#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৫.
সায়মার মা শুকনো হেসে জবাব দিলেন,
‘সায়মার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে। তখন থেকে সায়মাকে আমি একাই লালন পালন করছি। আর বর্তমানে উনার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তানিয়া তার বোনের মুখের দিকে তাকালেন। মনের মধ্যে খচখচ করে উঠে তার। তাও হাসি মুখে বললেন,
‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আর চিন্তা করবেন না, সায়মা খুব তাড়াতাড়ি নতুন এক বাবাকে পেতে চলছে। দেখবেন তার এই নতুন বাবা তাকে সবসময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে।’
সাইভিদের বাবাও উচ্ছল হেসে বললেন,
‘জ্বি বেয়ান, কোনো চিন্তা করবেন না। আমিও তো একটা মেয়ে পেতে যাচ্ছি। বুকে আগলে রাখবো আমি আমার মেয়েকে।’
খুশিতে সায়মার মায়ের চোখ ভিজে উঠল। ভাগ্য নিয়ে এসেছিল বটে মেয়েটা। নয়তো এমন ভালো পরিবার কখনোই পেত না। মেয়েকে নিয়ে উনার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না, বাবা না থাকলে যা হয় আরকি। মেয়েকে কোথায় বিয়ে দিবে, কোন পরিবারে বিয়ে দিবে এই নিয়ে যেন তার চিন্তার শেষ অন্ত নেই। ভয় পেতেন, যদি তার মেয়ের ভাগ্যও তার মতো হয়। তবে আজ তিনি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত। আর যাই হোক মেয়েটা ভালো থাকবে উনাদের সাথে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক প্রশান্তির নিশ্বাস। তিনি মৃদু হেসে অনুনয়ের সুরে বললেন,
‘আমি আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আপনারা ভীষণ ভালো মানুষ, আমি জানি সায়মা আপনাদের কাছে ভালো থাকবে। তাই তো ঐচ্ছির কথা শুনে আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়। আসলে কি বলুন তো, ছেলে মেয়ের সুখের লোভ প্রত্যেকটা মা বাবারই থাকে, আমারও আছে। আর আমি জানি আমার মেয়েটা সুখে থাকবে। ভরসা আছে আমার আপনাদের উপর।’
কথাটুকু বলে উনি উনার আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। সকলেই অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। একটা মেয়ের পাশে তার স্বামী না থাকলে তার আশেপাশের পরিবেশটা বড্ড সংকীর্ণ হয়ে উঠে তার জন্য। স্বামীকে ছাড়া একটা সন্তানকে মানুষ করা, তাকে পড়াশোনা শেখানো, বিয়ে দেওয়া এইসব কিছুই কোনো যুদ্ধের চেয়েও কম না। আর সায়মার মাও এই যুদ্ধের একজন সাহসী যোদ্ধা।
.
.
ঐচ্ছি সায়মাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো। সায়মা সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল। সকলেই তার সালামের জবাব দিল। ঐচ্ছি সায়মাকে নিয়ে গিয়ে সাইভিদের পাশে বসাল। তারপর নিজেও সায়মার পাশে বসে পড়ল। ঐচ্ছি বসাতে সায়মা আর নড়তে পারেনা। সাইভিদ আর তার মাঝে কেবল দুই ইঞ্চির দূরত্ব। তার অস্বস্তি লাগে ভীষণ। ঐচ্ছিকে একটু গুঁতা দিয়ে সরতে বলে। কিন্তু সে কি আর সরার মেয়ে, সে আরো সায়মার দিকে চেপে বসে। ঐচ্ছি হলেও তো চলতো, কিন্তু তার অসভ্য ভাই, সে তো আরো বড় মাপের অসভ্য। সেও তো চাইলে একটু সরে বসতে পারে, কিন্তু তা না করে সাইভিদ উল্টো আরো সায়মার ঘা ঘেঁষে বসে। বেচারি সায়মা না পারছে সহ্য করতে, না পারছে কিছু বলতে..
আংটি পড়ানো শেষে সায়মা আর সাইভিদকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বড়রা সবাই বিয়ের আলোচনায় বসে পড়লো। সাইভিদ সায়মার রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দিল। ঐচ্ছি তো এতে রেগে মেগে আগুন। তার এত বড় সাহস হয় কি করে? তার বান্ধবীকে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিল? তাকে একটু ঢুকতেও দিল না। কত খারাপ! দরজা আটকিয়ে কি করছে তারা। ঐচ্ছি রাগে গিয়ে দরছা ধাক্কাতে শুরু করে। ভেতর থেকে সাইভিদ কড়া গলায় বলে উঠে,
‘কি সমস্যা, ধাক্কাচ্ছিস কেন?’
ঐচ্ছি রাগি গলায় বলে,
‘তোমরা দরজা আটকিয়ে কি করো? আমাকে ভেতরে আসতে দাও। আমিও রুমে আসবো।’
সাইভিদ আবারও তেজ দেখিয়ে বলে,
‘ভেতরে আমরা বাসর করছি। তোকে কাবাব মে হাড্ডি হতে হবে না। যা ভাগ এখান থেকে।’
ঐচ্ছির চোখ মুখ কুঁচকে আসে। মুখ ফুলিয়ে ডেকে উঠে,
‘সামু, তুই তো দরজাটা খুলতে পারিস?’
ভেতর থেকে সায়মার কোনো সাড়াশব্দ আসে না। সাইভিদ বলে উঠে,
‘সামুও দরজা খুলবে না। আমরা এখন বিজি আছি। তুই যা তো এখান থেকে। বিরক্ত করিস না।’
ঐচ্ছি খালি পারে না হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে। তার সামুও তার কথা শুনছে না। বিয়ের আগেই তার সাথে এমন করছে আর বিয়ের পর তো তাকে চিনবেই না। ঐচ্ছির নাক টেনে দরজার কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে,
‘তুইও আমার সাথে এমন করলি সামু? ঠিক আছে মনে থাকবে আমার। আমি চলে যাচ্ছি। তোদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। টাটা বাই বাই..’
কথাটা বলে সে যায় না, কিছুক্ষণ দরজায় গায়ে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকে ঐচ্ছি। কিন্তু ভেতর থেকে কারোরই কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার সে রেগে যায়। আর দাঁড়িয়ে না থেকে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ছাদে চলে যায় সে।
সায়মাদের বাড়িটা একটু অন্যরকম। দুতালা একটা বিল্ডিং। নিচে গ্যারেজ। উপড়ে দুটো ফ্ল্যাট। তবে একটা ফ্ল্যাট একটু বেশিই ছোট। বলা যায় একজন মানুষের জন্যই এই ফ্ল্যাটটা ঠিক আছে। আর একটা ফ্ল্যাট, যেটাতে সায়মারা থাকে।সায়মাদের ফ্ল্যাটটা ঐচ্ছির বেশি পছন্দ। অনেক বড় এই ফ্ল্যাটটা। সায়মা আর তার মায়ের জন্য ফ্ল্যাটটা একটু বেশিই বড় হয়ে গিয়েছে। তবে ঐচ্ছির কাছে এই ফ্ল্যাটটা সবথেকে বেশি ভালো লাগে কারণ সায়মাদের ফ্ল্যাটের পেছনের দরজাটা খুললেই তাদের ছাদে যাওয়া যায়। এটাকে ছাদের চেয়ে ব্যালকনি বেশি বলা যেতে পারে। বেশ বড় এই জায়গাটা। আর সুন্দর ভাবে সাজানো। সবটাই করেছে সায়মা। হরেক রকম ফুল গাছে তার এই ছাদ ব্যালকনিটা সাজিয়েছে। আর রাত হলে আবার বিভিন্ন রঙের ফেইরি লাইটসও জ্বলে সেখানে। সায়মাদের বাসায় আসলেই এই ছাদেই পুরো সময় কাটিয়ে দেয় ঐচ্ছি। কখনো আড্ডা, কখনো এক কোণে বসে বই পড়া, কখনো বা এক কাপ চায়ের সাথে ফুলেদের পর্যবেক্ষণ; এইখানে আসলে এই তার কাজ।
ঐচ্ছি ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতাস যেন তার মাথার হিজাবটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ঐচ্ছি হাত দুটো ছড়িয়ে চোখে বুজে বাতাসটা উপভোগ করতে থাকে। হঠাৎই তার ফোনটা বেজে উঠতেই চোখ মেলে তাকায় সে। পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে রাফসান। মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করে। রাফসান তাকে সালাম দেয়। ঐচ্ছি সালামের জবাব দিতেই রাফসান স্মিত কন্ঠে বলে,
‘এংগেইজমেন্ট শেষ?’
‘জ্বি।’
‘ওহহ, তো এখন কি করছেন?’
ঐচ্ছি হেসে বলে,
‘বাতাস খাচ্ছি?’
রাফসান রসিকতার সুরে বলে,
‘কেন, মেয়ে পক্ষ বুঝি অন্য কিছু খেতে দেইনি?’
ঐচ্ছি কপাল কুঁচকে বলে,
‘খেতে কেন দিবেনা? অনেক কিছুই খেতে দিয়েছে। সব খাওয়াও শেষ। এখন ভাইয়া আর সায়মাকে আলাদা রুমে কথা বলতে পাঠিয়েছে। আর বড়রা অন্য রুমে সবাই বিয়ের আলোচনা করতে বসেছে।’
এইটুকু বলে ঐচ্ছি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
‘জানেন, আমাকে না কোনো রুমেই জায়গা দিচ্ছে না। মা আমাকে বললো, বড়রা কথা বললে ছোটদের থাকতে নেই, আমি যেন অন্য রুমে গিয়ে বসি। ভাবলাম সায়মার সাথে সায়মার রুমে গিয়ে বসবো। কিন্তু ঐ শয়তান সাইভিদটা আমাকে রুমের ভেতরে ঢুকতেই দিল না, দরজা আটকে দিল। কত বড় খারাপ দেখেছেন। সায়মাও দরজা খুললো না। সবাই খারাপ। আমি এখন কি করবো বলুন? তাই একা একা ছাদে বাতাস খেতে চলে এসেছি।’
কথাটুকু বলে নাক টানে ঐচ্ছি। রাফসান হাসে। শব্দ করেই হাসে। ঐচ্ছি চোখ ছোট ছোট করে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘বাহ, আপনিও মজা নিচ্ছেন তাই না। ভালো তো, খুব ভালো । আমারও একদিন সময় আসবে, সেদিন আমিও দেখে নিবো সবাইকে, হু।’
ঐচ্ছির এই কথা শুনে রাফসান আরো জোরে হাসতে আরম্ভ করে। ঐচ্ছি তো এবার আরো বেশি ক্ষেপে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
‘রাফসান, হাসছেন কেন? আমার কিন্তু এবার খুব রাগ হচ্ছে বলে রাখলাম।’
রাফসানের হাসি তো বন্ধই হচ্ছে না। বেচারা বাম হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে কোনোরকমে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে। জোরে জোরে কিছুক্ষণ দম নিয়ে বলে,
‘এই দেখুন, আমি একদম চুপ। আর একটুও হাসবো না। এখন থেকে আমি শুধু কাঁদবো। আপনি যাই বলবেন আমি তাতেই খালি কেঁদে যাবো। কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু ভাসিয়ে ফেলবো। যদিও আমি জীবনেও কাঁদিনি। তাও আপনার জন্য চেষ্টা করবো। না পারলে চোখে লেবুর রস দিয়ে কান্না আনবো, তাও কেঁদেই ছাড়বো। আর ভুলেও আর কোনোদিন হাসবো না, আপনার সামনে তো একদমই না। এবার আর আপনি রাগ করবেন না, প্লিজ।’
বলে আবারও ঠোঁট চেপে হাসে। ঐচ্ছি বেশ বুঝে রাফসান যে তাকে নিয়ে মজা করছে। তাই সে আর কিছু বলে না খালি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। ঐচ্ছির কোনরূপ সাড়াশব্দ না পেয়ে রাফসান বলে উঠে,
‘ঐচ্ছি, কথা বলছেন যে? সত্যি সত্যিই রাগ করেছেন নাকি?’
ঐচ্ছি ক্ষীণ সুরে বলে,
‘হু।’
রাফসান আস্তে করে বলে,
‘সরি।’
ঐচ্ছি হাসে, বলে,
‘একটা জিনিস চাইবো দিবেন?’
রাফসান কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘কি জিনিস?’
ঐচ্ছি অধৈর্য গলায় বললো,
‘আগে বলুন দিবেন?’
রাফসান মৃদু হেসে বললো,
‘সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই দিবো।’
‘আপনার সামর্থ্যের বাইরে আমি কিছু চাইবো না, রাফসান।’
রাফসান শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বলুন কি চাই আপনার?’
চলবে..