#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২০.
আকাশে আজ চাঁদ নেই। কৃষ্ণের বিষাক্ত মায়ায় আজ এই আকাশ আচ্ছাদিত। চারপাশে ভয়ানক নিরবতা। যেন এ কোনো মৃত্যুপুরী। দূর থেকে কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে কিছুটা দূরে একটা বাঁশ বাগান, সেখান থেকেই এই ডাকগুলো আসছে। যেন এই নিরবতার তালে তালে ঝিঁঝিঁ পোকারা দল বেধে গান গাইতে নেমেছে। রাস্তার ধারের সোডিয়াম আলোতে ঐচ্ছিদের বাড়ির ছাদটা আবছা আলোকিত। এই আবছা আলো রেখার আদলে নির্নিমেষ দাঁড়িয়ে আছে একজন সুঠাম দেহী যুবক। হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুলের ফাঁকে আটকে আছে তার এক জ্বলন্ত সিগারেট। তার থেকে কিছুটা দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সায়মা। ভয় না অস্বস্তি জানা নেই তার। মনে মনে ঐচ্ছিকে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে সে। কি দরকার ছিল এই সাইভিদের কথায় তাকে নাচতে নাচতে ছাদে পাঠিয়ে দেওয়ার? উফফ, বুকটা ধরফর করছে তার। এই লোকটা এখন তাকে একা পেয়ে কি করে বসে আল্লাহই জানেন। সায়মা আড়চোখে একবার সাইভিদের দিকে তাকাল। অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। শুধু হাতে থাকা সিগারেটটার লাল স্ফুলিঙ্গটাই দেখা যাচ্ছে। লোকটা কিছু বলছে না কেন? তখন থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। ছাদের দরজার ফাঁক দিয়ে ঐচ্ছি দেখার চেষ্টা করলো ভেতরে কি চলছে। কিন্তু এই অন্ধকার তার এই চেষ্টার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। আর এই দুইটা এমন বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? কিছু বললেও তো শোনা যেত। ঐচ্ছি কোমরে হাত দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
বেশ কিছুটা সময় এই নিরবতাই কাটল। সাইভিদের সিগারেটটা শেষ হতেই সেটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। সায়মার দিকে ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
‘তুমি কি এখনো আমাকে ভয় পাচ্ছো, সায়মা?’
সায়মা চোখের পাতা প্রশ্বস্থ করে সাইভিদের দিকে তাকাল। প্রসন্ন হেসে বললো,
‘না তেমন কিছু না। আসলে মিথ্যে বলার জন্য আমি দুঃখিত। আর..’
‘থাক সেসব। যেটা হওয়ার সেটা তো হয়েই গিয়েছে। সেসব নিয়ে আর কথা বলতে হবে না। আর তুমিও এত ভয় পেয়ো না। রাগ তো সেদিনই আমি দেখিয়ে ফেলেছিলাম। একটুও বেশিই বলে ফেলেছিলাম তাই না? সরি, আসলে আমারও না রাগ উঠলে আর হুশ থাকে না কাকে কি বলে ফেলি, পরে টের পায় আরকি। সেদিনের জন্য আমিও দুঃখিত। আশা করি এবার তুমি একটু ইজি হবে।’
সায়মা অবাক হলো। যাকে বলে ভীষণ অবাক। এত সহজেই সবটা ঠিক হয়ে গেল। সে অযথায় এত ভয় পাচ্ছিল। সাইভিদ ভাই আসলেই ভীষণ ভালো মানুষ। শুধু ভালো না বেস্ট উনি। সায়মার মুখে চমৎকার এক হাসি ফুটল। তবে সাইভিদের দৃষ্টিগোচর হলো না সেই হাসি, নিকষ কালো আধার পল্লবেই ঢাকা পড়ল সেটা। বুকটা এখন অনেক হালকা লাগছে তার। সমস্ত ভয় নিমিষেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সায়মা বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলল, হেসে হেসে বললো,
‘আপনি খুব ভালো ভাইয়া।’
কিঞ্চিত হাসল সাইভিদ, প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
‘কে বললো তোমায়?’
সায়মা লজ্জাসুলভ হেসে বললো,
‘বলতে হবে না আমি এমনিই বুঝেছি।’
বাঁকা হাসে সাইভিদ। এই মেয়েটাকে পটাতে তার বেশি সময় লাগবে না। একে নিজের কথায় আনতে পারলেই সবটা সত্য জানতে পারবে সে। সাইভিদ মৃদু হেসে হেয়ালির সুরে বললো,
‘তুমি খুব ভালো তো, তাই তোমার চোখে পৃথিবীর সবাই ভালো। যদিও আমি ভালো না, তাও তোমার চোখে তো ভালো হতে পেরেছি সেটাই বা কম কিসের।’
সায়মা মাথা নিচু করে স্মিত হাসে। লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
‘আচ্ছা ভাইয়া আমি এখন নিচে যাই ঘুমাতে হবে এখন। কাল তো আবার ঐচ্ছির এংগেইজমেন্ট, সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে।(একটু থেমে) গুড নাইট, ভাইয়া।’
সাইভিদ ফিচেল হেসে বললো,
‘ওকে গুড নাইট। হ্যাভ অ্যা সুইট ড্রিম, বিউটিফুল গার্ল।’
লজ্জায় লাজুক হাসি দেয় সায়মা। তারপর বেড়াল পায়ে বেরিয়ে যায় ছাদ থেকে। ছাদের দরজার বাইরে ঐচ্ছিকে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় সায়মা। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার হাত চেপে রুমে নিয়ে যায় ঐচ্ছি। সায়মাকে বিছানায় বসিয়ে তার সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল সে। সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে সে সায়মাকে বললো,
‘কি ব্যাপার সামু? দুজন কি এত গুচুর গুচুর ফুসুর ফুসুর করছিলে, হু? তলে তলে কি চলে বলতো? লক্ষণ তো খারাপ মনে হচ্ছে, ডাল মে তো জারুর কুছ কালা হ্যা।'(চোখ উপরে করে গভীর কিছু ভাবার ভান করে বললো ঐচ্ছি)
সায়মা ঐচ্ছিই কথা কানেই তুললো না। সে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বড় একটা হাই তুলে ঐচ্ছিকে বললো,
‘দোস্ত, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। লাইটটা একটু নিভিয়ে দে না।’
ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে সায়মার দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ঘুমাবি মানে কি? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। কি কথা বলছিলি দুজন, বল আমায়?’
সায়মার চোখ নিভু নিভু। চোখের পাতায় ঝুলছে একরাশ ঘুম। চোখ বুজেই সে ঐচ্ছিকে বললো,
‘কালকে বলি দোস্ত? আজ না সত্যিই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট বেবি।’
শেষ, খাতাম হো গ্যায়া সাব কুছ। এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও সায়মা চোখ খুলবে না। মরার মতো ঘুমায় পেত্নিটা। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলে সেই পাতা আর খুলানো যায় না যতক্ষণ না সে নিজে খুলছে। ঐচ্ছি আর দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? সেও লাইট নিভিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখ বুজতেই অদ্ভুত ভাবে সে রাফসানকে দেখতে পায়। বিকেলের পর থেকে এখন অবধি রাফসান তাকে একটাও কল দেইনি। ব্যস্ত নাকি? কি ভেবে ঐচ্ছি তার মোবাইলটা হাতে নেয়। ডায়েল অপশনে গিয়ে রাফসানের নাম্বারটা ডায়েল করে। কিন্তু কল দিবে কি দিবে না সেটা নিয়ে দুটানায় পড়ে যায় সে। যদি সে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তো ঘুমটা নষ্ট হবে। কি দরকার? কাল তো আসছেই। ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দেয় ঐচ্ছি। আবারো চোখ বুজে। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার রাফসানের মুখশ্রীটা তার অক্ষিপটে ভেসে আসছে। রাফসানকে নিয়ে কেন তার মন আর মস্তিস্ক এত ঘাটছে? কি দরকার অযথা মনকে এত উতলা করে তোলার? ভালোবাসা তো আর না, এটা তো কেবল ভালোলাগা। ঐচ্ছির মনে রাফসানের প্রতি সাময়িক আকর্ষণ। এই আকর্ষণ কেটে গেলেই সব শেষ। ঐচ্ছি বড় করে দম নেয়। না চাইতে ক্রমশ সে ঐ জ্বীনটার সাথে জুড়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে ঐচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছে রাফসানের মাঝে। আচ্ছা, যদি এই হারাতে হারাতেই একদিন ঐচ্ছির সমস্ত অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যায়, তখন কি হবে? ঐচ্ছি যদি নিজেই নিজেকে আর খুঁজে না পায়? যদি রাফসানের কাছে ঠকতে হয় তাকে, তখন? আচ্ছা রাফসানের মনেও ঐচ্ছির জন্য এই ফিলিংসটা সাময়িক না তো? সময়ের সাথে সাথে কি তবে রাফসানের ভালোবাসাটাও বিলিন হয়ে যাবে?
দুম করে শোয়া থেকে উঠে বসে ঐচ্ছি। না না, কখনোই না। নিজেকে নিয়ে কাউকে খেলতে দিবে না সে। রাফসান যদি তাকে সত্যিকারের ভালোবেসে থাকে তবে তাকে প্রমাণ করতে হবে। অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ ছাড়া এই স্বার্থপর দুনিয়ায় কিছুই বিশ্বাস করা যায় না। যেখানে মানুষ মানুষকে ঠকাচ্ছে সেখানে জ্বীন যে মানুষকে ঠকাবে না সেটার কি ক্যারান্টি। ঐচ্ছি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। রাফসান আগে তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে, তারপর সে মেনে নিবে সবটা। রাফসানের নাম্বারে লাগাতার কল দিতে থাকে ঐচ্ছি। প্রতিবারের মতোই কল রিসিভ করে রাফসান আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই উদ্ভ্রান্ত কন্ঠে ঐচ্ছি বলে উঠে,
‘আপনি আমায় কতটা ভালোবাসেন, রাফসান?’
ফোনের অপর পাশ নিরব। থেকে থেকে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দই কেবল শুনতে পাচ্ছে ঐচ্ছি। রাফসানের নিশ্বাসের ছন্দে ঐচ্ছির মনের চঞ্চলতা আরো বেড়ে গিয়েছে। আবারো সে প্রশ্ন করে,
‘কি হলো রাফসান বলুন না, কতটা ভালোবাসেন আমায়?’
রাফসান এবার মৃদু হাসে। নরম সুরে বলে উঠে,
‘ভালোবাসাটা কি পরিমাপ করা যায়, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি মুখ ঝামটা মেরে বসে। বিরক্তির সুরে বলে,
‘আচ্ছা মেনে নিলাম আপনি আমায় অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু এই ভালোবাসাটা যে সারাজীবন এমনই থাকবে তার কি গ্যারান্টি, আপনি তো আমাকে ঠকাতেও পারেন তাই না? তাই আমি অনেক ভেবে চিন্তে একটা ডিসিশন নিয়েছি, আপনাকে আপনার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। তাহলেই আমি বিশ্বাস করবো যে আপনি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন কিনা।’
রাফসান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ঐচ্ছিও কোনো কথা বললো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাফসান, গলার স্বর শক্ত করে বললো,
‘আমাকে কি করতে হবে ঐচ্ছি? আমি কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি?’
অধর জোড়া প্রশ্বস্থ করে হাসে ঐচ্ছি। এই তো সুযোগ পেয়েছে, এখন রাফসানকে সে যা বলবে সে তাই করবে। এই সুযোগেরই তো অপেক্ষা ছিল তার। ঐচ্ছি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। অতঃপর বলে..
চলবে..