#কৃষ্ণাবতী
১৪ম_পর্ব
কৃষ্ণা তখন অবাক চোখে অর্জুনের যাবার পথে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা একজনের চোখ এড়ালো না। সূক্ষ্ণ চোখে কৃষ্ণাবতীর দিকে সে তাকিয়ে থাকলো। মুখে একটা প্রশান্তির হাসি টেনে নিজ গন্তব্যে রওনা দিলো সে। কৃষ্ণা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই পেছন থেকে একটা চাপর মেরে তার ভাবনার জগতে ছেদ করে অন্না।
– অর্জুন দা কি বলে গেলো রে? তার তুই এমন হা করে কি ভাবছিলি? প্রেমে ট্রেমে পড়লি না কি?
– তোর মাথায় প্রেম বাদে কি কিছুই আসে না? আমি কোনো প্রেমে ট্রেমে পড়ি নি বুঝেছিস।
বেশ ক্ষেপেই কথাটা বলে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার কথা শুনে অন্না একটু ভ্রু উচিয়ে বলে,
– তুই নাহয় প্রেমে পড়িস নি কিন্তু অন্য কারোর মনের আবহাওয়া কিন্তু ভালো ঠেকছে না।
– মানে?
– মানে টা সময় হয়ে বুঝিয়ে দিবো। আন্দাজটা ঠিক না ভুল এটা তো জানতে হবে তাই না! চল ক্লাসে চল
বলেই টানতে টানতে কৃষ্ণাকে ক্লাসে নিয়ে গেলো অন্না। কৃষ্ণার মনে এখনো একটি প্রশ্ন ঘুরছে অর্জুন কিভাবে জানে তার কখন পড়া থাকে! এটা তো দেবব্রত ও জানে না__________
দুপুর ৩টা,
সূর্য্যি মামা মাথায় উঠে নিত্য করছেন। কড়া রোদে শীতের চিহ্নটুকু হারিয়ে গেছে। বাইলোজি পড়ার জন্য ছুটে এসেছে কৃষ্ণা এবং অন্না, কিন্তু আফসোস আজ স্যার ব্যাস্ত থাকায় কৃষ্ণা এবং অন্নার পড়া বাতিল হয়েছে। এতদূর স্যারের বাড়ি অবধি যেয়ে ফিরে যেতে হবে তাদের। রাস্তার ধার দিয়েই হাটছিলো তারা; তখন পেছন থেকে ডাক পড়লে তারা পেছনে ফিরে দেখে বাইকে হেলান দিয়ে অর্জুন দাঁড়ানো। কালো শার্টে মন্দ লাগছে না তাকে, চুল গুলো হাত দিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে, চোখের চশমাটা মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো সে। অন্না অবাক হয়ে বললো,
– একি অর্জুন দা আপনি এখানে?
– কাজ ছিলো, তোদের ক্লাস শেষ?
– না না, আজ স্যার নেই তাই কোচিং বন্ধ। বাসায় ই যাচ্ছিলাম
– অহ, কৃষ্ণাবতী তুমি কি বাসায় যাবে এখন? যদি না যাও আমার সাথেও যেতে পারো।
মৃদু কন্ঠের প্রশ্নটা কঠিন কোনো প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু কৃষ্ণা যেনো কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটার চোখজোড়া বেশ অদ্ভুত। উদাসীন কিন্তু মায়ায় ভরা৷ কৃষ্ণা কিছু বলতে যাবে তখনই কেউ বলে উঠে,
– হ্যা, ও এখন বাসায় ই যাবে।
কন্ঠটা খুব পরিচিত একজনের। কৃষ্ণা অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেড়েই যাচ্ছে কন্ঠটা শুনে। পেছনে না ফিরলেও কৃষ্ণা বলে দিতে পারছে কন্ঠটা আর কারো নয়, বরং তার মাষ্টারমশাই এর। দেবব্রত দ্রুত এসে কৃষ্ণার হাত চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসে। অন্নাকে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– গাড়িতে যেয়ে বস।
অন্না কথা না বাড়িয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। দেবব্রতকে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে অর্জুন বলে,
– আরে দেব দা তুমি এখানে? অন্নাকে নিতে এসেছো বুঝি?
– শুধু অন্নাকে নয়, কৃষ্ণাকেও নিতে এসেছি৷
দেবব্রত এখনো কৃষ্ণার হাত ধরে আছে। এই ব্যাপারটা অর্জুনের দৃষ্টি এড়ালো না। কলেজের সবাই জানে দেবব্রত এবং সৌদামিনীর কথা। তারা এই কলেজেই পড়াশোনা করেছে। তাদের ভালোবাসার স্তম্ভ গড়েও কলেজ থেকে। দেবব্রত যে অন্য কারোর হাত এতোটা অধিকারের সাথে ধরবে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে অর্জুনের জন্য। অর্জুন ধীর কন্ঠে বলে,
– কৃষ্ণাবতী আর তোমার সম্পর্ক কি দেব দা? না আসলে কৃষ্ণাবতীর হয়ে তুমি ডিসিশন নিচ্ছো তো তাই প্রশ্ন জাগলো মনে।
– আমার আর কৃষ্ণার সম্পর্কটা নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। তোর কৃষ্ণার সাথে কি কাজ সেটা আমাকে বললি না যে! আমি যতটুকু জানি তোর সামনে ফাইনাল। এখানে অহেতুক সময় নষ্ট করার ছেলে তো তুই নস। আর কৃষ্ণার সাথে এতোও জরুরি ও কোন কাজ থাকার কথা বলে আমার ধারণা নেই। তাই নয় কি অর্জুন?
দেবব্রতের তীক্ষ্ণগলায় প্রশ্নে অর্জুন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সত্যি ই প্রেমের তীব্রতার কারণে অর্জুন আজকাল নিজের সব কাজ ছেড়ে শুধু কৃষ্ণার এক ঝলক দেখবার জন্য উতলা হয়ে থাকে। ধীর কন্ঠে বললো,
– একটা কাজে এসেছিলাম, আসলে সামনের এন্যুয়াল ফেস্টে কৃষ্ণাবতীর সাথে আমার গাণ গাইবার কথা। বিকেলে রিহার্সাল ছিলো। কৃষ্ণাবতীর সাথে যেহেতু দেখাই হয়ে গিয়েছে তাই….
– কিন্তু কৃষ্ণা এখন যাবে না। কলেজের ফেস্ট। রিহার্সাল টাও কলেজের ফাকেই করে নিস। এখন বিকেল হয়ে গেছে। ও আমার সাথে বাসায় যাবে এখন। আসছি তাহলে
বলেই দেবব্রত কৃষ্ণার হাত ধরে গাড়িতে তুললো। পুরোটা সময় বান্দা তার হাত ধরেই ছিলো। কৃষ্ণার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো। এই প্রথম তার মাষ্টারমশাই তার হাত এতোটা সময় ধরেছিলো। মাষ্টারমশাই এর হাতের উষ্ণতা তার হাতের ভেতর অনুভব করছিলো কৃষ্ণা। তবে আরেকটি মানুষের মুখে একটা দুঃখের ছাপ নেমে এসেছে। সে যদি একটা বার পেছনে ফিরে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেতো। অর্জুন তখন ও দেবব্রতের গাড়ি যাবার পানে চেয়েছিলো। চোখের সামনে এখনো কৃষ্ণাবতীর হাতে হাত রাখা দেবব্রতের দৃশ্যটি ভাসছে_______
১১.
ছাঁদে চাঁদর পেছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। দেবব্রতদের ছাঁদটা বেশ পুরোনো ধাচের। কর্ণিশ মাজা অবধি। তাও ইটের গাটনি। ঠিক মাঝ বরাবর একটি তুলসি গাছ ইট দিয়ে বাধানো। মা, কাকীমা জল ঢালে তাতে। আজ বেশ কুয়াশা পড়েছে। মাঘ মাসের প্রথম দিন বলে কথা। কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া ক্ষনে ক্ষণে বইসে। দেবব্রতের ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোয়া কুয়াশায় মিলে যাচ্ছে। মাথায় একটা চিন্তা বেশ চড়াও হয়ে উঠেছে দেবব্রতের। সেই চিন্তার উৎস অর্জুনের চাহনী। অর্জুনকে কলেজের থেকেই দেবব্রত চিনে। তার খুব ভালো জুনিয়র ছিলো। তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো। ছেলেটা কখনোই মেয়ে নামক চক্করে পড়ে নি। সারাক্ষণ গাণ, পড়ালেখা আর রাজনীতিতে ব্যাস্ত ছিলো। কিন্তু আজ তার চাহনী যেনো অন্যকিছু বলছিলো। যে আবেগী চাহনীতে সে কৃষ্ণার দিকে দেখছিলো এই চাহনী একট সময় সে সৌদামিনীর প্রতি দেবব্রতের ছিলো। তবে কি!! দেবব্রতের বুক জ্বলছে, এটা কেনো যে বুঝতে পারছে না। হয়তো আজ নিকোটিনের ডোজ বেড়ে গেছে। তাই হবে। হঠাৎ একটা মৃদু স্বরের আওয়াজ পেতেই সব ক্লান্তির অবসান ঘটলো যেনো। হ্যা কৃষ্ণা গাণ গাইছে।
“বেলা গেল সন্ধ্যা হলো, আর কি বাকি আছে বলো
কার-বা আশে রইয়াছ বসিয়া রে।।
পাগল মন রে, আগবাজারে আইল যারা
বেপার করিল তারা, ভরল নৌকা হীরামুক্তা দিয়া
শেষবাজারে দোকান খুলে, সব হরাইলাম লাভে মূলে
পাগল মন রে, মহাজনকে বুঝাব কী করিয়া রে।।
পাগল মন রে, পুঁজি ছিল ষোলোআনা, বেপার করিতে দু’না
এসেছিলাম সঙ্গী ছয়জন লইয়া
কাম কামিনীর ফেরে পড়ে, নাও ভিড়াইলাম মদনপুরে
পাগল মন রে, সোনা নিল শিসা বদল দিয়া রে।।
পাগল মন রে, আকাশে ডুবিল বেলা, সঙ্গে ছয়টা চোরশালা
সন্ধ্যা বেলা আমায় গেল থইয়া
বিপদে মুর্শিদ ভরসা, বলে পাগল দুর্বিন শাহ্
পাগল মন রে, দয়া হলে নিবে উদ্ধারিয়া রে।।”
দেবব্রত চোখ বুঝে কৃষ্ণার আরতী উপভোগ করতে লাগলো। কি মধুর কন্ঠ। এই মেয়েটা এখনো তার বাড়ির ই বউ। এবং সারাটাজীবন সেটাই থাকবে_____
সকাল ৮টা,
আজ শুক্রবার, কলেজ বন্ধ। সকাল থেকে শাশুড়ী মা এবং কাকী শাশুড়ী মার সাথে রান্নাঘরে কাজ করেছে কৃষ্ণা। অবন্তীকা দেবী খিটখিট করলেও খুব খারাপ ব্যবহার তিনি করছেন না আজকাল কৃষ্ণার সাথে। উনার মুখটাই এমন, যদি ভালোভাবে কেমন আছো ও জিজ্ঞেস করেন তখন মনে হয় ঝগড়ায় নেমেছেন। রান্নাঘরে বউমা, শাশুড়ী মায়ের মোটামুটি দুতিন বার বিশ্বযুদ্ধ হয়েও গিয়েছে৷ হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ পেলে ছুটে যায় কৃষ্ণা দরজা খুলতে। এতো সকালে কারোর আসার কথা নয় তেমন ভাবে। দরজা খুলতেই দেখে……
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি