#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩০.
রাতের খাবার শেষে সকলে ড্রয়িং রুমে বসলো। সবার চোখ মুখই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। ঐচ্ছি ভয়ে জড়সড় হয়ে রুমের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে ফেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, ঐচ্ছির বাবা, আদনান সাহেব গলা ঝাড়লেন। শক্ত গলায় বলে উঠলেন,
‘তাহলে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল। আদনান সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঐচ্ছি ছোট্ট একটা ঢোক গিললো। গলার মাঝে যেন কথা আটকে গিয়েছে তার। বাবার অমন ধারালো দৃষ্টি ঐচ্ছির মনের ধুকপুকানিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের মুখের দিকে তাকালো সে। তিনি বেশ শান্ত দৃষ্টিতেই ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি জিভ দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে করে বললো,
‘বাবা আমি রা-রাফসানকেই বিয়ে করতে চাই।’
কথাটুকু বলেই চোখ বুজে ফেলে ঐচ্ছি। ভয়ে নিজের ডানহাতটা বামহাত দিয়ে খাঁমচে ধরে। না জানি তার বাবা এখন রিয়েকশন দেয়। মনে মনে ঝড়ের আশংকা করেও ঐচ্ছি টের পেল পরিবেশ শান্ত। সে পিটপিট করে চোখ খুলে সকলের দিকে তাকালো। কারোর মুখশ্রীতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ফুটে উঠলো না। সবাই আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বসে আছে তবে কেবল সাইভিদের মুখটাই একটু লালচে দেখাচ্ছে। সকলকে এমন শান্ত থাকতে দেখে ঐচ্ছির যেন আরো অস্বস্তি লাগছে। তখন তার বাবা বেশ শান্ত গলায় তাকে জিগ্যেস করলেন,
‘তুমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করতে চাও, ঐচ্ছি?’
বাবার এই প্রশ্নে ঐচ্ছি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে বুঝতে পারছে না সে। নিজের মাঝে কেমন একটা অনুশোচনা বোধ করছে তার। চোখ নামিয়ে হাত কচলাতে থাকে। মেয়ের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আদদান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘তবে তুমি যা চাও তাই হবে। তোমার খুশিতেই আমরা খুশি। আমি কালই রাফসানের মা বাবার সাথে কথা বলছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’
এইবলে তিনি আর বসলেন না। ধীর পায়ে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। তার পেছন পেছন ঐচ্ছির মাও চলে গেল। ঐচ্ছি অসহায় চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল তাদের যাওয়াই দেখলো। ঐচ্ছির খালামনিও ঐচ্ছির সাথে কোনো কথা বললেন না। ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে নিজের রুমে চলে গেলেন। ঐচ্ছির স্বচ্ছ অক্ষিকোটর ভিজে উঠে। সে জানে তার বাবা এখন যতই বলুক না কেন, মনে মনে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। ঐচ্ছি যে তার প্রাণ। তার একমাত্র সম্পদ। তার জান্নাত। তাই তিনি তাকে কষ্ট দিতে পারেননি। নিজে কষ্ট পেলেও ঠিক মানিয়ে নিয়েছেন। তার প্রাণ যদি ভালো থাকে তবে সেও ভালো থাকতে পারবে। ঐচ্ছির ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। সাইভিদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। স্মিত সুরে বলে উঠে,
‘কাঁদছিস কেন? তোর তো খুশি হওয়ার কথা। তোর আর রাফসানের বিয়ে হতে চলছে। কনগ্রাচুলেশন ঐচ্ছি।’
ঐচ্ছি উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে তাকায়। সাইভিদ বাঁকা হেসে বললো,
‘আমি তো জানতাম, রাফসান জ্বীন। কত নাটক সাজালি বলতো তুই আর তোর বান্ধবী সায়মা। তাও তো পারলি না সত্যটা গোপন রাখতে। যাকগে সেসব, সবকিছু জানার পরও খালা খালু এই বিয়েতে রাজি, এর থেকে ভালো খবর আরকি হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তুই জ্বীনের বউ হতে চলছিস। ভাবা যায়, আমার সেই ছোট্ট বেলার মিথ্যে বউটা আজ সত্যিকারের কারোর বউ হবে, তাও আবার একটা জ্বীনের বউ।’
এইবলে রাফসান হাসতে শুরু করে। যেই হাসিতে ফুটে উঠে তার একরাশ বিদ্রুপ আর বিদ্বেষ।
_____________________________
ঐচ্ছির ফোনটা তখন থেকে বেজে চলছে। সে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। রাফসান তখন থেকে কল দিচ্ছে, কিন্তু ঐচ্ছি ইচ্ছে করেই কল রিসিভ করছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। বড্ড অশান্তি লাগছে। বুকের ভেতর ভারি কিছু একটার চাপ অনুভব করতে পারছে সে। চোখ জুড়ে ঘুমও আসছে না। কোনোকিছু ভালো লাগছে না। নিজের উপরই এখন নিজে বড্ড বিরক্ত সে। তার নেওয়া সিদ্ধান্তে তার মা বাবা কষ্ট পাচ্ছে। আবার মা বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিলে সে নিজে কষ্ট পাবে। কোনদিকে যাবে সে? যেদিকেই যাও সেদিকেই কেবল কষ্ট। এইটুকু শান্তিও কোথাও নেই। বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। চোখমুখ কুঁচকে তার পাশে অযত্নে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকায়। পারছে না এক্ষুণি এটাকে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে। চোখমুখ খিঁচে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে ফোনটা রিসিভ করে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
‘বলুন!’
ওপাশ থেকে জবাব আসে,
‘কেমন আছেন?’
রাগ যেন এবার আকাশ ছুঁলো তার। মানে এতক্ষণ যাবৎ কল দিয়েছে শুধু এই কথাটা জিগ্যেস করার জন্য। রাগে ইচ্ছে করছে এই জ্বীনটাকে ইচ্ছেমতো কিছুক্ষণ গালিগালাজ করতে। কিন্তু ভদ্যতার খাতিরে সেটা সে করতে পারছে না। তাই সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,
‘অনেক অনেক ভালো আছি, খুশিতে আছি, আনন্দে আছি। এত আনন্দে, এত সুখে আছি যে আমার এখন আর এত সুখ সহ্য হচ্ছে না। এখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অতিরিক্ত সুখে আমি পাগল হয়ে গিয়েছে। পারলে এসে আমাকে মেরে দিয়ে যান। আমি আর পারছি না এত সুখ সহ্য করতে।’
ঐচ্ছির রাগে কাঁপতে থাকে। হঠাৎ যেন একটু বেশিই রাগ হচ্ছে তার। রাগে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। ঐচ্ছি শ্বাস প্রশ্বাসের তীব্র প্রতিধ্বনিতে রাফসান বুঝতে পারলো আবারও কিছু একটা হয়েছে, তাই ঐচ্ছি এত রাগ দেখাচ্ছে। রাফসান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বললো,
‘বার্গার খাবেন ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি হতভম্ব। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো রাফসানের কথাটা। মানে এত রাতে সে বার্গার খাওয়ার কথা বলছে। যেখানে সে এতটা রেগে আছে সেখানে রাফসান তাকে তার রাগের কারণ জিগ্যেস না করে তাকে বার্গার খাওয়ার কথা বলছে। মজা পেয়েছে নাকি? ঐচ্ছি এইদিকে দুঃখে কষ্টে মরে যাচ্ছে আর এই জ্বীন ঐদিকে তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে। কত বড় সাহস। ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে রাগি গলায় বললো,
‘মজা করছেন আমার সাথে।’
রাফসান হালকা হেসে মৃদু সুরে বললো,
‘উঁহু, আপনার তো বার্গার পছন্দ তাই জিগ্যেস করলাম খাবেন কিনা?’
ঐচ্ছি তখন কর্কশ গলায় জবাব দিল,
‘তা এত রাতে বার্গার কি আকাশ থেকে আসবে?’
রাফসান শান্ত গলায় বললো,
‘আকাশ থেকে কেন আসতে যাবে? আমার কাছ থেকে আসবে।’
ঐচ্ছি কপাল কুঁচকে জিগ্যেস করে,
‘আপনি এত রাতে বার্গার কই পাবেন?’
‘নিজে বানাবো।’
ঐচ্ছি এবার ভীষণ অবাক হয়। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
‘আপনি বার্গার বানাতে পারেন?’
‘জ্বি, পারি। বলতে পারেন আপনার জন্য শিখে নিয়েছি। এখন একটা কাজ করুন তো, একটু কষ্ট করে আপনার বারান্দার দরজাটা খুলে সেখানে যান।’
ঐচ্ছি ঝটপটে বলে উঠে,
‘কেন?’
রাফসান মৃদু হেসে বলে,
‘আপনার পার্সেল এসে গিয়েছে।’
ঐচ্ছি ভীষণ বিস্মিত হলো। বুক ভরা উত্তেজনা নিয়ে বারান্দার দরজাটা খুলে সেখানে প্রবেশ করলো। সে রীতিমত হা হয়ে তাকিয়ে রইল সেইদিকে। বারান্দার এক কোণে রাখা ছোট্ট টেবিলটার উপর একটা সাদা রঙের বক্স। ঐচ্ছি সেটা হাতে নিল। রুমে এসে খুলে দেখল সত্যিই এতে বার্গার। আরেক দফা অবাক হলো সে। পাশেই তার ছোট্ট হলুদ রঙের একটা চিরকুট। খুলে দেখলো সেখানে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা, ‘এই যে শুনছেন, ভালোবাসি’
ঐচ্ছি মুচকি হাসলো। ওপাশ থেকে রাফসান ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আমার জবাবটা দিবেন না, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি চুপ হয়ে গেল। চোখ বুজে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘আমিও’
চলবে..