||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১৬||
প্রহেলির হাতটা শক্ত করে ধরে দিব্য। হাতটা যেন ভরসা দিয়ে বলছে, “ভয় পেও না চন্দ্রমল্লিকা, আমি তো আছি। তোমার কিচ্ছু হতে দিব না। সব ঠিক করে দিব।”
তার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে মুখের উপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। দিব্য তার দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করে।
নাহিয়ান প্রহেলির সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, “আমাকে বিয়ে করেছ, এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে তার জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছ! তোমার কী একটুও মন কাঁদে না? আমি তোমার থেকে আলাদা হয়েছি এর মানে এই নয় যে তোমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছি। আমার ভালোবাসার ভিক্ষে চাচ্ছি তোমার কাছে, ফিরে এসো প্লিজ।”
নাহিয়ানের চোখে জল। প্রহেলি কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি। নাহিয়ানের চোখের জল তার ভেতরটাকে যেন ভেঙেচুরে দিচ্ছে। তার চোখেও জল টলমল করছে। চোখের পাতা এক করলেই তারা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। মায়ের দিকে দৃষ্টি পড়তেই বুকটা ধরে আসে তার। আরফা খাতুন হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। পরক্ষণেই শামসুল গাজীর দিকে তাকায়।
তিনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, “এসব কী বলছে মামণি? আমরা তো তোমার পছন্দ মেনে নিয়েছিলাম। চেয়েও ছিলাম তোমাকে তোমার পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। তুমিই তো বললে এই ছেলে তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে। এখন সে এসব কেন বলছে? কিসের বিয়ের কথা বলছে সে?”
প্রহেলির গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। বাবার কথার উত্তর কীভাবে দেবে সে! সেদিন যে নাহিয়ান এই বিয়েকে অস্বীকার করেছিল, মিথ্যে বলেছিল আজ আবার সেই বিয়ের দোহাই দিতে এসেছে। সে আসলে কী চায়!
প্রহেলি কিছু বলার আগে নাহিয়ান আরেকটু কাছে যায়। প্রহেলির হাতটা ধরতে চাইলেই দিব্য তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মাথাটা নিচের দিকে নিয়ে ভ্রু চুলকে বলে, “কিসের বিয়ের কথা বলছেন আপনি? কিসের ভিত্তিতে বলছেন? আপনার কাছে কী কোনো প্রমাণ আছে?”
নাহিয়ান দু’কদম পিছিয়ে যায়। কোনো কথা না বলে পেপারটা সামনে ধরে। দিব্য পেপারটা হাতে নিয়ে এক পলক দেখে নেয়৷ তারপর মোবাইল বের করে কাকে যেন কল করে বলে চলে আসতে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে একজন কালো কোট পরা ব্যক্তি এসে হাজির হোন। মনে হচ্ছিল তিনি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই হতবাক হয়ে আছে। এখানে কী হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না৷
কালো কোট পরা ব্যক্তি পেপার চেক করে বললেন, “পেপারটা নকল। এই বিয়ে হয়নি। তাছাড়া এখানে কনের সাইনও তো নেই৷ নিশ্চয়ই উনার মাথা নষ্ট তাই এসব উলটা পালটা কথা বলছেন।”
নাহিয়ান তেড়ে এসে বলল, “কীসব আজেবাজে কথা বলছেন? আমার আর প্রহেলির বিয়ে হয়েছে। রাহী দেখ কী বলছে এরা!”
উকিল বন্ধুর দিকে তাকায় সে। পেপারটা টান দিয়ে নিজের হাতে নিয়ে দেখে আসলেই প্রহেলির সাইন নেই কাগজে। এটা দেখামাত্র তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। কীভাবে হয়ে গেল এটা! রাহীর কাছে ছুটে গিয়ে পেপার দেখায়।
সে দেখে বলল, “এই একটা কপিই ছিল যা আমি তোকে দিয়েছিলাম। তুই কী করেছিস আমি তো জানি না। দেখ আমার যা করার আমি করেছি। এখন এসব তোর ব্যক্তিগত বিষয় আমি এসবে নেই। আমি বরং আসি এখন।”
কথাটা বলে রাহী এক পলক দিব্যের দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। প্রহেলি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিব্যের দিকে। সাইন তো সে নিজ হাতেই করেছিল। তাহলে পেপারে কেন সাইন নেই! কীভাবে কী হয়ে গেল সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
দিব্য ক্ষীণ হেসে বলল, “আমি জানি আপনি স্কুল লাইফ থেকেই প্রহেলির সর্বনাশ করার একটা সুযোগও হাতছাড়া করেননি। কিন্তু এবার আর সেই সুযোগ পাবেন না মি. নাহিয়ান। আপনি এখন এখান থেকে যাবেন নাকি আমি পুলিশ ডাকবো? আশা করি আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে।”
নাহিয়ান গর্জে উঠে বলে, “আমার সাথে বেঈমানী! তুই তোর ক্ষমতা খাটিয়ে এসব করেছিস তাই না? আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। যে বা যারা জড়িত আছে এই প্রতারণায় আমি তাদের কাউকে ছাড়বো না।”
শামসুল গাজী এগিয়ে বলেন, “ভদ্রভাবে কথা বলো। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।”
“বাবা তুমি একে ভদ্রতা শিখিয়ে লাভ নেই। এই শালা ভালো কথা কানে নেওয়ার নয়। একে তো আমি তার মতো করেই সোজা করবো।”, বলেই প্রান্ত নাহিয়ানের কলার ধরে টেনে নিয়ে যায়।
নাহিয়ান কোনোমতেই যেতে চাচ্ছে না। দরজার কাছে এসেও চিৎকার করে বলছে, “প্রহেলি প্লিজ ফিরে এসো, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমাকে একবার ক্ষমা করে দাও। ভুল করেছি আমি আর কখনো হবে না। তুমি চাইলে সব ঠিক করে দিব আমি।”
প্রহেলি কেবল তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে। না পারছে নাহিয়ানকে আটকাতে আর না পারছে কোনো কথা বলতে। মনে হচ্ছে বুকের উপর ভারি কোনো পাথর রাখা। এতকিছুর পরেও সে নাহিয়ানকে ভুলতে পারছে না। বারবার ইচ্ছে করে তার কাছেই ছুটে যেতে। কিন্তু সে এখন আর চাইলেও তা করতে পারবে না। ভালোবাসার উপর থেকে একবার বিশ্বাস উঠে গেলে তা আর ফিরে আসে না। তাছাড়া প্রহেলির কাছে তার বাবা বড় ভালোবাসার মানুষ নয়।
দিব্য প্রহেলির হাতে আংটি পরানোর জন্য বক্স খুলতে গেলেই তার মা বলেন, “বাবা, আরেকবার ভেবে নে। যা কিছু রটে তার কিছু তো ঘটে। পরে যেন তোকে পস্তাতে না হয়। মা হয়ে ছেলের ভালোই চাই আমি।”
দিব্য তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “যা ভাবার তা অনেক বছর আগেই ভেবে নিয়েছিলাম না। এখন কেবল তা আমলে নিচ্ছি। তোমাদের দোয়া থাকলেই হবে আর কিছু চাই না। জেনে রেখ তোমাদের ছেলে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।”
মৃদু হাসেন তার মা। ছেলের খুশিতেই তার খুশি। সন্তান বড় হয়ে গেলে কোনো বিষয়ে জোড়াজুড়ি করতে নেই। তাদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। তবে তিনি এই বিয়েতে যে খুব খুশি তাও নয়। তবুও ছেলের মন রাখতে রাজী হয়েছেন।
আংটিটা সামনে ধরে জিজ্ঞেস করে, “আংটি পরানোর অনুমতি কী পাওয়া যাবে মহারানী?”
প্রহেলি খালি গলায় ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। সাথে সাথে দিব্য আংটিটা পরিয়ে নেয়। প্রহেলিও তাকে কম্পিত হাতে আংটি পরায়। ফটোগ্রাফার ইচ্ছেমতো ছবি তোলে তাদের। খাওয়া-দাওয়ার অধ্যায় শুরু করতেই প্রহেলি বারান্দায় চলে যায়। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না তার। কেমন দম বন্ধ লাগছে। একটু বাইরের বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চায়। দিব্য এসে তার পাশে কখন দাঁড়ায় সে খেয়ালই করেনি। প্রহেলি চোখ বন্ধ করে বাইরের হিমেল বাতাস অনুভব করছে। দিব্য তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর, নিষ্পাপ মুখখানা। ইচ্ছে করছে এখনই ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সেই অধিকার বা অনুমতি কোনোটাই এখনো তার হয়নি। তবে আজকে তো প্রহেলিকে অর্ধেকটা নিজের করে নিয়েছে এই সপ্তাহেই সে তাকে পুরোটা নিজের করে নেবে।
“ভালোবাসি…চন্দমল্লিকা”
কেঁপে উঠে চোখ মেলে তাকায় প্রহেলি। কেমন নেশা ধরানো কণ্ঠে ভালোবাসি কথাটা শুনছে সে। কত জীবন পর শুনেছে তাও মনে নেই। বুকের ভেতর একটা শীতল অনুভূতি বয়ে যায়।
“তুই যা করছিস তা কী ঠিক করছিস? এসব কীভাবে করলি? আর এসবের মানেই বা কী? কেন এমন করছিস?”
“বিয়ের পরেও কী আমাকে তুই করে বলবে?”
“সবসময় প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন কেন করিস? কখনো উত্তর দিলেও তো পারিস।”
“একটা জিনিসের অনুমতি দিলে উত্তর দিব।”
“কিসের অনুমতি?”
দিয়ান তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “একটু ছুঁয়ে দেওয়ার।”
প্রহেলির হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। খানিকটা দূরে সরে যায় তার থেকে। দিব্য আরো কাছে এগিয়ে যায়। এভাবে অনুমতি চাইলে কী উত্তর দিতে হয় সে জানে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দিব্য তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের উপর রাখে।
“আমার হৃদস্পন্দন কী শুনতে পাও না তুমি? প্রতিটি স্পন্দন কেবল প্রহু প্রহু বলে। আমি তোমাকে প্রহু বলে ডাকতে চাই। কিন্তু কেন জানি পারি না আমি। কিসের একটা বাঁধা কাজ করে। সত্যি বলছি প্রহু, তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
দিব্য তার আরো কাছে আসে। প্রহেলি পেছনে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। দু’হাতে আগলে দাঁড়ায় সে।
প্রহেলি ইতস্তত করে বলল, “দেখ, আমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করিস না। আমি শুধু আমার পরিবারের কথা ভেবে এই বিয়েতে মত দিয়েছি। তোকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবো না আমি। এমনকি আমার থেকে কোনো আশাও রাখিস না তুই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে আমি নাইয়ানকে ভালোবেসেছি আর তাকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি ভার্জিন নই।”
দিব্য আরো কাছে এগিয়ে আসে। একদম মুখের কাছে আসতেই প্রহেলি দু’হাত তার বুকের উপর রেখে নিজের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। বাঁধা দিতেই হোক, প্রহেলি তাকে স্পর্শ করেছে। অন্তত এই আনন্দ নিয়ে সে আরো কয়েক বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। এভাবে যদি প্রতিদিন একবার ছুঁয়ে দেয় তাহলে প্রতিদিন সে একবার করে কাছে আসবে। তাতে সে তাকে খারাপ ভাবলে ভাবুক।
দোলা হুড়মুড়িয়ে বারান্দায় ছুটে আসে। সাথে সাথে সে প্রহেলিকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। ছোট বোনের সামনে এভাবে ধরা খেতে হবে ভাবেনি সে। লজ্জায় মুখটা আরক্ত হয়। প্রহেলি ভাবে সে এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। কিন্তু দিব্য যে অন্য কিছু ভেবে রেখেছে তা সে আঁচও করতে পারেনি।
দুইদিন পর তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। দিব্য দেরি করতে চাচ্ছে না। সবাই প্রথমে এতে রাজী হচ্ছিল না কিন্তু কনেপক্ষের দিক থেকে প্রান্ত আর বরপক্ষের দিক থেকে সোহেল রহমান রাজী হয়ে যান। তারা সবকিছু সামলে নেবে। একদিনেও বিয়ে সম্ভব। প্রহেলির মাথাটা ঝিম ধরে আছে। কেমন দ্রুত সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল কিছুই বুঝতে পারছে না। দিব্যকে সব সত্য বলার পরেও কেন এই বিয়ে করতে সে রাজী হলো। একটু বসে কথাও বলতে পারে না। সবাই বিদায় নিচ্ছিলেন। তখন দিব্য বলল, প্রহেলির সাথে দুইটা কথা বলতে চায় সে। এটা কেন জানি আশ্চর্যকর একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ কোনো কথা না বলে যাওয়ার সময় কথা বলতে চাচ্ছে। দিব্যকে কথা বলার জন্য প্রহেলির সাথে তার রুমে পাঠানো হয়।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা