কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৩১.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩১.
অস্থির হয়ে রুম জুড়ে পায়চারি করে চলছে ঐচ্ছি। কপালে লেগে আছে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকের উপরও জ্বলজ্বল করছে নোনতা তরলের ছোট ছোট দানাগুলো। অস্থিরতায় যেন বুক ছটফট করছে তার। ড্রয়িং রুমে বসে আছে রাফসান আর রাফসানের বাবা। আদনান সাহেব আজ মেয়ের বিয়ের তারিখ পাকা করবেন। ঐচ্ছির ইচ্ছে করছে একটু গিয়ে আড়িপেতে বাবার কথা শোনার জন্য। কিন্তু ড্রয়িং রুমের দরজার বাইরে তার মা আর খালা দাঁড়িয়ে থাকায় সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ঐচ্ছি ছটফট করতে করতে বিছানায় বসলো। সায়মার দিকে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘দোস্ত, আমার না খুব টেনশন হচ্ছে।’

সায়মা তখন বিছানার হেডবোর্ডটার সাথে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপছিল। ঐচ্ছি কথা শোনে দায়সারা ভাবে বললো,

‘তো আমি কি করবো?’

ঐচ্ছি চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল সায়মার কথা শোনে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

‘মরে যা তুই। তোর মতো এমন ফালতু মানুষের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কেমন বান্ধবী তুই? তোর একমাত্র কিউট সুইট বেস্টিটা টেনশনে মরে যাচ্ছে আর তুই তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে আরামসে মোবাইল টিপে যাচ্ছিস। একটু তো সান্তনাও দিতে পারিস। তোর জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতাম। তোর মতো এমন ভাব দেখিয়ে বসে থাকতাম না।’

কথাটুকু বলে ঐচ্ছি অভিমান করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। সায়মা ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বিরক্তির সুরে বললো,

‘এত ঢং করে লাভ নেই, আমি এখন তোমার রাগ ভাঙ্গাতে পারবো না।’

ঐচ্ছি চেচিয়ে উঠে বললো,

‘দরকার নেই তোমার রাগ ভাঙ্গানোর। আমার রাগে কারো কিছু যায় আসে নাকি? আমাকে তো কেউ ভালোই বাসে না। হু, আমিও আর কাউকে ভালোবাসবো না। কারোর রাগ ভাঙ্গাবো না। দেখি, পরে কেউ যেচে কথা বলতে আসে কিনা। তখন তাকে লাথি মেরে একেবারে উগান্ডা পাঠিয়ে দেবো।’

ঐচ্ছি আবারও মুখ ফুলায়। তা দেখে সায়মা মুখ টিপে হাসে। ঐচ্ছি আড়চোখে সায়মার হাসি দেখে রাগে জ্বলে উঠে। নাক মুখ কুঁচকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাহেরা বেগম তাদের রুমে আসেন। ঐচ্ছিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘ঐচ্ছি, একটু ড্রয়িং রুমে চলো; তোমার বাবা তোমায় ডাকছেন।’

ঐচ্ছি আঁতকে উঠে বললো,

‘কি, আমাকে কেন ডাকছে?’

‘জানি না, হয়তো বিয়ের ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলবেন।’

এবার যেন ঐচ্ছির ছটফটানি আরো বেড়ে যায়। চোখে মুখে নেমে আসে অল্প বিস্তর ভয়। ছোট একটা ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নেয় সে। তারপর ক্ষীণ সুরে বলে উঠে,

‘আমাকে কি যেতেই হবে মা?’

তাহেরা বেগম শান্ত কন্ঠে জবাব দিলেন,

‘হ্যাঁ।’

একরাশ অস্থিরতা আর ভয় নিয়ে বেড়াল পায়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো ঐচ্ছি। রুভে ঢুকেই রাফসানের বাবাকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল। রাফসানের বাবা বেশ হাসি মুখেই ঐচ্ছির সালামটা গ্রহণ করলেন। তারপর পরিষ্কার কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘কেমন আছেন, আম্মাজান?’

ঐচ্ছি মৃদু কম্পিত গলায় জবাব দিল,

‘জ্বি, ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

অধর ছড়িয়ে হাসলেন তিনি। জবাব দিলেন,

‘আলহাদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি দাঁড়িয়ে কেন আছেন আম্মাজান, বসুন না।’

খুব সন্তর্পণে ঐচ্ছি সোফার এক কোণে বসে পড়ে। এত হালকা ভাবে বসে যেন সোফার নরম গদিগুলো তার ভারে ব্যাথা না পায়। রাফসান ঠিক তার উল্টোপাশের সোফাটাতে বসা। রাফসানের পাশেই তার বাবা। আর তার পাশের সোফাটাতে ঐচ্ছির বাবা বসা। না চাইতেও রাফসানের অগোছালো দৃষ্টি ঐচ্ছির উপর পড়লো। কাচা হলুদ রঙের একটা থ্রি-পিসে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। মাথার উপর বড় এক ঘোমটা। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভয় মেয়েটাকে ভালোই কাবু করেছে। রাফসান মৃদু হাসে। অবশেষে এই মেয়েটাকে সে পেতে যাচ্ছে। তার নিজের করে পেতে যাচ্ছে। আর শুধু কিছু দিনের অপেক্ষা কেবল।

ঐচ্ছির বাবা মেয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

‘আমরা আগামী মাসের প্রথম শুক্রবারে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। তাতে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে, ঐচ্ছি?’

এচ্ছি অস্থির চোখদুটো প্রশ্বস্থ করে বাবার দিকে তাকালো। তার বাবার চোখ মুখ কেমন থমথমে হয়ে আছে। ঐচ্ছির কষ্ট হয়। ছোট একটা ঢোক গিলে একপলক রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান অধির আগ্রহে ঐচ্ছির জবাবের অপেক্ষা করছে। চোখ নামিয়ে ফেলে ঐচ্ছি। ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলে,

‘না, বাবা।’

আলহাদুলিল্লাহ বলে উঠলেন রাফসানের বাবা। চোখে মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। ঐচ্ছি বাবাও আলতো হাসলেন। তবে সেটা আনন্দের না কষ্টের সেটা বোঝা গেল না। রাফসানের বাবা আদনান সাহেবকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। ঐচ্ছির বাবাও তাকে খাওয়ালেন। ঐচ্ছির বাবা মুখের মিষ্টিটা খেয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে ঐচ্ছিকে বললেন,

‘ঐচ্ছি, রাফসানকে একটু তোমার রুমে নিয়ে যাও। আমার মনে হয় বিয়ের ব্যাপারে তোমাদেরও একটু আলাদা কথা বলা উচিত।’

ঐচ্ছি বাধ্য মেয়ের মতো বাবার কথায় মাথা নাড়াল। রাফসানকে নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করলো। সায়মা মুচকি হেসে ঐচ্ছির কানে কানে কিছু একটা বলেই সেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.

‘মন খারাপ?’

ঐচ্ছি ফিচেল হেসে বললো,

‘না।’

দুজনেই চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের মাঝেই কিছুটা দূরত্ব। এমনিতে এই দুটো প্রাণের আপন ভালোবাসায় সিক্ত হতে কত শত প্রয়াস আর যখনই প্রাণ যুগলের মিলন ঘটে তখনই তারা যেন কোনো নিষ্পন্ন আত্মায় পরিণত হয়। তখন যেন ভালোবাসার সব উন্মাদনা হারিয়ে ফেলে। বুক জুড়ে ফুলে ফেঁপে উঠে এক নতুন উত্তেজনা। যেই উত্তেজনা বুকের নিশ্বাসকে ভারি করে তুলে, হৃৎস্পন্দনকে বাড়িয়ে তুলে। যেন কোনো প্রেমের সম্মোহনে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। ঐচ্ছি আড়চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। সাদা রঙের শার্ট পরেছে সে। হাতাগুলো সুন্দর করে কনুই অবধি ভাজ করা। বিকেলের সূর্যের তীব্র হলুদ রশ্মিগুলো রাফসানের নীল চোখগুলোর উপর আছড়ে পড়ছে। উদ্ভুত ভাবে চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। ঐচ্ছির দৃষ্টি আটকে যায় সেখানে। সত্যিই রাফসানের চোখগুলো মোহনীয়। যে কাউকেই খুব সহজে সে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারবে। ঐ নীল চোখগুলোর সেই ক্ষমতা আছে। ঐচ্ছি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাফসানকে দেখতে থাকে। জ্বীন বলেই কি রাফসান অন্যদের তুলোনায় একটু বেশিই সুন্দর? নাকি তার চোখেই এত সুন্দর লাগছে, কোনটা?

‘এইভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে মুখে মশা ঢুকবে ম্যাডাম।’

ফট করেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেই ঐচ্ছি। সে যে এতক্ষণ হ্যাংলার মতো তাকিয়ে ছিল সেটা কি রাফসান বুঝে গিয়েছে। উফ, একটু তাকিয়েও শান্তি নেই। সব কিছু বুঝে ফেলে। ঐচ্ছি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে। রাফসান মৃদু হেসে বললো,

‘কি বলছেন বিড়বিড় করে? জোরে বলুন, আমিও একটু শুনি।’

ঐচ্ছি ব্রু বাকিয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আপনার না শুনলেও চলবে।’

রাফসান শান্ত কন্ঠে বললো,

‘ঠিক আছে, শুনলাম না।(কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আপনার যে আপনার সাইভিদ ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেটা বলেননি কেন আমায়?’

ঐচ্ছি স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

‘বললে কি হতো?’

রাফসান চোখের পাতা প্রশ্বস্থ করে ঐচ্ছির দিকে তাকাল, স্মিত সুরে বললো,

‘তাহলে আমি আর বিয়েট করতাম না।’

বড় বড় চোখ করে ঐচ্ছি রাফসানের দিকে তাকাল। কপালের উপর পড়লো বিশাল ভাজ। ঐচ্ছির চোখে মুখে উপচে পড়ছে এক ভয়ানক অস্থিরতা। তা দেখে হেসে ফেললো রাফসান। ঐচ্ছির কাছে এসে দাঁড়াল। তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,

‘চিন্তা করবেন না, ম্যাডাম। আপনাকে আমি এত সহজে ছাড়বো না। আপনি আপনার প্রেম মোহে আমাকে যতটা পাগল করে তুলেছেন আপনাকেও ঠিক আমার ততটাই পাগলামী সহ্য করতে হবে। বিয়েটা আগে হতে দিন। তারপর দেখুন, এই প্রেমিক জ্বীনটা তার ভালোবাসায় আপনাকে কি পরিমাণ উন্মাদ করে তুলে।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here