কেন এমন হয় পর্ব-১

অনেক লোক আতঙ্ক, উত্তেজনা আর কৌতুহল নিয়ে বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে।কেউ আফসোস করছে,আহারে কি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা!কেউ উপদেশ দিচ্ছে,কি ব্যবস্থা নিলে এরকম হতো না।কেউ বা জানতে চাইছে কি হয়েছে?
‘চারতলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মা আর মেয়ে দুজনেই মারা গেছে।’

ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ,যেই চার তলার কথা বলা হচ্ছে সেখানকারই বাসিন্দা আদনান আর ছেলে আহনাফ।
এ সব কথা শুনে আদনানের মনে হচ্ছে-
যত্তসব আজগুবি কথা বলছে সবাই,এটা কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা হলো ! ছেলে আহনাফকে নিয়ে বাজার করার জন্য কারওয়ান বাজারে গেল এই ঘণ্টা দেড়েক হবে। আহনাফ বাজারে যাওয়ার জন্য খুব জেদ করছিল,তাই ওকে নিয়ে গেল।
এ সব কথা বিশ্বাস করার মানে হয়?
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়েছিল রিয়া আর বলেছিল,’আমার বাবাটা কত বড় হয়ে গেছে , আমাদের জন্য বাজারে যাচ্ছে কেনাকাটা করতে!আর মনে পরে যাওয়ার ভঙ্গিতে রিয়া আদনানকে বলেছিল,’ বাইম মাছ পেলে, নিয়ে এসো তো।অনেক দিন বাইম মাছ খাওয়া হয় না।আম্মার হাতের বাইম মাছ ভুনা কি যে মজার হয়!আহ্।
মনে করে নিয়ে এসো।’
আদনান হেসে বলেছিল-,’তুমি বলেছ যখন, যেখান থেকে পারি নিয়ে আসবো।’
দুষ্টুমি করে আরো কিছু বলতে চেয়েছিল,ঐ সময় বাবু কেঁদে উঠাতে রিয়া তারাতাড়ি দরজা লাগিয়ে বাবুর কাছে চলে গিয়েছিল।

আদনানকে দেখেই জাফর ভাই এগিয়ে এসে বলল –
— আদনান ভাই আপনি আসছেন? দারোয়ান বলল, বাজারে গেছেন ,এই বাজারে গিয়ে কেউ খুঁজে পেল না আপনাকে। আপনার মোবাইল কোথায়?এত বার রিং দিলাম ধরেন নি। কি ভাবে যে কি হয়ে গেল?

অসম্ভব ভালো মানুষ তিনি, প্রতিবেশী হিসেবে ও চমৎকার । আদনান ভেবে পাচ্ছে না, তিনি কিভাবে এ সব অবাস্তব কথা বলছেন!
কিন্তু জাফর ভাইয়ের গলা কাঁপছে,ভেতর থেকে যেন কথা আঁটকে আঁটকে আসছে।

আদনানের মনে পড়ল ভুলে মোবাইল বাসায় রয়ে গেছে।
কিন্তু এরা এ সব কি বলছে?এটা কি ভাবে সম্ভব ?উপরে তাকিয়ে দেখলো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতক্ষণে মাথার ভেতর থেকেও ধোঁয়া বের হতে লাগলো,একটা বিপদের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো।
মাঝে মাঝে রিয়া চুলায় রান্না রেখে ভুলে যায়,হয়তো সেটাই পুড়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
বাজারের ব্যাগ ফেলে আদনান দৌড়ে উপরে উঠতে চাইলে কয়েকজন ওকে ধরে আটকালো।
ছয় বছরের আহনাফ, কি হয়েছে বুঝতে পারছে না।ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।একসময় আদনানকে জিজ্ঞেস করে-
—কি হয়েছে বাবা?সবাই কি বলছে?
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ,মনে মনে বলল,’যা কিছু শুনছি সব কিছু যেন মিথ্যে হয়,যা শুনছি যেন মিথ্যে হয়।’
আদনান আবারো ভিতরে ঢুকতে চাইলে , পরিচিত জনেরা তাকে ঢুকতে দিল না। পুরো বিল্ডিংয়ের বারোটি পরিবারের সবাই এখন নিচে।ছয় তলার ভাবি আহনাফকে কোলে নিয়ে বসে আছেন।সবাই আদনান আর আহনাফ কে ঘিরে আছে।
ফায়ার সার্ভিসের লোক , ছুটির দিন হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছে। কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
মিথ্যে হয়নি, সবকিছুই নির্মম সত্যি।সাত বছরের সংসার জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী,ভালোবাসাময় স্ত্রী রিয়া আর এগারো মাস বয়সী মেয়ের লাশ দেখেও বিশ্বাস হলো না আদনানের। পুড়ে যাওয়া বিকৃত ওরা তো আদনানের পরিচিত কেউ না।ওরা যেন বড্ড অপরিচিত জন।
গ্রামের বাড়িতে আদনানদের পারিবারিক গোরস্থানে ওদের দাফন করা হলো।
পরিবার, প্রতিবেশী যে যখন যেভাবে পারে বোঝায়,’যা হবার তা তো হয়েই গেছে, ছেলের কথা চিন্তা করে হলেও স্বাভাবিক জীবনে তো ঢুকতে হবে।’
আদনান ভাবে, ছেলেকে নিয়ে ঐ বাসায় ঢুকে দম তো বন্ধ হয়ে যাবে।প্রতিটা কোনায় রিয়ার প্রতিধ্বনি, প্রতিটা জিনিসে ওর ছোঁয়া, বাবুর কলকলানি,এ সব এখন শুধুই স্মৃতি । দুঃসহনীয় স্মৃতি।

রেডি ফ্ল্যাটটা কেনার আগে,দেখতে এসে খুব পছন্দ হয় রিয়ার। বাচ্চা মেয়েদের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল আর বার বার বলছিল,’ নিজেদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে ,ভাবতেই কি যে ভালো লাগছে।
দখিনের বারান্দায় বসে দুজনে বিকেলে চা খাবো, বৃষ্টির ঝাপটায় ভেজানো চোখের পাতায় , তোমার চোখে চোখ রেখে বলবো, ভালোবাসি।ঠিক তখনই আহনাফ এসে বলবে মা-বাবা তোমরা কি করছ? তখন ওকে কোলে তুলে নিয়ে দু’জনেই হেসে উঠবো।’
কিন্তু যখন শুনলো সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হবে তখন আপত্তি করল রিয়া।আমি বোঝালাম, এখন যেখানেই ফ্ল্যাট কিনি না কেন সিলিন্ডারই ব্যবহার করতে হবে, সরকারি লাইনের গ্যাসের অনুমতি নেই।
রিয়ার মনের এ সব ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাসাটায় উঠতেই আবার কনসিভ করলো রিয়া । শরীর ভালো লাগতো না।এর পর মেয়ে হলো ,আহনাফ খুব বিরক্ত করত, মনের মত গুছাতেও পারেনি বাসাটা।ঐ সময় রিয়ার বোন হিয়া মাঝে মাঝে থেকে হেল্প করতো। আহনাফ ও হিয়ার খুব ভক্ত।খালামনি বলতে অজ্ঞান।খালামনিকে সে খামমনি ডাকে। এ সব ভাবতে ভাবতে আদনানের চোখ ভিজে ওঠে।

আদনানের মনে হয় কেন যে কিনতে গেলো ,এই ফ্ল্যাট।মনে হয় যদি পেছনে যাওয়া যেত,তাহলে এমনটা হতো না। কখনো কিনতো না ।কোন লিক্ তো সিলিন্ডারে ছিল না,গ্যাসের গন্ধ ও তো নাকে লাগে নি কখনো, তাহলে হঠাৎ করে কিভাবে এমন হলো?

আদনানের আম্মা-আব্বা, শ্বশুর-শাশুড়ি ,বোন আরো অন্য আত্নীয়রা মিলে আদনানের সাথে কথা বলতে বসেছে। নানান কথার মাঝে আদনানকে আবার বিয়ে করানোর কথাটাই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল।

আদনান সবাইকে বলল-
—এখন যদি রিয়ার জায়গায় আমি মারা যেতাম, তাহলেও কি একই কথা হতো?স্ত্রী মারা যাওয়ার একমাস না পেরুতেই স্বামীর বিয়ের কথা শুরু হয়ে যায়,কত অজুহাতে! আবার কোন বিধবা স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে হলে এই সমাজ বাঁকা চোখে দেখে।কি আশ্চর্য বাঁকা চোখে দেখা , মানুষের সৃষ্টি , এই বাঁকা সমাজ!

আদনানের আম্মা বললেন-
—বাবা ,আহনাফের কথা তো ভাবতে হইবো। তুই অফিস গেলে কে দেখব?তোর আব্বা তো ঢাকা গিয়া থাকতে চায় না।আর আহনাফরে এইখানে রাখার মত পরিবেশ তো নাই ।
এ সব প্রশ্নের উত্তরে আদনান কিছুই বলল না,আসলে এ সবের উত্তর তার ও জানা নেই।

একজন বলল,’মানুষের একজন সঙ্গীর তো দরকার আছে।’
এই কথায় আদনান উত্তর দেয় না, মনে মনে ভাবে-
মানুষের জৈবিক চাহিদার কন্ট্রোল সম্পূর্ণ নিজের কাছে। নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পারলে মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কি? প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে হারিয়ে এই চাহিদা তার কাছে খুবই গৌন এখন , কিন্তু আহনাফ কে দেখাশোনার জন্য একজন লোক তো পেতে হবে।কোন মহিলা তো যাবে না, একজন পুরুষ পাওয়া গেলে তবুও একটা উপায় হয়।
এই প্রস্তাবটাই সবার সামনে উপস্থাপন করলো আদনান।
আহনাফ কে দেখাশোনার জন্য সবাই মিলে একজন উপযুক্ত লোক খুঁজতে লাগলো । কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
আদনানের শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো।যে কোন সময় আসা -যাওয়া করতে পারে। আহনাফের খাওয়া,গোসল, দেখাশোনা সবকিছুই এখন হিয়া করছে।
হিয়া বাংলায় অনার্স করছে, রিয়ার বাসা থেকে ভার্সিটি অনেক দূরে হয়ে যাওয়াতে, যাতায়াতের কষ্ট হয়ে যেতো তাই বেশির ভাগ সময় হলেই থাকতো হিয়া।তবে রিয়া আসার জন্য বললেই এসে হাজির হতো।রিয়া হয়তো টাকি মাছের ভর্তা বানিয়েছে বলতো, ‘হিয়া আয়’ কিংবা ‘আজ তোর ভাইয়াকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাবো বাবুদের তোর কাছে রেখে ,আয়’,এমনি হিয়া হাজির।বোন দুজন ছিল বন্ধুর মতো।তবে দুইবোনের বিপরীত স্বভাব।হিয়া খুব চুপচাপ, শান্ত।বোনকে হারিয়ে আরো যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে।
গ্রামের একজন, সম্পর্কে দাদি হয়,কথাটা সেই প্রথম উঠালো-আহনাফের উপযুক্ত মা হবে হিয়া। সারাজীবন তো একা থাকবে না আদনান। একসময় না একসময় বিয়ে করবে, তখন ছেলেটার কষ্ট হবে।কেমন না কেমন মেয়ে কপালে জোটে?এর থেকে নিজের খালাই সৎ মা হোক,এটাই অনেক ভালো।

চলবে..

  • #কেন এমন হয়
    পর্ব-১
    ফাহমিদা লাইজু

২য় পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1199428647238827/

৩য় পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1200056127176079/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here