#কৃষ্ণাবতী
৮ম_পর্ব
কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে দেবব্রত। দেবব্রতের নত মাথা দেখে বিদ্রুপের স্বরে তিনি বলেন,
– মাথা নিচু করার মতো কাজ কেনো করো বলো তো? যাক গে, আমি কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। যেই পিতৃপরিচয়ের খোটা তুমি মেয়েটাকে দিয়েছিলে সেই কথাটা স্পষ্ট করে দেবার জন্য এসেছি। যে মেয়েটাকে তুমি অপয়া বলে দাবী করেছো, সেই মেয়েটার বাবা-মায়ের জন্য আজ তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। কথাগুলো এভাবে বলবো সেটা কখনোই চিন্তা করি নি। তোমার বাবা কখনোই চায় নি যে আমি তোমাকে অতীতের কথাগুলি বলি। কিন্তু পাপবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাই তোমাকে এই কথাগুলো বলতে বাধ্য হচ্ছি।
– দাদান একটু খোলসা করবে কি?
প্রদীপ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসেন। লাঠির উপর হাত জোড়া বদ্ধ করে ঠান্ডা গলায় অতীতের গল্পটির পাতা উলটাতে থাকেন। আর দেবব্রত অবাক চোখে নিজের কৌতুহলের অবসানের প্রতীক্ষায় থাকে।
৬.
সাল ২০০২,
জুলাই মাসের শেষের দিক। বৃষ্টির ঘনঘটায় সারাদেশ থৈ থৈ করছে। মিরপুরের দিকের কাহিনীটাই এমন, এক প্রহরের বৃষ্টিও নৌকাবাইচের জন্য যথেষ্ট। সারাদিনের অক্লান্ত বৃষ্টির ফল হাটু অবধি পানি। বাসা থেকে বের হওয়াটাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্যামলী তখন সাত মাসের পোহাতী। অপেক্ষা করছে সোমনাথের ফেরার। সোমনাথ সাহা, শ্যামলীর স্বামী। সোমনাথ নারায়ন বাবুর অফিসের ম্যানেজার। নারায়ন বাবু তখন এতো প্রতিপত্তিশালী ছিলেন না। ছোট ব্যবসা করে তার দিন চলতো। বছর পাঁচেক হলো গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন তারা। তাই সোমনাথের বেতন ও বেশি না। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। তবে সোমনাথের অর্থের অভাব থাকলেও সততার কোনো অভাব নেই। দুকুলের কেউই নেই তার। গ্রামের সরল মেয়েকে মনে ধরে বিধায় বিয়ে করে শহরে নিয়ে এসেছে। ভালোই তো চলছে তাদের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম প্রহারের জানান যে তার ছিলো না। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলী। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতো চললো এখনো বাসায় আসে নি সোমনাথ। চিন্তার ভাঁজ কপালে পড়ছে শ্যামলীর। দিনকাল ও যে খুব ভালো তাও নয়। ক্ষণে ক্ষণে দাঙ্গা ফাসাদ হচ্ছে। এই দাঙ্গা ফাসাদের মাঝে লোকটা যে কোথায় গিয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ায় বুকে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায় শ্যামলীর। দরজা খুলতেই দেখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি টেনে কাকভেজা সোমনাথ দাঁড়িয়ে আছে। মেকি রাগের স্বরে শ্যামলী তাকে বলে,
– এতো দেরি হচ্ছিলো যে! জানেন কতো ভয়ে ছিলাম আমি!
– আমার বাঘিনীর বুঝি ভয় ও হয়?
– হয় না তা? আচ্ছা দেরি হলো যে।
– বড়কর্তার একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম। বড়বাবুর(দেবব্রত) শরীরটা ভালো নেই। তাই সব কাজ সেরে তারপর এসেছি। আর দেশের যা পরিস্থিতি শুধুই দাঙ্গা। রাস্তায় তো নামতে ও ভয় হয়।
– কি হয়েছে বড়বাবুর?
– কি জানি তবে খুব খরচার চিকিৎসা, ভগবান তাকে বাঁচিয়ে তুলুন এটাই কামনা।
– খেয়েছেন?
– উহু, হয় নি। সময় পাই নি। তুমি?
– এখনো না
– সেকি এখন সন্ধ্যে নেমেছে।
– একা একা কি খাওয়া যায় বলুন। এখন তো আপনি এসেছেন, ভাত বেড়ে আনি?
– আনো
সোমনাথের সম্মতি পেয়ে শ্যামলী রান্না ঘরের দিকে গেলো। মাঝে মাঝে সোমনাথের খুব অবাক লাগে, এই কম বেতনের চাকরিতে শ্যামলী কোনো আক্ষেপ করে না। কি সুন্দর করে সবকিছু মানিয়ে হাসি মুখে সংসার করে যাচ্ছে সে। শুনেছিলো অভাব দরজা দিয়ে ঢুকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। অথচ তেমন কিছুই ঘটলো না তাদের বেলায়। অবশ্য বড়কর্তাকে ও দোষ দিতে পারে না। তিনি তাকে নিজের ছোট ভাই এর মতো দেখে এসেছেন। মহাজন ভালো হলে টাকা কম দিচ্ছে তাতে কিছুই যায় আসে না। আকাশ পাতাল ভাবছিলো সোমনাথ। তখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে আসে। এই সন্ধ্যাতে কে এসেছে এটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। দরজা খুলতেই দেখে কাকভেজা নারায়ন বাবু হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
– বড়কর্তা আপনি?
– একখানা বেপদ হয়ে গেছে সোম। তোর সাহায্যের যে খুব দরকার।
– কি বেপদ কর্তা?
– বলার সময় নেই। তোর এখন আমার সাথে যেতে হবে।
– এখন ই?
– হ্যা, এখনই
নারায়নবাবুর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। খুব বড় কিছু না হলে লোকটা এতো ব্যাতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন না। তবে কি দেবব্রতের শরীরটা বেশি খারাপ হয়েছে?
– কর্তা, বড়বাবুর শরীরটা কি ভালো নেই?
এবার আর নারায়নবাবু নিজেকে আটকাতে পারলেন না। হু হু করে কেঁদে উঠলেন। সোমনাথ তাকে ঘরের ভেতরে ঢুকালো। রান্নাঘর থেকে শ্যামলী বেরিয়ে এলো। আকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
– কর্তা আপনি কাঁদছেন কেনো?
– আমার ছেলেটারে বাঁচা সোম। আমার ছেলেটা
– কর্তা কাঁদবেন না, একটু স্থির হন। কি হয়েছে একটু বলুন। নয়তো কিভাবে বুঝবো আমি?
সোমনাথের জোর করায় এবার নারায়নবাবু মুখ খুললেন। গ্লানিবোধে তিনি চোখে চোখ তোলার সাহস পাচ্ছেন না। চাঁপা কন্ঠে বললেন,
– যেই নতুন কাজটা পেয়েছিলাম। তাদের টাকাটা এই সপ্তাহে দিতে হতো। আমার কাছে টাকা নেই রে সোম
– টা…টাকা নেই মানে?
– মানে আছে, কিন্তু দেবব্রতের শরীরটা খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন একটা অপারেশন দরকার। এখন এতোগুলো টাকা কোথায় পাবো বল?
– কিন্তু কর্তা তাদের টাকা ফেরত কিভাবে দিবেন?
এবার নারায়নবাবু চুপ করে গেলেন। কি বলবেন বুঝে উঠছেন না। ইতস্তত করে বলেন,
– দিতে হবে না, আমি তাদের বলেছি টাকাটা চুরি হয়ে গেছে। এ মিথ্যে বলা ছাড়া আমার যে কোনো উপায় নেই রে। আমার ছেলেটা নয়তো মরে যাবে।
– তারা মেনে নিয়েছেন?
শ্যামলী আর সোমনাথ অবাক চোখে নারায়ন বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামলীর বুকটা টিপটিপ করছে। আগাম বিপদের আভাস পাচ্ছে যেনো সে। নারায়ন বাবু ধীর কন্ঠে বলেছেন,
– হ্যা মেনে নিয়েছে। তার জন্য অবশ্য তোর একটা কাজ করতে হবে।
– কি কাজ কর্তা?
– তোর কিছু দিনের জন্য পলাতক হয়ে থাকতে হবে। কারণ আমি বলেছি টাকাগুলো নিয়ে তুই পালিয়েছিস
– এ কি বলছেন কর্তা? কর্তা আমি কখনো আপনাদের সাথে বেইমানি করি নি। আমাকে চোর অপবাদ দিবেন না দয়া করে
– তুই আমার বিশ্বস্ত বলেই তো, তোর কাছে আসা। এমন করিস না। আমার ছেলেটা মরে যাবে সোম। আমার দেবব্রত মরে যাবে। গ্রামের জমি বিক্রি করতে অনেক সময়। আমি কথা দিচ্ছি একমাসের মধ্যে সব ঠিক করে দিবো। আমি তোর পায়ে পড়ছি। সোম, আমাকে সাহায্য কর।
নারায়ন বাবু রীতিমতো সোমনাথের পা জড়িয়ে ধরলেন। সোমনাথ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শ্যামলীর চোখে পানি, যে দোষ তার স্বামী করে নি তার দায়ভার নিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু নারায়ন বাবুর অসহায়ত্বকেও নজর এড়াতে পারছে না। সেও বাচ্চার মা হতে চলেছে; একটা বাচ্চাকে নয় বছর অবধি মানুষ করে তাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে দেখাটা সত্যি ই কষ্টের। নারায়ন বাবু আজ সত্যি ই অসহায়। একমাত্র ছেলে দেবব্রতের হার্টে ছিদ্র ধরা পড়েছে। কলকাতায় নিয়ে অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু আফসোস সেই টাকাটুকু তার নেই। ধার দেনা করেও কিছুতেই জোগাড় করতে পারছেন না। বাবাকে ও বলেছেন কিন্তু গ্রামের জমি বিক্রি করে আর কত দেখে পাবেন!! তার ব্যাবসার এক ক্লাইণ্টের বড় অংকের টাকা তার কাছে রয়েছে। ক্লাইন্টকে সেই টাকাটা ফেরত দিতে হবে। বিনিময়ে তার টাকার কিছু পার্সেন্ট তিনি পাবেন। অসহায়ত্ব, অভাব আর ছেলের করুণ পরিণতি তাকে একটা পাপ করতে উদগ্রীব করছে। সে পুরো টাকাটা দিয়ে দেবের চিকিৎসা করাবেন। ক্লাইন্টকে বলবেন সোমনাথ টাকাটা নিয়ে পালিয়েছে। তাতে কিছু সময় পাবেন। তারপর সেই উছিলায় ইন্সুরেন্সের কিছু টাকাও পাবেন তিনি। কিন্তু সোমনাথের মতো একজনকে এভাবে ফাঁসাতেও তার খুব খারাপ লাগছে। সোমনাথ রাজী না হলে ছেলেটাকে মরতে হবে। সোমনাথ এবার ধীর কন্ঠে বললো,
– কর্তা আমার ও বাচ্চা আসছে। আমি যদি চোর অপবাদ নিয়ে পালিয়ে থাকি তবে তাকে কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে বলুন? আর যদি আমার বাচ্চাটি মেয়ে হয় তবে!
– কিচ্ছু সহ্য করতে হবে না আমি বলছি। আমি শ্যামলী আর তোর অনাগত সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছি। শুধু এক-দুই মাসের ব্যাপার৷ আর আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোর ছেলে হলে আমি দেবের মতো তাকে মানুষ করবো। আর মেয়ে হলে আমার দেবের বউ করে নিজের বাড়ির বড় বউ করবো। আমার মুখের কথা রইলো তোমাদের কাছে।
– কিন্তু…
এবার শ্যামলী সোমনাথকে ডেকে বললো,
– এক-দুই মাস ই তো। আমরা বরং গ্রামে চলে যাই। কর্তার সমস্যা দূর হলে উনি আপনার নামের চোর অপবাদ ও সরিয়ে দিবেন। কর্তা আমাদের মহাজন। তার নুন খেয়েছি। আজ সে বিপদে পড়েছেন এটুকু করতে পারবো না আমরা? আমাদের ও তো সন্তান আসছে। সন্তান হারানোর কষ্ট কেউ পাক এটা আমি চাই না।
– শ্যামলী, তুমিও
– হ্যা আমি ই বলছি। মানা করবেন না।
শ্যামলীর কথায় যেন নারায়ন বাবু আশ্বস্ত হন। সোমনাথ শ্যামলীকে খুব ভালোবাসে, সে যে শ্যামলীর কথা রাখবে এটা যেন বেদবাক্য। সোমনাথ আর কথা বাড়ালো না। শ্যামলী যখন নারায়ন বাবুকে সাহায্য করতে চাচ্ছে, তার আপত্তির তো কারণ নেই। আর নারায়নবাবুকে নিজের বড় দাদার মতো করে দেখে সে। তার ছেলের এতো বড় বিপদে চুপ থাকা তার পক্ষেও সম্ভব নয়। সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার উছিলায় ওই বাচ্চাটার জীবন বাঁচিয়ে দিবে। সোমনাথ নারায়নবাবুর কথায় রাজী হয়ে গেলো। শ্যামলীর হাতজোড়া ধরে মাথানত করে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলেন,
– বোন আমার, তোমার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবো না। তোমার এই দাদা আজ তোমার থেকে তোমার অনেক বড় সুখ দাবি করে ফেলেছে।
– বোন ও বলছেন আবার ঋণের কথাও তুলছেন। এভাবে ছোট করবেন না কর্তা। আমার জায়গায় আপনি হলেও তাই করতেন।
প্রথমে যদিও সোমনাথের সাথে শ্যামলীর গ্রামে যাবার কথা ছিলো। পরে তা বদলায়। ওই রাতে সোমনাথকে উত্তরবঙ্গের বাসের টিকিট ধরিয়ে দেন নারায়নবাবু। সেই ঝড়ের রাতেই পুটলি গুছিয়ে আর হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে পাড়ি দিতে হয় সোমকে। সোমনাথ যাবার বেলায় শ্যামলীর মুখখানা হাতের আদলে নিয়ে আদুরে গলায় বলে,
– চিন্তা করো না, আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো। দেখো। আমাদের মেয়ে হলে তার নামটা কৃষ্ণা রেখো। আমাকে চিঠি লিখো। আমি একটা থাকার ব্যাবস্থা করেই তোমাকে ঠিকানা জানিয়ে দিবো। নিজের খেয়াল রেখো। আর আমার জন্য অপেক্ষা করো।
শ্যামলী তখন মুখে আঁচল চেপে শুধু অশ্রু ঝড়ায়।সোমনাথ নারায়ন বাবুর হাত ধরে বলে,
– কর্তা, প্রার্থনা করি যাতে বড়বাবু ঠিক হয়ে যায়। শুধু একটা আবদার, আমার বউ বাচ্চাকে একটু দেখবেন।
– ধুর বোকা, সে দেখবো না আমি? তুই নিশ্চিন্তে যা। দেখিস সব ঠিক করে দিবো এক মাসে।
– আসি শ্যামলী
এটা তাদের শেষ কথোপকথন ছিলো। নারায়নবাবু পরদিন সকালেই শ্যামলীকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। ভেবেছিলেন তার হিসেব অনুযায়ী ই সব হবে। কিন্তু পরদিন খবরে আসে, উত্তরবঙ্গে যাওয়া কিছু বাসে দাঙ্গাকারীরা আগুণ ধরিয়ে দিয়েছে। তাতে অনেক যাত্রীও মারা গেছেন। সোমনাথকে না ভেবে নারায়ন বাবু কলকাতা যাবার ব্যাবস্থা করেন। এদিকে সোমনাথকে পুরো আটঘাট বেধেই চোর প্রমাণ করেন তিনি। তাতে বড় অংকের একটা টাকাও পান তখন। তা নিয়ে ক্লাইন্টকে শোধ করে নিজের সম্মান ও রাখেন। মাঝ থেকে সোমনাথ চোর প্রমাণ হয়ে যায়। তার এরুপ অসদউপায় প্রদীপ বাবুর একদম ই পছন্দ হয় নি। কিন্তু ছেলেকে বাধা দেবার উপায় ও নেই। দেবব্রতের চিকিৎসা শেষে দু মাস পর দেশে ফিরেন নারায়ন বাবু। ততদিনে কৃষ্ণাও জন্ম নেয়। শ্যামলী সোমনাথের কোনো খোঁজ না পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে যায়। গ্রামের সবাই বলতে থাকে সোমনাথ তাকে ভোগ করে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সে তো জানে সোমনাথ তাকে ছেড়ে কেনো গিয়েছে। সময় যেতে থাকে। প্রদীপ বাবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন সোমনাথের খোঁজ নিতে। তখন না টেকনোলজি ভালো ছিলো, না মোবাইল ফোন সচারাচর দেখা যেত; তাই তারা ধারণা করেন সেই রাতের বাস দূর্ঘটনায় হয়তো সোমনাথ মারা গেছে। শ্যামলীকে এই কথা জানাবার পর ও সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। তার ধারণা সোমনাথ তার সিঁদুরের জোরে ঠিক ফেরত আসবে। সময়ের টানে সোমনাথেরও আর ফেরা হলো না। নারায়নবাবুর ব্যাবসা দিনদিন বড় হতে থাকে। অর্থের দাপটে সোমনাথের ত্যাগের কথা যেনো ভূলেই যান তিনি। প্রদীপ বাবুই কেবল এটা ভুলতে পারেন নি। শ্যামলী এবং কৃষ্ণাকে সকলভাবেই সহায়তা করেন তিনি। শ্যামলীর মৃত্যুর পর নারায়ন বাবু যেনো তার কথা থেকেও মুক্তি পেয়ে যান। তিনি দেবব্রতের বিয়ে সৌদামিনীর সাথে ঠিক করেন। কিন্তু ভাগ্যের ফের। সেই সোমনাথের মেয়েকেই তার ছেলে পুত্রবধু রুপে বাড়ি নিয়ে এসেছে। কি অদ্ভুত না!!!
প্রদীপ বাবুর চোখ ছলছল করছে। আজকের এই প্রতিপত্তির পেছনে কোথাও না কোথাও দুটো জীবন কত ত্যাগ না করেছে। দেবব্রতের চোখ স্থির। অজান্তেই চোখ ভিজে আসছে। আজ তার এতো সুন্দর জীবনের পেছনে কৃষ্ণার সকল সুখের আহুতি হয়েছে। কৃষ্ণার ভাগের সব সুখগুলো কেড়ে তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন নারায়ন বাবু। প্রদীপ বাবু উঠে দাঁড়ালেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
– হয়তো পাপের ঘড়াটা আমরা ভরেছি, মাশুল তোমায় দিতে হচ্ছে। পারলে ক্ষমা করো। আসছি।
ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে চা হাতে বসে রয়েছেন অবন্তীকা দেবী। মাথায় আচল টেনে ট্রাংক হাতে গড় প্রণাম করলো কৃষ্ণা তাকে। হঠাৎ এভাবে গড় প্রণাম করতে দেখে বেশ অবাক হলেন তিনি। হতচকিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,
– এই মেয়ে কি করছো তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি?
– না না মা, আমি তো চলে যাচ্ছি। তাই আশীর্বাদ নিয়ে এসেছি।
– চলে যাচ্ছো মানে? কোথায় যাচ্ছো?
– দাদানের সাথে গ্রামে, একেবারের জন্য
কৃষ্ণার কথায় বেশ চোখমুখ চকচক করে উঠলো অবন্তীকা দেবীর। হিনহিনে গলায় বললেন,
– যাক বাবা, আপদ বিদেয় হচ্ছে। বাবার সুমতি হয়েছে।
কৃষ্ণার কথাটা ভালো লাগে নি। একটু কষ্ট ও লেগেছিলো। কিন্তু কিছু বললো না। সবার কাছ থেকে একে একে বিদেয় নিলো। অন্নার মনটা বেশ খারাপ। তার সই চলে যাচ্ছে বলে কথা। ততক্ষণে প্রদীপ বাবুও চলে এলেন। কৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– সব নিয়েছিস?
– হ্যা, দাদান
নারায়ন বাবু এগিয়ে এসে বললেন,
– বাবা, থেকে গেলে হতো না?
– না নারায়ন, এই মেয়েটাকে এই দুদিনে কম অপমান তো করো নি। এর চেয়ে বরং আমি তাকে গ্রামেই নিয়ে যাই। কি হবে বড়ো জোর। একটু কটু কথাই শুনবো। তাতে কিছুই হবে না। আসছি।
মাথা নত করে ফেললেন নারায়ন বাবু। কৃষ্ণা মেয়েটার মাঝে সোমনাথ এবং শ্যামলীর ছায়া দেখতে পান তিনি। ভালোই হচ্ছে, গ্লানিবোধ থেকে রক্ষা পাবেন। যাবার বেলায় কৃষ্ণার চোখ শুধু ফিরে ফিরে তার মাষ্টারমশাই এর রুমের দিকে তাকাচ্ছিলো। একটা বার শেষ দেখা দেখতে পেলে মন্দ হতো না। পরমূহুর্তেই নিজেকে নিজে কড়া শাসন করে দিলো কৃষ্ণা,
– এতো বেহায়া তো তুই ছিলি না কৃষ্ণা। ভোরের অপমান সব গুলে মেরে দিলি? তার তো সুবিধাই হচ্ছে, তুই গেলে দিদিমনির সাথে ঘর বাঁধতে পারবেন। তোকে শেষ দেখা দিতে তার বয়েই গেছে।
হঠাৎ করেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো কৃষ্ণার। না বুঝেও তার মাষ্টারমশাইকে মন দিয়ে দিয়েছে যে সে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো মনটা বারে বারে হাহাকার করছে। বিদ্রোহ করছে। দাদানের পিছু পিছু ঘরের চৌকাঠ পার হবে ঠিক তখনই………
চলবে
( পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ কালকে রাতে দিবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না)
মুশফিকা রহমান মৈথি