কোথাও কেউ ভালো নেই -০৬
একা ঘরে পূরবী বসে বসে কাঁদতে লাগলো। ঘটনাটা মনে পড়লেই বুক কেঁপে উঠে পূরবীর। এতোগুলো মানুষের সামনে কিভাবে এরকম একটা কাজ সে করলো ভেবে পাচ্ছে না।সে তো ঠিকমতই কাপ দিয়েছিলো ভাবীকে,তবুও কেনো পড়ে গেলো।
এসব ভাবতে ভাবতে পূরবীর চোখ থেকে জলধারা বইতে লাগলো।
তানভীর রুমে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর পূরবীকে টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপরে শুইয়ে দিয়ে পূরবীর চুলে বিলি কাটতে লাগলো।
তানভীরের আদরে পূরবী ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো তার ভাগ্য আসলেই খারাপ।
তানভীর পূরবীর কপালে একটা চুমু খেলো।তারপর ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে পূরবীকে বললো,”বক্সটা খোলো পূরবী তোমার জন্য একটা গিফট আছে।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো পূরবী।তারপর ফোনের বাক্সটা খুললো।ভিতর থেকে বের হয়ে এলো একটা স্মার্টফোন।
আনন্দে পূরবী যেনো মূক হয়ে গেলো।
একটা ফোন ছুঁয়ে দেখার কতো ইচ্ছে ছিলো তাদের দুই বোনের তা কেবল অসহায় দুই বোন জানে।
হঠাৎ করেই পূরবীর মনে হলো সে আসলে ভীষণ সুখী একটা মেয়ে।আল্লাহ তাকে এরকম একটা স্বামী দিয়েছে যে না বলতেই তার মনের কথা বুঝে যায়।
পূরবীর মা বেঁচে থাকতে একটা বাটন ফোন ব্যবহার করতো।আশেপাশের অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও ফয়েজ আহমেদ স্ত্রীর জন্য আনেন নি এরকম কোনো ফোন।
পূরবীর বান্ধবীরা সবাই বলতো মায়ের মোবাইলে তারা নাটক,সিনেমা,কার্টুন কতো কিছু দেখে ইউটিউব থেকে।সেজেগুজে ছবি তোলে।
শুনে শুনে পূরবী স্বপ্ন দেখতো তার মায়ের ও এরকম একটা ফোন হবে। তারপর তারা দুই বোন মিলে ছবি তুলবে।রাতে পড়া শেষ হলে কার্টুন দেখবে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয় নি।পারভীন বেঁচে থাকতে এরকম ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পায় নি।তবে সালমা পেয়েছে। ফয়েজ আহমেদ নিজের অল্পবয়সী সুন্দরী বউয়ের জন্য দেশে আসার সময় একটা স্মার্টফোন নিয়ে আসেন।
ফোন দেখে দুই বোন অঝোরে কেঁদেছিলো।না,নতুন মা’কে ফোন দেয়ায় তাদের কোনো হিংসে হয় নি।তবে কষ্ট হয়েছে এটা ভেবে যে তাদের মা এরকম একটা ফোন ব্যবহার করতে পারে নি।
কে জানে,সবসময় অসুস্থ থাকা মায়ের প্রতি হয়তো বাবার সেই ভালোবাসা ছিলো না।
অথচ ফয়েজ আহমেদ পারভীন বেগমকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে।
প্রথম বার পারভীন বেগমকে দেখেছন ফয়েজ আহমেদ কলেজে।একই কলেজে পড়তেন দুজনে।পারভীনের রূপে মুগ্ধ হয়ে ফয়েজ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশ চলে যায়।
দুই বছর পর যখন দেশে ফিরে তখন জানতে পারে পারভীনের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে।
হাতে বিষের শিশি নিয়ে পারভীনের সাথে দেখা করতে যান ফয়েজ।বিষ খাওয়ার ভয় দেখিয়ে পারভীনকে রাজি করান যাতে এই সম্বন্ধে রাজি না হয়।
দুদিন পরেই বাবা মা’কে নিয়ে যান বিয়ের জন্য।সেদিন পারভীনের বাবা মা সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে ফয়েজের পাগলামি দেখে।বাধ্য হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দিতে।তাছাড়া অমত করার ও উপায় ছিলো না।ছেলে বিদেশে থাকে,ভালো কামাই করে।তখনকার সময়ে এরকম পাত্র ক’জনা ছিলো!
সেই ভালোবাসার পাত্রে কবে যে ফুটো হয়ে গেছে পারভীন টের পায় নি।হাঁফানিতে ভোগা পারভীন বুঝতে পারে নি যে মানুষটা মুগ্ধ হয়ে তাকাতো তার দিকে,তার তাকানোর মাঝে এখন প্রবল বিতৃষ্ণা রয়েছে।
কে বলেছে ভালোবাসা বদলায় না?
সময় বদলায়,মানুষ বদলায়,মানুষের মন বদলায়,সাথে ভালোবাসা ও বদলে যায়।
একই ছাদের নিচে থাকা,একই পরিণয়সূত্রে বাঁধা মানুষটির সাথে কথা হয় হয়তো,খোঁজ নেওয়া হয়,কিন্তু মুগ্ধতা কেটে গেলে মনের খোঁজ আর কেউ নেয় না।একটা সময় যার কাছে এলে স্বস্তি মিলতো তাকেই একটা সময় ভীষণ অস্বস্তিকর লাগে।
মনের দূরত্ব বেড়ে যায়,সম্পর্কের রঙ বদলে যায়।
রুক্ষ চেহারার,লাবন্য হারানো মুখের দিকে তাকালে ফয়েজ আর মুগ্ধ হতো না।তাছাড়া বিয়ের ১২ বছর পর দুটো মেয়ের জন্ম হলো,একটা ছেলে হলো না বলেও ফয়েজের মানসিকতা বদলে গেলো।
চোয়াল ভেঙে পড়া মানুষটাকে অসহ্য লাগতো।সে জন্যই হয়তো তাকে মুক্তি দিতে আল্লাহ পারভীনকে নিয়ে গেলেন।
নতুন বউয়ের বয়স ২৭-২৮,ফয়েজের এখন ৪৫-৪৬ বছর। তাই বউয়ের মন রাখার জন্য অনেক কিছুই করে সে।
এসব পূরবী জানে।মা কতোদিন৷ কাতরে কাতরে পূরবীর কাছে নিজের বুকের জমানো সব কথা বলে গেছে।নতুন মায়ের প্রতি বাবার এখনকার ব্যবহার আর পূরবীর মায়ের সাথে করা ব্যবহার দুটোর পার্থক্য কি পূরবীর চোখে পড়ে নি?
পড়েছে,কিন্তু অভিযোগ করবে কার কাছে!
আল্লাহ ছাড়া কাউকে বলে নি পূরবী।
এসব ভাবতে ভাবতে পূরবী কাঁদলো।তানভীরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদলো।কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বললো।
তানভীরের ভীষণ মায়া হলো।
আহা বেচারা!
ভাগ্য তাকে নিয়ে কেনো এরকম খেলেছে তানভীরের জানা নেই।পূরবীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তানভীর বললো,”আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না পূরবী। সবাই তো এক রকম হয় না।কেউ কেউ কথা রাখতে জানে।”
নির্ভার হয়ে পূরবী তানভীরকে ছেড়ে দিলো।একটু লজ্জিত ও হলো নিজে থেকে এভাবে তানভীর কে জড়িয়ে ধরায়।
তানভীর বুঝতে পেরে বললো,”আমি ঠিক করেছি সুরভীকে এখানে নিয়ে আসবো।এই বাড়িতে থাকবে সুরভী তোমার সাথে। ওখানে ও কেমন থাকবে সেটা আমার চাইতে তুমি ভালো করে জানো।
এখন তুমি নেই,ওর উপর দিয়ে কখন কোন ঝড় যাবে কেউ জানবে না।
তার চাইতে ভালো এখানে নিয়ে আসি।”
পূরবী প্রথমে ভীষণ খুশি হলো।কিন্তু পর মুহুর্তে সমস্ত খুশি কর্পূরের মতো উবে গেলো।
তানভীর হেসে বললো,”ভয়ের কিছু নেই।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।”
পূরবী তবুও শঙ্কিত হলো।বোনের শ্বশুর বাড়িতে সুরভী থাকলে লোকে নানান কথা বলবে।আর তানভীর চলে গেলে সবাই কেমন ব্যবহার করবে তা নিয়ে ও পূরবী চিন্তিত হলো।
পূরবী মাথা নেড়ে বললো,”না লাগবে না।এটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না।”
তানভীর এক মুহুর্ত ভেবে বললো,”তাহলে এক কাজ করি।সুরভীকে একটা লেডিস হোষ্টেলে দিয়ে দিই।সব খরচ আমি দিবো।তবুও তো তোমার ছোট মায়ের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে।প্রতি সপ্তাহে না হয় একবার আসবে আমাদের বাসায়।বৃহস্পতিবার এসে শনিবার সকালে চলে যাবে।”
এই প্ল্যান পূরবীর পছন্দ হলো।মাথা নেড়ে সায় দিলো পূরবী। তারপর একটু ভেবে বললো,”আপনি কেনো এতোকিছু করবেন আমার বোনের জন্য?”
তানভীর হেসে বললো,”এখন তো আমি আর তুমি আলাদা কেউ না।তোমার চিন্তা আমার ঘুম নষ্ট করার কারণ। তোমার কপালের চিন্তার ভাঁজ আমার মাথা ব্যথার কারণ। আমি চাই তুমি খুশি থাকো।তুমি খুশি থাকলে আমার দুনিয়া খুশি থাকবে।
তোমার যতো না পাওয়া ছিলো আমি তা প্রাপ্তিতে ভরিয়ে দিবো পূরবী।কখনো যেনো তোমার মনে না হয় তোমার জীবন আজীবন কষ্টে কেটেছে।”
পূরবীর ভীষণ ভয় হলো তানভীরের কথা শুনে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো,”যেই মানুষটা আমাকে এভাবে রক্ষা করছে আমি পারব কি তার বিশ্বাস রাখতে সারাজীবন?
আল্লাহ,আমার কোনো কাজ যেনো এই মানুষটার কষ্টের কারণ না হয়।”
তানভীর মৃদু স্বরে পূরবীকে ডাকলো।তারপর উঠে গিয়ে আলমারির নিচ থেকে দলা মোচড়া করে রাখা একটা পুরনো শার্ট বের করলো।
শার্টের ভিতর থেকে দেনমোহরের নগদ চার লক্ষ টাকা বের করে পূরবীর হাতে দিয়ে বললো,”এই টাকা তোমার। দেনমোহরের চার লক্ষ টাকা আছে এতে।এই টাকার উপর আমার কোনো অধিকার নেই।তোমার যা খুশি তা করতে পারো তুমি এই টাকা দিয়ে। আমি কখনো এটা নিয়ে তোমাকে প্রশ্ন করবো না।কালকে রাতেই দেওয়ার ছিলো,কিন্তু দেওয়া হয় নি।”
এতো টাকা পূরবী কি করবে ভেবে পেলো না।কেনো-ই বা দিলো এতো টাকা তাকে তাও বুঝতে পারলো না।
পূরবীর শরীর কাঁপতে লাগলো একসাথে এতো টাকা দেখে।
পূরবী বললো,”আমার লাগবে না এতো টাকা।আপনার কাছে রেখে দিন আপনি। ”
তানভীর হাসলো শুনে।তারপর বললো,”অবশ্যই লাগবে।আমি আরো এক লক্ষ টাকা দিয়ে পাঁচ লক্ষ মিলিয়ে তোমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিবো দশ বছরের জন্য।”
পূরবী এসবের কোনো মানে বুঝলো না।তবে এটুকু বুঝলো,সামনে বসে থাকা মানুষটার মন একেবারে স্বচ্ছ। এই মানুষটা তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো রাখবে।এই মানুষটার কাছে সে সবচেয়ে দামী। এই মানুষটা শুধু মানুষ না।এক অমূল্য রত্ন তার জন্য।এর কোনো অবমূল্যায়ন সে করবে না কখনো।
পূরবীদের বাড়ি থেকে মেহমান এলো তিরিশ জনের মতো। সালমা প্রথমে বাড়ির সামনে নেমে হতভম্ব হলো!
এ কোথায় সে পূরবীকে বিয়ে দিয়েছে!
এতো ভালো জায়গায় পূরবীকে বিয়ে দিয়েছে সালমার বিশ্বাস হলো না।নিজের উপর নিজের প্রচন্ড রাগ হলো কেনো বিয়ের আগে খোঁজ খবর নেয় নি।তাহলে তো পূরবীকে না দিয়ে ঘরে থাকা নিজের অবিবাহিত বোনকে বিয়ে দিতো তানভীরের সাথে।
নিজের বোকামির জন্য নিজের গালে নিজে থাপ্পড় মারলো সালমা।ভিতরে গিয়ে পূরবীকে দেখে সালমার বুকে চিনচিনে ব্যথা হতে লাগলো।
গতকাল এরা তেমন কোনো গহনা দেয় নি পূরবীকে।কিন্তু এখন দেখছে পূরবীকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে তানভীর। কানে দুল,গলায় দুটো হার,হাতে মোটা চুড়ি,কপালে টিকলি,পায়ে সোনার নুপুর।
এ যেনো মোমের পুতুল বসে আছে সালমার সামনে। রূপ যেনো ঠিকরে বের হচ্ছে এই মেয়ের শরীর থেকে।
সবুজ রঙের কাতান শাড়ি পরা পূরবীকে দেখে সালমার মনে হলো রূপকথার রানী।সাদা পাঞ্জাবি পরে হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা যেনো রাজার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
সালমার ভীষণ আফসোস হলো।সেই সাথে আফসোস হলো রেবেকার ও।ভেবেছিলো গহনাগাঁটি সব নিজের একমাত্র মেয়ে তারিনকে দিবে।কিন্তু কে জানতো তানভীর যে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সব বের করে নিবে পূরবীর জন্য।রেবেকা ভেবেছিলেন সব গহনার কথা তানভীরের মনে নেই।কিন্তু ভুল ভাঙলো তখন, যখন দেখলো তানভীর জিজ্ঞেস করছে,বিয়ের জন্য এনে রাখা সোনার ব্রেসলেট নেই কেনো?
রেবেকা থমথমে গলায় জবাব দিলো,”ওটা তোর আপা নিয়েছে।ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওটা।”
তানভীর ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমিও আমার বউয়ের জন্য পছন্দ করেই কিনেছি মা একটা একটা করে।তাছাড়া আপাকে আমি নিজেই পাঁচ ভরি সোনার হার আর কানের দুল দিয়েছি।তোমাকে পাঁচ ভরি দিয়ে হার আর কানের দুল দিয়েছি।তোমাদের দেয়ার পরে আমি আমার বউয়ের জন্য কিনেছি যাতে তোমরা কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করতে না পারো যে তোমাদের না দিয়ে নিজের বউয়ের জন্য কেনা শুরু করেছি।তবে কেনো তুমি আপাকে দিলে ব্রেসলেট?
এখনই আপার থেকে নিয়ে দিবে তুমি।”
তারিন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনলো।রাগে জিদে তারিন ঠিক করলো মেহমান আসলে সবার সামনেই সে সিনক্রিয়েট করবে।রাস্তার ভিখিরিকে তার ভাই রানী বানাতে চাচ্ছে,এটা তারিনের হজম হলো না।তেমনই হজম হলো না রেবেকার,আর তার মতো সালমার ও হজম হলো না পূরবীর এই সুখ।তিনটি ঈর্ষান্বিত মন ছক কষতে লাগলো একটা অসহায় মেয়ের বিরুদ্ধে।
চলবে…..
জাহান আরা।