কৃষ্ণাবতী
১৩ম_পর্ব
কৃষ্ণা মুখ ফুলিয়ে রসায়নের বিক্রিয়া কষতে লাগলো। তাও এই উছিলাতে দেবব্রতের রুমে তো প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। হঠাৎ কারোর চিৎকার শুনতে পায় তারা। দেবব্রত দৌড়ে গিয়ে দেখে তার মা অবন্তীকা দেবী সিড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন। ছাঁদ থেকে নামবার সময় এই ঘটনা ঘটেছে। পা এবং মাজায় অসম্ভব ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। ব্যাথায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন অবন্তীকা দেবী। কৃষ্ণা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরতে গেলে তিনি এর মাঝেই বলেন,
– এই মেয়ে তুমি আমায় ছুবে না।
তার বারণ শুনে দু কদম পিছিয়ে যায় কৃষ্ণা। কৃষ্ণার মুখখানা বেশ মলিন হয়ে যায়। দেবব্রত তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে সব ঠিক হয়ে যাবে। রীতা দেবী, অন্না এবং দেবব্রত অবন্তীকা দেবীকে তুলে নিজ রুমে নিয়ে যায়। নারায়ন বাবু দুদিন ঢাকার বাহিরে গিয়েছেন কিছু ব্যবসা জনিত কাজে। অবন্তীকা দেবীর ব্যাথায় নাজেহাল অবস্থা। কৃষ্ণার বেশ অস্থির লাগছে। যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক অবন্তীকা দেবী তাকে কিন্তু সে তাকে মায়ের জায়গাটাই দিয়েছে। বাগানের আকন্দ গাছ থেকে গোটা দশেক পাতা ছিড়ে তা দিয়ে গরম ছেক দেয় সে অবন্তীকা দেবীর পায়ে। প্রথমে বেশ কবার মানা করেন অবন্তীকা দেবী। তখন কৃষ্ণা একটু কড়া কন্ঠেই বলে,
– আপনার তো আমার সাথে সমস্যা মা, নিজের সাথে তো নয়। তাহলে কেনো আমার উপরে রাগ দেখিয়ে ব্যাথাটা বাড়াচ্ছেন। একটু শান্ত থাকুন, দেখবেন ব্যাথা কমে যাবে।
– বাবু, এই মেয়েটাকে কিছু বল। আমার তো মনে হয় আমাকে পুরোই পঙ্গু বানিয়ে দিবে। তোরা ডাক্তার বাবুকে ফোন দে না।
অবন্তীকা দেবীর কথা শুনে দেবব্রত ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– মা, আমি ডাক্তার কাকুকে ফোন দিয়েছি। কৃষ্ণাতো ভুল কিছু করছে না। তুমি একটু শান্ত হও না।
– কিভাবে শান্ত হবো। মেয়েটা কি পাতা দিয়ে ছেক দিচ্ছে। আরো ব্যাথা করছে।
– একটু সময় দাও। ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ, আমার জন্য একটু শান্ত হও।
দেবব্রতের কথার সাথে পেরে উঠলেন না অবন্তীকা দেবী। চোখ মুখ খিচে কৃষ্ণার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। মিনিট বিশেক পর যখন ব্যাথাটা একটু প্রশমিত হতে লাগলো তখন তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা কমতে লাগলো৷
– মা, এখন কেমন লাগছে? ব্যাথা কমেছে?
– ব্যাথা কি তোমার বান্ধবী নাকি! বললেই কমে যাবে। আর আমার একেবারেই ভালো লাগছে না কারণ তুমি আমার সামনে বসে রয়েছো। তোমাকে দেখলেই ব্যাথা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
– আমার মুখটা কি ছাঁদের সিঁড়ির মতো? আপনি স্বীকার না করলেও আমি জানি আপনার ব্যাথা করছে না।
– বেশি জানো তো তুমি
– আমি বই তে পড়েছি, আকন্দ ফুলের পাতা দিকে সেক দিলে ব্যাথা কমে যায়। এখন বই কি কম জানে?
রীতিমতো অবন্তীকা দেবীর সাথে কথা কাটাকাটি চলছে কৃষ্ণার। দেবব্রত এই দৃশ্য থেকে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। যেমন বুনোওল তার মা ঠিক তেমনই বাঘা তেতুল তার বউ৷ একেবারে খাপে খাপ। রীতা দেবী ফিসফিস করে দেবব্রতের কানে বললেন,
– এতোদিন পর একেবারে যোগ্য হাতে দিদিভাই পড়েছে।
– ঠিক বলেছো কাকী মা।
ঘন্টা দুয়েক বাদে নারায়ন বাবুর বন্ধু অনিন্দ্যবাবু এসে অবন্তীকা দেবীকে পরীক্ষা করেন। পা পিছলে যাওয়ায় পা টা খানিকটা মচকে গিয়েছে। আর মাজায় ব্যাথা পেয়েছেন। তিনি কৃষ্ণার বেশ প্রশংসাও করেছেন। মেয়েটা তাড়াতাড়ি নিজের উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছে বলেই অবন্তীকা দেবীর ব্যাথা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। ডাক্তার বাবু যাবার পর আরেকটি ঝামেলা উৎপন্ন হলো। রাতে অবন্তীকা দেবীকে একা তো রাখা যাবে না। তার হাটতে গেলে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। একজনকে তার সাথে থাকতেই হবে। এই উছিলাতে দেবব্রতও ঝোপ বুঝে কোপ মারলো। সে কৃষ্ণাকে অবন্তীকা দেবীর সাথে থাকার জন্য বললো। তখনই অবন্তীকা দেবী বাধ সাধলেন,
– না না বাবু, ও আমার সাথে থাকবে না।
– কেনো? আমি কি রাতে আপনার জায়গায় ঘুমোবো নাকি! বরং আমি থাকলে রাতে আপনার ভয় লাগবে না। ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জানা আছে আমার।
– নিজের ঘরে ভূত তাড়াও গে যাও। আমি তোমার সাথে থাকবো না ব্যাস।
– আজিব তো..
দুজনের মধ্যে আবারো বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দেখে দেবব্রত একটু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– কি সমস্যা তোমাদের? একটা রাত একসাথে থাকবে তাতেই ঝগড়া করে একাকার করে ফেলছো। মা, কৃষ্ণা নাহয় বাচ্চা। তুমিও কি বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি! আর কৃষ্ণা তোকেও বলি, কোমড় বেধে ঝগড়া করে যাচ্ছিস কখন থেকে। আর যদি একটা টু শব্দ শুনেছি তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।
দেবব্রতের ধমক যেনো ঔষধের মতো কাজ করলো। দুজনই একেবারে চুপ হয়ে গেলো। চুপ হলে কি হবে তাদের চোখের দৃষ্টির যুদ্ধ যেনো তখন ও অবিরাম চলতে লাগলো।
রাত ৩টা,
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো অবন্তীকা দেবীর। বাথরুমে যাওয়াটা খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণাকে এতো রাতে তুলবেন, ইচ্ছে করছে না। যদিও সে কৃষ্ণাকে দেখতে পারেন না। কিন্তু মেয়েটির মুখ দেখলে কেমন যেনো মায়া লাগে তার। মেয়েটির চেহারার মাঝে শ্যামলীর একটি ছাপ রয়েছে। যেকারণে রাগারাগি করলেও বেশি কিছু বলতে পারেন না। কি ভালো হতো যদি শ্যামলীর মেয়েটাকে দেবব্রতের বউ করে এ বাড়ি আনা যেত। অবশ্য তার স্বামী ব্যাপারটাকে কখনোই মেনে নিবেন না। কারণ তার বন্ধুর মেয়ে সৌদামিনীকে তার বেশি পছন্দ। অবশ্য সৌদামিনী মেয়েটাও খারাপ ছিলো না। নম্র ভদ্র একটা মেয়ে, উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু কেনো যে তার শ্বশুরমশাই এই মেয়েটাকে তার ছেলের বউ করে আনলেন কে জানে। বয়সের তুলনায় বেশি পাকা। অবন্তীকা দেবী নিজেই কষ্ট করে উঠতে গেলেন। কৃষ্ণাকে ডাকবেন না তিনি, মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে তার জন্য কম করে নি। শোয়ার সময় ও মাঝায় মালিশ করে দিচ্ছিলো। মেয়েটাকে আর কষ্ট দেওয়াটা অমানবিক হয়ে যাবে।
– কিছু লাগবে মা?
অবন্তীকা দেবী উঠেই পড়েছিলেন প্রায়। তখনই কৃষ্ণা বলে উঠলো কথাটা। মেয়েটা তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে। অবন্তীকা দেবী অবাক হয়ে বললেন,
– তুমি ঘুমোও নি?
– যদি আপনার কিছু তাকে তাই ঘুমাতে যাই নি।
– কাল তো কলেজ আছে তোমার? পারবে না ঘুমিয়ে? কষ্ট হবে তো!
অবন্তীকা দেবীর কথায় কৃষ্ণা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– পারবো। আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।
– আমার বয়েই গেছে তোমাকে নিয়ে চিন্তা করতে। চলো আমাকে বাথারুমে যেতে সাহায্য করো। তুলো আমাকে।
কৃষ্ণা শুধু হাসলো। তার শ্বাশুড়ি মা মুখে স্বীকার না গেলেও মনে মনে ঠিক তার জন্য চিন্তা করছে। ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগছে কৃষ্ণার। সময় লাগবে কিন্তু একটা সময় ঠিক নিজের জায়গা করে নিতে পারবে সে। এখন শুধু অপেক্ষা মাষ্টারমশাই এর মনে নিজের জায়গা করে নেওয়া____
১০.
সকাল ৯টা,
বটতলায় গরম চা হাতে বসে রয়েছে অর্জুন। দৃষ্টি কলেজের গেটের দিকে। অপেক্ষা তার কৃষ্ণাবতীর। মেয়েটাকে দেখার জন্য বেহায়া মনটা আকুপাকু করছে। রোজ রোজ এই বটতলায় বসে তার কৃষ্ণার অপেক্ষা করতে বেশ লাগে। প্রতিদিন একনজর দেখেই আড়ালে চলে যায় সে। তখনই একটা জুনিয়র এসে বলে,
– অর্জুন দা এবারও গানের লিষ্টে তোমার নাম দিয়ে দিছি। এবারেও বার্ষিক অনুষ্ঠানে তোমাকেই গাণ গেতে হবে বলে দিচ্ছি।
– তোরা তো দেখছি আমার কাছে একটা বার শোনাও জরুরী মনে করিস না৷ আমার যদি সময় না হয়?
– না বললে তো চলবে না। তোমার বিপদ সংকেত ও নাম লিখিয়ে৷ তোমাদের ডুয়েটের ব্যাবস্থা করে দিয়েছি।
কথাটা শুনেই যেনো মনটা ভালো হয়ে গেলো অর্জুনের। তার কৃষ্ণাবতীর সাথে গাণ গাইতে পারবে সে। রিহার্সালের অজুহাতেও এক সাথে সময় কাটাতে পারবে। জুনিয়রগুলো আজকাল বেশ কাজের হয়ে গেছে। তখনই কলেজের গেট দিয়ে কৃষ্ণাবতীর আগমন ঘটলো। নীল রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পড়া। ঢেউ খেলানো চুলগুলো খুলে দিয়েছে। অশান্ত বাতাসের সাথে সাথে চুলগুলো ও উড়ছে। আনমনেই উঠে দাঁড়ালো অর্জুন। হাটতে হাটতে ঠিক দাঁড়ালো কৃষ্ণার সামনে। হঠাৎ কেউ সামনে এসে পড়ায় কৃষ্ণাও হতচকিত হয়ে উঠলো। অবাক চোখে তাকাতেই দেখলো তার সামনে অর্জুন দাঁড়ালো। হলুদ একটা পাঞ্জাবী আর কালো একটি জিন্স তার পড়নে। কেউ দেখলে বলবে হুমায়ুন আহমেদের হিমু এবং রুপা চরিত্র যেনো গল্প থেকে উঠে এসেছে। টানা টানা চোখে অবাক দৃষ্টি প্রয়োগ করতেই অর্জুন মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
– গাণ গাইতে পারো?
– হ্যা?
– বললাম গাণ গাইতে পারো? সোজা বাংলা ভাষা, এ ছাড়া হিন্দী অথবা ইংলিশেও বলতে পারি। বলবো?
– হ্যা পারি, কেনো বলুন তো?
– কারণ এন্যুয়াল ফেস্টে তোমার পার্টনার আমি। আমি বরাবর ই ভালো গাই। এখন তোমার সুর যদি আমার সুরে না মিলে তখন তো সমস্যা। আজ বিকেলে প্রাক্টিস। চলে এসো
বলেই হাটা দিতে নিলে কৃষ্ণা পিছন থেকে বলে উঠে,
– আমার কোচিং আছে বিকেলে। বিকেলে পারবো না যে
– বাইলোজি কোচিং তো চারটায় শেষ হয়। চারটার পর থেকে তো ফ্রি। আমি তোমাকে পিক আপ করে নিবো। পাঁচটার সময় আমিই বাসায় পৌছে দিবো তোমায়। বাসায় বলে দিও
– আপনি কি করে জানলেন আমার চারটায় বাইলোজি পড়া আছে?
কৃষ্ণার কথা শুনে ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি একে চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলে,
– সিক্রেট, বলা যাবে না। রেডি থেকো।
বলেই হাতের চাবির রিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেলো৷ কৃষ্ণা তখন অবাক চোখে অর্জুনের যাবার পথে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা একজনের চোখ এড়ালো না। সূক্ষ্ণ চোখে কৃষ্ণাবতীর দিকে সে তাকিয়ে থাকলো। মুখে একটা প্রশান্তির হাসি টেনে নিজ গন্তব্যে রওনা দিলো সে। কৃষ্ণা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই..…….
চলবে
[গতকাল গল্প না দেবার জন্য সরি, পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ কালকে সকালে দিবো। কাল দুটো পর্ব পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি