||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১১||
“কথা দিয়ে মানুষ কেন কথা রাখে না?”, দিয়ানের প্রশ্নে কেঁপে উঠে প্রহেলি।
চুপচাপ বসে মোবাইল টিপছিল সে। আচমকা তার কণ্ঠস্বর শুনে ভয় পেয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে নেয়। সাদা একটা পাঞ্জাবির উপর কালো রঙের কটি পরেছে। চোখে কালো ফ্রেমের সাদা চশমা। দাড়ি রাখলে আরো আকর্ষণীয় লাগতো তাকে। এখন তো তাকে নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে মনে হয় তখন পুরুষ মনে হতো। আশেপাশের অনেক মেয়ে তার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। বর-কনের ফটোসেশান চলছে অন্য পাশে। ওদিকে কারো কোনো খোঁজ নেই।
প্রহেলি ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। আপনি কি আমাকে কোনোভাবে স্টক করছেন?”
“আপনার এটা মনে হওয়ার কারণ?”
“গতকাল যা করলেন সেগুলোর অর্থ আমি কী ধরে নেবো? একটু বিস্তারিত বললে কী ভালো হতো না? আমার উৎসুক মনটা তো জানতে চায়।”
দিয়ান নিজের পরিচয় দিতে চায় না প্রহেলির সামনে। সে অপেক্ষা করবে মানুষটা তাকে চেনে কী না। কিন্তু এখন তার এই বিষয়টাকে অন্যভাবে সামলাতে হবে।
সে ম্লান হেসে বলল, “মেহরাব ভাইয়ার মুখে শুনেছিলাম আপনার আর নাহিয়ান সাহেবের স্কুল লাইফের ফ্যামাস সেই প্রেমের গল্প। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যদি কোনোদিন ছোট্ট একটা নাটক করতে হয় তাহলে এই দিয়ান কখনো পিছপা হয় না।”
প্রহেলি অর্থপূর্ণ হাসে। দিয়ানের কথায় যে সে বিশ্বাস করে ফেলেছে এমন নয়। তবু সে তাকে বোঝায় সে বিশ্বাস করেছে।
“আমি ভুল না করলে তুমি সেই দিয়ান, যে চট্টগ্রামে আমাদের বাসার সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলতে।”
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দিয়ান। ঘাড়টা ঈষৎ বাঁকা করে বলল, “জি আমি সেই দিয়ান।”
ক্ষীণ হাসে প্রহেলি। সে যা ভাবছিল আসলেই তা সঠিক।
“শোন, আমি তোমাকে তুমি করে বলব। বয়সে ছোটদের আপনি বলে সম্বোধন আমার ঠিক আসে না। তবে তুমি আমাকে আপনি করেই বলবে। আর হ্যাঁ আমাকে আপু ডাকবে। তোমার থেকে আমি সম্ভবত দুই বছরের সিনিয়র।”
শব্দ করে হেসে দেয় দিয়ান। তার সারা শরীর দুলে উঠে। অদ্ভুত এক রহস্যমাখা সেই হাসি। আশেপাশে অসংখ্য কথার ভীড়ে তার হাসির শব্দ মিলিয়ে যায়। কিন্তু মুগ্ধ হয় প্রহেলি। এই হাসির সাথে সে আগে থেকে পরিচিত। কিন্তু কোথায় তা মনে নেই। দিয়ান যেন কঠিনভাবে কাউকে মনে করিয়ে দিয়ে যাওয়ার খেলায় মেতেছে। অথচ প্রহেলি পারছে না মনে করতে।
তার চোখের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলল, “দুই বছর এক মাস তেরো দিনের বড়।”
প্রহেলির চোখেমুখে অসংখ্য ভাবনার স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠেছে। এই ছেলে কী লুকোচ্ছে তার থেকে। মাথাটা যেন এলোমেলো করে দিয়েছে তার। উদ্ভট সব চিন্তা এসে ভর করেছে। মেহরাব হাতের ইশারা করে প্রহেলিকে ডাকে। পূজা আর প্রহেলি উঠে যায় ছবি তুলতে। দিয়ান স্থির বসে রয় সেই চেয়ারে। সেই সাথে স্থির তার চোখের মণি। প্রহেলিকে যেন চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কত কথা ছিল বলবার, অথচ কিছুই বলা হয়ে উঠে না। কেবল সঠিক সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়।
প্রহেলি মাকে খুঁজতেই দেখল আরফা খাতুনের পাশ থেকে নাহিয়ান যাচ্ছে। তার মুখে কেমন অদ্ভুত এক হাসি। মানুষ দুঃসাধ্য কোনো জিনিস হাসিল করার পর যে প্রাপ্তির হাসি হাসে সে হাসির থেকেও ভিন্ন এই হাসি৷ মনটা কেমন ভয়ে কাতর হয়ে আসে। বুকের ভেতর চাপা ব্যথা অনুভব করছে প্রহেলি। কেন জানি মনে হচ্ছে খারাপ কোনো কিছু হতে চলেছে তার সাথে!
গায়ে হলুদের মতো বিয়ের দিনও প্রহেলিক্র হুট করেই হারিয়ে ফেলে দিয়ান। যাকে চোখে চোখে রাখতে চায় সেই চোখের পলকে হারায়। পেয়ে হারানোর এক জটিল খেয়াল নেমেছে দু’জন। কখন কে জিতে যায় নিয়তিই জানে। হারানোর তালিকা বিশাল বড় এবার অন্তত প্রপ্তির তালিকা ভারী করতে চায় দিয়ান।
পরদিন বউ ভাতের অনুষ্ঠানে প্রহেলি আর আসে না। তার মা আরফা খাতুন একাই আসেন। দিয়ান বেশ কয়েকবার আশপাশে খুঁজে তাকে পায় না। পূজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এক্সকিউজ মি, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”
পূজা উৎকণ্ঠা গলায় বলল, “অবশ্যই! কেন নয়! আপনার কোনো কাজে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। তবে তার বিনিময়ে কিন্তু আরো ভালো খেলতে হবে। বলে বলে ছক্কা…।”
দিয়ান পরিমিত হেসে বলল, “আপনার বান্ধবী প্রহেলিকা আজ বউ ভাতে আসলেন না কেন?”
সে ইতস্তত করে বলল, “আসলে তার অনেক জ্বর।”
পূজা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে৷ তার চেহারাই বলে দিচ্ছে সব কথা। তবু দিয়ান কোনো প্রশ্ন করে না৷ তবে এই মুহূর্তে তার প্রহেলিকে এক পলক না দেখলে শান্তি পাবে না। প্রহেলির মা একা এসেছেন আজ বউ ভাতে। তার ভাই নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে অফিসে থাকবে।
“আমি আপনার বান্ধবীর বাসায় যেতে চাই। এক পলক না দেখলে আমার মনের অসুখ সাড়বে না।”, বলেই কাতর চোখে তাকায় সে।
তার চোখজোড়া যেন প্রিয়জনকে দেখার আশায় বহু বছরের তৃষ্ণার্ত। পূজা কীভাবে এই মানুষটাকে মিথ্যে বলবে বুঝতে পারছে না। তার মন তাকে সায় দিচ্ছে না।
সে ম্লানমুখে বলল, “আমি আপনাকে নিয়ে গেলে তার সমস্যা হতে পারে৷ এমনিতেও সে অনেক বড় বিপদে পড়ে গেছে।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় দিয়ান। পূজা জানায়, গতকাল নাহিয়ান প্রহেলির মায়ের কাছে তাদের সম্পর্কের কথা সবকিছু বলে দেয়৷ প্রান্তের মোবাইল নম্বরে তাদের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি পাঠায়। আরফা খাতুনকেও ছবিগুলো দেখায়৷ বাড়িতে যাওয়ার পর প্রান্ত প্রহেলিকে অনেক মেরেছে। ব্যথায় জ্বর এসেছে তার৷ সারারাত জ্বরে কেঁপেছে। ব্যথায় বিছানা থেকে নড়তে পারছে না। সকালে গিয়ে পূজা দেখে এসেছে তাকে। সারা শরীরে মারের ভয়াবহ দাগ বসে গেছে। প্রান্ত খুব শীঘ্রই প্রহেলিকে বিয়ে দিয়ে দেবে। যাও পড়ানোর ইচ্ছে ছিল আর পড়াবে না এখন। আজ থেকে তো তার বাইরে যাওয়াও বন্ধ। পূজার কথা শুনে দিয়ানের মুখ রাগে লাল হয়ে আসে। প্রান্ত যদি প্রহেলির ভাই না হতো তবে আজ তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সে। রাগ সামলে নিজেকে শান্ত রাখে। সবরকম পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার অসাধারণ এক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে সে।
পূজাকে সাথে নিয়ে প্রহেলিদের বাড়িতে চলে আসে দিয়ান। ঠিক দুপুর বেলা। আকাশে ফকফকা রোদ। এই মুহূর্তে প্রান্ত বাড়িতে নেই৷ অফিসে আছে সে। আরফা খাতুন তো বউ ভাতের অনুষ্ঠানে। তার আসতে অন্তত বিকেল হয়ে যাবে। বাসায় কেবল কাজের মেয়ে।
পূজা দরজায় কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কাজের মেয়ে রুমা এসে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কারে চাইতাছেন আফা?”
“আমি প্রহেলির বান্ধবী পূজা। তার সাথে দেখা করতে এসেছি।”, ইতস্তত করে বলল।
রুমা পূজার পা থেকে মাথা অবধি একবার তাকায়। তারপর বলে, “আফার লগে কেউর দেখা করন মানা আছে। প্রান্ত ভাই জানলে আমার চাকরি নট কইরা দিব।”
“আপনি কী প্রহেলিকে একটুও ভালোবাসেন না? আমি আসলে তার জন্য ডাক্তার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। রাত থেকে তার ভীষণ জ্বর। ডাক্তার দেখিয়েই চলে যাব।”
ততক্ষণে দিয়ান এসে তার পাশে দাঁড়ায়। সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা আর হাতে কালো একটা ব্যাগ। এই ছোট ছেলে ডাক্তার হতে পারে এ বিষয়ে সন্দেহাতীত ভাবে রুমা। তার দেখা সব ডাক্তাররা ফরসা একদম দুধের মতো। কিন্তু তাদের পেট মোটা হয়। মাথায় টাক থাকে। আর বয়স চল্লিশোর্ধ্ব হয়। তবু পূজার অনুরোধে ভেতরে ঢুকতে দেয় সে তাদের। কিন্তু সময় কেবল বিশ মিনিট। এর বেশিক্ষণ ট্রিটমেন্ট করা যাবে না। তাড়াতাড়ি দেখে ওষুধ দিয়ে যেতে হবে। তার কথামতো রাজী হয়ে যায় তারা।
দিয়ান প্রহেলির রুমে ঢুকে। পূজা দরজায় দাঁড়িয়ে রুমাকে বলল, “আমার জন্য এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি, ডাক্তার সাহেবের জন্য এক কাপ হট কফি। আর প্রহেলির জন্য নরমাল পানি দিয়ে এক মগ লেবুর শরবত বানিয়ে আনলে খুবই উপকার হতো।”
এসব কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য যাতে রুমা এখানে উপস্থিত না থাকে। নাহলে সে এখান থেকে এক পা নড়বে না। রুমা রুমের ভেতরে বারবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে ফিরে যায়। পূজা দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারাদারি করতে লাগে। দিয়ান বিছানার কাছে এসে শিউরে উঠে৷ একটা মানুষকে কেউ এভাবে জানোয়ারের মতো মারতে পারে! হলুদ ড্রেসে তাকে একদম শর্ষের ফুল মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ফুলের গায়ে কতশত আঘাতের চিহ্ন। হাতের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেধেছে। ঠোঁটের কোণ কেটে গেছে। দিয়ান হাঁটু ভাজ করে তার মাথা বরাবর ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা
[বিঃদ্রঃ সারাদিন ব্যস্ত থাকায় আজ গল্প দিতে দেরি হলো। তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আগামী পর্ব আরো বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আপনার মূল্যবান মন্তব্য করবেন। একটা মন্তব্য লেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। ভালোবাসা ও ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক। কারো কোনো প্রয়োজনে মেসেজ দিতে পারেন Bornali Suhana আইডিতে। এবং কখনো আমার এই আইডি না থাকলে Bornali Suhana – বর্ণালি সোহানা পেইজে আমার গল্প পাবেন।]