কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ২৩.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

২৩.
সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে সাইভিদ। টিভির পর্দায় আটকে আছে সাইভিদের তীক্ষ্ণ নজর। হুট করেই কোথ থেকে ঐচ্ছি ছুটে এলো। সাইভিদের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল,

‘তুমি কি সায়মাকে পছন্দ করো, সাইভিদ ভাইয়া?’

চা টা গিলতে গিয়ে নাকে মুখে বাজে। কাশতে থাকে সাইভিদ। ঐচ্ছির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,

‘এমন আলতু ফালতু কথা না বলে সর আমার চোখের সামনে থেকে।’

ঐচ্ছি সরলো না। কপালের উপর সমান্তরাল ভাজটাকে আরো খানিকটা চওড়া করে কাট কাট গলায় বলে উঠল,

‘আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও? সায়মাকে পছন্দ করো তুমি?’

সাইভিদ রাগে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে ঐচ্ছিকে জোরে একটা ধমক দিয়ে বলে,

‘বের হো এখান থেকে নয়তো এক থাপ্পড়ে সবগুলা দাঁত ফেলে দিব, বেয়াদব মেয়ে।’

ঐচ্ছি হতভম্ব হয়ে যায়। সাইভিদ এত রেগে গেল কেন? পছন্দ না করলে না করবে এতে এত রেগে যাওয়ার কি আছে? ঐচ্ছি বুঝে উঠতে পারে না তার উপর সাইভিদের এত কিসের রাগ। আজ সারাদিন সাইভিদ ঐচ্ছির সাথে একটুও কথা বলেনি। রাফসানরা আসার পর থেকেই মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছিল। কারোর সাথেই ভালো করে কথা বলেনি। কিন্তু বিকেলে আবার হুট করেই সায়মাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যাওয়া, তাকে ফুল দেওয়া সবটাই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ঐচ্ছির কাছে। আর এখন আবার এই রাগ। ঐচ্ছি আর দাঁড়াল না। মুখ কালো করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ঐচ্ছি চলে যেতেই সাইভিদ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। এত কেন রাগ হচ্ছে তার? কার উপর এত রাগ হচ্ছে? ঐচ্ছির উপর? নাকি ঐ রাফসানের উপর? সাইভিদ হাটুর উপর দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে সেই হাতের উপর মাথা ঠেকায়। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বুকের ভেতর তীব্র এক ব্যথা অনুভব করে সে। কিছু না পাওয়ার ব্যথা। এই ব্যথার কারণ কি ঐচ্ছি? সাইভিদ ঢোক গিলে। গলাটা ধরে উঠে তার। কেন তার এত কষ্ট হচ্ছে। নিজের ইচ্ছেতেই তো সব কিছু মেনে নিয়েছে সে। ছোট্টবেলা থেকে যাকে পছন্দ করে আসছে আজ সে অন্য কারোর অঙ্গীকার বদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তার এখানে কি করার আছে? সবাই তো জানতো ঐচ্ছির প্রতি তার অনুভূতিটা, ঐচ্ছিও তো জানতো। তাহলে কেউই যখন কিছু করলো না তবে সে কেন করবে? ঐচ্ছিও তো খুশি মনে সবটা মেনে নিয়েছে। আর ছোটবেলায় এই মেয়েটাই বউ সেজে বলতো,’সাইভিদ ভাইয়া, একদিন আমি বড় হয়ে ঠিক এইভাবেই তোমার জন্য বউ সাজবো। আর তুমি বর সেজে পালকিতে করে আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে, কেমন?’ আজ সব ভুলে গেল মেয়েটা। মুখের ঐ হাসিটাই বলে দেয় ঐচ্ছিও রাফসানকে পছন্দ করে। সে এই বিয়েতে খুশি। সাইভিদ নাকের পাল্লা ফুলিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

‘তবে আমি কেন তোর জন্য কষ্ট পাবো? তুই যদি অন্য কারোর মধ্যে সুখ খুঁজতে পারিস তবে আমি কেন পারবো না? আমিও পারবো, আমিও পারবো তোকে ছাড়া বাঁচতে, দেখেনিস তুই।’

.

খাতায় করা অঙ্কগুলোর দিকে একপলক তাকিয়ে খাতাটা দূরে সরিয়ে রাখে ঐচ্ছি। হবে না, তার দ্বারা এইসব অঙ্ক একেবারেই হবে না। সায়মা ব্রু কুঁচকে বলে উঠল,

‘খাতা দূরে সরালে কি করে হবে? আগামী মাসে যে মিড সেই খবর আছে তোমার?’

ঐচ্ছি আড়াআড়ি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মাথার উপরের ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ওসব বাদ দে তো। সামনে না আমার বিয়ে, এখন সেসবের প্ল্যানিং কর।’

সায়মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দিকে তাকাল। বইটা বন্ধ করে ঐচ্ছির পাশে এসে বসলো। তারপর গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

‘আচ্ছা দোস্ত, সেদিনও না তুই এই বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলি তবে এখন এত সহজেই সবটা মেনে নিচ্ছিস যে? রাফসান ভাইয়া কি এখন তোকেও তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছে নাকি?’

ঐচ্ছি হাসল, বললো,

‘আরে না। আসলে কি বলতো, চেষ্টা অনেক করেছি। কিন্তু এই রাফসান নাছোড়বান্দা, দুনিয়া উল্টে গেলেও আমাকে উনি ছাড়বেন না। আর আমিও নিজেকে উনার কাছ থেকে ছাড়াতে পারবো না। আমি রাজি না থাকলে উনি জোর করেই আমাকে বিয়ে করবেন। এখন তুই বল, আর কি করবো আমি? উনাকে তো কম বুঝায়নি তাও উনি কিছুই বুঝলেন না। উনার ইচ্ছাতেই সব কিছু হলো। আর এখন বাকি বিয়ে, তিনমান সময়ের আরো তো দুই মাস আছে। দেখি না এর মধ্যে কিছু হয় কিনা?’

সায়মা কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে উঠল,

‘আচ্ছা, তুই আর সাইভিদ ভাই নাকি এক জন অন্যজনকে পছন্দ করতি? কথাটা কি সত্যি ঐচ্ছি?’

ঐচ্ছি অবাক হয়। শোয়া থেকে উঠে বসে বলে,

‘তোকে এসব কে বলেছে?’

‘ভাইয়াই আজ বলেছে।’

শান্ত, স্থির, নিষ্কম্প দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বসে থাকে ঐচ্ছি। ভাবছে, সায়মাকে এসব বলার কি দরকার ছিল সাইভিদের? ফোঁস করে এক দম ফেলে সে। আস্তে করে বলে,

‘হুম করতাম। কিন্তু এখন আর করিনা।’

এই বলে ঐচ্ছি তার ডান হাতটা সায়মাকে দেখিয়ে বলে,

‘এই যে দেখ, আমার হাতে রাফসানের অঙ্গুরীয়ক। আমার উপর এখন রাফসান ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষের কোনো অধিকার থাকতে পারে না। না আমারও সেই অধিকার আছে, রাফসান ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষকে নিয়ে ভাবার। (একটু থামল, জোরে একটা শ্বাস টেনে বললো) জানিস তো ঐচ্ছি, এই ভাগ্য নামক জিনিসটা মানুষকে বড্ড কষ্ট দেয়। আর কষ্ট দেয় এই ভালোবাসাও। আমারও না কষ্ট হয়। যখন নিজেকে নিয়ে ভাবি, নিজের ভবিষ্যতটাকে নিয়ে ভাবি। সাইভিদ ভাইয়া আমাকে ভালো রাখতে পারতো, কিন্তু এর মাঝে চলে এলো রাফসান। সেও আমায় ভালোবাসায়, মারাত্মক রকম ভালোবাসে। সেও আমায় সারাজীবন ভালো রাখতে পারবে। কিন্তু আমি, আমি তো নিজেই জানি না যে আমি কার সাথে ভালো থাকতে পারবো? জানিস, আমার মন আর মস্তিষ্ক আমাকে কি পরিমাণ জ্বালায়? কত শত দুশ্চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরে? এখন ভাবতে ভাবতে না মাথা ব্যথা করে। কত ভাবা যায় বলতো? না জানি, আমার জন্য সামনে আরো কি কি অপেক্ষা করছে?’

ঐচ্ছির স্বচ্ছ চোখগুলো নোনতা জলে ঘোলা হয়ে উঠে। নাক টেনে মেকি হাসে সে। সায়মার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলে উঠে,

‘তোর সাইভিদ ভাইয়াকে পছন্দ তাই না?’

সায়মা চোখ মুখ খিচে ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠলো,

‘ধুর, এইসব কি বলছিস তুই?’

ঐচ্ছি হেসে ফেলে। সায়মার গাল টেনে বলে উঠে,
‘থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না। আমি না হয় খালামনির সাথে কথা বলবো।’

সায়মা বড় বড় চোখ করে বলে উঠল,

‘কি বলবি?’

ঐচ্ছি ঠোঁট চেপে হেসে হেয়ালির সুরে বললো,

‘এই যে, আমার সামু বেবিটাই যেন আমার ভাবি হয়।’

সায়মার অক্ষিকোটর থেকে চোখগুলো বোধ হয় এবার বেরিয়ে আসবে। মেয়েটা বলে কি! ঐচ্ছির চুলে জোরে টান দিয়ে সায়মা রাগি গলায় বললো,

‘লাথি খেতে মন চায় তোর। মন চাইলে বল, এক লাথি মেরে রাফসান ভাইয়ের কোলে নিয়ে ফেলবো তোকে।’

ঐচ্ছি লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো,

‘যাহ দুষ্টু, কি বলিস এসব? বিয়ের আগেই জামাইর কোলে চড়ে বসাটা কি ঠিক হবে নাকি? রাফসান কি ভাববে বলতো?’

সায়মা রাগের মধ্যেও ঐচ্ছির কথা শুনে হেসে ফেলে। ঐচ্ছিও হেসে দেয়। পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে সায়মাকে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে। সায়মাও করলো তাই। শুরু হয়ে গেল দুজনের পিলো ওয়ার।

___________________

রাতের খাওয়া দাওয়া করে রুমে আসতেই ঐচ্ছির ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখল সেই পরিচিত নাম্বার। মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করলো সে। সালাম দিতেই ওপাশ থেকে রাফসান শান্ত কন্ঠে তার সালামের জবাব দিল। ঐচ্ছি জিগ্যেস করলো,

‘খেয়েছেন?’

রাফসান মৃদু স্বরে বললো,

‘জ্বি, আপনি?’

‘আমিও। কি করছেন?’

‘আকাশের তারা দেখছি।’

ঐচ্ছি ছোট্ট করে বললো,

‘ওহহ।’

তারপর দুজনেই চুপ। নিঃশ্বাসের শব্দ গুনছে দুইজন। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে তাদের এই হৃদকম্পন যেন আলোড়ন জাগাচ্ছে। দুজনেই টের পাচ্ছে দুজনের মনের কিছু অব্যক্ত অনুভূতি। রাফসান চোখ বন্ধ করলো। অক্ষিপটে ভেসে উঠল তার হৃদয়মোহিনীর পদ্মলোচন আঁখি জোড়া। কাজলবিহীন শুকনো সেই চোখযুগলেও যেন ছিল এক প্রাণনাশকারী মায়া। যে মায়াতে ডুবে গিয়েছে রাফসান, তলিয়ে গিয়েছে তার বিশাল গভীরতায়। ঐচ্ছি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল, কোমল গলায় বলে উঠল,

‘আজ এত চুপ কেন রাফসান?’

চোখ মেলল রাফসান। আবারো তাকাল আকাশের পানে। একটা তারা খসে পড়ল। রাফসান মৃদু হাসল, বললো,

‘আজ যদি আমি এই বিয়েটা ভেঙ্গে দেই, তাহলে কি আপনি খুব খুশি হবেন, ঐচ্ছি?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here