কোথাও কেউ ভালো নেই-০৩
মেহমান বিদায় নেয়ার সাথে সাথে সালমা এসে খপ করে ধরলো পূরবীকে।খামে কতো টাকা আছে তা দেখার জন্য।পূরবী মুচকি হেসে খাম বের করে দিলো।
ভালো করে ঘুরিয়ে দেখলো সালমা খাম খোলা হয়েছে কি-না। তারপর খামটি খুললো।
ভিতরে ১০০ টাকার ৫ টা নোট শুধু।বিড়বিড় করে সালমা বললো,”আস্ত ছোটলোক তো এরা!৫০০ টাকা দিয়ে গেলো!তাও আবার খামে পুরে!”
সালমা ভেবেছিলো ২-৩ হাজার টাকা থাকবে হয়তো ভিতরে। তা দিয়ে নিজে একটা শাড়ি কিনে নিবে।এখন ৫০০ টাকা দেখে বিরক্তিতে মুখ বাঁকালো।
টাকাগুলো ছুঁড়ে মারলো পূরবীর মুখে।
সালমা যাবার পর পূরবী হাসতে হাসতে উঠে রুমের দরজা লাগালো।
তারপর সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো।
সুরভী কিছুই বুঝতে পারছে না।পূরবী হাসি থামিয়ে আরেকটা ছেঁড়া খাম দিলো সুরভীকে।সুরভী দেখলো খামের উল্টো পিঠে ছোট ছোট অক্ষরে লিখা আছে,”আম্মা গো,আমি ও তোমার মতো মা হারিয়েছে অল্প বয়সে।সৎ মায়ের অত্যাচার আমিও সহ্য করেছি।এই খামে দশ হাজার টাকা আছে তোমার জন্য,ভিতরে আরেকটা খাম আছে সেই খামে ৫০০ টাকা আছে।তোমার মা কে তুমি ভিতরের খামটা দিও যখন উনি চাইবে।এই টাকাগুলো তোমাদের দুই বোনের জন্য।পছন্দসই কিছু কিনে নিও।”
চিঠিটা পূরবী যত্ন করে লুকিয়ে রাখলো নিজের বইয়ের ভাঁজে।এই মানুষটাকে সে আজীবনের জন্য বাবার স্থানে বসিয়েছে। আজীবন তাকে সেই সম্মান পূরবী দিবে।
————–
আজকে পূরবীর বিয়ে।সকাল থেকে পূরবীর ভীষণ পেটে ব্যথা করছে।আজ একদিকে রেজাল্টের টেনশন অন্যদিকে বিয়ের টেনশন,অন্যদিকে আজ পূরবীর মেয়েলি সমস্যা দেখা দিয়েছে। তলপেট ব্যথায় ফেটে যাবার যোগাড়।
সুরভী কিছুক্ষণ পর পর পূরবীর কাছে এসে পূরবীকে দেখছে।তার বুবু এমনিতেই সুন্দর কিন্তু আজকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে বুবুকে।সুরভী ভাবছে তার বিয়ের দিন কি তাকেও এরকম সুন্দর লাগবে?
তানভীর কল দিলো সকাল বেলা।পূরবীর পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো তানভীরের কল দেখে।
এই লোকটির সাথে পূরবীর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেনো বাজে কথা বলে লোকটা।
দেশে আসার আগের দিন একবার কল দিয়েছিলো তানভীর।পূরবীর সাথে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর তানভীর জিজ্ঞেস করলো তোমার ইনারের মাপ কতো পূরবী।
তানভীরের কাছে এই প্রশ্ন যৌক্তিক মনে হলেও পূরবীর কাছে মনে হলো খুবই নোংরা একটা প্রশ্ন।দাঁত কিড়মিড়িয়ে পূরবী বললো,”আপনি একজন নোংরা লোক।”
তারপর কল কেটে দিলো। পূরবী কল কেটে দিয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।১৫ বছরের একটা মেয়ের কাছে এরকম একটা প্রশ্ন যথেষ্ট সেনসেটিভ।
তানভীর ভেবেছিলো মালয়েশিয়া থেকেই বউয়ের জন্য ইনার,নাইট ড্রেস,মেয়েলি অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে।রুমের অন্যান্য বন্ধুদের দেখেছে বিয়ে করতে দেশে যাবার আগে সব এখান থেকেই নিয়ে গেছে।সবাই হবু বউয়ের থেকেই সব জেনেছে কল দিয়ে।অথচ কারো বউ এরকম রিয়েক্ট করে নি।
সেই হিসেবে সে পূরবীকে জিজ্ঞেস করেছে।কিন্ত পূরবী এভাবে তাকে খারাপ ভাববে তা তানভীর বুঝে নি।
এখন আবার তানভীরের কল দেখে পূরবীর গলা শুকিয়ে গেলো। নানী,দাদী কেউ না থাকায় পূরবীকে কেউ বুঝিয়ে দেয় নি স্বামী মানে কী,স্বামীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে।১৫ বছর বয়সী একটা মেয়ের কাছে স্বামী,সংসার,শ্বশুরবাড়ি যথেষ্ট আতংকের ব্যাপার,আর তার মধ্যে যদি মেয়েটি হয় মা হারা,তবে আর কথাই নেই।
সালমা কল রিসিভ করে পূরবীকে দিলো।পূরবীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো তানভীরের হ্যালো শোনার পর।
তানভীর বুঝতে পেরে কল কেটে দিলো। ভিতরে ভিতরে ভীষণ বিরক্ত হলো।
ভেবেছিলো পূরবীকে বলবে পার্লারে গিয়ে সাজতে,কিন্তু কথা-ই তো হলো না।আর কি করার!
দুপুরের কাঠফাটা রোদের মধ্যে বরপক্ষ এলো।যেহেতু কোনো গেইট দেওয়া হয় নি তাই বিয়েতে গেইট ধরা হলো না।তানভীর অবশ্য ভেবেছিলো গেইট ধরা হবে,সেখানে টাকা লাগবে।আবার বরের হাত ধোঁয়াতে এলে টাকা দিতে হয়,জুতা চুরি করলে টাকা দিয়ে জুতা নিতে হয়।
এসব ভেবে পকেটে করে তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে এলো।কিন্তু বিয়ে বাড়ির চেহারা দেখেই তানভীর বুঝলো এই বাড়িতে যে মেয়েটা থাকে সে ভালো নেই।পূরবীর উপর হওয়া রাগ চলে গেলো তানভীরের।
গরমে ঘেমে সবার অবস্থা খারাপ তখন।সুরভী গেলো সবার জন্য শরবত নিয়ে।তানভীরকে শরবত দিতে গিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো সুরভী। তানভীর হাসলো দেখে।তারপর সুরভীকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,”ভাই’কে কি কেউ লজ্জা পায় বলো?
আমি তো আজ থেকে তোমার ভাই।”
মুহুর্তেই সুরভীর সব জড়তা কেটে গেলো।
লাল বেনারসি শাড়িতে সাজিয়ে যখন পূরবীকে উঠানে করা স্টেজে আনা হলো,তানভীর এক নজর দেখেই চোখ নামিয়ে ফেললো।এক নজরেই তানভীরের মনে হলো তার চোখ জলসে গেছে।
বন্ধুরা ফিসফিস করে বললো,”দোস্ত,ভাবী তো আগুন সুন্দরী। ”
তৌসিফ মুগ্ধ হয়ে তাকালো ভাবীর দিকে।মা,বোন,ভাবীদের কাছে যতো নিন্দেমন্দ শুনেছে এই মেয়ের নামে সব কিছু মিথ্যে মনে হলো তৌসিফের কাছে।
এক মুহুর্তের জন্য হিংসে হলো তৌসিফের নিজের ভাইয়ের ভাগ্যকে।
দুপুর দুইটা পাঁচ মিনিটে বিয়ে হলো। পূরবী শক্ত করে সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো। এই বিশাল পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে পূরবীর।যার জন্য পিছুটান রয়ে যাবে এই বাড়িতে। যার চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হবে পূরবীর।দেহটা থেকে প্রাণটা আলাদা করে এই ১২ বছরের মেয়ের কাছে রেখে পূরবী তার নতুন বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
একটা অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ালো পূরবী।
কে জানে ভাগ্য সেই জীবনে তার সাথে কি খেলা করে!
অথবা প্রাণ সঁপে দেওয়া ছোট মেয়েটাকে নিয়েই ভাগ্য কি করে তার কথা কে বলতে পারে!
————–
গাড়ি থেকে নামার পর তানভীর পূরবীকে কোলে তুলে নিলো।হালকা পাতলা মানুষটাকে এক টানেই তুলে ফেললো তানভীর।
লজ্জায়,ভয়ে পূরবী খামছে ধরলো তানভীরের ঘাড়।
পূরবীর নখ লেগে তানভীরের ঘাড় জ্বলে উঠলো। পূরবীর কানের কাছে মুখ এনে তানভীর ফিসফিস করে বললো,”খামচানোর জন্য পুরো রাত পড়ে আছে,এখন ছাড়ো।”
পূরবী বুঝলো না তানভীরের কথার মানে,পড়ে যাবার ভয়ে বরং আরো জোরে ধরলো।
ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো একটা ডিশে করে মহিলারা পানি এনে রেখেছে।
তারিন বললো,”মান দিবেন না-কি ঠ্যাং দিবেন?”
পূরবী বুঝলো না কি করতে হবে এখন।তানভীর পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে সবার অলক্ষ্যে পূরবীর হাতে ধরিয়ে দিলো।
পূরবী হাত বাড়াতেই তানভীরের দুই ভাবী টাকা কেড়ে নিয়ে ছুটে চলে গেলো।
তাদের পিছনে পিছনে গেলো তারিন।
রেবেকা গম্ভীরমুখে বললো,”পা দিয়া আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ডিশের পানি ফেলে দাও।তারপর ঘরে ঢুকে রুমালে বাঁধা ধান ছাদের দিকে ছুড়ে মারো।”
পূরবী তাই করলো।ছোট পাখির ছানার মতো শরীরটা তিরতির কাঁপতে থাকলো এসব করতে গিয়ে।
৮ বেডরুমের বিশাল এই বাড়িটি পূরবীর কাছে ছোটখাটো রাজবাড়ির মতো মনে হচ্ছে।এতো বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে তার ভাবতেই পূরবীর কাছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে।
তেমনি অন্যদিকে এক অজানা ভয় ও পেয়ে বসেছে পূরবীকে।
চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে সব অচেনা মুখ।নিজেকে মনে হচ্ছে নীড় হারা পাখি।
পূরবীর ওয়াশরুমে যেতে হবে।কাকে বলবে পূরবী ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে।আশেপাশে চেনা কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না।
হন্তদন্ত হয়ে তানভীর পূরবীর কাছে এলো একটা ঠান্ডা পেপসি নিয়ে।একটা গ্লাসে ঢেলে পূরবীর মুখের সামনে ধরলো।
আশেপাশের সবাই হাসতে লাগলো তানভীরের কাজ দেখে।কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বললো,”এখন থেকেই এতো খেয়াল!”
তানভীর নির্বিকার রইলো।
পূরবী খেতে চাইলো না,গ্লাস সরিয়ে রাখলো।কিন্তু তানভীর জোর করে খাইয়ে দিলো।
পূরবীর তলপেটে ব্যথা আরো বেড়ে গেলো। লজ্জায় তানভীরকে বলতেও পারলো না ওয়াশরুমের কথা।
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”কোনো সমস্যা? ”
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পূরবী বলেই দিলো।শুনে তানভীর হাত ধরে নিয়ে গেলো রুমের দিকে।
ওয়াশরুমে যেতে যেতে তানভীর জিজ্ঞেস করলো পূরবীর রোল রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার কতো।
পূরবীর হঠাৎ করে মনে পড়লো আজকে রেজাল্ট দিবে।ভয়ে ভয়ে পূরবী বললো।
রেজাল্ট দেখে তানভীর গমগমে স্বরে বললো,”পূরবী…..!”
ভয়ে পূরবীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।
হাহা করে হেসে তানভীর বললো,”ভয় পাচ্ছো কেনো?
তোমার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে।গোল্ডেন এ প্লাস এসেছে তোমার। তুমি এতো ভালো ছাত্রী আগে তো জানতাম না।
আমি তো টেনেটুনে ইন্টার পাশ করেছি।”
চলবে……..?
লিখা: জাহান আরা