কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ২৬.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

২৬.
সকাল সকাল আজ ঘুম ভেঙ্গে গেল ঐচ্ছির। এমনি এমনি না অনেক হৈ চৈ এ। বাড়িতে যেন হট্টগোল লেগেছে। পিট পিট কলে চোখ খুলে বসে ঐচ্ছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ আটটা বাজে। বাইরে থেকে অনেক শব্দ আসছে। সকাল সকাল এত হৈ চৈ কেন শুরু হলো বুঝে উঠতে পারে না ঐচ্ছি। বালিশের পাশ থেকে উড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দরজা খোলে বাইরে যায় সে। ড্রইং রুম থেকে শব্দগুলো আসছে। ঐচ্ছি ধীর পায়ে সেদিকে যায়। দরজার সামনে গিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। তাতেই চমকে উঠে সে। রাফসান এত সকালে এখানে কি করছে। সকলের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যেন তারা ভয়ানক রেগে আছে। কিছু একটা ঘটে গিয়েছে। আদনান সাহেব চেচিয়ে উঠে বললেন,

‘কখনোই না। আমি কোনোমতেই আমার মেয়ের বিয়ে একটা জ্বীনের সাথে দেব না।’

ঐচ্ছি স্থির হয়ে যায়। তার মানে রাফসান সব কিছু সবাইকে বলে দিয়েছে। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সে। ভয়ে শরীর ঘেমে উঠে। আল্লাহ, এখন এই ঝামেলা কে সামলাবে? রাফসানের দিকে তাকায় ঐচ্ছি। বেশ শান্ত ভাবে সোফার এক কোণে বসে আছে সে। গায়ের উপর বড় একটা চাদর জড়ানো তার। ফর্সা মুখটাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। সবার মুখভঙ্গি দেখে ঐচ্ছি বুঝে গিয়েছে এতক্ষণে সবাই মিলে রাফসানকে ধুয়ে ফেলেছে। ঐচ্ছি অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে। মায়া হচ্ছে ওর, রাফসানের জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে। সাইভিদও প্রচন্ড রেগে আছে। পারে না রাফসানকে এক্ষুণি মেরে ফেলতে। দেয়াল ঘেঁষে এক কোণে দাঁড়িয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে। ঐচ্ছির মা এবার বলে উঠে,

‘তুমি এখনো কেন এখানে বসে আছো? যাও বেরিয়ে যাও এখান থেকে। ঐচ্ছিকে তুমি কোনো দিনও পাবেনা। তাই আর ওর পিছে পড়তে এসো না। নয়তো আমরা জ্বীন ছাড়ানোর জন্য অন্য ব্যবস্থা করবো।’

রাফসান কাতর চোখে তাহেরা বেগমের মুখের দিকে তাকায়। তাহেরা বেগম চোখ মুখ শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। হুট করে রাফসান উঠে এসে তাহেরা বেগমের পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। রাফসানের এমন কান্ডে তাহেরা বেগম হকচকিয়ে উঠেন। কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি নিয়ে বললেন,

‘কি হচ্ছে এসব?’

বাকি সবাইও কিছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ে। অবাক চোখে রাফসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাফসান কাতর কন্ঠে বলে উঠে,

‘আমাকে ক্ষমা করবেন, আম্মিজান। আমি যে ঐচ্ছিকে প্রচন্ড ভালোবাসি। উনাকে আমি ছাড়তে পারবো না আম্মিজান।’

থমকে যায় তাহেরা বেগম। সাথে বাকি সবাইও। রাফসানের মুখে আম্মিজান শব্দটা শুনে কিছু সময়ের জন্য বুকটা কেঁপে উঠে তার। মনে পড়ে যায় তার সেই ছোট্ট ছেলেটার কথা। চোখের কোণ ভিজে উঠে। রাফসানের চোখে মুখে অসহায়ত্ব দেখে তাহেরা বেগমের মনও অস্থির হয়ে উঠে। কতটা ভালোবাসলে এইভাবে আকুতি করা যায়। কিন্তু তাও তিনি পারবেন না। নিজের মেয়ের জীবনকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তিনি ঠেলে দিতে পারবেন না তিনি। শক্ত করে নেন নিজেকে। কঠোর গলায় বলে উঠেন,

‘না, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। তুমি সহজে আমার মেয়েকে না ছাড়লে আমাদের কাছে বিকল্প পদ্ধতি ভাবা আছে। ছোটবেলায় গ্রামে এমন অনেক জ্বীনের তান্ডব দেখেছি। একটা ভালো হুজুর আনলেই তোমাদের সব খেলা শেষ হয়ে যাবে। দেখো রাফসান, আমি চাইছি না তোমার বা তোমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করতে তাই বলছি আমার মেয়ের পেছন ছেড়ে দাও। আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দাও। জ্বীন আর মানুষের বিয়ে কখনোই সম্ভব না। না চাইলেও এই বাস্তবটা তোমাকে মানতেই হবে। কিছু করার নেই, ভুলে যাও ঐচ্ছিকে। তোমাদের মধ্য থেকেই কাউকে বিয়ে করে সুখী হও।’

রাফসান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। জোরে জোরে দুটো নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাহেরা বেগমের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে শুকনো হাসল। অতঃপর বললো,

‘আম্মিজান, আমাদের জ্বীনেদের ভালোবাসা মারাত্মক সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। আর আমি কোনো খারাপ জ্বীন নই আম্মিজান। আমি ইদ্রিসে জ্বীননাত। জ্বীন জাতিদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী জাতি। আমি নিজের শক্তির বলে এক্ষুণি আপনাদের মেয়েকে আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারতাম। আমাকে আটকানোর ক্ষমতা আপনাদের কারোর নেই। কিন্তু আমি এমনটা করবো না আম্মিজান। আমি জানি আপনারা আপনাদের মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন। আমিও ভালোবাসি। বিশ্বাস করুন আম্মিজান, আমি উনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আর আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার মেয়েকে আমি এইটুকুও কষ্ট পেতেও দিব না কোনোদিন। প্লিজ আম্মিজান, প্লিজ, আমার থেকে ঐচ্ছিকে কেড়ে নিবেন না। আমি উনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আম্মিজান। আমা…’

বাকি কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রাফসানের গালে সজোরে এক ঘুষি মারে সাইভিদ। সাইভিদের এহেন কাজে বাড়ির বাকি সবাই চমকে উঠল। সাইভিদ যে এমন কিছু করে ফেলবে ভাবতেও পারেনি তারা। ঐচ্ছি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে। রাগে সারা শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠে তার। সাইভিদের সাহস কি করে হলো রাফসানের গায়ে হাত তোলার? রাগে ফেটে পড়ছে সে। কিন্তু রাফসান, তার যেন কিছুই হলো না। সে শান্ত দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে তাকাল। ফিচেল হেসে বললো,

‘দেখুন ভাই, আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই তাও অযথা আপনি আমার সাথে লাগতে এসেছেন। কি দরকার ভাই? অযথা কোনো জ্বীনের সাথে লাগতে আসার কি প্রয়োজন? আমি কিন্তু সবসময় এমন শান্ত থাকি না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড অশান্ত হয়ে উঠি। তাই সাবধান করছি, নিজের লিমিট ক্রস করবেন না। নয়তো সেটা আপনার জন্যই খারাপ হবে।’

ক্ষেপে উঠে সাইভিদ। রাফসানের দিকে তেড়ে এসে বলে,

‘কেন, কি করবি তুই? দেখা কি করবি? আমিও দেখি তোর কত ক্ষমতা।’

রাফসান তার কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না। কিন্তু ঐচ্ছি এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সোজা রুমে এসে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,

‘ঠিক ভাবে কথা বলো রাফসান ভাইয়া। ভুলে যেও না উনি এখন আমাল ফিয়ন্সি। কোন সাহসে উনার গায়ে হাত তুললে তুমি? ক্ষমা চাও উনার কাছে। এক্ষুণি।’

ঐচ্ছির কথায় আরেক দফা অবাক হলো সকলে। সাইভিদ এবার জোর গলায় বললো,

‘কে তোর ফিয়ন্সি? এই জ্বীন? জ্বীনের বউ হতে চাস তুই?’

ঐচ্ছি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘হ্যাঁ, হতে চাই। আমি জ্বীনের বউই হতে চাই। শুনেছ সবাই, আমি রাফসানকেই বিয়ে করবো। উনি জ্বীন কি মানুষ সেটাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বিয়ে করতে হলে উনাকেই করবো। নয়তো করবোই না।’

কথাটা শেষ হতেই তার গালে সশব্দে এক চড় বসিয়ে দেয় তাহেরা বেগম। চেচিয়ে উঠে বলেন,

‘মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর? নাকি এই জ্বীন এখন তোকেও হেপনোটাইজ করে ফেলেছে, কোনটা? মানুষ হয়ে জ্বীনকে বিয়ে করতে চাস? কেন? বিয়ে করার জন্য কি দুনিয়াতে মানুষের ছেলের অভাব পড়েছে যে তোকে জ্বীনকে বিয়ে করতে হবে? এই বিয়ে আর রাফসানের চিন্তা দুটোই মাথা থেকে দূর কর। আর এই সব কিছুকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা।’

ঐচ্ছি চোখের পাল্লা প্রশ্বস্থ করে রাফসানের দিকে তাকাল। রাফসান নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,

‘মা, আমি রাফসানকে ভালোবাসি। আর আমি উনাকেই বিয়ে করবো।’

তাহেরা বেগম স্তম্ভিত। তার মনে হচ্ছে রাফসান বোধ হয় তার মেয়েকেও এবার নিয়ন্ত্রণ করছে। উনি নিজের রাগকে দমিয়ে রাখলেন। কিছু না বলেই ঐচ্ছির ডান হাতটা চেপে ধরে তাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন। ভেতর থেকে গলা ফাটিয়ে ডাকছে ঐচ্ছি। কিন্তু তাহেরা বেগম শুনলেন না। ড্রয়িং রুমে ফিরে এসে রাফসানের সামনে দাঁড়ালেন। কঠোর গলায় বলে উঠলেন,

‘চলে যাও রাফসান। আমার মেয়ের আশে পাশে যেন তোমাকে আর না দেখি।’

প্রতিত্তরে রাফসান কিছু বললো না। শান্ত ভাবে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। রাফসান চলে যেতেই তাহেরা বেগম আদনান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘নাজমুল হুজুরকে কল দিয়ে আমাদের বাসায় আসতে বলো। এখন একমাত্র উনিই আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here