কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৪০.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৪০.
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যেই সাইভিদ নিচে নেমে। ঐচ্ছি তো হা করে সাইভিদের দিকে চেয়ে আছে। মানে সায়মা এত বড় কাজটা করলো কি করে? হায় মাবুদ! এবার তো ঐচ্ছিকেও তার শর্ত অনুযায়ী এক সপ্তাহ সায়মার কথা শুনে চলতে হবে। এখন এই কুত্তিটা তাকে দিয়ে কি কি করায় এক আল্লাহই জানেন।
.
.
দুপুর দুটো,

সাইভিদ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সায়মাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার বাবা, আর তার একটা ফ্রেন্ডও তার সাথে গিয়েছে। তবে তানিয়া জুবায়ের যাননি, তিনি তার বোনের সাথে বাড়িতেই থেকেছেন। বিয়ে বাড়ি কেবল নামেই বিয়ে বাড়ি। বাড়ির কজন মানুষ ছাড়া বাইরের কেউই নেই। ঐচ্ছিরা যদিও ইচ্ছে করেই বাইরের কাউকে জানায়নি তবে, সাইভিদের মা বাবা এখন ওতো বড় করে অনুষ্ঠান করতে চাইছেন না। আকতের মতো একটা বিয়ে করিয়ে উনারা বউকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবেন, নিজেদের বাসায়। উনাদের উদ্দেশ্য সেখানে গিয়েই উনারা উনাদের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করবেন।

ঐচ্ছি লাল রঙের একটা বেনারসী পরেছে। গায়ে হালকা কিছু সোনার গয়না। কিছুক্ষণ আগেই সে আর সায়মা পার্লারে গিয়েছিল সাজতে। সাজ শেষেই দুজনে দুজনের বাসায় চলে যায়। ঐচ্ছির যদিও পার্লার থেকে সাজার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ঐ যে সায়মা কাছে সে হেরেছে এখন তো এক সপ্তাহ তাকে সায়মার সব কথা শুনতেই হবে। তাই সায়মার কথা মতোই সে আর সায়মা পার্লারে সেজেছে। তবে আহামরি কোনো ব্রাইডাল মেকাপ না একেবারেই সিম্পল। দুজনকেই সেই সাজে সুন্দর লাগছে।

.

ঐচ্ছি তার রুমে বিছানার এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ফ্যান ছাড়া অবস্থাতেই টেনশনে রীতিমতো ঘামছে সে। এইদিকে বিকেল এখন প্রায় চারটা বাজতে চললো, অথচ রাফসানদের কোনো খবরই নেই। রাফসানকে ম্যাসেজ দিয়েছে ঐচ্ছি তবে সে রিপ্লাই দেইনি। ঐচ্ছির মা এসে এবার উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

‘ঐচ্ছি, তুই রাফসানকে একটা কল দে না। এত লেইট কেন হচ্ছে ওদের। কাজী সাহেব কখন থেকে এসে বসে আছেন।’

ঐচ্ছি শুকনো মুখে বললো,

‘হ্যাঁ মা, দিচ্ছি।’

মোবাইলটা হাতে নিল সে। রাফসানের নাম্বারে কল দিতে যাবে তখনই রাফসান তাকে ম্যাসেজ দিল, ‘এই তো চলে এসেছি আমরা। আপনাদের বাড়ির সামনেই।’

ঐচ্ছির মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটে উঠল। সে উচ্ছল কন্ঠে মাকে বললো,

‘মা, রাফসান ম্যাসেজ দিয়েছে। উনারা নাকি চলে এসেছে, আমাদের বাসার সামনেই।’

ঐচ্ছির মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ঐচ্ছির রুমে তখন হঠাৎই এক দমকা হাওয়া বয়ে গেল। ঐচ্ছি অবাক চোখে বারান্দার দিকে তাকাল। সেই বাতাসের সাথে এক অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ ঐচ্ছির নাকে এসে ঠেকল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো তার। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়ে সেই ঘ্রাণটাকে নিজের শরীরে ভেতর মিশিয়ে নিল সে।

দরজায় কলিং বেল বাজতেই ঐচ্ছির বাবা আনোয়ার সাহেব ব্যস্ত ভঙিতে দরজাটা খুলে সাদরে রাফসানের পরিবারকে গ্রহণ করলেন। তাদের নিয়ে গিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলেন। সেখানেই সোফার এক পাশে একটা চেয়ারে সাদা পাঞ্জাবী গায়ে, আধ পাকা লম্বা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ লোক বসা। রাফসান তাকে সালাম দিল। লোকটি সালামের উত্তর দিয়ে তীক্ষ্ণ ভাবে রাফসানের দিকে তাকাল। রাফসান তার মুখ বরাবর অপর পাশে সোফাটাতে বসলো। তার পাশেই বসলো সাদমান। আর তার পাশে তাদের আম্মাজান। তাদের আব্বাজান বসলো আরেক সোফায় আনোয়ার সাহেবের পাশে। কাজী হিসেবে তো আজ নাজমুল হুজুরের আসার কথা ছিল, ঐচ্ছির বাবা হুজুরকে বলেছেনও এসে ওদের বিয়েটা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি সাফ মানা করে দিয়েছেন। উনি এখন গিয়েছেন সাইভিদদের সাথে সায়মাদের বাড়িতে। সাইভিদ আর সায়মার বিয়ে উনি পড়াবেন। ব্যাপারটা রাফসানের কাছে মোটেও ভালো লাগেনি, হুজুর কথা দিয়েও কথা রাখলেন না।
.
রাফসানের বাবা সৌজন্য হেসে বললেন,

‘আমরা দুঃখিত বেয়াই। আসলে পারিবারিক একটা কারণে আমার ছোট ভাইটার সাথে একটু দূরে যেতে হয়েছিল আমাকে তাই আপনাদের এখানে আসতে একটু লেইট হয়ে গিয়েছে। কিছু মনে করবেন না দয়া করে।’

প্রসন্ন হাসলেন আনোয়ার সাহেব। তার এই হাসিতেই প্রকাশ পেল তিনি যে কতটা বিরক্ত হলেন রাফসানের বাবার কথায়। আজকে তার ছেলের বিয়ে অথচ তিনি তার ভাইয়ের সাথে অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন, এটা কোন কথা? আজই যেতে হলো উনাকে? কি অদ্ভুত! মেয়ের জন্য সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছেন তিনি। আনোয়ার সাহেব তার একরাশ বিরক্তিটা নিজের মনের মাঝেই চেপে রাখলেন। মুখে স্বাভাবিক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন,

‘না না সমস্যা নেই। কাজী সাহেব তো আছেনই, বিয়েটা তাহলে এখুনি পড়ানো যাক।’

ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন রাফসানের বাবা, বললেন,

‘জ্বি, অবশ্যই।’

ঐচ্ছির বাবা এবার কাজী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘কাজী সাহেব, আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’

কাজী সাহেব ব্রু কুঁচকালেন। আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘উনি তো মানুষ নন।’

চমকিত হলেন সকলে। রাফসান বাঁকা হাসল। গম্ভীর গলায় বললো,

‘আমাকে কেন আপনার মানুষ মনে হচ্ছে না কাজী সাহেব?’

বৃদ্ধ কাজী রাফসানের দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল।

রাফসান হাসলো, বললো,

‘এবার তাহলে বিয়েটা পড়ান।’

কাজী সাহেব মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। আনোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কাজী সাহেব যে এখন রাফসানের বশে চলে গিয়েছেন সেটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। অগত্যাই তাকে সবটা মেনে নিতে হলো।

রাফসানের কবুল বলা শেষ হতেই সবাই গেল ঐচ্ছির রুমে। রাফসানের সাথে তার ভাই আর মা বসা। ড্রয়িং রুমে এসে তাদের সাথে সৌজন্য বিনিময় করলেন ঐচ্ছির মা তাহেরা বেগম। ঐদিকে ঐচ্ছির রুমে ঐচ্ছির খালা বড় এক চাদর ধরলেন ঐচ্ছি আর কাজী সাহেবের মাঝখানে। কাজী সাহেব খিনখিনে সুরে কাবিননামা পড়ে ঐচ্ছিকে কবুল বলতে বললেন। হঠাৎই কেঁদে ফেলে ঐচ্ছি। শব্দ করেই কাঁদতে থাকে সে। তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে তার আগের দিনগুলোর কথা। মা বাবার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলোর কথা, সায়মার কথা আর সাইভিদের কথাও। আজ হঠাৎ করে আবারও মনে পড়ছে তার, সে যা করছে ঠিক করছে তো? পারবে তো সে একটা জ্বীনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে, জ্বীন পরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে? বুকটা ধুরুধুরু করে কাঁপছে তার।অঝোরে চোখে বেয়ে পানি পড়ছে। তার খালামনি তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মিহি কন্ঠে বললেন,

‘কাঁদছিস কেন মা? তোর কথাতেই তো সবকিছু হয়েছে। তোর খুশির জন্য তোর মা বাবা উনাদের বুকে পাথর রেখে তোর সব কথা শুনেছে। এখন তুই যদি এইভাবে কাঁদিস তাহলে তো তোর মা বাবা কষ্ট পাবেন তাই না? কাঁদিস না, সোনা। কবুলটা বলে ফেল।’

ঐচ্ছি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলছে। সত্যিই তো তার জন্যই তার মা বাবা এত কষ্ট পাচ্ছে। যদি কখনো রাফসান তাকে ঠকাই তাহলে সে কখনো তার সেই মুখ নিয়ে তার মা বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। মরে যাওয়া ছাড়া তখন বুঝি আর কিছুই করার থাকবে না তার।

ঐচ্ছির বুকটা হঠাৎই কোনো এক অজানা ব্যাথায় কেঁপে উঠে। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে সে। তাও পারছে না। চোখ মুখ খিঁচে নিজেকে শক্ত করলো, অতঃপর ধরা গলায় আস্তে করে বললো,

‘কবুল।’

তারপর একই ভাবে পরপর আরো দুবার সে কবুল বললো।
বাকি সকলে বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ’।

অবশেষে ঐচ্ছি রাফসানের বিয়ে সম্পন্ন হলো। ঐদিক থেকে খবর এলো, সাইভিদ আর সায়মার বিয়েও নাকি হয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উনারা নাকি বউ নিয়ে ফিরছেন। ভাসা ভাসা এক আনন্দে মেতে উঠল পরিবারগুলো। ঐচ্ছির মা বাবা ব্যস্ত হয়ে রাফসানদের খাবারের ব্যবস্থা করতে লাগল। খাবার খাওয়ার পরই শুরু হবে ঐচ্ছির বিদায়ের পালা। অতিরিক্ত ভয় আর টেনশনে সবসময়ই ঐচ্ছির পেটে মোচড় দেয়, এখনো দিচ্ছে। তবে এই শাড়ি টাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার কোনরূপ সাহস পাচ্ছে না সে। তাই চুপচাপ বিছানার এক কোণে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর ঐচ্ছির রুমে তার খালামনি এসে বললো,

ঐচ্ছিকে নাকি এখন ড্রয়িং রুমে যেতে হবে। সকলের খাওয়া শেষ। কিছুক্ষণের মাঝেই সাইভিদরাও চলে আসবে। তারপর শুরু হবে ঐচ্ছির বিদায়ের পালা।

ঐচ্ছির এবার আরো ভয় লাগতে শুরু করে। ভয়ে ভয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে সে সকলকে সালাম দেয়। সবাই তার সালামের জবাব দিতেই তার খালামনি তাকে রাফসানের পাশে বসায়। ভয় আর অস্থিরতায় ঐচ্ছি একবারও রাফসানের দিকে তাকাল না। সে যে রাফসানের পাশে বসেছে সেই খেয়ালও আদৌ তার আছে কিনা কে জানে। তার সম্পূর্ণ চিন্তা তো এখন তার বিদায় বেলা নিয়ে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here