#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৪.
রাফসান স্বাভাবিক। যেন সে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো এমন একটা প্রশ্নের। কিন্তু তার পাশে বসা ঐচ্ছির ইতিমধ্যে টেনশনে ঘাম ছুটে গিয়েছে। রাফসান স্মিত কন্ঠে বললো,
‘এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছি না।’
নাজমুল হুজুর একটু নড়ে চড়ে বসলেন। আধপাকা দাড়িগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘কিন্তু ঐচ্ছি তো এই বিয়েতে রাজি না। তাকে কোনোপ্রকার জোর আপনি করতে পারেন না, রাফসান। তা না হলে আমি বাধ্য হব আপনাকে আটকাতে।’
রাফসান ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। কন্ঠস্বর খানিকটা চওড়া করে বলে,
‘আমি ইদ্রিসে জ্বীননাত মাওলানা সাহেব। আমাকে আপনি এত সহজে আটকাতে পারবেন না। আমি ঐচ্ছিকে ভালোবাসি। আর আপনি নিশ্চয়ই খুব ভালো করেই জানেন একটা জ্বীনের ভালোবাসাটা ঠিক কতটা মারাত্মক। আর সে যদি হয় আমার মতো ইদ্রিসে জ্বীন তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।(একটু থেমে)..মাওলানা সাহেব, আপনার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে তাই না? ক্লাস ফাইভে পড়ে? আপনার বিবিজান তো আবার অন্তসত্ত্বা, অযথা কি দরকার তাদেরকে জামেলার মধ্যে ফেলানোর। জান বাঁচানো ফরজ। তাই নিজেকে নিয়ে আগে ভাবুন তারপর না হয় অন্যদের নিয়ে ভাববেন।’
মওলানা এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার তার চোখে মুখে কপট রাগ দেখা দেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। গলার স্বর এখন আর আগের মতো নরম না করেই কঠিন গলায় বলে উঠেন,
‘আপনার তো দেখছি খুব স্পর্ধা। আপনি জানেন আমি কে? আর আমি আপনার সাথে ঠিক কি কি করতে পারি?’
রাফসানের অধরপল্লবে এখনো বাঁকা হাসি ঝুলছে। সে তার চেয়ারটাই হেলান দিয়ে বসে। হাতদুটো বুকের উপর ভাজ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,
‘জ্বি, অবশ্যই জানি আপনি কে। আপনি একজন প্রখ্যাত মাওলানা। যার ওয়াজ শোনার জন্য দূর দূর প্রান্ত থেকে মুসল্লিরা ছুটে আসে। মাওলানা নাজমুল শেখ,আপনার ওয়াজ কিন্তু আমার বাবাজানও শোনেন। তাই আপনাকে চিন্তে আমার খুব বেশি একটা কষ্ট হয়নি।’
মাওলানা সাহেব এবার ধাতস্থ হলেন। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে কাটকাট গলায় বললেন,
‘ঐচ্ছির পেছন ছেড়ে দিন,রাফসান।’
‘কখনোই না।’
রাফসানের নির্বাক কন্ঠ। ঐচ্ছি একপলক রাফসানের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে ফেলে। মাওলানা সাহেব এবার নরম সুরে বললেন,
‘দেখুন রাফসান বোঝার চেষ্টা করুন, ঐচ্ছি এই বিয়েতে রাজি না। আর এটা কোনোভাবে সম্ভবও না। আমি আপনাকে সহজভাবে বলছি দয়া করে ঐচ্ছির পিছ ছেড়ে দিন। আর তা না হলে আমাকে কিন্তু অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’
রাফসান নিরব। রাফসানকে চুপ থাকতে দেখে ঐচ্ছির চোখে মুখে আনন্দের রেশ ফুটে উঠে। রাফসান কি তবে মেনে নিয়েছে? সে কি সত্যি সত্যিই তার পিছ ছেড়ে দিবে? ঐচ্ছির আনন্দ বেশিক্ষণ টিকলো না। রাফসানের কথা শুনে তার আনন্দ পুরোপুরি মিঁইয়ে গেল।
‘ঐচ্ছি এই বিয়েতে রাজি না বলেই তো বিয়েটাতে আপনারও আপত্তি তাই তো? যদি কোনোদিন ঐচ্ছি নিজ থেকে এই বিয়েতে রাজি হয় তবে তখন আর আপনি কোনো বাধা দিবেন না তো?’
নাজমুল হুজুর ঐচ্ছির দিকে তাকাল। ঐচ্ছি বিষাদগ্রস্থ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাজমুল হুজুর জানে ঐচ্ছি কখনোই এই বিয়েতে রাজি হবে না। তাই তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,
‘ঠিক আছে। ঐচ্ছি যদি নিজ থেকে কোনোদিন এই বিয়েতে রাজি হয় তবে আমি নিজেই আপনাদের বিয়ের কাজি হবো।’
ঐচ্ছি অবিশ্বাস্য চোখে নাজমুল হুজুরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রাফসানের অধরপল্লবে ফুটে উঠে রহস্যময় হাসি। রাফসান ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে,
‘ওকে ফাইন। যদিও আমাদের বিয়েটা এইমাসেই হওয়ার কথা ছিল তবে আমি ঐচ্ছিকে আরো তিনমাস সময় দিলাম।(ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে)..শুনুন ঐচ্ছি, তিনমাস অনেকটা সময়। আপনি ভাবুন,উপলব্ধি করুন। কিন্তু আমার থেকে নিজেকে দূরে সরার কথা কল্পানাইও আনবেন না। সময়টা শুধু এইজন্যই দিয়েছে যেন আপনি আমাকে বুঝতে পারেন, আমার ভালোবাসাটাকে অনুভব করতে পারেন। আর তিনমাস পর যেন আপনি নিজ থেকে এই বিয়েতে রাজি হতে পারেন। আশা করি বুঝতে পেরেছেন?’
ঐচ্ছি কিছু বললো না। রাফসান কিছুক্ষণ শ্রান্ত দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দিকে চেয়ে রইল। ঐচ্ছি নিশ্চুপ,নির্বাক। রাফসান ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়াল। থমথমে গলায় বললো,
‘আমি তাহলে উঠছি। আর ঐচ্ছি, আমার কথাগুলো মনে রাখবেন। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু সবসময় আপনার সাথেই থাকব তবে চিন্তা করবেন না আগামী তিন মাস আমি আপনাকে বিয়ে সমন্ধে কোনোপ্রকার জোর করবো না। আমি সময় দিলাম, এবার নিজেকে গুছিয়ে নিন।’
এই বলে রাফসান রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।
ঐচ্ছি এবার চোখ তুলে নাজমুল হুজুরের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
‘হুজুর উনার কথা শুনে তো মনে হলো তিন মাস পর যদি আমি রাজি না হই তাহলে উনি তখনও জোর করেই আমাকে বিয়ে করবেন। তাহলে এই সময়ের কি দরকার ছিল হুজুর? আমার মত কখনোই পাল্টাবে না। না আজ না তিন মাস পর, আমি কখনোই ঐ জ্বীনকে বিয়ে করবো না।’
‘করতে হবে না বিয়ে। আমি আছি তো, এখন মনোযোগ দিয়ে শুনুন আমার কথাগুলো…’
_______________________________
দিবাকর ডুবল, চারদিক ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল নিকষকৃষ্ণ আধারে। বাড়ির সামনে বিশাল বারান্দা। সেখানে একপাশে রাখা ডিভাইনে বসে আছে রাফসান। চোখ মুখে ছেয়ে আছে একরাশ গাম্ভীর্য। অক্ষিকোণের দৃষ্টি তার ঈষৎ স্বচ্ছ। পিচ কালারের অধর জোড়া মৃদু কাঁপছে। অশান্ত মন বেকুল হয়ে উঠেছে তার প্রেয়সির জন্য। আরও তিনমাস অপেক্ষা করা কি তার পক্ষে সম্ভব? আর ঐচ্ছি, সেকি আদৌ ভালোবাসবে তাকে? রাফসান ডিভাইনে শুয়ে পড়ে। অক্ষিপল্লব রুদ্ধ করলো। ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বিষন্ন গলায় বললো,
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।
অনন্ত প্রেম
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘খুব ভালোবাসেন তাকে তাই না ভাইজান?’
রাফসান চোখ মেলে তাকায়। সাদমান দাঁড়ানো। চোখ মুখ উদাসীন। ভাইজানের কষ্টে সেও ব্যথিত। রাফসান উঠে বসলো, শুকনো হাসি দিয়ে বললো,
‘বস।’
সাদমান তার ভাইয়ের পাশে বসলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘বলুন না ভাইজান, খুব ভালোবাসেন তাকে তাই না?’
রাফসান অধর ছড়িয়ে হাসলো। তারপর মাথা হেলিয়ে বললো,
‘হুম, ভালোবাসি।’
সাদমান নির্বাক ভঙ্গিতে চেয়ে রইল তার ভাইয়ের দিকে। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে ঝরঝরে গলায় বলে উঠে,
‘ভাইজান আপনি তো চাইলেই ভাবিজানকে সম্মোহন করতে পারেন। তাহলে এত ভেবে কি লাভ। বিয়েটা কোনোরকমে হয়ে গেলেই দেখবেন ভাবিজান বাধ্য হয়েই সবটা মেনে নিবে। আর আপনি তো তাকে ভালোবাসেন তাই না, ভাবিজান আপনার ভালোবাসাও ঠিক বুঝবে দেখবেন।’
রাফসান হতাশ কন্ঠে বললো,
‘না রে ভাই। সম্মোহনই যদি করতে হতো তাহলে সেটা আমি আরো আগেই করতে পারতাম। কিন্তু সম্মোহন করে ঐচ্ছিকে পেলেও ঐচ্ছির ভালোবাসা তো আর পাবো না। আমার যে ঐচ্ছির ভালোবাসা লাগবে ভাই। তাতে যদি আমাকে তিন মাস কেন তিন বছরও অপেক্ষা করতে হয় আমি তাও করবো। কিন্তু ঐচ্ছিকে কোনোদিন আমার থেকে দূরে যেতে দিব না।’
সাদমান এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার ভাইয়ের মুখপানে। ইশ, কি ভালোবাসা! ইদ্রিসে জ্বীননাতদের মাঝে সবথেকে শক্তিশালী জ্বীনটাকেও কিভাবে দুর্বল করে ফেললো। সাদমানের কষ্ট হচ্ছে। সে আর কিছু বললো না। নিরবে চলে গেল সেখান থেকে।
____________________
‘আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারেন না,রাফসান। আপনি বলেছেন এই তিনমাস আপনি আমাকে কোনোপ্রকার জোর করবেন না বিয়ের জন্য তাহলে এসব কি। কেন করছেন এমন?’
বিকট শব্দে হেসে উঠে রাফসান। ঐচ্ছি দুহাতে তার কান চেপে ধরে। যে হাসিতে ঐচ্ছির মনে প্রশান্তি ছেয়ে যেত আজ সেই হাসিতে ঐচ্ছির বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। ঐচ্ছি কাঁদতে থাকে। রাফসান তার হাসি থামিয়ে বলে,
‘আমি তো বিয়ে করতে চাইছি না ঐচ্ছি। আমি তো বাসর করতে চাইছি।’
কথাটা বলেই রাফসান ঐচ্ছির দিকে এগিয়ে যায়। ঐচ্ছির গায়ের উপর থেকে একটান দিয়ে উড়নাটা সরিয়ে দিতেই চিৎকার দিয়ে উঠে বসে ঐচ্ছি। শরীর ঘেমে একাকার। বুক ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে তার। কি ভয়ানক স্বপ্ন দেখলো সে। ঐচ্ছি তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার মুখ আর গলার ঘাম মুছলো। রুম জুড়ে তখন পিনপতন নিরবতা। মাথার উপর ফ্যানটা খটখট করে ঘুরছে। বেশ কিছুক্ষণ সে ওভাবেই বসে রইল। ভয়টা খানিকটা কমতেই ঐচ্ছি ডানপাশে ঘুরে যেই না শুতে যাবে তখনই আয়নায় কারো প্রতিবিম্ব দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে সে।
আয়নার সেই প্রতিবিম্বটি তখন বলে উঠল,
‘ভয় পাবেন না ভাবিজান, আমি সাদমান।’
চলবে..