কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ২১.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

২১.
‘আজ সকালটা একটু বেশিই সুন্দর তাই না, সামু?’

ঐচ্ছি আপ্লুত কন্ঠে বললো। সামু মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘হুম, আসলেই তাই।’

ঐচ্ছি মুচকি হাসল। কপালের মাঝ বরারবর ছোট্ট একটা টিপ খুব যত্ন করে সায়মা পরিয়ে দিল। ঐচ্ছির কাঁধের কাছে মুখ এনে খুশি খুশি গলায় বললো,

‘ভীষণ মিষ্টি লাগছে তোকে।’

ঐচ্ছি মাথা নিচু করে লাজুক হাসি দেয়। সায়মা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অনুনয়ের সুরে বলে উঠে,

‘দোস্ত, আজ একটু কাজল পর না রে। আরো বেশি সুন্দর লাগবে।’

ঐচ্ছির মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দের মতো আওয়াজ করে বললো,

‘উহু, আমার কাজল পছন্দ না।’

সায়মা হতাশ কন্ঠে বললো,

‘আজকে একটু পরলে কি হয়।’

ঐচ্ছি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। সায়মার গাল টেনে বললো,

‘আমার হয়ে তুই পরে নে। তোকে কাজলে বেশ মানায়।’

সায়মা মুখ কালো করে ফেলল। কাজলের সাথে যে এই মেয়ের কি এত শত্রুতা আল্লাহই জানেন। সায়মা নিজের চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেয়। বড় বড় চোখগুলোতে বেশ মানায় সেই কালো রঙ। ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

‘ইশ, আমার বান্ধবীটাকে কি কিউট লাগছে। থু থু, নজর যেন না লাগে।’

সায়মা ভেংচি কেটে বলে,

‘হয়েছে আর মজা নিতে হবে না।’

ঐচ্ছি হা হা করে হেসে বলে,

‘মজা কে নিচ্ছে। তুই যে কতটা সুন্দরী সেটা তুই নিজেও জানিস না। বাই দ্যা ওয়ে একটা সিক্রেট কথা কি জানিস তুই?’

সায়মা ব্রু নাচিয়ে বলে,

‘কি কথা?’

ঐচ্ছি সায়মার কাছে এগিয়ে গেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘সাইভিদ ভাইয়াও আজ সাদা শার্ট পরেছে। আর তুইও সাদা থ্রি-পিস, তার মানে সেইম টু সেইম। ও মাই গড, হুয়াট অ্যা কম্বিনেশন!’

এইটুকু বলেই দুহাত নাড়িয়ে হাসতে থাকে ঐচ্ছি। সায়মা ক্ষেপে যায়। নাকের পাল্লা ফুলিয়ে কড়া গলায় বলে উঠে,

‘এতে এত লাফানোর কি আছে? কালার তো সেইম হতেই পারে। স্বাভাবিক!’

ঐচ্ছি চোখ নাড়িয়ে হেয়ালির সুরে বললো,

‘দিস ইস নট স্বাভাবিক বান্ধবী, দিস ইস টু মাচ অস্বাভাবিক। কাল রাতে কি এই নিয়েই তোমরা আলোচনা করেছিলে নাকি যে আজ দুজন সেইম কালারের জামা পরবে? কি সামু বেবি, কি চলে? বলো বলো, তলে তলে আমার ভাইয়ের সাথে লাইন মারার চেষ্টায় আছো নাকি?’

চোখ গরম করে সায়মা। ঐচ্ছি ফিক করে হেসে দেয়ে। সায়মা তেড়ে এসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঐচ্ছির রুমে আসে তাহেরা বেগম। তিনি সায়মাকে তাড়া দিয়ে বললেন,

‘সায়মা, ঐচ্ছিকে নিয়ে আয়। রাফসানরা এসে পড়েছে।’

এইটুকু বলেই তিনি আবার বেরিয়ে যান।

ঐচ্ছির হাসি উবে যায়। পেট মোচড় দিয়ে উঠে। সায়মার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঐচ্ছি বলে উঠে,

‘দোস্ত, আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।’

সায়মা চোখ মুখ খিঁচে শক্ত গলায় বলে,

‘কখনোই না। এত কষ্ট করে শাড়ি পরিয়েছি। ওয়াশরুমে গেলে এখন পুরো শাড়ি নষ্ট হবে। কোনো দরকার নেই ওয়াশরুমে যাওয়ার।’

ঐচ্ছি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

‘ইট’স আরজেন্ট, দোস্ত। প্লিজ!’

সায়মা চেতে উঠে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘সমস্যা কি তোর? সবসময় এমন করিস। পরীক্ষার হলেও যাওয়ার আগে তুই ওয়াশরুমে দৌড়াদৌড়ি করিস। এখন তোর এংগেইজমেন্ট, সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে। আর এখন তুই ওয়াশরুমে গিয়ে বসে থাকবি? খবিশ একটা!’

ঐচ্ছি চোখ মুখ ছোট করে অসহায় কন্ঠে বলে উঠে,

‘আমি কি করবো? আমার পেটে মোচড় দেয়।’

সায়মা তেতিয়ে উঠে বললো,

‘তোমার পেট এত মোচড়াই কেন? দেখা যাবে বাসর ঘরেও জামাইরে বসাই রেখে তুমি বাথরুমে গিয়ে বসে থাকবা। আজাইরা যতসব।’

ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টিয়ে জোরে নাক টানল। অভিমানের সুরে বললো,

‘যা যাবোই না।’

সায়মা ঐচ্ছির ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

‘আমিও যেতে দিচ্ছি না। তুমি এখন আমার সাথে ড্রয়িং রুমে যাবা, যেখানে তোমার হবু বর আংটি নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

ঐচ্ছি মুখ কালো করে বললো,

‘হুম চল।’

বেড়াল পায়ে এগিয়ে গেল দুজন। ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে গিয়েই ঐচ্ছি দাঁড়িয়ে পড়ল। সায়মা ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কি হলো, চল।’

ছোট্ট একটা ঢোক গিলল ঐচ্ছি। ভয়ে ভয়ে রুমের ভেতরে পা রাখল। রুম জুড়ে এতক্ষণ নানা আলোচনা চললেও এখন সবাই নিরব। সবার গভীর দৃষ্টি এখন ঐচ্ছির উপর নিবদ্ধ। ঐচ্ছির অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। এতগুলো মানুষ তার দিকেই হা করে তাকিয়ে আছে। শুধু তো মানুষ না জ্বীনও। বাইরের কেউ না আসলেও রাফসানের জ্বীন পরিবারের সবাই’ই এসেছে। রাফসানের মা আবিদা হোসাইন বসা থেকে উঠে এলেন। ঐচ্ছির কাছে এসে মিষ্টি করে হেসে বললেন,

‘মাশাল্লাহ, কি মিষ্টি লাগছে আমার মেয়েটাকে।’

অধর জোড়া প্রশ্বস্থ করে ঐচ্ছি হাসে। আবিদা হোসাইন তাকে নিয়ে রাফসানের পাশে বসায়। রাফসান এখনো ঐচ্ছিকে দেখেনি। ঐচ্ছি যদিও আড়চোখে তাকে দেখেছে। কালো রঙের পাঞ্জাবীতে মারাত্মক লাগছে তাকে। আম্মাজান, আব্বাজান তার মুখ বরারবর বসা বিধায় রাফসান ঐচ্ছির দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করছে। রাফসানের পাশেই বসা সাদমান, তার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ভাইজান, আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভাবির থেকে বেশি লজ্জা আপনি পাচ্ছেন।’

রাফসান চোখ রাঙিয়ে সাদমানের দিকে তাকাতেই সাদমান একদম চুপ হয়ে যায়। রাফসান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসে। তার পাশেই তার প্রেয়সি। তার খুব কাছে। রাফসান চোখ যায় ঐচ্ছির হাতের দিকে, আর কিছুক্ষণ পরেই এই হাতের অনামিকা আঙ্গুলটাতে রাফসানের নামের অঙ্গুরীয়ক থাকবে। হাতের দিকে তাকাতেই রাফসানের নজর পড়ে ঐচ্ছির শাড়ির দিকে। ভীষণ অবাক হয় সে। শাড়ির নিচটা দেখতে পাচ্ছে সে। এটা তো সেই শাড়ি যেটা রাফসান সেদিন ঐচ্ছির জন্য পছন্দ করেছিল। নীল আর সাদা রঙের মিশ্রণে একটা জামদানী শাড়ি। কিন্তু ঐচ্ছি তো বলেছিল তার এটা পছন্দ না। সে তো অন্য একটা শাড়ি নিয়েছিল, তবে এটা কিভাবে এল? রাফসান বিস্মিত হলো। ঐচ্ছি কি তবে ইচ্ছে করেই সেদিন এমন করেছিল? আজ তাকে এত দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য? রাফসানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ঠোঁটে কোণে প্রশান্তির হাসি ফুটে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি বিলিন হয়ে যায়, যখন কাল রাতের কথা তার মনে পড়ে। ঐচ্ছির কথামতো তাকে তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গেলে ঐচ্ছিকে সে হারিয়েও ফেলতে পারে। কিন্তু ঐচ্ছিও তার প্রমাণ না নিয়ে ছাড়বে না। রাফসানের মনে ভয় ঝেঁকে বসে। ঐচ্ছিকে হারানোর ভয়। রাফসানের বাবা আহমাদুল্লাহ হোসাইন ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন, বললেন,

‘এবার তাহলে শুভ কাজটা সেরে ফেলা যাক? কি বলেন বেয়াই?’

ঐচ্ছির বাবাও হাসলেন, বললেন,

‘অবশ্যই বেয়াই।’

রাফসানের আম্মাজান রাফসানের হাতে একটা আংটি দিয়ে বললেন,

‘নাও বাবা, ঐচ্ছিকে এই আংটি টা পরিয়ে দাও।’

মৃদু হেসে মায়ের হাত থেকে আংটিটা নেয় রাফসান। আলতো স্পর্শে ঐচ্ছির হাতটা তুলে নেয়। খুব যত্ন সহকারে আংটিটা ঐচ্ছির অনামিকা আঙ্গুলটাতে পরিয়ে দেয়। তবে এইবারও সে ঐচ্ছির দিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি ঐচ্ছির হাতের উপরই। ঐচ্ছিও রাফসানের হাতে আংটি পরিয়ে দেয়। খুশিতে মেতে উঠে দুই পরিবার। মিষ্টি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত সবাই। তার মাঝেই ঐচ্ছি খেয়াল করে রাফসান তার দিকে এখনো তাকাচ্ছে না। এমনিতে তো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আর যেদিনই ঐচ্ছি একটু সাজে সেদিনই এই খবিশ জ্বীন তার দিকে তাকায় না। ঐচ্ছি ভীষণ ক্ষেপে যায়। রাফসানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে বলে উঠে,

‘আমার থেকে কি আমার হাতটা বেশি সুন্দর যে আপনি আমার দিকে না তাকিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন?’

রাফসান কোনো জবাব দেয় না। ঐচ্ছি তাতে আরো বেশি রেগে যায়। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। রাফসান ভালোই বুঝতে পারে যে ঐচ্ছি রেগে গিয়েছে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই পাত্তা দিল না। ঐচ্ছিকে দারুণ ভাবে ইগনোর করে সাদমানের সাথে কথা বলতে শুরু করলো সে। তাতে যেন বাজ পড়ল ঐচ্ছির মাথায়। রাগে শরীর রি রি করে উঠল। এত এত অপমান। নাক ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘মা, আমি আমার রুমে যাচ্ছি।’

কথাটা বলেই হন হন করে বেরিয়ে পড়ল সে। সবাই এক পলক সেদিকে তাকিয়ে আবারো নিজেদের কাজে মনোযোগ দিল। ঐচ্ছির মা বাবার সাথে রাফসানের মা বাবাও ঐচ্ছির রাগ সম্পর্কে অবগত। অবশ্য রাফসানই তাদের ঐচ্ছির ব্যাপারে সব কিছু বলেছে। হুট হাটই রেগে যায় মেয়েটা। রাগ তার সবসময়ই নাকের ডগায় লেগে থাকে। তাই আর এই নিয়ে রাফসানের মা বাবা কোনো অভিযোগ করলেন না। মানুষের মেয়ে হয়ে জেনে শুনে যে সে তাদের জ্বীন ছেলেকে বিয়ে করছে সেটাই অনেক।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here