন আছো, ভাইয়া?’

‘খারাপ থাকার কি কোনো কারণ আছে?’

কথাটা বলেই সে হনহন করে বাড়ির ভেতর চলে যায়। পাশ কাটিয়ে যায় তাহেরা বেগমকেও। তাহেরা বেগম কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। ছেলেটা রেগে আছে। থাক, রাগ পড়ুক তারপরই না হয় কথা বলা যাবে। তাহেরা বেগম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে যান তার বোনের দিকে। জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। তানিয়াও কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা মারা যাওয়ার পর এই বোনই তাকে আগলে রেখেছে। বোনকে ছাড়া তিনি নিঃস্ব। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলতে থাকে দুই বোনের দুঃখের সমাচার। ঐচ্ছি সেখানে নিরব দর্শক। আর সায়মা ঐচ্ছির রুমেই খাপটি মেরে বসে আছে সাইভিদের ভয়ে। এক পর্যায়ে তাদের দুঃখ বিলাস শেষ হয়। সবাই একে একে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। ঐচ্ছির খালু আসতে পারেনি বলে ঐচ্ছির কিছুটা মন খারাপ হয়। কিন্তু খালামনি তাকে বুঝিয়ে বলায় সে বুঝেছে। অফিসে কাজের চাপ অনেক। চেষ্টা করেছে খুব, তবুও ছুটি পায়নি। তাই আর আসতেও পারেনি। এক্ষেত্রে তো আর কারোরই কিছু করার থাকে না। ঐচ্ছিও তাই মেনে নিয়েছে ব্যাপারটা।

.

‘সাইভিদ ভাইয়া, মা তোমাকে ড্রয়িং রুমে ডাকছে।’

ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না আসায় ঐচ্ছি মাথাটা একটু এগিয়ে রুমের ভেতর উঁকি দেয়। না রুম তো খালি। তবে কি সাইভিদ ভাইয়া বারান্দায়? ঐচ্ছি পা টিপে টিপে রুমে ঢোকে। নাকে আসে বিচ্ছিরি এক গন্ধ। নাক ছিটকায় ঐচ্ছি। সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেট টেনে যাচ্ছে সাইভিদ। ঐচ্ছি এগিয়ে যায় সাইভিদের দিকে। নিরবে সাইভিদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখ নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার সামনে থাকা সুঠাম দেহি পুরুষ মানুষটা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘কি চাই?’

হঠাৎ সাইভিদের কন্ঠ শোনে ভয় পেয়ে যায় ঐচ্ছি। বুকে থু থু দিয়ে শুকনো কন্ঠে বলে,

‘মা তোমাকে ডাকছিল।’

‘তো?’

সাইভিদের তাচ্ছিল্যের সুরে থমকে যায় ঐচ্ছি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,

‘মায়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি ভাইয়া। আর মাও খুব অনুতপ্ত। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে মাও খুব কষ্ট পেয়েছেন। তাই তিনি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। প্লিজ ভাইয়া, আর রাগ করে থেকো না। একবার নিচে গিয়ে মায়ের কথাগুলো শুনো। প্লিজ, ভাইয়া চলো।’

ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেটটা চেপে ধরে তাতে জোরে টান দেয় সাইভিদ। তারপর ঠোঁটের মাঝ থেকে সিগারেটটা সরিয়ে নাক মুখ দিয়ে কুন্ডলী পাকানো কিছু সাদা ধোঁয়া বের করতে থাকে। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

‘খালামনি যে সবকিছু রাফসানের কথায় করেছে, সেটা কি তুই জানিস ঐচ্ছি?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here