কৃষ্ণাবতী
১৫ম_পর্ব
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ পেলে ছুটে যায় কৃষ্ণা দরজা খুলতে। এতো সকালে কারোর আসার কথা নয় তেমন ভাবে। দরজা খুলতেই দেখে তার মামা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে। রিপন বাবু কৃষ্ণাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন,
– ভালো আছিস মা?
– মামা, তুমি আসো না ভেতরে আসো৷
রিপন বাবু হালকা ইতস্তত বোধ করছিলেন। তাদের তুলনায় দেবব্রত অর্থের দিক দিয়ে অনেক উপরে। রিপন বাবুর পরণে সাদা কুর্তা, সাদা ধুতি এবং তিন বছর পুরোনো চটি। এতো বড় ঘরের বউ তার ভাগনী। এটা যেনো তার কাছে স্বপ্ন। আরো ইতস্ততবোধ হচ্ছে এতো সকালে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন। না জানি তারা কি মনে করেন। আসলে তিনি রাতেই রওনা দিয়েছিলেন৷ আসতে আসতে সকাল হয়ে গিয়েছে। আজ একটু সকাল সকাল পৌছে গিয়েছেন। কৃষ্ণা তার মামার অস্বস্তি বোধ বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলে,
– উনারা খুব ভালো, কিছুই মনে করবেন না। আসো।
কৃষ্ণার সাড়া না পেয়ে অবন্তীকা দেবী রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন। হিনহিনে কন্ঠে বলেন,
– কে এসেছে কৃষ্ণা?
বসার ঘরে যেতেই অবন্তীকা দেবীর চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠেন,
– এ কি রিপন দাদা তুমি? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম বলো! কেমন আছো?
– এইতো বৌদি ভালো। ক্ষমা করবেন এই সকালে এসে উঠেছি।
– ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন। মনে করতে যাবো কেনো। দাড়ান বাবুর বাবাকে ডাকছি। কৃষ্ণা যাও তো বাবাকেও ডেকে আনো। তুমি এসেছো জানলে বাবা ও কম খুশি হবেন না। আজ কিন্তু থেকে যেতে হবে। কোনো কাজে এসেছিলে বুঝি?
কৃষ্ণাও দেরি না করে শাশুড়ি মায়ের কথা পালনের জন্য ছুটলো। অবন্তীকা দেবীর প্রশ্ন শুনে রিপন বাবু একটু অনুরোধের স্বরে বলে,
– আসলে কৃষ্ণাকে দেখি না তিন মাস হতে চললো, আমার ভাগনী বললে ভুল হবে, ওতো আমার মেয়েই। ওরা তো দ্বিরাগমনেও গেলো না। তাই ভাবলাম যদি তাদের এসে নিয়ে যেতে হয়।
– ভাগনী মানে? কৃষ্ণা?
– হ্যা, বৌদি। আসলে শ্যামলী মারা যাবার পর থেকে ও আমার কাছেই ছিলো। মা মরা মেয়ে, একটু চঞ্চল। ছোট তো। ভুল ত্রুটি করলে ক্ষমা করে দিয়েন বৌদি।
-… …..
– দেবব্রত আমার মেয়েটার জন্য কোনো দেবদূতের চেয়ে কম নয়। আসলে ওদের বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে সেই পরিস্থিতিতে আপনারা তাকে যে মেনে নিবেন এটাই আমাদের জন্য অনেক।
অবন্তীকা দেবী চুপ করে রিপন বাবুর কথাগুলো শুনে যাচ্ছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যেই মেয়েকে বের করার জম্য সে উঠে পড়েছিলেন সেই মেয়ে আর কেউ নয় বরং শ্যামলী সাহার ই মেয়ে। সেই শ্যামলী যার ত্যাগের জন্য আজ তাদের এই অবস্থা। অবন্তীকা দেবী ঘাড় কাত করে কৃষ্ণার দিকে তাকালেন। কৃষ্ণা তখন প্রদীপ বাবু কে নিয়ে বসার ঘরে দিকেই আসছিলো। কি মায়াবী একটা মুখ। তাদের সুখের জন্য মেয়েটি পিতৃস্নেহ থেকে আজ বঞ্চিত। না চাইতেও অতীত তিক্ততা চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে জোর পূর্বক হাসি টেনে বললেন,
– রিপন দাদ বসো। আমি জলখাবার নিয়ে আসছি।
গ্লানিবোধ খুব খারাপ। মানুষের ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খায় এই গ্লানি বোধ। যে মানুষের নিজের অপকর্মের জন্য গ্লানি বোধ হয় না সে হয়তো মানুষ ই নয়_______
বিকেল ৪টা,
নিজের ঘরে ব্যাগ গুছাচ্ছে কৃষ্ণা। মনটা বেশ উচ্ছ্বাসিত। গ্রামে যাবে সে। আহা! কতদিন পর আবার পা রাখবে সেই গ্রামে। মামার সাথে সে এবং তার মাষ্টারমশাই গ্রামে যাবে। খুশিতে আটখানা হয়ে আছে কৃষ্ণা৷ মাষ্টারমশাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে মামা। সে তো যেতেই চাচ্ছিলো না। আজ অনেকদিন পর একেবারে রাঙ্গা বউ সাজবে কৃষ্ণা। একটা লাল জামদানি আটপৌরে করে পড়ে নিলো সে। সিঁথি রাঙ্গিয়ে দিলো লাল সিঁদুরে, হাত ভর্তি শাখা পলা। চোখের নিতে মোটা কাজল, কপালে লাল টিপ। চুলগুলো ছেড়ে দিলো, বেলীফুল থাকলে খোপা করতো। তখনই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। দরজা খুলতেই দেখে অবন্তীকা দেবী একটা বাক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলেন তিনি। কর্কশ কন্ঠে বললেন,
– শোন মেয়ে এদিকে আসো। দেখো তো এই গয়নাগুলোর কোনটা পড়ে যাবে।
– এসবের কি দরকার মা?
– অবশ্যই দরকার আছে। তুমি এই ছ্যাবলার মতো কোনো গয়না ছাড়া যাবে নাকি গ্রামে। লোকে দেখলে বলবে ভটাচায্যিরা এতোই কিপটে যে বউকে গয়নাও দেয় নি। এহহ বুঝি না মনে করেছো! তুমি আসলে আমাদের নাক কাটাতে চাও।
– এ বাবা, আমি কি তা বলেছি।
– তাহলে চুপ করে সামনে বসো। আমি ই বেছে দিচ্ছি।
অগত্যা, চুপ করে কৃষ্ণাকে বসতে হলো। ঘন্টা খানিক লাগিয়ে অবন্তীকা দেবী কৃষ্ণাকে সাজালেন। সাজানো শেষ হলে নিজের ই চোখ ফেরাতে পারছেন না। আহা! ঠিক যেনো কিশোরী অন্নপূর্ণা! চোখের থেকে কাজল নিয়ে ঘাড়ের নিচে দিয়ে দিলেন। কেনো আঙ্গুলে একটু কামড়ে থু থু দিলেন যাতে নজর না লাগে তার ঘরের লক্ষীর। কৃষ্ণা যাতে তার মমতাময়ী রুপ না টের পায় তাই একটু কড়া কন্ঠে বললেন,
– ভেবো না তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমার সাজানোই এতোটা সুন্দর।
কৃষ্ণা কিছুই বললো না, সে জানে তার শ্বাশুড়ি মা একটু অন্যরকম। সে শুধু ঘাড় কাত করে সায় দিলো।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। এখন বের হলে রাতের মধ্যেই পৌছে যাবে গ্রামে। সিগারেটে সুখ টান দিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। তিনদিনের ছুটি পেয়েছে মাত্র। তিনদিন গ্রামে কাটালে মন্দ হয় না। রিপন বাবু গাড়িতে সব মালপত্র উঠিয়ে দিয়েছেন। লোকটা বেশ সাদামাটা সরল প্রকৃতির৷ কৃষ্ণাকে খুব ভালোবাসেন তিনি। তাই তো বারবার তার হাত ধরে বলছিলেন মেয়েটাকে একটু নিজের মতো গড়ে নিতে। দেবব্রত আজকাল সেই প্রচেষ্টায় ই আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণার অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিলো দেবব্রত। তখন নুপুরের রুনুঝুনু কানে বাজে। পেছনে ফিরতেই মনে হলো স্বর্গ থেকে যেনো স্বয়ং লাল শাড়িতে কোনো অপ্সরা ধারাতে অবতরিত হয়েছে। একজন স্নিগ্ধ শান্তি বয়ে গেলো দেবব্রতের মনে। ধীর পায়ে হেটে যখন কৃষ্ণা তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন যেনো এক ঘোরের মাঝে ছিলো দেবব্রত। নেশাগ্রস্ত চোখে শুধু দেখেই যাচ্ছিলো কৃষ্ণাকে। এমনটা তো হবার কথা না। তাহলে কি নিকোটিনের পরিমাণ মাথায় জেকে বসেছে! দেবব্রত খেয়াল করলো, বুকের স্পন্দন বাড়ছে। হার্টবিট যেনো বুক ছিদ্র করে বেড়িয়ে আসবে। এমনটা হবার কথা নয়। আসলে এমনটা হবার কথা নয়। কৃষ্ণা তখন ধীর কন্ঠে বললো,
– যাবেন না?
দেবব্রত কিছু না বলেই ধপ করে গাড়িতে উঠে পড়লো। আজকাল মনটা অবাধ্য হয়ে গেছে। না না পাগল হয়ে গেছে। হয়তো ছ্যাকা খাবার ফলাফল। নাকি অন্য কিছু!
১২.
মাঘ মাসের তৃতীয় দিন। ঠান্ডা বাতাস বইসে, কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। ঘড়ির কাটা নয়টার কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু সূর্যের কিরণ এখনো দেখা যায় নি। খেতের মাঝে চাঁদর মুড়ে হাটছে দেবব্রত। আজ দুদিন হয়েছে তাদের গ্রামে আসা। শিশির ভেজা মাঠে খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা। গ্রামের বাতাসে একটা স্বস্তি আছে যা ইটপাথরের শহরে পাওয়া যায় না। বুক ফুলিয়ে বাতাস নেওয়া যায়। তাদের গ্রামটা সেই পিছিয়ে থাকা গ্রামের মধ্যে একটি। যেখানে এখনো খুব উন্নতি হয় নি। বিদ্যুৎ বলতে সৌর বিদ্যুৎ। সুন্দর সুন্দর ঘর দেখতে পাওয়া যায় না অহরহ। প্রায় মাটির, টিনের ঘর ই বেশি। রিপন বাবুদের ও তেমনই। টিনের ঘর। তবে সামনে বিরাট উঠোন। উঠোনে তুলসি গাছ। বেশ পরিপাটি বাড়ি। হাটাহাটি করে ঘরে ঢুকতে যাবে তখনই একটি খিলখিল হাসি কানে এলো দেবব্রতের। সেদিকে নজর দিলে দেখে কৃষ্ণা শিপ্রাদের সাথে কিতকিত খেলছে। কি উল্লাসিত কিশোরী। শাড়িটা তুলে আচল গুটিয়ে ঘাসফড়িং এর মতো লাফাচ্ছে সে। মনে অজান্তেই দেবব্রত একমনেই দেখতে লাগলো তাকে। ফোনটা বের করে বেশ কটা ছবিও তুলে নিলো। কি সুন্দর মুখখানা। হঠাৎ খেয়াল করলো……
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি