#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৩.
‘তুই সায়মাকে বিয়ে করতে চাস মানে?’
চেচিয়ে উঠে বললেন তানিয়া জুবায়ের। ছেলের কথা শুনে রীতিমতো হতভম্ব তিনি। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই এসে বলছে সে নাকি সায়মাকে বিয়ে করবে। বললেই হলো নাকি? ভীষণ ভাবে রেগে যান তিনি। খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
‘পেয়েছোটা কি তোমরা দুই ভাই বোন, একবার ঐচ্ছি এত নাটক করলো তার বিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তার কথা মতোই সেই জ্বীনের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। এখন আবার তুমি। দুদিনও হলো না সায়মাকে চেনো তার মধ্যেই তুমি তাকে বিয়ে করতে চাইছো? এটা কেমন কথা সাইভিদ? হয়েছেটা কি তোমার?’
ভাবলেশহীন ভাবে সোফার এক কোণে বসে আছে সাইভিদ। মায়ের এই গলা ফাটানো চিৎকার আদৌ তার কানে যাচ্ছে কিনা কে জানে? সে বেশ মনোযোগ দিয়ে মোবাইল দেখছে। ছেলের এহেন আচরণে তানিয়া ভীষণ ভাবে রেগে যান। কঠিন গলায় বলে উঠেন,
‘তুমি কিছু বলছো না কেন? কিছু জিগ্যেস করছি তো আমি।’
রুমে তাহেরা বেগমও ছিলেন। বোনকে রেগে যেতে দেখে তার কাঁধে হাত রেখে ইশারা দিয়ে তাকে শান্ত হতে বললেন। তারপর আস্তে করে গিয়ে সাইভিদের পাশে বসলেন। সাইভিদের মাথার উপর হাত রেখে নরম গলায় বললেন,
‘তোর সায়মাকে পছন্দ, সাইভিদ?’
চোখ তুলে তাকায় সে। মোবাইলটা পকেটে পুরে সোজা হয়ে বসে। তারপর হেসে জবাব দেয়,
‘পছন্দ বলেই তো বিয়ে করতে চাইছি।’
তেতিয়ে উঠলেন তানিয়া। সাইভিদকে বললেন,
‘কতটুকু চিনিস তুই মেয়েটাকে? এইতো সবে দুইদিন হলো সায়মাকে দেখেছিস তাতেই তাকে তোর এত পছন্দ হয়েছে যে একেবারে বিয়েই করে ফেলতে চাইছিস? তুই আদৌ সিরিয়াস তো সাইভিদ? নাকি আবারও মজা করছিস আমাদের সাথে? দেখ সাইভিদ, বিয়েটা কিন্তু কোনো ছোট খাটো বিষয় না, সারাজীবনের সম্পর্ক এটা। তাই যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবে চিন্তে নে, বারবার বলছি আমি।’
সাইভিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার মায়ের দিকে। মায়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ফিচেল হেসে নির্বিকার গলায় বললো,
‘আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে মা। আমি সায়মাকেই বিয়ে করবো। আর আমাদের বিয়েটা ঐচ্ছির বিয়ের দিনই হবে। একসাথে দুই বিয়ে। ঐচ্ছি রাফসানের বউ হয়ে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে আর সায়মা আমার বউ হয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করবে। তুমি বাবার সাথে কথা বলে কালই এই ব্যাপারে সায়মার মা বাবার সাথে কথা বলো।’
কথাটুকু বলে দম ফেললো সাইভিদ। তারপর দ্রুত হেটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরেই ঐচ্ছি দাঁড়ানো। সাইভিদকে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে সে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ে।
তানিয়া বিষন্ন মন নিয়ে সোফায় বোনের পাশে বসলেন। ভেজা গলায় বললেন,
‘ছেলে মেয়ে দুইটা কি শুরু করেছো বলোতো, আপা? ওদের কাছে আমাদের মতামতের কোনো মূল্যই নেই। সব সিদ্ধান্ত ওরা নিজেরাই নিবে। মা বাবা হিসেবে কি আমাদের এইটুকুও অধিকারও নেই যে আমরা ওদের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবো? আপা, আমি জানি সায়মা যথেষ্ঠ ভালো মেয়ে। তাও এইভাবে হুট করেই কি একটা বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলা যায়? আর ওর বাবাকেই বা আমি এখন কি বলবো? এই ছেলেটা আমাকে একটু শান্তি দিল না, সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে গেল।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তাহেরা বেগম। দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন,
‘বুঝবে না রে বোন, যতদিন না তারা নিজেরা মা বাবা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তারা আমাদের কষ্টটাও বুঝবে না। থাক এখন আর কষ্ট পাস না। নিজের ছেলেকে তো ভালো করেই চিনিস, কতটা জেদি। সে যখন বলেছে সায়মাকে বিয়ে করবে তার মানে করবেই। আর এত টেনশন নিস না, সায়মা খুব ভালো মেয়ে। এতদিন চলছে তো ঐচ্ছির সাথে, দেখেছি তো মেয়েটাকে বেশ ভালো আর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তুই এখন ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখ উনি কি বলে? তারপর বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’
জোরালো শ্বাস টেনে তানিয়া বললেন,
‘হুম, দেখি কথা বলে উনি কি বলেন।’
______________________
রুমের দরজা আটকিয়ে, স্পিকারে গান চালিয়ে উরা ধুরা ডান্স দিচ্ছে ঐচ্ছি। খুশি যেন আজ আর তার ধরে না। আহা, চারদিকে শুধু খুশি আর খুশি। এত আনন্দ কই রাখবে সে। ইশ, ভাবতেই তো খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করে, তার একমাত্র বেস্টি এখন তার ভাবি হবে। ও আল্লাহ! ঐচ্ছি লাফাতে লাফাতে হাঁপিয়ে উঠে। তাই সে ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। শরীর থেকে অনবরত গাম ঝড়ছে তার। সে হেসে উঠলো। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রাফসানকে কল করলো,
‘হ্যালো! জানেন, মারাত্মক এক কান্ড ঘটে গিয়েছে। শুনলে আপনি খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন।’
রাফসান চাপা স্বরে বললো,
‘থাক তাহলে আর বলতে হবে না?’
ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে বলে,
‘কেন বলবো না?’
রাফসান হেয়ালির সুরে বললো,
‘ঐ যে বললেন না, কথাটা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তো আমি পাগল হলে আপনাকে কে বিয়ে করবে শুনি? তার চেয়ে এমন কথা না শোনাই ভালো।’
ঐচ্ছি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে,
‘আরে ওটা তো জাস্ট কথার কথা। আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে।’
রাফসান মৃদু হেসে বললো,
‘আচ্ছা বলুন।’
ঐচ্ছি উঠে বসলো। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘জানেন, সাইভিদ ভাইয়া নাকি সায়মাকে বিয়ে করবে। তাও আবার আমাদের বিয়ের দিন।’
রাফসান কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
‘মানে?’
ঐচ্ছি অধৈর্য গলায় বললো,
‘মানে আবার কি? সাইভিদ ভাইয়া সায়মাকে বিয়ে করবে। খালামনিকে তিনি সোজাসুজি বলে দিয়েছেন যে, যত তাড়াতাড়ি পারে সায়মার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে। আর উনি নাকি আমাদের বিয়ের দিনই বিয়ে করবেন। মানে একদিনে দুটো বিয়ে। ইশ, আমার কতদিনের শখ ছিল, আমি আর সামু একসাথে বিয়ে করবো। অবশেষে আমার ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলছে। উফ, কি যে খুশি লাগছে না বলে বোঝাতে পারবো না!’
রাফসান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভারি গলায় বললো,
‘ব্যাপারটা কি আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে না, ঐচ্ছি? না মানে সে তো দু’দিন আগেও আপনাকে পছন্দ করতো, আপনাকে বিয়েও করতে চেয়েছিল। অথচ এখন হুট করে সায়মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। স্ট্রেন্জ!’
সায়মা বিরক্ত হয়। ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘তো, তাতে আপনার কি সমস্যা? সবকিছুতেই আপনার আজগুবি কথাবার্তা। আপনি কি কোন কিছুই সোজা ভাবে ভাবতে পারেন না নাকি। সবকিছুকেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ভাবতে হবে। এতদিন সাইভিদ ভাইয়া আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল বলে আপনার সমস্যা ছিল, এখন আবার সায়মাকে বিয়ে করতে চাওয়াতেও আপনার সমস্যা হচ্ছে। আপনার জন্য কি উনি বিয়েও করবে না নাকি?’
রাফসান হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই বলে,
‘না না আমার কোনো সমস্যা নেয়। বরং উনি বিয়ে করলেই আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। তা সব তো বুঝলাম, কিন্তু উনি আমাদের বিয়ের দিনই কেন বিয়ে করতে চাইছেন? দিনের কি অভাব পড়েছে নাকি?’
ঐচ্ছি স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দেয়,
‘হয়তো দিনটাকে আরো বেশি স্মরণীয় করে রাখার জন্য।’
রাফসানও বললো,
‘হবে হয়তো।’
ঐচ্ছি আস্তে করে ডাকলো,
‘রাফসান!’
বাঁকা হেসে রাফসান বললো,
‘আপনার প্রেমে এমনিতেই আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি ম্যাডাম। এমন ভাবে ডাকলে এবার পুরো নিহত হয়েই যাবো।’
লজ্জা পেয়ে যায় ঐচ্ছি। ধুর আর কথাই বলবে না সে। একটু কথা বলতে গিয়েও শান্তি নেই, এই অসভ্য জ্বীনটা তাকে লজ্জা দেওয়া ছাড়া কথাই বলতে পারেনা। ফোনটা কেটে বারান্দায় চলে যায় সে। ঐ দূরে পশ্চিম আকাশে কমলা রঙের সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। তার তীক্ষ্ণ আলোর রেশ ঐচ্ছির চোখে এসে বিঁধছে। ঐচ্ছি চোখ পিট পিট করে অন্যদিকে তাকায়। রাস্তার ওপারের বড় কাঁঠাল গাছটায় দুটো কবুতর বসা। ধবধবে সাদা তাদের গায়ের রঙ। ঐচ্ছি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কবুতরগুলোও তাকে দেখছে। হুট করেই কবুতর দুটো উড়ে এসে ঐচ্ছির বারান্দার রেলিংটার উপর বসলো। হঠাৎ করেই এমন কিছু হওয়ায় ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় সে। কিন্তু কবুতরগুলো নড়ে না। ঐখানেই বসে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঐচ্ছির কেমন যেন ভয় করে। সে রুমে গিয়ে বারান্দার দরজা আটকে দেয়। বুকের উপর থু থু করে বিছানায় বসতেই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রাফসান কল দিচ্ছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাফসান বলে উঠে,
‘ভয় কেন পাচ্ছেন, ঐচ্ছি। ঐ কবুতরগুলোকে আমি পাঠিয়েছে। ঐগুলোও জ্বীন। ভালো জ্বীন, আপনার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না। আপনার খেয়াল রাখার জন্যই আমি ওদেরকে আপনার কাছে পাঠিয়েছি।’
বিষয়টা ঐচ্ছির কাছে ভালো লাগেনি। সে গম্ভীর সুরে বলে,
‘আমাকে খেয়াল রাখার জন্য কাউকে পাঠাতে হবে না রাফসান। আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি। এই কবুতরগুলোকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন। ওদের অমন ভাবে তাকিয়ে থাকাটা আমার ভালো লাগছে না।’
রাফসান ঐচ্ছি কে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। হয়তো তার কথাটা ঐচ্ছির ঠিক পছন্দ হবে না। সে শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ওদের চলে যেতে বলছি।’
কলটা কেটে দিয়েই ঐচ্ছি জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। এর মাঝেই কবুতরগুলো উধাও হয়ে গেল। তা দেখে ঐচ্ছিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
চলবে..